পৃথিবীর যে দুই জায়গায় গাড়ির কোনো গতিসীমা নেই
গাড়ির বিজ্ঞাপনে সব সময় বড় বড় করে লেখা থাকে—ঘণ্টায় ২০০ মাইল গতি! কিন্তু এ তথ্যের আসলে কোনো দাম আছে? বাংলাদেশে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে পারবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে। শহরের রাস্তা বা সিটি করপোরেশনের ভেতরে তো মাত্র ৪০ কিলোমিটার ঘণ্টায়। তা ছাড়া বাংলাদেশ যেমন জনবহুল দেশ, তাতে প্রায় সব সময় রাস্তাঘাটে জ্যাম লেগে থাকে। টানা ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালানোও প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তোমার গাড়ি তো এর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি গতিতে চলতে পারে।
একটু ভেবে দেখো, সত্যি সত্যি যদি তোমার গাড়ি পুরো গতিতে চালাতে পারতে? কোনো জরিমানার ভয় বা লাইসেন্স বাতিলের চিন্তা যদি না থাকত? এমন জায়গা পৃথিবীতে সত্যি আছে। তবে পুরো পৃথিবীতে এমন জায়গা মাত্র দুটি।
প্রথম জায়গাটির নাম আইল অব ম্যান। এটি যুক্তরাজ্য আর আয়ারল্যান্ডের মাঝখানের ছোট্ট একটি দ্বীপ। জায়গাটা তিনটি কারণে বিখ্যাত। এক, এখানে কর দিতে হয় খুব কম। দুই, মোটরস্পোর্টের জন্য এটা স্বর্গ। তিন, জায়গাটা ব্রিটেনের অংশ, আবার ঠিক অংশও না! ব্যাপারটা একটু জটিল।
২০১৫ সালে অ্যালান থমসন নামের এক পুলিশ অফিসার বলেছিলেন, ‘আমরা অনন্য। তুমি ফেরি থেকে নেমে ১৫ মিনিটের মধ্যে পাহাড়ি রাস্তায় উঠে ঘণ্টায় ১৮০ মাইল বেগে গাড়ি চালাতে পারবে। এতে আইন ভাঙার কোনো ভয় নেই।’
এর মানে এই না যে পুরো দ্বীপেই কোনো গতিসীমা নেই। আবাসিক এলাকায় আর শহরের ভেতরে সাধারণত ঘণ্টায় ৩০ মাইল বেগে গাড়ি চালাতে হয়। কিন্তু হাইওয়েতে যত ইচ্ছা গতি ওঠানো যায়।
দ্বীপটা মোটরগাড়ি দুর্ঘটনার জন্যও কুখ্যাত। বিশেষ করে মোটরবাইক দুর্ঘটনা। দ্বীপে মানুষ আছেন ৮৫ হাজারের কম। আর প্রতিবছর নিয়মিতভাবে মাত্র দুই সপ্তাহে অন্তত তিন-চারজন রাস্তায় প্রাণ হারান।
যেকোনো দুই সপ্তাহ না কিন্তু। মে আর জুন মাসে আইল অব ম্যান ট্যুরিস্ট ট্রফি বা টিটি রেস হয়। পুরো দ্বীপে চলে এই মোটরবাইক রেস। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক রেস বলা হয় একে।
টিটি রেসের সপ্তাহ না হলেও রাস্তাগুলো সাধারণ মানুষের জন্য খোলাই থাকে। তবে এই ট্র্যাক নতুনদের জন্য নয়। এখানে আছে প্রচণ্ড বাঁক। আছে উঁচু-নিচু রাস্তা, শহরের বাধা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শুরু করে ৪২২ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত ওঠানামা করে রাস্তা। সব মিলিয়ে বেশ চ্যালেঞ্জিং। তার ওপর জায়গাটা ব্রিটেন আর আয়ারল্যান্ডের মাঝামাঝি। মানে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির রাজধানী।
এসব কারণে এ দ্বীপে দুর্ঘটনার হার পাশের দেশগুলোর দ্বিগুণ। অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য যে এ সংখ্যা ৩০ বছর আগের চেয়ে অর্ধেক কমেছে।
দ্বিতীয় জায়গার নাম জার্মানির বিখ্যাত হাইওয়ে অটোবান। আইনকানুন না মানার কথা শুনলে সবার আগে তোমার মাথায় হয়তো জার্মানির কথা আসবে না! তাই হয়তো তোমার কাছে একটু অদ্ভুত শোনাচ্ছে। দেশটা নিয়ম আর শৃঙ্খলার জন্য বিখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও গতিসীমার কেন কোনো লিমিট নেই?
এটা ঠিক যে অটোবানের প্রায় ৭০ শতাংশ জায়গায় তুমি যেমন ইচ্ছা গতিতে গাড়ি চালাতে পারো। ২০২৩ সালে ফ্র্যাঙ্কলিন মাও নামের এক গবেষক দেখিয়েছিলেন, অটোবানে গাড়ির গড় গতি ঘণ্টায় ১৪১ দশমিক ৮ কিলোমিটার। কোনো গতিসীমা না থাকলেও সাধারণ মানুষ এখানে বেশি জোরে গাড়ি চালান না। তা ছাড়া ট্রাফিক তো আছেই। বাণিজ্যিক গাড়িগুলোকে আবার গতিসীমা মানতে হয়। এতে রাস্তায় একটু জ্যাম হয়। তাই চাইলে ২০০ বা ২৫০ কিলোমিটার গতিতে এখানে সব সময় গাড়ি চালানো যায় না।
তবে জার্মানিতে গতিসীমা না থাকলে অন্যান্য দেশের তুলনায় মৃত্যুহার কিন্তু কম। ২০২১ সালে জার্মান হাইওয়ে রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিবদন অনুসারে, জার্মানিতে প্রতি এক বিলিয়ন কিলোমিটার গাড়ি চলাচলে ১ দশমিক ৪১ জন মারা যান। সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে ৩ দশমিক ৪৫ জন, ফ্রান্সে ২ দশমিক ১৩ জন এবং ইতালিতে ৩ দশমিক ৬৬ জন মারা যান।
অর্থাৎ অন্য যেসব দেশে গতিসীমা আছে, সেই দেশের তুলনায়ও অটোবান নিরাপদ। আইল অব ম্যানের চেয়ে যে অনেক বেশি নিরাপদ, তা তো বুঝতেই পারছ! এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। জার্মান সরকার জাতীয় সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে প্রচুর টাকা ঢালে। তা ছাড়া ওখানকার গাড়িগুলোও তুলনামূলক ভালো। আর জার্মানির চালকেরাও বেশ দক্ষ। এখানে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া একটা যুদ্ধের মতো! বাধ্যতামূলক ৮ ঘণ্টার ফার্স্ট এইড কোর্স, কমপক্ষে ৩৭ ঘণ্টার ড্রাইভিং ক্লাস, আর কঠিন সব তাত্ত্বিক পরীক্ষায় পাস করতে হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স করতেও প্রায় আড়াই লাখ টাকার বেশি খরচ করতে হয়!
যাহোক, পৃথিবীতে দুটি গতিসীমাহীন রাস্তার খোঁজ দিলাম, চাইলে একবার ঘুরে আসতেই পারো। তবে জার্মানির অটোবানে গিয়ে একটু গাড়ি চালানোর কথা ভাবলে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কথা ভুলো না যেন! আর আইল অব ম্যানে গেলে একটু সাবধানে যেয়ো।
সূত্র: আইএফএল সায়েন্স