মঙ্গলকে কি পৃথিবীর মতো সবুজ বানানো সম্ভব
কল্পনা করো, একদিন মঙ্গল গ্রহে গাছপালা জন্মাবে। বয়ে যাবে নদী। মানুষ অক্সিজেন মাস্ক ছাড়াই হেঁটে বেড়াবে সেখানে। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগছে, তাই না? এই ধরনের স্বপ্নকে বিজ্ঞানীরা বলেন টেরাফর্মিং। সহজ ভাষায় বললে, কোনো গ্রহকে এমনভাবে বদলে ফেলা যাতে সেখানে পৃথিবীর মতো পরিবেশ তৈরি হয়। অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞানীরা এই ধারনাকে নিছক সায়েন্স ফিকশন মনে করতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে।
পায়োনিয়ার ল্যাবস নামের একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ডক্টর এরিকা ডিবেনেডিক্টিস আর তাঁর টিম বলছেন, মঙ্গল গ্রহকে বসবাসযোগ্য করার বিষয়টা এখন আর অসম্ভব নয়। আগে যেটা একেবারেই করা যেত না, সেটা এখন শুধু কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। তাঁরা ২০২৫ সালের গ্রিন মার্স ওয়ার্কশপের জন্য একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে এখনই গবেষণা শুরু করা দরকার।
৩০ বছর আগেও এই পরিকল্পনা ছিল হাস্যকর। কিন্তু এখন কেন পরিস্থিতি বদলে গেছে? এর পেছনে কয়েকটা বড় কারণ আছে। প্রথমত, স্পেসএক্সের স্টারশিপ মহাকাশে জিনিসপত্র পাঠানোর খরচ হাজার গুণ কমিয়ে আনতে পারবে। দ্বিতীয়ত, সিনথেটিক বায়োলজি বা কৃত্রিম জীববিজ্ঞানে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তৃতীয়ত, জলবায়ুর মডেল তৈরির প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে এখন। সব মিলিয়ে প্রশ্ন এখন এটা নয় যে আমরা পারব কিনা। বরং প্রশ্নটা হলো, আমাদের তা করা উচিত হবে কিনা। আর যদি করতেই চাই, তাহলে শুরুটা হবে কীভাবে?
গবেষকেরা তিন ধাপে মঙ্গলকে বদলানোর কথা ভাবছেন। প্রথম ধাপে মঙ্গলকে গরম করতে হবে। এখন মঙ্গল গ্রহ ভীষণ ঠান্ডা। সেখানকার তাপমাত্রা প্রায় ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়াতে হবে। এটা করার জন্য বিশেষ ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাস বা কৃত্রিম অ্যারোসল ব্যবহার করা যেতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, মঙ্গলে অনেক বরফ জমা আছে। যদি তাপমাত্রা বাড়ানো যায়, তাহলে সেই বরফ গলে পানি হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেখানে এতো বরফ আছে যে প্রায় চল্লিশ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৩০০ মিটার গভীর সমুদ্র তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ, মঙ্গলে গ্রহেও সমুদ্র দেখা যেতে পারে!
দ্বিতীয় ধাপে আসবে জীবন। তবে প্রথমে মানুষ নয়, অতি ক্ষুদ্র জীবাণু। বিজ্ঞানীরা এমন কিছু বিশেষ ব্যাকটেরিয়া তৈরি করতে চান, যেগুলো ভীষণ কঠিন পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। এদের বলা হয় এক্সট্রিমোফাইল। এসব জীবাণু তীব্র ঠান্ডা, তেজস্ক্রিয়তা আর কম বায়ুচাপেও বেঁচে থাকতে পারবে। এরা মঙ্গলের মাটিতে শৈবালের মতো ছড়িয়ে পড়বে আর সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে অক্সিজেন তৈরি করবে। এই কাজটা সম্পন্ন করতে হয়তো কয়েক দশক সময় লাগবে।
তৃতীয় আর শেষ ধাপটা হবে সবচেয়ে লম্বা। এতে হাজার বছরও লাগতে পারে। এই পর্যায়ে মঙ্গলে অক্সিজেনসমৃদ্ধ বাতাস তৈরি করতে হবে যাতে আমরা মঙ্গলে শ্বাস নিতে পারি। প্রথমে বিশাল ডোমের মধ্যে এই কাজ শুরু হবে। প্রতিটা ডোম হবে প্রায় ১০০ মিটার উঁচু। সেখানে গাছপালা লাগিয়ে বা পানির অণু ভেঙে তৈরি করা হবে অক্সিজেন। তারপর ধীরে ধীরে ডোমের বাইরেও ছড়াতে থাকবে গাছপালা। যদিও শুধু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এই কাজ শেষ করতে হাজার বছর লেগে যাবে। কিন্তু একদিন হয়তো মানুষ সত্যিই মঙ্গলের খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াতে পারবে, কোনো হেলমেট ছাড়াই।
তবে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। মঙ্গলের বিশাল বরফের চাদরের নিচে আসলে কী লুকিয়ে আছে? যখন মঙ্গল গরম আর আর্দ্র হয়ে যাবে, তখন সেখানকার ভয়ঙ্কর ধুলিঝড়গুলো কেমন আচরণ করবে? পানি ভেঙে অক্সিজেন তৈরির জন্য যেসব উপাদান দরকার, সেগুলো কি মঙ্গলেই পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাবে, নাকি পৃথিবী থেকে নিয়ে যেতে হবে?
আর শুধু বৈজ্ঞানিক সমস্যাই নয়, নৈতিক প্রশ্নও আছে। মঙ্গলকে বদলে ফেললে হয়তো সেটা আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। মঙ্গলের নিজস্ব ইতিহাস আছে। সেটা বদলে দিলে আমরা হয়তো অনেক কিছু জানার সুযোগ হারাবো। আর যদি মঙ্গলে কোনো ধরনের প্রাণ থেকে থাকে, এমনকি ক্ষুদ্র জীবাণু হলেও, আমাদের হস্তক্ষেপ সেগুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
তবে গবেষকরা বলছেন, এই গবেষণা থেকে পৃথিবীরও লাভ হবে। মঙ্গলের জন্য যেসব প্রযুক্তি তৈরি হবে, যেমন শুষ্ক পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এমন ফসল বা বদ্ধ পরিবেশে টেকসই ব্যবস্থা, সেগুলো পৃথিবীতেও কাজে লাগবে। মহাকাশের জন্য সবুজ প্রযুক্তি তৈরি করতে গিয়ে হয়তো পৃথিবীর জন্যও আমরা ভালো কিছু পাবো।
সত্যি বলতে, পুরো ব্যাপারটা বেশ আকর্ষণীয়। গবেষকরা কিন্তু বলছেন না যে আগামীকাল থেকেই মঙ্গলে কাজ শুরু করে দাও। তাঁরা বলছেন, আগে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করো ও জলবায়ুর মডেল তৈরি করো। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে মঙ্গলে গিয়ে ছোট ছোট এক্সপেরিমেন্ট করো। কোনো গ্রহকে একদম বদলে ফেলার আগে আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে, আমরা কী নিয়ে কাজ করছি এবং কী ঝুঁকি নিচ্ছি।
সূত্র: ইউনিভার্স টুডে