দেশসেরাদের নাম ঘোষণা করে শেষ হলো বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবের জাতীয় পর্ব
শেষ হলো বিকাশ–বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবের জাতীয় পর্ব। গত ৩১ অক্টোবর, শুক্রবার ঢাকার সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব।
প্রতিবারের মতোই জাতীয় সংগীত পরিবেশনার সঙ্গে জাতীয় পতাকা ও উৎসব পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিনব্যাপী আয়োজন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ও ভেন্যু প্রধান ব্রাদার লিও জেমস পেরেরা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞানের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল, অ্যাসোসিয়েশন ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ফারজানা আলম, বিকাশ লিমিটেডের ইভিপি ও রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান হুমায়ূন কবির এবং বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। আরও উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও গবেষকেরা। রোবট ‘নাও’-এর ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বিকাশ–বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবের জাতীয় পর্ব। এরপর অতিথি ও শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে বেলুন উড়িয়ে উৎসবের সূচনা উদ্যাপন করেন।
উদ্বোধনের পরপরই শুরু হয় কুইজ প্রতিযোগিতা। আঞ্চলিক পর্বের বিজয়ীরা অংশ নেয় এই পর্বে। দেশের সাতটি অঞ্চলের প্রায় ১৫০ শিক্ষার্থী এতে প্রতিযোগিতা করে। নিম্নমাধ্যমিক বিভাগে অংশ নেয় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এবং মাধ্যমিক বিভাগে নবম-দশম শ্রেণি ও ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। পাশাপাশি আয়োজিত হয় একটি বিশেষ কুইজ, যাতে অংশ নেয় নিবন্ধিত ৫০ জন শিক্ষার্থী। একই সময়ে শুরু হয় প্রজেক্ট প্রদর্শনীর বিচারকার্যও।
এরপর শুরু হয় ‘সায়েন্স আনপ্লাগড’ পর্ব। বিজ্ঞানের নানা মজার বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক আদনান মান্নান এবং কার্টুনিস্ট নাসরীন সুলতানা মিতু। মিতু ‘কালিতুলিতে গল্পবিজ্ঞান’ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক চমৎকার বিজ্ঞান-আড্ডায় অংশ নেন।
এদিকে প্রজেক্ট প্রদর্শনীতে বিচারকেরা ঘুরে ঘুরে দেখেন শিক্ষার্থীদের তৈরি অসাধারণ সব প্রজেক্ট, করেন নানা প্রশ্ন, দেন উৎসাহ। দুপুরের বিরতির পর আবারও শুরু হয় অনুষ্ঠানমালা।
বিকেলের পর্ব শুরু হয় বিজ্ঞানবক্তা আসিফের ‘মহাজাগতিক ক্যালেন্ডার’-এর আলোচনার মধ্য দিয়ে। এরপর আসে বহুল প্রতীক্ষিত ‘বিজ্ঞান ম্যাজিক শো’। মঞ্চে আসেন জাদুকর রাজীব বসাক। বিজ্ঞান আর জাদুর মিশেলে তিনি দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন পুরোটা সময়।
এরপর আসে রুবিকস কিউব প্রতিযোগিতা। মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই কিউব মিলিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। এ পর্ব সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড দলের সদস্য রঙ্গন রায়। মাত্র ২৪ সেকেন্ডে কিউব সমাধান করে প্রথম হয় বরিশাল জিলা স্কুলের দিলশার। দ্বিতীয় হয় চ্যাম্পিয়ন একাডেমির আহমেদ, তৃতীয় রুহান। পুরস্কার তুলে দেন অতিথিরা।
এরপর মঞ্চে আসেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী সাফা কবির। শিক্ষার্থীদের রুবিকস কিউবের দক্ষতা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘ওদের দেখে আমি অবাক!’ তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেন।
বর্তমান সময়ে আলোচনায় থাকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নিয়েও ছিল বিশেষ পর্ব। এতে বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক এআই অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দলের দলনেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক বি এম মইনুল হোসেন। তিনি এআই কীভাবে কাজ করে এবং তার সঠিক ব্যবহারের দিকনির্দেশনা দেন শিক্ষার্থীদের।
এরপর মঞ্চ মাতান গায়ক দ্য রকস্টার শুভ—তাঁর গান ‘নিটোল পায়ে রিনিক-ঝিনিক’ গেয়ে।
সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লেও উৎসবের আনন্দ তখনো অটুট। এবার মঞ্চে আসেন বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। তিনি আলোচনা করেন এলিয়েনের অস্তিত্ব ও বিজ্ঞানের সংযোগ নিয়ে। ‘সায়েন্স আনপ্লাগড’-এর শেষ বক্তা হিসেবে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন সহজ ভাষায় শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরেন ‘রিলেটিভিটি এবং আইনস্টাইনের মহাবিশ্ব’।
অনুষ্ঠান শেষে ঘোষণা করা হয় প্রতিযোগিতার ফলাফল। একাডেমিক টিমের বিচার শেষে নির্বাচিত হয় প্রজেক্ট ও কুইজের সেরারা।
প্রজেক্ট প্রদর্শনীতে বিএএফ শাহীন কলেজের আরীব বিন ফারুক ও সাইম ইবনে সারওয়ার ‘দ্য সল্টিং আউট’ প্রজেক্ট তৈরি করে প্রথম হয়। দ্বিতীয় স্থান লাভ করে বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের এস এম সাইফান শাফি (পোকেডেক্স: দ্য আলটিমেট অ্যাডভান্সড এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট) এবং তৃতীয় স্থান সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের রায়িন আর রাদের প্রজেক্ট ‘ক্লাইমাকোর’। এই তিনটি প্রজেক্টের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় বিকাশের সৌজন্যে ল্যাপটপ।
কুইজ প্রতিযোগিতায় মাধ্যমিক ক্যাটাগরিতে প্রথম হয় রংপুর জিলা স্কুলের মো. ফাহিম ফয়সাল। দ্বিতীয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের রাজর্ষি দাশ গুপ্ত। তৃতীয় রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মো. রিফাত সময়।
নিম্নমাধ্যমিক বিভাগে প্রথম হয় পারমাণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইরাম মাহমুদ রুহান। দ্বিতীয় হয় নাচোল উপজেলা স্কুলের তাহমিদ উল ইসলাম এবং তৃতীয় হয় বরিশাল জিলা স্কুলের দিলশান হোসেন। প্রতিটি বিভাগে ১৫ জন করে শিক্ষার্থী পুরস্কৃত হয়।
বিশেষ কুইজে প্রথম হয় চ্যাম্পিয়ন একাডেমির তানভির হোসেন, দ্বিতীয় সিভিল এভিয়েশন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আহমেদ মুস্তাকিম খান এবং তৃতীয় বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মৌনি জামান রুকান। এ ছাড়া রুবিকস কিউব ও সুডোকু প্রতিযোগিতার শীর্ষ তিনজনকেও পুরস্কৃত করা হয়। সুডোকু প্রতিযোগিতায় প্রথম আদর্শ চক্রবর্তী, দ্বিতীয় সামিউল হক এবং তৃতীয় আল মাহিম।
বিজ্ঞান প্রজেক্টে প্রথম তিনটি দলকে দেওয়া হয় বিকাশের সৌজন্যে ল্যাপটপ, আর কুইজের দুই বিভাগের সেরাদের দেওয়া হয় বিকাশের বিশেষ পুরস্কার ও বিজ্ঞানচিন্তার সৌজন্যে ট্যাব। আরও ছিল বই, বিজ্ঞানবাক্স, সার্টিফিকেট, মেডেল, ট্রফিসহ নানা পুরস্কার।
এ উৎসবের স্ন্যাকস পার্টনার ছিল ড্যান কেক, আইসক্রিম পার্টনার পোলার। সহযোগিতায় ছিল অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স, অনুপম প্রকাশনী, জ্ঞানকোষ, গুফি এবং ঢাকা কমিক্স।
দিনের শেষ আলোয় ফটোসেশন, উল্লাস আর হাসি-আনন্দের মধ্য দিয়ে পর্দা নামে এবারের বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবের জাতীয় পর্বে। সারা দিনব্যাপী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাইমুম মৌসুমী বৃষ্টি, আর পুরস্কার বিতরণী পর্ব সঞ্চালনা করেন শিবলী বিন সারওয়ার।
সারা দেশের মোট সাতটি অঞ্চলে তৃতীয়বারের মতো আয়োজন করা হয় বিকাশ–বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবের আঞ্চলিক পর্ব। মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও বিজ্ঞানচিন্তা-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজনটি সম্পন্ন হয়।