ইস্পাতের চেয়ে ১০ গুণ শক্তিশালী কাঠ কীভাবে তৈরি করলেন বিজ্ঞানীরা
প্রাচীনকাল থেকে আসবাবপত্র, দালানকোঠা, নৌকা কিংবা গাড়ি তৈরির মতো বিভিন্ন নির্মাণকাজে কাঠ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এর একটি দুর্বলতা হলো শক্তি ও স্থায়িত্বের দিক থেকে এটি ধাতব পদার্থের তুলনায় অনেক দুর্বল। বিশেষ করে ইস্পাতের সঙ্গে এর তুলনায় চলে না। কিন্তু এবার এই কাঠকেই এমনভাবে বদলে দেওয়া হয়েছে, যা ইস্পাতের চেয়েও ১০ গুণ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও বিজ্ঞানীরা ঠিক এই কাজই করেছেন। তাঁরা এমন একধরনের ‘সুপারউড’ তৈরি করেছেন, যা শুধু হালকা নয়, বরং খুব মজবুত ও টেকসই।
নতুন ধরনের এই কাঠ তৈরি করেছে একটি মার্কিন কোম্পানি ইনভেন্টউড। তারা দাবি করছে, ‘সুপারউড’ ইস্পাতের চেয়ে ১০ গুণ পর্যন্ত বেশি শক্তি নিয়ে ওজন বহন করার ক্ষমতা রাখে। এটি একই সঙ্গে সাধারণ কাঠের চেয়ে ছয় গুণ পর্যন্ত হালকা। সম্প্রতি বাজারে এসেছে এই পণ্য। এই কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা হলেন পদার্থবিজ্ঞানী লিয়াংবিং হু।
এক দশকের বেশি আগে অধ্যাপক লিয়াংবিং হু কাজ শুরু করেছিলেন এই কাঠ নিয়ে। তাঁর লক্ষ্য ছিল নতুন করে কাঠ তৈরি করা। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ম্যাটেরিয়ালস ইনোভেশনে কাজ করার সময় লিয়াংবিং হু কাঠকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তিনি কাঠ থেকে এর একটি মূল উপাদান লিগনিনের কিছু অংশ সরিয়ে নেন। এই লিগনিন কাঠের রং তৈরি করে এবং কিছু পরিমাণ শক্ত করে। এই পরিবর্তনের ফলে কাঠটি স্বচ্ছও হয়ে উঠেছিল। লিয়াংবিং হু এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক।
অধ্যাপক হুর গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল কাঠকে আরও শক্তিশালী করে তোলা। কারণ, কাঠ হলো উদ্ভিদ তন্তুর প্রধান উপাদান। এটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকা জৈব পলিমার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর প্রথম বড় সাফল্য আসে ২০১৭ সালে। এ সময় তিনি এক বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এ পদ্ধতিতে তিনি সাধারণ কাঠকে প্রথমে রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করেন। যার ফলে কাঠের প্রাকৃতিক শক্তি প্রদানকারী উপাদান সেলুলোজ আরও বৃদ্ধি পায়। এই কাঠ উন্নত নির্মাণসামগ্রীতে পরিণত হয়।
সুপারউড তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথমে কাঠকে পানিতে ভিজিয়ে সেদ্ধ করা হয় এবং বিশেষ রাসায়নিক দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এরপর এটিকে কোষের স্তরে ভেঙে ফেলার জন্য প্রচণ্ড গরম চাপ দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াতেই কাঠটি অনেক বেশি ঘন ও শক্ত হয়ে ওঠে। সপ্তাহব্যাপী এই প্রক্রিয়ার পর তৈরি হওয়া কাঠ অধিকাংশ ধাতু ও সংকর ধাতুর চেয়েও বেশি শক্ত ছিল। এই প্রক্রিয়াকে নিখুঁত করে তিনি এই সুপারউড তৈরি করেন। মোট ১৪০টিরও বেশি ধাপ পেরিয়ে অধ্যাপক হু এখন সুপারউড বাণিজ্যিকভাবে বাজারে এনেছেন। ‘নেচার’ জার্নালে সুপারউড নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
যদিও সুপারউড এখন কয়েক ঘণ্টায় তৈরি করা যায়। তবু এর ব্যাপক উৎপাদন শুরু হতে সময় লাগবে। প্রাথমিকভাবে এটি ঘরের বাইরের কাজে ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে। পরে ঘরের ভেতরের কাজেও এটি ব্যবহার করা হবে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, আসবাবপত্রের দুর্বল ধাতব জয়েন্ট ও স্ক্রুর বদলে সুপারউড ব্যবহার করে সেগুলোকে আরও মজবুত করা সম্ভব। তাঁরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে এই কাঠ দিয়ে সম্পূর্ণ ভবন তৈরি করা যাবে।
সুপারউড তৈরির প্রক্রিয়াটি বাঁশসহ ১৯ ধরনের কাঠের ওপর কার্যকর হয়েছে। ইনভেন্টউড জানিয়েছে, সুপারউড সাধারণ কাঠের চেয়ে ২০ গুণ বেশি শক্তিশালী ও ছত্রাক-পোকামাকড়ের প্রতি প্রতিরোধী। যদিও এটি এখন সাধারণ কাঠের চেয়ে দামি। তবে এর কার্বন নির্গমন ইস্পাতের চেয়ে ৯০ শতাংশ কম। কোম্পানির লক্ষ্য দামের দিক থেকে সাধারণ কাঠের চেয়ে সস্তা হওয়া না, বরং ইস্পাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা।
অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারড কাঠ যেমন প্লাইউড তৈরি করা হয় আঠা দিয়ে কাঠকে জোড়া দিয়ে। কিন্তু সুপারউড আণবিক স্তরে পরিবর্তন করা কাঠ।
বর্তমানে কাঠ দিয়ে আকাশচুম্বী ভবনও তৈরি করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিলওয়াকি শহরে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু কাঠের টাওয়ার আছে। যেটি প্রায় ২৮৪ ফুটের মতো লম্বা। সেখানে আরও বড় টাওয়ার তৈরির পরিকল্পনা চলছে। এই পরিবর্তন জরুরি। কারণ, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী কংক্রিট বিশ্বের মোট কার্বন নির্গমনের প্রায় ৭ শতাংশের জন্য দায়ী। আবার কাঠের পরিবেশগত সুবিধাও অনেক। ইস্পাত ও কংক্রিটের চেয়ে এটি উৎপাদনে কম শক্তি লাগে।
সূত্র: সিএনএন