ব্ল্যাকহোলের মতো কালো কাপড় বানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা
এবার বিজ্ঞানীরা নিয়ে এলেন ‘সবচেয়ে কালো কাপড়’। এটি এমন এক কালো রং, যা চোখে পড়লে মনে হবে সামনে যেন একটা শূন্যতা। ছোট একটা ব্ল্যাকহোল। আলো পড়ছে, অথচ ফিরে আসছে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন এক কাপড় বানানো হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়া সবচেয়ে কালো কাপড়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই কাপড়ের অনুপ্রেরণা এসেছে নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলের এক অপূর্ব পাখি থেকে। ম্যাগনিফিসেন্ট রাইফেলবার্ড নামে এই পাখি বার্ড অব প্যারাডাইস পরিবারের সদস্য।
কর্নেল ইউনিভার্সিটির গবেষকদের তৈরি এই কাপড়ের নাম ‘আল্ট্রাব্ল্যাক উল’। দেখতে সাধারণ কাপড়ের মতো হলেও এর ভেতরের গঠন একেবারেই আলাদা। এই কাপড় বানানোর জন্য প্রথমে নেওয়া হয় সাদা মেরিনো উল। এই উলকে প্রথমে রাঙানো হয় পলিডোপামিন দিয়ে। মেলানিনের কৃত্রিম রূপ এটি। মেলানিন আমাদের ত্বক, চুল আর চোখের রঙের জন্য দায়ী প্রাকৃতিক রঞ্জক। এরপর এই রাঙানো উলকে রাখা হয় একটি প্লাজমা চেম্বারে, যেখানে বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত গ্যাস কাপড়ের তন্তুর ওপরে তৈরি করে অসংখ্য সূক্ষ্ম কাঁটার মতো গঠন। যেগুলোকে বলা হয় ন্যানোফাইব্রিল।
এই ক্ষুদ্র গঠনগুলোর কাজ একটাই, আলোকে আটকে রাখা। আলো কাপড়ের ওপরে পড়ে ভেতরে ঢুকে যায়, বেরিয়ে আসার পথ আর খুঁজে পায় না। এভাবেই অসম্ভব কালো এক কাপড় তৈরি হয়েছে। এই কাপড় ৯৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ আলো শোষণ করতে পারে। কর্নেল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক এবং গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক লারিসা শেফার্ড বলছেন, গবেষণার সময় অধ্যাপকেরা এসে কাপড়টি দেখে বলেছিলেন, ‘এ যেন একটা ব্ল্যাকহোলের দিকে তাকিয়ে থাকা।’
এই কাপড় দিয়ে গবেষকেরা একটিমাত্র নমুনা পোশাক তৈরি করেছেন। পোশাকটির নকশায় ইচ্ছা করেই রাইফেলবার্ডের পালকের ছাপ দেওয়া হয়েছে। যেন প্রকৃতি আর প্রযুক্তির যোগটা টের পাওয়া যায়। লারিসা শেফার্ডের মতে, এই কাপড় উচ্চমূল্যের ফ্যাশনে ব্যবহার করা হতে পারে।
এই কাপড় ‘আল্ট্রাব্ল্যাক’ নামের এক বিশেষ রঙের শ্রেণিতে পড়ে। সাধারণত যে বস্তু শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের কম আলো প্রতিফলিত করে, সেগুলোকে আল্ট্রাব্ল্যাক বলা হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ভ্যান্টাব্ল্যাক, যা ২০১৪ সালে তৈরি হয়েছিল। ভ্যান্টাব্ল্যাক আসলে কোনো কাপড় না, একটি আবরণ। কার্বনের অতিক্ষুদ্র নল দিয়ে তৈরি করা। এটি ৯৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ আলো শোষণ করতে পারে। টেলিস্কোপ, ক্যামেরা, মহাকাশযান আর কিছু বিলাসবহুল শিল্পকর্মে এটি ব্যবহার করা হয়। তবে ভ্যান্টাব্ল্যাক কাপড়ের মতো পরা যায় না। দামও অনেক বেশি। সেই তুলনায় আল্ট্রাব্ল্যাক উল পরা যায়। দামে কম, তৈরি করাও সহজ।
প্রকৃতিতে মাছ আর প্রজাপতির শরীরেও এমন আল্ট্রাব্ল্যাক রং দেখা যায়। কর্নেলের গবেষকেরা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে অনুকরণ করে রংটিকে আরও উন্নত করেছেন। নতুন কাপড়টি প্রায় ১২০ ডিগ্রি কোণ থেকেও সমানভাবে কালো দেখা যায়। রাইফেলবার্ডের পালক বা আগের আল্ট্রাব্ল্যাক কাপড় অনেক সময় পাশ থেকে দেখলে চকচকে লাগে।
এই কাপড়ের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও আলাদা। ঘরের ভেতরে এই কাপড় পরলে শরীর স্বাভাবিকই থাকবে। কিন্তু রোদে বেরোলেই এটি বেশি আলো শোষণ করে দ্রুত শরীর গরম করবে। তবে এই বৈশিষ্ট্যকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যেমন পোশাকের কাঁধ বা পিঠের অংশে আল্ট্রাব্ল্যাক স্তর ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব জায়গায় ঘাম বেশি হয়। ঘাম শুরু হলে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শরীর দ্রুত ঠান্ডা হয়। খেলোয়াড়দের পোশাকে এই কৌশল ব্যবহার করা হয়।
পোশাক ছাড়াও এই কাপড় আরও ব্যবহার করা যাবে সৌর প্যানেল, ক্যামেরা ও মহাকাশপ্রযুক্তিতে। টেলিস্কোপ বা স্যাটেলাইটে এটির ব্যবহার সম্ভব। তবে গবেষকেরা মনে করছেন, এসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে গেলে এখনো কিছু প্রযুক্তিগত বাধা কাটাতে হবে। এই কাপড় ধোয়ার পর কাপড়ের কর্মক্ষমতা কিছুটা কমে যেতে পারে। আর ন্যানো গঠন তৈরির জন্য যে প্লাজমা প্রক্রিয়া দরকার, তা ব্যাপক উৎপাদনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সূত্র: সিএনএন