ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ভাঙতে গাজার দিকে যাচ্ছে ৫০টির বেশি জাহাজ
৫০টির বেশি জাহাজ যাত্রা শুরু করেছে গাজা উপকূলে। দুটি লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছে এই যাত্রা। এক. ভাঙতে হবে অবরোধ; দুই. জরুরি মানবিক ত্রাণ সরবরাহ পৌঁছে দিতে হবে গাজার মানুষের কাছে।
গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। অবরোধ ভাঙার চেষ্টা হয়েছে বারবার। এই চেষ্টায় নিয়মিত বাধা দিয়েছে ইসরায়েল। তবে এবারের যাত্রায় বিশেষ কিছু দিক আছে। আগের সব কটি চেষ্টার মিলিত বহরের চেয়ে বড় এবারের উদ্যোগ। অনেকগুলো দেশের মানুষ মিলে যাত্রা শুরু করেছে।
দুটি বহর যাত্রা শুরু করেছে গাজার উদ্দেশে। প্রথম বহরে আছে অসংখ্য ছোট বেসামরিক জাহাজ। জাহাজগুলোতে আছেন অ্যাক্টিভিস্ট, মানবাধিকারকর্মী, চিকিৎসক, নাবিক। সঙ্গে আছে মানবিক সাহায্য বা ত্রাণ। ২ সেপ্টেম্বর স্পেনের বন্দরগুলো থেকে যাত্রা শুরু করেছে এই জাহাজের মিছিল। ৪ সেপ্টেম্বর এই বহরটি দ্বিতীয় বহরের সঙ্গে তিউনিসিয়ায় মিলিত হবে। আয়োজকেরা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক মিশন হিসেবে বর্ণনা করছেন। এই মিশনে যোগ দেবে ৪০টির বেশি দেশ থেকে আসা ৫০টির বেশি জাহাজ।
আছেন গ্রেটা থুনবার্গ
২২ বছর বয়সী সুইডিশ জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ সম্ভবত সুমুদ ফ্লোটিলাতে থাকা সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি। ২০১৮ সালে নিজ দেশে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে স্কুল ধর্মঘট শুরু করে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি।
গ্রেটা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন সর্বকনিষ্ঠ ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন। ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তিনি ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানাতে শুরু করেন। তখন থেকে ইসরায়েলপন্থীদের সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
তবে গ্রেটা থুনবার্গ দমে যাননি। জোর গলায় ফিলিস্তিনের পক্ষে সক্রিয় হয়েছেন। গত জুন মাসে ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙতে চাওয়া একটি নৌবহরে যোগ দিয়েছিলেন। ম্যাডলিন নামের সেই জাহাজে ইসরায়েলি বাহিনী বাধা দিয়েছিল। থুনবার্গসহ জাহাজে থাকা অন্যদের আটক করেছিল তারা। আটক করে কিছু পরে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল।
এ ঘটনা গ্রেটাকে দমাতে পারেনি। তিনি যোগ দিয়েছেন গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা টু গাজায়।
কোন কোন দেশ অংশ নিচ্ছে
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা মিশন থেকে জানানো হয়েছে, ছয় মহাদেশের ৪৪টি দেশ ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ভাঙার এই বৃহত্তম সামুদ্রিক মিশনে অংশ নিতে যাচ্ছে। এই দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অন্তর্ভুক্ত। অংশগ্রহণকারীরা কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়।
কোন কোন সংগঠন এতে অংশ নিচ্ছে
এই মিশনটি চারটি প্রধান জোট দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। যাদের মধ্যে অনেকেই এর আগে স্থল ও সমুদ্রপথে গাজায় সহায়তা প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছিল। আছে গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা। এটি একটি তৃণমূল আন্দোলন, যা গাজার প্রতি সংহতি জানাতে এবং অবরোধ ভাঙতে বৈশ্বিকভাবে কর্মসূচি আয়োজন করে। পাশাপাশি আছে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন। সমুদ্রপথে মিশন পরিচালনার ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে তাদের। বর্তমান গাজা অবরোধ ভাঙার প্রচেষ্টায় ব্যবহারিক পরামর্শ, দিকনির্দেশনা এবং অপারেশনাল সহায়তা দিচ্ছে তারা। এ ছাড়া এই মিশনে যোগ দিয়েছে মাগরেব সুমুদ ফ্লোটিলা। উত্তর আফ্রিকাভিত্তিক এই উদ্যোগটি ফিলিস্তিনিদের কাছে ত্রাণ ও সহায়তা পৌঁছে দিতে সংহতিমূলক মিশন পরিচালনা করছে। আর আছে সুমুদ নুসানতারা। মালয়েশিয়া এবং আরও ৮টি দেশের জনগণের নেতৃত্বে গঠিত এই বহরটির লক্ষ্য গাজা অবরোধ ভাঙা এবং গ্লোবাল সাউথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সংহতি গড়ে তোলা।
সব মিলিয়ে এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সমন্বিত বেসামরিক নৌবহর হবে।
কারা যুক্ত আছেন
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার ওয়েবসাইট অনুসারে, এই জোটে আছেন মানবিককর্মী, চিকিৎসক, শিল্পী, ধর্মীয় নেতা, আইনজীবী, নাবিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। এই দলের সবাই মানুষের মর্যাদা, অহিংস কার্যক্রম এবং এই সত্যে বিশ্বাস করেন। তাঁরা মনে করেন, গাজার অবরোধ ও গণহত্যা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
সুইডিশ অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেটা থুনবার্গ, ইতিহাসবিদ ক্লিওনিকি অ্যালেক্সোপওলু, মানবাধিকারকর্মী ইয়াসেমিন আকার, সমাজ পরিবেশবিদ থিয়াগো আভিয়া, রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ও আইনজীবী মেলানি শভাইজার এবং ফিলিস্তিনি অ্যাক্টিভিস্ট সাইফ আবুশকের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা একটি পরিচালক কমিটি গঠন করেছেন।
যদিও কয়েক শ মানুষ এই নৌবহরে গাজার দিকে যাত্রা করেছেন। আরও হাজার হাজার মানুষ এই উদ্যোগে অংশ নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন।
জাহাজ কখন ছেড়েছে, গাজায় পৌঁছাতে কত সময় লাগবে
বার্সেলোনার প্লাকা দেল রেই-তে এক সংবাদ সম্মেলনে সাইফ আবুশকে বলেছেন, নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে নির্দিষ্ট বন্দর ও জাহাজের বিস্তারিত তথ্য পরে জানানো হবে। দলটি অনুমান করছে, ৩ হাজার কিলোমিটারের (১,৬২০ নটিক্যাল মাইল) এই যাত্রা শেষ করতে বহরটির সাত থেকে আট দিন সময় লাগবে।
ফ্লোটিলা কী এবং কেন সমুদ্রপথে ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে
ফ্লোটিলা হলো একদল নৌকা বা জাহাজের সমন্বয়ে গঠিত একটি বহর। সংকটপূর্ণ অঞ্চলে খাদ্য, ওষুধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ পৌঁছে দিতে ব্যবহৃত হয় ফ্লোটিলা। সাধারণত যখন আকাশপথ বা স্থলপথ বন্ধ থাকে বা ব্যবহার করা কঠিন হয়, তখন ফ্লোটিলা ব্যবহার করে ত্রাণ পাঠানো হয়। ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল গাজার আকাশসীমা এবং সমুদ্রসীমা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা পণ্য ও মানুষের চলাচল সীমিত করে দিয়েছে। আর যুদ্ধের আগেও গাজায় কোনো কার্যকর বিমানবন্দর ছিল না। ২০০১ সালে ইসরায়েল ইয়াসির আরাফাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংসের মাত্র তিন বছর আগে চালু হয়েছিল এই বিমানবন্দর।
মানবিক এই ফ্লোটিলাগুলো সাধারণত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এবং আন্তর্জাতিক নৌ আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। সমুদ্রপথে ত্রাণ পাঠানোর মাধ্যমে এই সুমুদ ফ্লোটিলা ইসরায়েলের অবরোধের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিরোধের একটি বার্তা দিতে চায়।
আগের ফ্লোটিলাগুলোর কী হয়েছিল
গাজার অবরোধ ভাঙার জন্য বেশ কয়েকটি ফ্রিডম ফ্লোটিলা আগে চেষ্টা চালিয়েছে। ২০০৮ সালে ফ্রি গাজা মুভমেন্টের দুটি নৌকা সফলভাবে গাজায় পৌঁছেছিল, যা ছিল ইসরায়েলের নৌ অবরোধের প্রথম সফল লঙ্ঘন। ২০০৮ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এই আন্দোলনে ৩১টি নৌকা যাত্রা শুরু করেছিল। যার মধ্যে পাঁচটি ইসরায়েলের কঠোর বিধিনিষেধ সত্ত্বেও গাজায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়। তবে ২০১০ সাল থেকে গাজার অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করা সব ফ্লোটিলাকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েল বাধা দিয়েছে বা আক্রমণ করেছে।
২০১০ গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা: ২০১০ সালে ইসরায়েলি কমান্ডোরা আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাভি মারমারা জাহাজে অভিযান চালান। এই আক্রমণে ১০ জন অ্যাক্টিভিস্ট নিহত এবং কয়েক ডজন আহত হন, যা বিশ্বব্যাপী ক্ষোভের সৃষ্টি করে। জাহাজটি মানবিক ত্রাণ ও ৬০০ জনের বেশি যাত্রী বহন করছিল।
২০১১ ফ্রিডম ফ্লোটিলা II: এটি ২০১০ সালের মিশনের ফলোআপ হিসেবে ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে।
২০১৫ ফ্রিডম ফ্লোটিলা III: এটি ইসরায়েলের নৌ অবরোধ ভাঙার জন্য আন্তর্জাতিক অ্যাক্টিভিস্টদের তৃতীয় প্রধান প্রচেষ্টা ছিল। ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন পরিচালিত এই মিশনে কয়েকটি জাহাজ ছিল, যার নেতৃত্বে ছিল সুইডিশ পতাকাবাহী মেরিয়েন অব গোথেনবার্গ।
২০১৮ জাস্ট ফিউচার ফর প্যালেস্টাইন: এটিও গাজার অবরোধ ভাঙার জন্য ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের একটি চলমান প্রচেষ্টা ছিল।
২০২৫ ব্রেক দ্য সিজ ‘কনশেন্স’: ২ মে গাজার উদ্দেশে যাত্রা করার প্রস্তুতিকালে কনশেন্স জাহাজটি মাল্টা উপকূল থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে সশস্ত্র ড্রোন দিয়ে দুবার আক্রান্ত হয়।
২০২৫ ম্যাডলিন: ৯ জুন ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের ম্যাডলিন জাহাজটিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা থেকে প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় আটক করে।
২০২৫ হান্ডালা: ২৬ জুলাই ইসরায়েলি বাহিনী হান্ডালা জাহাজে হামলা চালায়। জাহাজটি ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছিল।