গোবি ও তাকলামাকান মরুভূমিকে ঠেকাতে গ্রেট গ্রিন ওয়াল তৈরি করেছে চীন

‘গ্রেট গ্রিন ওয়াল’ চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবেশগত প্রকল্পলাইভ সায়েন্স

চীন দেশটা বেশ বড়। এর উত্তরাংশে ছড়িয়ে আছে বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা। তুমি চীনের উত্তরের অংশে যাও, দেখবে গাছে গাছে ভরে আছে। সারিবদ্ধ গাছ লাগিয়ে এখানে লম্বা বন তৈরি করা হয়েছে। কখনো ধূসর বালুর সাগরের কিনার ঘেঁষে আছে এই বন। কখনো জনবসতির গা ঘেঁষে চলে গেছে। এসব গাছ এক মহাপরিকল্পনার অংশ। নাম ‘গ্রেট গ্রিন ওয়াল’। চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবেশগত প্রকল্প। এর লক্ষ্য দুই বিশাল মরুভূমি গোবি ও তাকলামাকানের বিস্তার ধীরে ধীরে থামিয়ে দেওয়া।

১৯৭৮ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের আওতায় চীন এরই মধ্যে ৬৬ বিলিয়নের বেশি গাছ লাগিয়েছে। মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তানের সীমান্ত বরাবর প্রায় ২ হাজার ৮০০ মাইলজুড়ে ছড়িয়ে আছে এই কৃত্রিম বনের বেল্ট। এখানেই শেষ নয়, চীনা কর্তৃপক্ষ আগামী ২৫ বছরে আরও ৩৪ বিলিয়ন গাছ লাগাতে চায়। পরিকল্পনা সফল হলে ১৯৭০–এর দশকের শেষ দিকের তুলনায় পৃথিবীর মোট বনভূমির প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে যাবে।

আরও পড়ুন

এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক নাম ‘থ্রি-নর্থ শেল্টার ফরেস্ট প্রোগ্রাম’। এর মূল উদ্দেশ্য মাটি ক্ষয় ও বালু জমা কমানো। ১৯৫০-এর দশক থেকে উত্তর চীনে দ্রুত নগরায়ণ ও কৃষিজমি সম্প্রসারণের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে শুরু করেছিল। এলাকাটা এমনিতেই শুষ্ক। এই অঞ্চলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে পড়ে। বাড়তে থাকে বালুঝড়। এসব ঝড় মাটির ওপরের উর্বর স্তর উড়িয়ে নিয়ে যায়। পাশাপাশি শহরে বালু ও সূক্ষ্ম ধূলিকণা জমিয়ে দূষণ বাড়ায়। বিশেষ করে বেইজিংয়ের মতো বড় শহরগুলোয় এর বাজে প্রভাব পড়ে।

আসলে উত্তর চীন বহু আগেই শুষ্ক ছিল। হিমালয় পর্বতমালা মঙ্গোলিয়া সীমান্তের দিকে বৃষ্টির পথ আটকে দেয়। ফলে সেখানে খুব কম বৃষ্টিপাত হয়। এ কারণেই গোবি ও তাকলামাকান এত বিশাল। এই দুই মরুভূমি প্রায় ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে। আকারে প্রায় আলাস্কার কাছাকাছি।

আরও পড়ুন

পাঁচ দশক চেষ্টা করেও মরুভূমির অগ্রযাত্রা পুরোপুরি থামেনি। গোবি মরুভূমি এখনো প্রতিবছর প্রায় ৩ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার তৃণভূমি বিলীন করছে। প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ও কৃষিজমি ধ্বংস করছে, শহরের বায়ুদূষণও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তবে কিছু সাফল্যও আছে। গত বছর চীনা সরকার জানিয়েছে, তাকলামাকান মরুভূমিকে পুরোপুরি সবুজ বেষ্টনীর মধ্যে আনা হয়েছে। এর ফলে বালিয়াড়িগুলো স্থিতিশীল হয়েছে। ১৯৪৯ সালে চীনের বনভূমি ছিল মাত্র ১০ শতাংশ, সেখানে এখন চীনের বনভূমি ২৫ শতাংশের বেশি। এই বনকে টিকিয়ে রাখতে আরও গাছ লাগানো চলতে থাকবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রেট গ্রিন ওয়াল হবে প্রায় ২ হাজার ৮০০ মাইল লম্বা। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, এই সবুজ প্রাচীর কি সত্যিই মরুকরণ থামাতে পারছে?

আরও পড়ুন

কিছু গবেষণায় দেখা যায়, বালুঝড়ের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। আবার অন্য গবেষকেরা মনে করেন, এই হ্রাসের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে জলবায়ুর স্বাভাবিক পরিবর্তন, বনায়ন নয়। সমালোচকেরা আরও বলেন, গাছের টিকে থাকার হার খুব কম। কারণ, বিশাল এলাকাজুড়ে মাত্র একটি-দুটি প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। মূলত পপলার ও উইলোগাছ আছে এখানে। এ–জাতীয় বনের রোগ বা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যেমন ২০০০ সালে নিংশিয়া প্রদেশে একটিমাত্র রোগে প্রায় এক বিলিয়ন পপলারগাছ মারা গিয়েছিল।

আরও বড় সমস্যা হলো পানির অভাব। অনেক এলাকায় এমন জায়গায় গাছ লাগানো হয়েছে, যেখানে স্বাভাবিকভাবে গাছ বাঁচার মতো পানি নেই। পানি দেওয়া ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে এখানে গাছ টিকে থাকতে পারে না। চীনা একাডেমি অব সায়েন্সেসের মরুকরণ বিশেষজ্ঞ শিয়ান শুয়ে একবার বলেছিলেন, বালিয়াড়িতে ব্যাপকভাবে গাছ লাগানোর ফলে মাটির আর্দ্রতা ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে, যা কিছু অঞ্চলে মরুকরণ বাড়িয়ে দিতে পারে।

একই সঙ্গে এক জাতীয় বন হওয়ায় এই গ্রিন ওয়াল জীববৈচিত্র্য বাড়াতে তেমন সাহায্য করছে না। তবু এই প্রকল্পের প্রভাব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আফ্রিকায় অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু হয়েছে আরেকটি ‘গ্রেট গ্রিন ওয়াল’, যা পাঁচ হাজার মাইল দীর্ঘ এক সবুজ বেল্ট। যার লক্ষ্য সেখানকার ভূমিক্ষয় ও মরুকরণ ঠেকানো।

আরও পড়ুন