অস্ট্রেলিয়ার কুবার পেডিতে কেন মানুষ মাটির নিচে বাস করে
অস্ট্রেলিয়ার নাম শুনলেই আমাদের মনে প্রথমে আসে ক্যাঙারু, প্লাটিপাস বা কোয়ালার মতো অদ্ভুত সব প্রাণীর কথা। মনে হয় যেন পৃথিবীর সব অদ্ভুত জিনিসই সেখানে আছে। কিন্তু এই দেশেই লুকিয়ে আছে এক আশ্চর্যজনক শহর, যার নাম কুবার পেডি। এই শহরে গেলে তুমি কাউকে তেমন একটা দেখতে পাবে না। এমনকি কোনো বাড়িঘরও চোখে পড়বে না। কিন্তু একটু ঘুরে বেড়ালেই দেখা মিলবে এক বিশাল শহরের, যার পুরোটাই মাটির নিচে। সেখানে পুরো শহরের মানুষজন মাটির নিচেই বাস করে। কিন্তু এই আধুনিক যুগে এসেও কেন সেখানকার মানুষ মাটির নিচে গুহার মতো বাড়িতে থাকছে?
অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে অ্যাডিলেড থেকে প্রায় ৮৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই কুবার পেডি শহর। শহরটি বিখ্যাত হওয়ার প্রধান কারণ এখানে পাওয়া বিপুল পরিমাণ মূল্যবান ওপাল খনিজ। ওপাল পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান রত্নপাথরগুলোর একটি। ওপালের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব এর রঙের খেলা। শহরটি মূলত ওপাল খনিজ উত্তোলন ও কৌতূহলী দর্শনার্থীদের ভিড়ের কারণেই টিকে আছে।
কুবার পেডি শহরের জন্ম হয়েছিল সেই রত্নপাথর আবিষ্কারের মাধ্যমে। সালটা ছিল ১৯১৫। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ১৪ বছর বয়সী এক বালক হঠাৎ একটি মূল্যবান রত্নপাথর খুঁজে পায়। সেই ছোট্ট আবিষ্কার থেকেই গড়ে ওঠে আজকের কুবার পেডি। এখানে এত পরিমাণ ওপাল পাওয়া যায় বলে এটিকে বিশ্বের ওপাল রাজধানী বলা হয়। তবে কুবার পেডি শহর প্রচণ্ড উত্তপ্ত স্থান। বর্তমানে কয়েক হাজার মানুষ এখানে বাস করে।
‘কুবার পেডি’ নামের অর্থ হলো ‘গর্তে থাকা সাদা মানুষ’। নামের মধ্যেই এখানের মানুষের জীবনযাত্রার কথা আছে। তবে এই শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এর মাটির নিচের বাড়িগুলো, যাদের স্থানীয় ভাষায় ‘ডাগআউট’ বলা হয়। দিনের বেলায় কুবার পেডিতে প্রচণ্ড গরম পড়ে। এখানে নিয়মিত তাপমাত্রা থাকে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এই অসহ্য গরমের হাত থেকে বাঁচতেই সেখানকার মানুষজন বিশেষ পদ্ধতিতে মাটির নিচে ঘর বানিয়ে স্বাভাবিক ও আরামদায়ক জীবন কাটায়। মাটির নিচে থাকার কারণে গরমকালজুড়ে ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক ও শীতল থাকে।
প্রকৃতির চরম তাপ থেকে বাঁচতে কুবার পেডির মানুষজনের মাটির নিচে বাড়ি বানানোর এই কৌশল এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের চংকিং শহর নাগরিকদের প্রচণ্ড গরমের হাত থেকে বাঁচাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত বিমান হামলা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খুলে দিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো এখন তাপ থেকে বাঁচার শীতল স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিশ্বের বেশির ভাগ ওপাল এই ছোট্ট শহর থেকেই আসে, কিন্তু এখানে কোনো বড় খনি কোম্পানি নেই। কারণ, ওপাল মাটির নিচে ঠিক কতটা পরিমাণে আছে, তা পরীক্ষা করে বের করা যায় না। এটি খুঁজে বের করার একমাত্র উপায় হলো খনন করা। এ কারণে ছোট ছোট খনির শ্রমিকেরা এখানে আসেন। জমির মালিকের অনুমতি নিয়ে মাটি খুড়ে ওপাল বের করেন।
বাইরে থেকে দেখলে ডাগআউটগুলো সাধারণ গুহা মনে হলেও, ভেতরে এগুলো আধুনিক জীবনের সব সুবিধা নিয়ে তৈরি। এখানে রান্নাঘর, বেডরুম এমনকি ভূগর্ভস্থ চার্চ, রত্নের দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও সুইমিং পুলও রয়েছে। ছাদ ধসে না পড়ার জন্য ডাগআউটগুলোকে কমপক্ষে চার মিটার বা ১৩ ফুট গভীর হতে হয়। এসব বাড়ির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এদের তাপমাত্রা। বাইরের তাপমাত্রা যখন ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকে, তখনো মাটির পুরু দেয়াল ভেতরের তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে স্থিতিশীল রাখে, যা বাড়িকে দিনের প্রায় সব সময় স্বাভাবিক ও শীতল রাখে। তাই দিনের প্রচণ্ড গরম বা ধুলাবালু সবকিছু থেকেই ডাগআউটের বাসিন্দারা রেহাই পান। এভাবে মাটির নিচে থেকে তারা এক শান্ত, আরামদায়ক ও স্বাভাবিক জীবন কাটান।
সূত্র: বিবিসি, দ্য টেলিগ্রাফ