আফ্রিকান সোনালি বিড়াল বাঁচাতে কাজ করছেন প্রাক্তন শিকারিরা
পোষা বিড়ালেরা লুকিয়ে থাকলে ওদের খুঁজে পাওয়া যে কত মুশকিল, এটা হয়তো তোমরা অনেকেই জানো। বাড়ির ছোট সীমানার মধ্যেই ওদের খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে চিন্তা করো, আফ্রিকান বিশাল বনভূমিতে লুকিয়ে থাকা বনবিড়ালদের হিসাব রাখা কত কঠিন! মানুষের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে ওরাও পছন্দ করে। কিন্তু সংরক্ষণবিদদের ধারণা মতে, আফ্রিকান সোনালি বিড়ালদের সংখ্যা ভয়ানকভাবে কমে এসেছে। পোষা বিড়ালের চেয়ে আকারে দ্বিগুণ বড় এই প্রজাতির বিড়ালদের সম্পর্কে মানুষের জানাশোনা খুব কম। রহস্যময় এসব বনবিড়ালকে ঠিকমতো চেনার আগেই কি এরা বিলুপ্ত হয়ে যাবে? ওদের বিলুপ্তি ঠেকাতে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই কাজে লাগাচ্ছেন সংরক্ষণবিদেরা। এমনকি আফ্রিকান সোনালি বিড়ালদের প্রাক্তন শিকারিরাও ওদের সংরক্ষণে সহায়তা করছেন।
এমবাকার সঙ্গে এমওয়েজির পরিচয়
উগান্ডার বুয়েনদি ইমপেনিট্রেবল ফরেস্ট ন্যাশনাল পার্কের ক্যামেরা ট্র্যাপ পরীক্ষা করছিলেন প্রাণিবিদ এমওয়েজি মুগেরওয়া। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে বড়সড় এক বিড়াল। সাদাকালো ফুটেজ দেখে এমওয়েজি চিনতে পারেননি এটা কোন প্রজাতির বিড়াল। এরপর তিনি অনেক বিশেষজ্ঞকে দেখান ভিডিওটি। দুই দশকের বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনেক প্রাণিবিদও বিড়ালটিকে চিনতে পারেননি। কিন্তু এমওয়েজি যখন সেই ভিডিওটি উগান্ডার স্থানীয় মানুষদের দেখান, তারা সঙ্গে সঙ্গেই চিনে ফেলে বিড়ালটিকে। জানা যায়, স্থানীয় লোকজনের কাছে আফ্রিকান সোনালি বিড়ালদের নাম ‘এমবাকা’। স্থানীয় মানুষ ও শিকারিদের পাতা ফাঁদে এসব বিড়াল প্রায়ই আটকা পড়ত। তাই তাদের কাছে প্রাণীটি বেশ পরিচিত।
এটি ছিল প্রায় ১৬ বছর আগের কথা। এর পর থেকেই এমওয়েজি মুগেরওয়া এই রহস্যময় বিড়ালদের নিয়ে কাজ করছেন। এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র তিনবার এমবাকাদের দেখা পেয়েছেন তিনি। এমবাকাদের নিয়ে করা কাজের জন্য এমওয়েজি ‘ইন্ডিয়ানাপলিস উদীয়মান সংরক্ষণবাদী পুরস্কার’ও পেয়েছেন। তবু আফ্রিকার সব প্রজাতির বিড়ালের মধ্যে এই এমবাকারাই সবচেয়ে কম পরিচিত। এদের নিয়ে গবেষণাও হয়েছে সবচেয়ে কম।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সাহায্য করছে
এমওয়েজি মুগেরওয়া জানতেন, একা তিনি কখনো আফ্রিকান সোনালি বিড়ালদের সব তথ্য বের করতে পারবেন না। তাঁর আশঙ্কা ছিল, অসাধারণ রহস্যময় এই প্রজাতিটিকে ঠিকভাবে চেনার আগেই এরা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। কিন্তু ওদের বাঁচাতে হলে আগে ওদের সম্পর্কে জানতে হবে। তাই ২০১৯ সালে তিনি একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। ১৯টি দেশের ৪৬ জন সংরক্ষণবিদ নিয়ে গঠিত তাঁর সংস্থাটির নাম ‘আফ্রিকান গোল্ডেন ক্যাট কনজারভেশন অ্যালায়েন্স’ (এজিসিসিএ)। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অর্থায়নে এজিসিসিএ আফ্রিকান সোনালি বিড়ালদের আনুমানিক আবাসস্থলজুড়ে অসংখ্য ক্যামেরা ট্র্যাপ স্থাপন করে। ১৯টি দেশজুড়ে ৩০টি জায়গায় ক্যামেরা বসানো হয়। আফ্রিকান যেকোনো প্রজাতির ওপর করা গবেষণার মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ সংখ্যক ক্যামেরা ট্র্যাপ স্থাপন করার নজির। এতগুলো ক্যামেরায় ধারণ করা হাজার হাজার ছবি একে একে দেখা মানুষের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ।
এমন সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় প্যান্থেরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের অ্যালগরিদম তৈরি করে। এআই অ্যালগরিদমটি প্রতিটি আফ্রিকান সোনালি বিড়ালকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু কীভাবে? ওদের লোমের ধরন দেখে। মানুষেরা যেমন আলাদা আলাদা আঙুলের ছাপ ধারণ করে, তেমনি এসব বিড়ালেরও লোমের ঘনত্ব ও ধরন আলাদা। এমওয়েজি জানান, এআই ছাড়া এভাবে প্রতিটি বিড়ালকে আলাদা করে শনাক্ত করা অসম্ভব ছিল। কারণ, লোমের মধ্যে এত ছোট ছোট খুঁটিনাটি পার্থক্য খালি চোখে ধরা পড়ে না। এমবাকাদের সংরক্ষণ করার জন্য এই এআই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এআইয়ের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে কোথায় এমবাকাদের ঘনত্ব বেশি এবং এমবাকাদের আনুমানিক সংখ্যা কত।
প্রাথমিকভাবে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সংরক্ষিত স্থানেও আফ্রিকান সোনালি বিড়ালদের সংখ্যা অনেক কম। উগান্ডা ও গ্যাবনে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, সেখানে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে ১৬টি এমবাকা রয়েছে। এই সংখ্যাটি আশঙ্কাজনক। শিকারিদের বিচরণ আছে এমন এলাকায় ওদের সংখ্যা সংরক্ষিত এলাকার চেয়ে ৫০ শতাংশ কমে আসে। সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা গেছে, এমবাকারা দিনে ও রাতে উভয় সময়ে সচল থাকে। কিন্তু এরা মূলত নিশাচর স্বভাবেরই হয়। আশা করা যাচ্ছে, এই গবেষণার সম্পূর্ণ তথ্য আগামী বছর পাওয়া যাবে।
প্রাক্তন শিকারিরাও যখন সংরক্ষক
আফ্রিকান সোনালি বিড়ালদের সংখ্যা গণনা করা ওদের বাঁচানোর প্রাথমিক ধাপ মাত্র। গবেষণার শুরুতেই এমওয়েজি বুঝতে পারেন, এই বিড়ালদের সংখ্যা কমার মূল কারণ শিকারিদের পাতা ফাঁদ। ২০১৯ সালে ৮০টি আফ্রিকান সোনালি বিড়াল শিকারিদের ফাঁদে পড়েছিল বলে তথ্য আছে এমওয়েজির কাছে। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশ ফাঁদই ছিল অন্যান্য প্রাণীকে লক্ষ্য করে পাতা।
প্রাণী হত্যার এই সংকট মোকাবিলা করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে এমওয়েজিকে। আফ্রিকান সোনালি বিড়ালদের বাঁচাতে তিনি বিশ্বের প্রথম গোষ্ঠীভিত্তিক শিকার দমন সংস্থা খোলেন। তাঁর এই সংস্থার নাম ‘এমবাকা’। সোনালি বিড়ালদের আনাগোনা আছে এমন অঞ্চলের প্রায় ৮ হাজার পরিবারের সঙ্গে কাজ করছে এমবাকা। গ্যাবন, উগান্ডা, অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র ও দক্ষিণ সুদানের মতো অনেক দেশে কাজ করছে এই সংস্থা। স্থানীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর যেসব মানুষকে আফ্রিকান সোনালি বিড়ালদের সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা অনেকেই প্রাক্তন শিকারি। তাদের কাজ এখন ক্যামেরা লাগানো, কোনো এমবাকা দেখলে ওদের হিসাব রাখা এবং অবশ্যই এমবাকাদের কোনো ক্ষতি না করা। এর বিনিময়ে এমওয়েজির সংস্থা প্রাক্তন শিকারিদের চিকিৎসাসেবা দেয় এবং তাদের গবাদিপশু পালনে সহায়তা করে। এভাবে শিকারিদের সংরক্ষণের কাজে লাগানোর ফলে আফ্রিকান সোনালি বিড়ালদের বাসস্থান সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
আশা করছি, এআই ও প্রাক্তন শিকারিদের ব্যবহার করে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের যে কাজ শুরু হয়েছে, তা বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় অন্যান্য প্রজাতি বাঁচাতেও পথ দেখাবে। আর এভাবেই বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে থাকা সব প্রাণীর জন্য এমওয়েজি মুগেরওয়ার মতো কেউ–না কেউ হয়তো আশার আলো হয়ে এগিয়ে আসবেন।