মানুষকে তো অনেক ভোট দিলেন, এবার ভালুককে ভোট দিন

ভালুক যত ভয়ানকই হোক না কেন, ওরা দেখতে বেশ নাদুসনুদুস। গোলগাল মুখ দেখলে ওদের আদর করতে ইচ্ছা করে। ভালুকদের ছবি দেখলে মনে হয়, গিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে থাকি। সুযোগ থাকলে তো কয়েকটা ভালুক বাসায়ই নিয়ে আসতাম! তবে বাস্তবে কোনো ভালুককে জড়িয়ে ধরতে গেলে প্রাণ নিয়ে আর ফিরে আসা লাগবে না। তাই আমি ইন্টারনেটেই ভালুকদের ছবি দেখি।

একদিন হঠাৎ চোখে পড়ল, ভালুকদের মোটা হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায়। আলাস্কার কাটমাই জাতীয় উদ্যানের ব্রুকস নদীর তীরে হওয়া এই প্রতিযোগিতার নাম ‘ফ্যাট বিয়ার উইক’! খেয়ে খেয়ে ওখানকার কোন বাদামি ভালুক সবচেয়ে বড় ভুঁড়িওয়ালা হতে পারবে, সেটা নিয়ে ইন্টারনেটে চলছে ভোটাভুটি। এসব ভালুকের নামও আছে। মোটা হওয়ার জন্য ওরা এখন দিনভর খেয়েই চলছে। এটা দেখে আমার ভীষণ কৌতূহল হলো। হঠাৎ করে আলাস্কায় এত এত ভালুক গোগ্রাসে গেলা শুরু করল কেন?

ফ্যাট বিয়ার উইক ২০২৫
এক্সপ্লোর ডট অর্গ
আরও পড়ুন

বাঁচতে হলে খেতে হবে

ভালুকদের হাইবারনেশন বা শীতনিদ্রার গল্প আমরা সবাই কমবেশি জানি। শীতকালটা কালো আর বাদামি ভালুকরা ঘুমিয়েই কাটায়। শীতনিদ্রার সময় বাদামি ভালুকরা নিজেদের গর্তের ভেতরেই থাকে, প্রায় কোনো কাজই করে না। এ সময় শরীরের শক্তি বাঁচাতে ওরা হার্টরেটও কমিয়ে ফেলে। তবে ভালুকদের এই শীতনিদ্রার দৈর্ঘ্য জায়গাভেদে আলাদা হয়। যেমন মেক্সিকোর কিছু অঞ্চলে বাদামি ভালুকরা কয়েক দিন কিংবা কয়েক সপ্তাহ কাটায় শীতনিদ্রায়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় ওরা প্রায় অর্ধেক বছর শীতনিদ্রায় ডুবে থাকে। এত লম্বা সময় না খেয়ে থাকতে গেলে শরীরে তো আগে থেকেই যথেষ্ট রসদ জমা থাকা দরকার, তাই না? সে কারণেই শীতনিদ্রায় যাওয়ার আগে সক্রিয় মৌসুমে ভালুকদের খাওয়াদাওয়া অনেক গুণ বেড়ে যায়। এটা কিন্তু স্রেফ ভোজনরসিক ভালুকদের খেয়ালখুশি খাওয়া নয়। এটা ওদের টিকে থাকার জন্য জরুরি। তাই এ সময় একেকটা ভালুক দিনে ৪০টা পর্যন্ত স্যামন মাছ খেতে পারে! এভাবে একটি ভালুক দিনে দুই কেজি কিংবা এরও বেশি ওজন বাড়াতে পারে। আর এই বাড়তি ওজন গর্ভবতী মা ভালুকদের সবচেয়ে বেশি দরকার হয়। কারণ, ওরা যখন ওদের গর্তে শীতনিদ্রায় থাকবে, তখনই ওদের শাবক জন্ম নেবে। শীতনিদ্রায় গেলেও মা ভালুকদের হার্টরেট আর কিছু শারীরিক প্রক্রিয়া অন্য ভালুকদের চেয়ে বেশি সচল থাকে।

ইন্টারনেটে ‘মোটা’ ভালুকদের ফাটাফাটি লড়াইয়ের শুরু

একটু মজাদার খাবারদাবার খেয়ে পেটটা ফোলালেই যে কত ঝামেলা! কেউ খোঁচা দেয়, কেউ সমালোচনা করে। অথচ কয়েকটা ভালুক খেয়ে খেয়ে সুস্বাদু স্যামন মাছের সরবরাহ নিজেরাই শেষ করে দিচ্ছে, এ নিয়ে মানুষের এত আগ্রহ কীভাবে এল?

আলাস্কার কাটমাই জাতীয় উদ্যানে মাইক ফিটজ
ফিটজ ন্যাচারালিস্ট

‘ফ্যাট বিয়ার উইক’ আয়োজন করার বুদ্ধি প্রথম আলাস্কার কাটমাই জাতীয় উদ্যানের একজন প্রাক্তন বনরক্ষী, মাইক ফিটজের মাথায় আসে। তিনি লক্ষ করেন, মানুষ ভালুকদের মোটা হওয়া, ওদের মোটা হওয়ার আগের-পরের ছবি আর ওদের পরিবর্তন দেখতে ভালোই আগ্রহী। তাই ২০১৪ সালে তিনি শুরু করেন ফ্যাট বিয়ার ডে। এই এক দিনের ছোট্ট অনলাইন প্রতিযোগিতায় এসেছিল ১ হাজার ৭০০ ভোট। এরপর এই প্রতিযোগিতা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে। এখন এই প্রতিযোগিতা বিশ্বব্যাপী এক জমজমাট ইভেন্ট! আয়োজকদের আশা, মোটা ভালুকদের নিয়ে মানুষের এই আগ্রহ আসলে ভালুক সংরক্ষণ এবং ওদের বাসস্থান রক্ষার জন্য সচেতনতা বাড়াবে। গত বছর ১০০টির বেশি দেশ থেকে ১২ লাখ ভোট পড়েছে এ প্রতিযোগিতায়।

আরও পড়ুন

সাইজ ডাজ ম্যাটার

ভালুকদের জন্য ওজন অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ। ওদের সফলতার একটি নির্দেশক এটি। তবে এই ওজনই সবকিছু নয়। যে ভালুক সবচেয়ে বেশি প্রতিকূলতা পেরিয়ে সবচেয়ে বেশি মোটা হতে পারবে, সেটিকে ফ্যাট বিয়ার উইকে সবচেয়ে সফল মনে করা হয়। ফ্যাট বিয়ার উইকের বিজয়ী আপেক্ষিক হলেও, মোটা এবং একই সঙ্গে ‘সফল’ ভালুকই এ প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়নের উপাধি পায়। কাটমাই জাতীয় উদ্যানে প্রায় ২ হাজার ২০০ ভালুক থাকে। এদের মধ্যে যারা ফ্যাট বিয়ার উইকে অংশ নেয়, ওদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা জীবনকাহিনি অনলাইন পেজে তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা যায় ওদের ছবি, জীবনকাহিনি, ওজন, রোগবালাই ও আচার-ব্যবহার। ভোটারদের উৎসাহিত করা হয় যেন তাঁরা শুধু ওজন দেখে নয়, ভালুকদের জীবন সম্পর্কে একটু জানার পরে ভোট দেন। তুমি ওদের পেজে গেলে ভালুকদের জীবনকাহিনি পড়ে সত্যিই মজা পাবে। বুঝতে পারবে, ভালুকদের সঙ্গেও মানুষের কত মিল আছে। যদিও মানুষের শরীর ভালুকদের মতো ৫০০ কেজির হয় না। কিন্তু খাবারদাবার নিয়ে লড়াই হোক বা নিজের জায়গা ধরে রাখার যুদ্ধ—এগুলো ঠিকই করে।

আরও পড়ুন

সেরা ৪ মোটা ভালুক

ভালুক নিয়ে এত কথা জানলাম, এবার তো ওদের দেখা লাগবেই, তাই না? কাটমাই জাতীয় উদ্যান বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় বাদামি ভালুকের আবাস। এ বছর সেখানে ২৩ সেপ্টেম্বর ফ্যাট বিয়ার উইক শুরু হয়েছে, যা ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে। ইতিমধ্যে অনলাইন ভোটের মাধ্যমে সেরা চার ভালুক বাছাই করা হয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর এই চার ভালুকের মধ্যে দুই রাউন্ডে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। একটি রাউন্ডে লড়াই করবে ৬০২ ও ৩২ চাঙ্ক নামের দুটি ভালুক। অন্য রাউন্ডে লড়াই করবে ১২৮ গ্রেইজার এ ৮৫৬। চলো জেনে আসি এই চার দানবাকৃতির ভালুক নিয়ে। এর ফলে তুমি তোমার চ্যাম্পিয়ন ভালুকটি বেছে নিতে পারবে।

ভালুক ৩২ চাঙ্ক

চোয়ালে ক্ষত থাকা চাঙ্কের মোটা হওয়ার আগে ও পরে
এক্সপ্লোর ডট অর্গ

চোয়াল ভাঙা এই পুরুষ ভালুক সেরা চার–এ জায়গা করেছে, এরপর আর কী বলব? চাঙ্ক ২০২৫ সালের জুনে প্রজনন মৌসুমের শেষে ব্রুকস নদীর তীরে ফিরে আসে চোয়ালে বিশাল এক ক্ষত নিয়ে। সেই স্থায়ী ক্ষত নিয়েও বিশাল দেহের কারণে ভালুকটি নিজের পছন্দের মাছ ধরার জায়গা দখল করতে সক্ষম হয়। মুখ ঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলেও দ্রুতই নিজের ক্ষত সামলে খেতে শিখে নিয়েছে। এভাবেই নিজের আকার ও আধিপত্য দুটোই ধরে রেখেছে।

আরও পড়ুন

ভালুক ৬০২

নাচতে জানা ভালুক, ৬০২-এর মোটা হওয়ার আগে ও পরে
এক্সপ্লোর ডট অর্গ

৬০২ একটি পুরুষ ভালুক, যে খুশি হলে অদ্ভুতভাবে পা দাপিয়ে নাচে। এই নাচের কারণে সহজেই ওকে চেনা যায়। এ বছর গ্রীষ্মকালজুড়ে ওকে অনেকবার দেখা গেছে। অন্য ভালুকদের চেয়ে বেশ আলাদা ৬০২। সে একদম গ্রীষ্মের শেষের দিকে জুলাইয়ের ৭ তারিখে ব্রুকস নদীর তীরে আসে এবং ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকে। কারণ, সে জানে মৌসুমের শেষ দিকে স্যামন মাছ বেশি পাওয়া যায়। নিজের বিশাল দেহ ব্যবহার করে মাঝেমধ্যে এটি পছন্দের জায়গায় মাছ ধরতে ধরতে ঘুমিয়েও নেয়।

১২৮ গ্রেইজার

রক্ষণশীল মা, ১২৮ গ্রেইজারের মোটা হওয়ার আগে ও পরে
এক্সপ্লোর ডট অর্গ

চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন যদি কোনো ভালুক হয়ে থাকে, তবে তা অবশ্যই গ্রেজার। হালকা বাদামি রঙের এই মেয়ে ভালুক গ্রেজার ২০২৩ সালের ফ্যাট বিয়ার উইকের চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০২৪ সালেও এটি চ্যাম্পিয়ন হয়। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কোনো মা ভালুক ফ্যাট বিয়ার উইকে জেতে। ওর ছানা ২০২৫ সালের ফ্যাট বিয়ার উইক জুনিয়রের চ্যাম্পিয়ন। এবার গ্রেজার তৃতীয়বার সন্তান প্রসব করেছে। সে নিজের ছানাদের নিয়ে এতই রক্ষণশীল যে অন্য ভালুকরা ওকে ভীষণ ভয় পায়। একই সঙ্গে ও মাছ ধরায় দারুণ পারদর্শী। সব মিলিয়ে গ্রেজারের তুলনা কেবল সে নিজেই।

আরও পড়ুন

ভালুক ৮৫৬

হাল না ছাড়া ভালুক ৮৫৬-এর মোটা হওয়ার আগে ও পরে
এক্সপ্লোর ডট অর্গ

বয়স হলেও নিজের জায়গা ধরে রাখা যায়, তা বোঝা যায় পুরুষ ভালুক ৮৫৬–কে দেখে। উচ্চতায় ৫ ফুটের বেশি লম্বা এই ভালুক ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ব্রুকস নদীর তীরে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভালুক ছিল। ২০ বছরের বেশি বয়স হওয়া সত্ত্বেও সে নিজের বিশাল আকার ধরে রেখেছে। যদিও ওর এখন নতুন ও আরও বড় ভালুকদের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে, কিন্তু বুদ্ধি ও সামাজিক দক্ষতা ৮৫৬-কে এখনো নিজের জায়গা ধরে রাখতে সাহায্য করছে।

যদি তোমার একটি ই–মেইল অ্যাড্রেস থাকে, এই লিংকে গিয়ে তুমিও ভোট দিতে পারবে তোমার পছন্দের ভালুককে ফ্যাট বিয়ার উইকের বিজয়ী করার জন্য। একই সঙ্গে তুমি তোমার বন্ধুদেরও জানাতে পারো মোটা ভালুকদের এই প্রতিযোগিতা সম্পর্কে।

আরও পড়ুন