গাজার পথে যাত্রা করা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা এখন কোথায়

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলাআল-জাজিরা

ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ভাঙার চেষ্টা হয়েছে বেশ কয়েকবার। এর মধ্যে এখন চলছে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার যাত্রা। ফিলিস্তিনের গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে জরুরি মানবিক ত্রাণ পৌঁছে দিতে শুরু হয়েছে এই যাত্রা। যাত্রার শুরুতে এখানে ছিল ৪০টির বেশি দেশের ৫০টির বেশি জাহাজ। 

স্পেন এবং তিউনিসিয়া থেকে দুটি বহর যাত্রা করেছে। মিশনে আছেন মানবাধিকারকর্মী, চিকিৎসক, শিল্পী, ধর্মীয় নেতা, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। এই বহরে আছেন সুইডিশ জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। তিনিই সম্ভবত বহরের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ। 

এর আগে ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙার আরেকটি মিশনে অংশ নেওয়ার জন্য তাকে ইসরায়েলি বাহিনী আটক করেছিল। গ্রেটা থুনবার্গ ছাড়াও ইতিহাসবিদ ক্লিওনিকি অ্যালেক্সোপওলু, মানবাধিকারকর্মী ইয়াসেমিন আকার এবং ফিলিস্তিনি অ্যাক্টিভিস্ট সাইফ আবুশকের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই বহরের পরিচালনা কমিটিতে ছিলেন। সম্প্রতি কমিটির দায়িত্ব বদল হয়েছে। গ্রেটা কমিটি থেকে সরে গিয়েছেন। জাহাজও বদল করেছেন। তবে ফ্লোটিলায় গাজার দিকে যাত্রায় আছেন এখনো।  

আরও পড়ুন

যাত্রা ৩,০০০ কিলোমিটারের (১,৬২০ নটিক্যাল মাইল)। এই যাত্রা শেষ করতে বেশ সময় লাগছে। এরই মধ্যে ড্রোন হামলার শিকার হয়েছে এই বহর। কিছু জাহাজ যাত্রা শেষ না করে ফিরে গেছে আন্তর্জাতিক জলসীমায় চলার অনুপুযুক্ত হওয়ার কারণে।  

ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙার প্রচেষ্টা এর আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে। ২০০৮ সালে দুটি নৌকা সফলভাবে গাজায় পৌঁছেছিল। এটি ছিল অবরোধ ভাঙার প্রথম সাফল্য। ২০১০ সালে ইসরায়েলি কমান্ডোরা মাভি মারমারা নামে একটি জাহাজে হামলা চালিয়ে ১০ জন অ্যাক্টিভিস্টকে হত্যা করেছিল। ২০১১, ২০১৫, ২০১৮ সালে ইসরায়েল বিভিন্ন ফ্লোটিলাকে বাধা দিয়েছে বা আক্রমণ করেছে। ২০২৫ সালে কনশেন্স ও ম্যাডলিন নামের দুটি জাহাজকে ইসরায়েলি বাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় আটক করেছে। সর্বশেষ হান্ডালা নামের আরেকটি ত্রাণবাহী জাহাজেও হামলা চালানো হয়েছে।

এখন গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার বহর আছে ভূমধ্যসাগরে। স্বেচ্ছাসেবকেরা জাহাজের ওপরের ডেকে একত্রিত হয়ে ড্রিল করছেন। জরুরি অবস্থার জন্য নিরাপত্তা প্রোটোকলগুলো পর্যালোচনা করছেন। কী ঘটলে কী করতে হবে, অনুশীলন করছেন। লাইফ ভেস্ট পরা, মানুষের সংখ্যা গণনা করা থেকে নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হওয়া পর্যন্ত, সবকিছুই অনুশীলন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন
স্বেচ্ছাসেবকেরা জাহাজের ওপরের ডেকে একত্রিত হয়ে ড্রিল করছেন
ছবি: আল-জাজিরা

এই ধরনের মহড়াগুলো সাধারণত হয় কোনো জাহাজে আগুন লাগলে, কেউ পানিতে পড়ে গেলে বা জাহাজে জাহাজে সংঘর্ষ হলে। তবে এই মহড়াটির ধরন ভিন্ন।

যদি ইসরায়েলি সেনারা জাহাজ থামায়, জাহাজে উঠে আসে, ভলান্টিয়ারদের আটক করে, তাহলে কীভাবে নিজেদের হাত ওপরে তুলে ধরতে হবে, সে বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মিশনের মূল লক্ষ্য অহিংসতা, তাই সবাই অহিংস থাকার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

ফ্লোটিলাটি ইতালির সিসিলি থেকে যাত্রা শুরুর পর ইয়েলো জোন বা ‘হলুদ অঞ্চলে’ প্রবেশ করেছে। ইতালির জলসীমা এবং সাইপ্রাসের আন্তর্জাতিক জলসীমার মধ্যবর্তী এই অঞ্চলে ইসরায়েলি আক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। তাই আক্রমণের শিকার হলে কীভাবে আচরণ করতে হবে, তার মহড়া দেওয়ার জন্য এই জায়গাটি উপযুক্ত।

ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই মানবিক ফ্লোটিলাকে বলেছে ‘জিহাদি ফ্লোটিলা’। হামাসের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে বলে দাবি করেছে তারা। এই মাসের শুরুতে যখন ফ্লোটিলাটি স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করে, মানবাধিকার কর্মীদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন ইসরায়েলের এক মন্ত্রী। তাঁদের আটকও করতে চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন
ম্যাপে লাল চিহ্নিত অংশ গাজা (কায়রোর পাশে)। নীল দাগগুলো সুমুদ ফ্লোটিলার চলার পথ
সুমুদ ফ্লোটিলার ওয়েবসাইট থেকে

সম্প্রতি ফ্লোটিলার পরিচালক কমিটির সদস্য সাইফ আবুকাশেক সাংবাদিকদের বলেছেন, এই ধরনের অভিযোগ ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ এবং এটি একটি ‘পুরোনো প্রোপাগান্ডা কৌশল’।

শুরুতে আশা করা হয়েছিল ফ্লোটিলার এই মিশন ৭ থেকে ১০ দিনে শেষ হবে। কিন্তু বেশ কিছু বাঁধায় সেটি হয়নি। আয়োজক ও স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর দেরি হওয়াসহ অন্যান্য প্রতিকূলতা অনেক চাপ সৃষ্টি করেছে।

তিউনিসিয়ার বন্দরে এই ফ্লোটিলায় ড্রোন হামলা হয়েছে। সমুদ্রযাত্রার জন্য অনুপযোগী কিছু নৌকার কারিগরি সমস্যা হয়েছে। পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকাও নানা ধরনের সাধারণ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। জাহাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে রাত জেগে আকাশের দিকে নজর রাখতে হচ্ছে, যেন আরও ড্রোন হামলা না হয়।

তাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ জলসীমায় প্রবেশ করছেন। ইসরায়েল অতীতে সব ফ্লোটিলাকে এই জলসীমায় আটকে দিয়েছে। তিউনিসিয়া থেকে সিসিলির উদ্দেশ্যে যাত্রার সময় ফ্লোটিলায় মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার জন্য নৌকার ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ আগ্রহী ছিল। কিছু নৌকা কারিগরি পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় বেশি মানুষ অংশ নিতে পারেনি। সঙ্গে উত্তাল ভূমধ্যসাগর তো আছেই।  

আরও পড়ুন

তিউনিসিয়ার বিজের্তে বন্দরে চোখে জল নিয়ে কিছু স্বেচ্ছাসেবক বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ কো-অর্ডিনেটরদের কাছে গিয়ে নিজেদের জায়গা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জায়গা পাননি। 

ইতালিতে কয়েক দিন থাকার পর নৌকাগুলো আবার যাত্রা শুরু করেছে। বহরটি হলুদ অঞ্চল পার হয়ে এখন লাল অঞ্চলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। লাল অঞ্চলটি গাজার সমুদ্রতীর থেকে ১০০ নটিক্যাল মাইল (১৮৫ কিলোমিটার) দূরে অবস্থিত। বিপদ এখানে অনেক গুণ বেড়ে যায়।

এই বিপদের আগাম প্রস্তুতির জন্য ফ্রিডম ফ্লোটিলায় বেসামরিক মহড়া চলছেই।

সূত্র: আল-জাজিরা ইংলিশ 

আরও পড়ুন