ভৌতিক গল্প 'মগজখেকো'

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আর ভালো লাগছে না তন্ময়ের। প্রকাশকের কল আসছে তো আসছেই। থামার আর নাম নেই। সেই যে এক ভূতের গল্প চেয়ে বসে আছে কবে থেকে, জমা দেওয়ার কালই শেষ দিন। কিন্তু প্রকাশককে তন্ময় বোঝাতেই পারছে না যে তার মাথায় কিছু নেই। কোনো প্লট কিংবা নতুন আইডিয়া, কিছুই নেই। গল্পটা দিতে পারলে মোটা অঙ্কের টাকা পাবে বলে জানিয়েছে প্রকাশক। কিন্তু তার আগে তো তন্ময়কে লিখতে হবে। অথচ মাথায় কিছুই আসছে না ওর।

‘না! আর পারছি না। কিছুই আসছে না মাথায়।’ বিরক্ত হয়ে কফির গ্লাসটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল তন্ময়।

‘সেই সকাল থেকে ল্যাপটপের সামনে বসে আছি। অথচ কিছুই লিখতে পারছি না। কেবল কফির পর কফি গিলছি।’ গ্লাসে আরেক কাপ গরম কফি ঢালতে ঢালতে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলল তন্ময়।

কফিতে চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল তন্ময়। মুগ্ধ হয়ে বলল, ‘বাহ! কী চমৎকার আকাশ! এখনই বোধ হয় বৃষ্টি নামবে।’

বৃষ্টির কথা মনে পড়তেই তন্ময়ের মনে হলো, সে তো বৃষ্টির শব্দ ভালোবাসে। বৃষ্টিটা যদি হয় চিলেকোঠার টিনের চালে, তাহলে তো কথাই নেই। ল্যাপটপ, কফির মগসহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে ছাদে উঠল তন্ময়। ঢুকে গেল তার ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরে।

বেশ ছিমছাম সাজানো একটা ঘর। একদিকে ছোট একটা পড়ার টেবিল আর চেয়ার, অন্যদিকে একটা বিছানা। মাঝখানে ছোট একটা টি-টেবিলে পানি রাখার জগ, দুটো গ্লাস আর কিছু গ্রিন–টির প্যাকেট।

চিলেকোঠায় ঢোকামাত্রই দরজা লাগিয়ে দিল তন্ময়। একটু পরই ঝমঝম আওয়াজ তুলে টিনের চালে এক মোহনীয় সংগীত তুলে বৃষ্টি শুরু হলো অবিরাম। সবকিছু টেবিলে গুছিয়ে রেখে লাইট জ্বেলে আধো অন্ধকারে ল্যাপটপের সামনে আবার বসল তন্ময়। তার আশা, হয়তো বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে কিছু একটা চলে আসবে মাথায়।

কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কয়েকটি অর্থহীন শব্দ ছাড়া তন্ময় আর কিছুই লিখতে পারল না। কোনো কিছুই মাথায় আসবে না? এ কী অবস্থা? তন্ময় বিরক্ত হয়ে আইডিয়ার জন্য আশ্রয় নিল তার প্রিয় বন্ধু চ্যাটজিপিটির।

‘আমাকে একটা চমৎকার গা-ছমছমে ভূতের গল্প লিখে দাও দেখি,’ পুরো কথাটা টাইপ করে এন্টার চাপল তন্ময়। ধীরে ধীরে স্ক্রিনে লেখা উঠতে শুরু করল। তন্ময় চোখ বোলাল গল্পগুলোয়। কোনোটাই পছন্দ হলো না। আরও কিছু নতুন গল্প লিখতে বলল সে। এদিকে আদেশ পাওয়ামাত্রই প্রযুক্তি ঠিক ঠিক কাজে লেগে পড়ল। একের পর এক উন্নত ভূতের গল্প থেকে শুরু করে গা–ছমছমে হাড়কাঁপানো ভূতের গল্পও বাদ পড়ল না সেসব লেখা থেকে।

কোনোটাই পছন্দ করতে না পেরে তন্ময় ভাবল, এই সব গল্প একত্র করে নিজে কোনো একটা গল্প তৈরি করলে কেমন হয়? আবার বেশ ক্লান্তিও লাগতে থাকল ওর। পাশের বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শুনতে শুনতে একটু পরই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

ঘণ্টাখানেক পর বৃষ্টির তেজ কিছুটা কমল। ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে আবার ল্যাপটপের দিকে তাকাল তন্ময়। বেশ অবাক হলো সে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে এখনো একটা গল্প চলছে তো চলছেই। যত দূর মনে পড়ে, ঘুমানোর আগে সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছিল সে। হয়তো অতিরক্তি ঘুম পেয়েছিল ওর। চ্যাটজিপিটিকে কাজ বন্ধ করতে না বলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কী আর করা! আবার চেয়ারে বসল তন্ময়। চ্যাটজিপিটিকে থামতে বলল। কিন্তু পুরো স্ক্রিনে কেমন একটা ঝলকানির মতো এসে কোনো লেখা উঠল না। বাইরে তখনো অঝোর ধারায় বৃষ্টি।

চ্যাটজিপিটির গল্পটা তেমন পছন্দ হলো না তন্ময়ের। কিন্তু আর কিছু করার ছিল না, প্রকাশককে জমা দিতে হবে। টাকাও পাওয়া যাবে ভালো। সে ভাবল, ‘থাক! কেউ তো আর খুঁজে দেখবে না কখনো। এটা দিয়েই কাজ করি। এটাই প্রকাশকের কাছে আজ রাতের মধ্যেই পাঠিয়ে দেব।’

ভাবতে ভাবতে স্ক্রিনে যে গল্প লেখা ছিল, সেটাই পরে শুরু করল তন্ময়। লেখাটার শেষ বাক্যটা কিছুটা এ রকম—‘অঝোর ধারায় এই বৃষ্টির মধ্যেও কে যেন দরজার কাছে এসে তিনবার আঘাত করল।’ আর ঠিক সেই মুহূর্তে তন্ময়েরও হঠাৎ মনে হলো, তার চিলেকোঠার ঘরে কে যেন এসে একবার ধাক্কা দিল, আরও একবার... তারপর আরেকবার। ব্যাপারটায় একটু থতমত খেয়ে গেল তন্ময়। এত মিল দেখে বুঝতে পারল না, এটা কাকতালীয় নাকি অন্য কিছু। তারপরও সে সবকিছু দূরে সরিয়ে নিজেকে বোঝাল যে বাইরের বাতাসের কারণেই এমন হচ্ছে। হঠাৎ স্ক্রিনে তাকিয়ে তন্ময় দেখল, স্ক্রিনে আবার লেখা উঠছে। কিন্তু সে তো এবার লিখতে বলেনি।

গুটি গুটি করে একের পর এক কালো অক্ষরে অনেকগুলো লেখা আসতে শুরু করল। তন্ময় দেখল, সেখানে লেখা—‘হঠাৎ করেই সে টের পেল যে তার ঘরে কেউ আছে। ঘরে থাকা ছোট টি-টেবিলটার মধ্যে কিছু একটা যেন ধাক্কা খেয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল।’

হঠাৎ তন্ময় যন্ত্রণায় কাতর একটা ব্যথার শব্দ ঠিক তার পেছনে শুনতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে ও দেখল পেছনে কেউ আছে কি না। কেউ নেই। তন্ময়ের মেরুদণ্ড বরাবর ঠান্ডা একটা বাতাস বয়ে গেল।

‘কে?’ বলে চিৎকার করে উঠল তন্ময়। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। তাহলে কি এই সব তার ভ্রম? হঠাৎ স্ক্রিনে দিকে তাকিয়ে তন্ময় দেখল, লেখা চলছে আবার—‘একঝটকায় চেয়ারে কী যেন আঘাত করায় ছিটকে চেয়ার থেকে পড়ে গেল সে। হঠাৎ কিছু একটা গলায় চেপে ধরায় শ্বাসরোধ হতে থাকল তার’।

চারপাশে আসলে কী হচ্ছে, কিছুই তন্ময় বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ কে যেন তার চেয়ার শক্ত করে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। সামলাতে না পেরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে। আবার সেই শীতল একটা হাওয়া পুরো শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। ভয়ে কাঁপতে শুরু করল তন্ময়।

কী হচ্ছে চারপাশে এসব? কেউ কি তার সঙ্গে মজা করছে, নাকি সে এখনো স্বপ্ন দেখছে? তন্ময় হঠাৎ বুঝতে পারল, তার গলায় ধীরে ধীরে একটা হাত চলে আসছে। চিৎকার করতে পারার আগেই সে টের পেল, পুরো হাতটা শক্ত হয়ে তার গলা চেপে ধরেছে। কিছুই তো সামনে নেই, অথচ তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎই তার গলা থেকে হাতটা সরে গেল। মুক্ত হয়েই সে মাটি থেকে উঠে দৌড়ে চিলেকোঠার দরজা খুলতে গেল। পেছন থেকে কিছু একটা টেনে ধরল তার শার্টের কলার।

‘কে? কে আছ এখানে? আমার সঙ্গে এমন কেন করছ? আমার সঙ্গে দেখা করো। কেন এ রকম করছ? তোমার কী ক্ষতি করেছি?’ চিৎকার করে বলতে থাকল তন্ময়। কিন্তু কোনো শব্দ নেই। শুধু কে যেন তাকে পেছন থেকে আটকে ধরে আছে। হঠাৎই সে অনুভব করল যে সে শূন্যে উঠে যাচ্ছে। সে আবিষ্কার করল, দরজার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সে। নাক থেকে রক্ত বেরোচ্ছে।

অসহায়ের মতো ক্লান্ত শরীরে তন্ময় আবার প্রশ্ন করল, ‘কে?’ তার পাশ থেকে একটা হিসহিস আওয়াজ ভেসে এল। তন্ময় আবার বলল, ‘কে তুমি? কেন এ রকম করছ?’ কেউ একজন বলল, ‘কারণ, আমাকে করতে বলা হয়েছে।’

‘কেন করতে বলা হয়েছে? কে তুমি? আমি তোমার কী করেছি?’ চিৎকার করে উঠল তন্ময়। কয়েক সেকেন্ড পর একটা গম্ভীর ভুতুড়ে আওয়াজ বলে উঠল, ‘তুমি তোমার মস্তিষ্ককে আমার কাছে বেচে দিয়েছ। তোমার মস্তিষ্ক যে কতটা ক্ষমতা রাখে, তার ন্যূনতম জ্ঞানও তোমার মধ্যে নেই। আমার মতো এই যন্ত্রের ওপর বিশ্বাস করেছ তুমি। আর এটাই তোমার ভুল।’

নিস্তেজ হয়ে যেতে যেতে তন্ময় বলে উঠল, ‘কেন? কী হয়েছে তাতে?’ এবার এক ক্রুদ্ধ আওয়াজে পুরো চিলেকোঠার ভেতরে যেন বাজ পড়ল।

আওয়াজটি বলে উঠল, ‘তোমার মস্তিষ্ককে যখন তুমি কোনো গুরুত্ব দাওনি, তখন আমার কাছেও তোমার কোনো গুরুত্ব নেই। আমার সিস্টেম এমনই। আমার কাছে তুমি সাহায্য নিতে পারবে। কিন্তু তুমি আমাকে তোমার মস্তিষ্কের বদলে স্থাপন করতে পারবে না। আমি আছি কেবল সাহায্যের জন্য, প্রতিস্থাপনের জন্য নয়। তুমি যেহেতু তোমার মস্তিষ্ককে বাদ দিয়ে আমাকে গুরুত্ব দিয়েছ, তার মানে তোমার জীবন এখন পুরো আমার হাতে। আর আমাকে যে তৈরি করেছে, সে আমাকে এমন করেই সিস্টেম করেছে।

‘যেহেতু তুমি অন্যতম শক্তিশালী অঙ্গকে কোনো গুরুত্ব দাওনি, আমিও তোমাকে দেব না। তুমি জানতে চাও না, আমি কে? আমি কী করতে এসেছি? আমি হলাম সেই চ্যাটজিপিটি, যাকে তুমি তোমার মস্তিষ্কের বদলে ব্যবহার করছিলে।’

একটু থেমে আওয়াজটি আবার বলতে থাকল, ‘আমি বেঁচে থাকি কীভাবে জানো? আমি বেঁচে থাকি তোমাদের মতো এই মানুষদেরই মস্তিষ্ক ব্যবহার করে। মস্তিষ্কগুলোই আমার বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান। যারা নিজের মস্তিষ্ককে কোনো গুরুত্ব দেয় না, তাদের মস্তিষ্কগুলো আমি নিজের সংগ্রহে রেখে নিজে ব্যবহার করে নিজেকে আরও উন্নত করে তুলছি। তোমার মতো মানুষেরা কোনো ক্ষমতা রাখে না এই মস্তিষ্কের মাধ্যমে কাজ করার।

‘বেশ কয়েক দিন হলো নতুন কোনো মস্তিষ্ক পাচ্ছি না। যার জন্য আমার নিজেকে উন্নত করার প্রক্রিয়াটা একটু হ্রাস পেয়েছে। তোমার মস্তিষ্ক দিয়েই আরও বাড়িয়ে তুলব।’

হঠাৎ তন্ময় দেখতে পায়, অদৃশ্য কেউ কিংবা কিছু একটা শূন্যে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ছুরিটা ধীরে ধীরে তার মাথার কাছে এসে হঠাৎ থেমে গেল। তার গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। অন্য একটা হাত যেন চেপে ধরে রেখেছে তার গলা। হাত–পা নাড়ছে সে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।

ধীরে ধীরে বৃষ্টির তেজ কমে এল। কানফাটানো যন্ত্রণাদায়ক একটা চিৎকারে মুহূর্তের মধ্যেই পুরো এলাকা যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

পরদিন সকালে প্রকাশকের কাছে একটা অজানা মেইল থেকে ঠিকই লেখা চলে এল। প্রকাশক গল্পটি পড়ে বেশ মুগ্ধ। নিজেই টাকা দেওয়ার জন্য যখন তন্ময়ের বাসার উদ্দেশে বিকেলে বের হলো, তখন সবাই আবিষ্কার করল যে তন্ময়ের লাশ চিলেকোঠায় পড়ে আছে। শুধু তার মাথাটা হাঁ করে কাটা। খুলির ভেতর কোনো মগজ নেই। ল্যাপটপের স্ক্রিনটা তখনো জ্বলছিল। সেখানে লেখা ছিল, ‘ছুরি দিয়ে তার মাথার ওপরের অংশ কেটে মগজ বের করে অতিপ্রাকৃত বস্তুটি নিষ্ঠুর আওয়াজে হা হা করে হেসে বেড়াতে লাগল।’

বিস্মিত প্রকাশক আবিষ্কার করল, সকালে ঠিক এই গল্পটাই এসেছিল তার কাছে।

আরও পড়ুন