ভৌতিক গল্প 'মহামায়া'

যেদিন বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, ঠিক সেদিনই বিচ্ছিরিভাবে আবিরের ডান হাতখানা ভেঙে গেল। ভাগ্য ভালো, পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পরেই ঘটল ঘটনাটা। নইলে ফিজিকসে ফেল করা লাগত। শেষ পরীক্ষা ওটাই ছিল।

ঘটনা হয়েছে কী, মিন্টু, ইকরাম, পাভেল, জিসানরা আগেই বের হয়েছে। মিন্টু আর ইকরাম জাঁদরেল ছাত্র। ফিজিকসে একসময় ওরা মারাত্মক কিছু একটা করে ফেলবে, এটা সবাই জানে। আর পাভেল জিসানরা অত কিছু ভেবে পরীক্ষা দেয় না। ওদের মা-বাবা নাকি এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না।

‘মানুষের টাকা মেরে না খেলেই আমি খুশি, বুঝলি!’ পাভেলের বাবা নাকি এ কথা বলেছেন ওকে।

ব্যস, পাভেল এবার স্বাধীন। কোনোমতে পাস মার্কস তুলতে পারলেই হলো। আবিরের অবশ্য বাসা থেকে ও রকম চাপ নেই পড়াশোনা নিয়ে। সত্যি বলতে, বাবা কিংবা মা কেউ কোনো দিন বলেননি যে খুব ভালো রেজাল্ট করা চাই।

আসলে ফিজিকস আবিরের প্রিয় বিষয়। কাজেই লিখে শেষ করা যায় না— এ রকম বিষয়বস্তু আবিরের ঝুলিতে প্রচুর। সুতরাং সবার শেষে বের হলো সেদিন আবির হল থেকে। আর সেটাই কাল হলো। ততক্ষণে পাভেলরা তিন নম্বর সাইজের একটা ফুটবল নিয়ে স্কুল মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ওই হলো আবিরের আরেক নেশা। খুব একটা ভালো না খেললেও ভীষণ পোকা ও ফুটবলের।

‘এই, আবির এসে গেছে। আমার দলে খেলবি তুই আবির…দ্রুত আয়।’ দূরে থেকে চেঁচায় পাভেল।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বেশ জাঁকালো শীত এবার। সারা দিনে সূর্য একবারের জন্য হয়তো উঁকি দিয়ে যায়। স্থায়িত্ব মোটে ঘণ্টা দুয়েক। তারপর আবার কুয়াশা। ঘোলাটে চারদিক। কাজেই ভোরের শিশির স্কুল মাঠের ঘাস ভিজিয়ে রাখে বিকেল পর্যন্ত। সেই বাসি শিশিরেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে গিয়ে বেকায়দায় পিছলে ডান হাতের ওপর পড়ল আবির। সামনের পুরো দেড় মাস ছুটি। পুরো সময় স্লিংয়ে হাত ঝুলিয়ে রাখতে হবে ভেবে নিজের ওপরই মন খারাপ হলো ওর।

আজ দুই দিন হলো আবিররা মহামায়া লেকের একটা রিসোর্টে এসে উঠেছে। খুব সুন্দর নাম রিসোর্টের—আইভরি। সামার ভ্যাকেশনেই আসার কথা ছিল। আবিরের ছোট ভাই আরিফ টাইফয়েডে পড়ল ঠিক ভ্যাকেশনের প্রথম দিনই। কাজেই এই ট্যুর প্ল্যান বহুদিন ধরেই ঘোঁট পাকাচ্ছিল।

প্রথম দুই দিনে রিসোর্টের গাছপালা আর টলটলে একখান পুকুর ছাড়া আর কিছু দেখেনি ওরা। বিচ্ছু আরিফটা নাকি দু–একবার লেকের ওখান থেকে একা একা ঘুরে এসেছে। কিন্তু আবির বের হতে পারছে না। মায়ের ধারণা, পিচ্ছিল কোথাও পড়েটড়ে আবার ব্যথা পাবে আবির। তার ওপর বেজায় ঠান্ডা। টনসিল ফোলার ব্যারামও আছে আবিরের।

আইভরির মালিক মায়ের কলেজজীবনের বান্ধবী লিজা আন্টি আর তাঁর স্বামী কর্নেল শামস আঙ্কেল। বলতে গেলে একরকম দাওয়াত করেই ওদের এনেছেন তাঁরা। সাধারণত এটা পিক সিজন। তবু পুরোনো বান্ধবী আসবে বলে লিজা আন্টি বাইরের গেস্টের জন্য রিসোর্ট বন্ধ রেখেছেন দিন দশেক।

‘শার্লি, ছেলে দুটোকে নিয়ে লেকের পাড় থেকে ঘুরে আয়, যা।’ তৃতীয় দিনের দিন সকালবেলা লিজা আন্টি ব্রেডে জ্যাম মাখাতে মাখাতে হাঁক ছাড়লেন।

‘পারব না মা। আমার মাথা ধরেছে।’ দুদ্দাড় করে পা ফেলে দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেল আবিরের চেয়ে বছর দুয়েকের বড় শার্লি। বেজায় গম্ভীর।

লিজা আন্টি এবার গলা চড়ালেন, ‘তোর মাথাব্যথার নিকুচি করি অসভ্য মেয়ে। নেমে আয় বলছি এক্ষুনি।’ আন্টি নিজেই উঠে পা বাড়ালেন দোতলার দিকে।

মা–মেয়েতে ওপরতলায় বেশ কিছুক্ষণ গজগজ হলো। অন্য লোকের ঝগড়া কান পেতে শুনতে নিষেধ করেছেন মা। কাজেই না শোনার ভান করল আবির। ওর ছোট ভাই মহা ধুরন্ধর আরিফের আবার এসব বিষয়ে বিরাট আগ্রহ। মন দিয়ে শোনে।

নাশতার টেবিলে আবিরের বাবা ব্যাংকার কামাল সাহেব পত্রিকা সরিয়ে গোঁফের ফাঁক দিয়ে বললেন,

‘আবির, আরিফকে নিয়ে তুই নিজেই যা না। ঘুরেটুরে আয়। বেচারি মেয়েটা যেতে চাইছে না।’

‘নাইস আইডিয়া, শার্লি দারুণ অলস। তোমরা কেন খামাখা সময় নষ্ট করবে। যাও যাও। এক্সপ্লোর বয়েজ, গো।’ আঙ্কেল শামসের বাজখাই কণ্ঠ কাঁপিয়ে দিল ছোট্ট কটেজটা।

মহামায়া লেক যারা দেখেনি, তাদের জন্য এর বর্ণনা দেওয়া বৃথা।

ঘড়িতে সকাল ১০টা হলেও ঘন কুয়াশার জন্য মনে হয় ভোর হতে এখনো দেরি। হঠাৎ হঠাৎ কুয়াশা সরে গিয়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। সোনালি আলোতে উদ্ভাসিত হচ্ছে কুয়াশার চাদরে গা ঢাকা দিয়ে থাকা সবুজ বনভূমি। যদিও এর পুরোটাই কৃত্রিম, মানে মানবসৃষ্ট আরকি। লেকটাও।

লেকের কোল ঘেঁষে ছবির মতো সুন্দর ছোট ছোট কিছু বাড়ি নিয়ে গোটা এলাকাটা মনে হয় বুঝি এইমাত্র ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে নেমে এল। আইভরি রিসোর্টের ডান দিকে পঞ্চাশ কদম হাঁটলেই একটা লম্বা জেটি চলে গেছে লেকের ওপর অনেক দূর পর্যন্ত। কিছু চেয়ার পাতা ওখানে। দুই ভাই পাশাপাশি বসে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে উপভোগ করল এই সৌন্দর্য। মন ভালো হয়ে গেছে আবিরের।

‘ভাইয়া চল, ওই ওদিক দিয়ে পানিতে নামি। শুধু পায়ের পাতা ভেজাব, প্রমিস।’ এই দুইদিনে গলা ভেঙে গেছে বিচ্ছু আরিফের।

‘মাথা খারাপ তোর। মা জানলে…’

‘আহ, মাকে বলতে যাবে কে, আশ্চর্য! আয় না।’

‘উঁহু, নো। তুই গেলে যা বাবা। আমি নাই।’ বুকে হাত গুঁজে বসে রইল আরিফ। আবিরের কোনো কথায় আজ পর্যন্ত সায় দিয়ে লাভ হয়নি। শেষমেশ কালপ্রিট হতে হয়েছে। আরিফ নিজেই জেটি থেকে নেমে পানি থেকে ছোট ছোট পাথর কুড়াতে লাগল।

‘এই, কিসে পড়ো তুমি?’

চমকে পেছনে ফিরে তাকাল আবির। শার্লি। লাল একটা চাদরে আগাগোড়া নিজেকে ঢেকে এসেছে। কিন্তু বোকা মেয়েটা কান ঢাকেনি। লেকের উন্মাদ বাতাসে ওর চুল উড়ে বেড়াচ্ছে। ঢেকে দিচ্ছে চোখ–মুখ।

‘কী হলো, বোবা নাকি?’ তাড়া দিল মেয়েটা।

‘এইট। এবার নাইনে উঠব।’

‘হুম, পানির অত কাছে বোসো না। সরে আসো এদিকে।’ মুরব্বির মতো বলে মেয়েটা।

আদেশ পালন করল আবির, ‘তোমার মাথাব্যথার কী হলো?’

জবাব দিল না মেয়েটা। আরিফের চেয়ারটায় বসতে বসতে দূরে কী যেন দেখল খানিকক্ষণ। এরপর দেখল আবিরের ভাঙা হাতখানা।

‘কী হয়েছিল?’ মাথা নেড়ে ইশারায় হাতটা দেখায় মেয়েটা।

ঘটনাটা বলল আবির।

‘তোমার ভাইটাকে দেখছি না।’ এদিক–ওদিক তাকাল শার্লি।

‘পাথর কুড়াচ্ছে। ওই যে।’

‘খবরদার...না।’ চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা।

‘মানে…’

‘মানে…ভুলেও পানির কাছে যেতে দিয়ো না। কিছুদিন আগেই একটা ছেলে ডুবে মরল এই লেকে,’ যন্ত্রণায় যেন বেঁকে গেছে মেয়েটার মুখটা, ‘ওরই বয়সী। ওহ, ফুলে ঢোল হওয়া নীল লাশটা দেখেছিলাম আমরা সবাই।’

তক্ষুনি ছুটতে ছুটতে হাজির হলো আরিফ, ‘ভাইয়া দেখ, কী পেয়েছি।’ নীলচে একটা পাথর ওর হাতে। কোকিলের ডিমের সাইজ। নিখুঁত গোল, নিরেট। আর বেশ উজ্জ্বল রং।

‘এই, তুমি পানিতে নেমেছিলে কেন? এত সাহস তোমার?’ খেঁকিয়ে ওঠে শার্লি। লাল চাদর গায়ে আর এলোমেলো লম্বা চুলে ওকে ঠিক একটা পাগলির মতো লাগছে—যার কথা কেউ বিশ্বাস করে না।

সেদিন দুপুরে।

গলদা চিংড়ির ঝোল দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে প্রশ্ন করে আবির, ‘আঙ্কেল, এই লেকে নাকি একটা ছেলে ডুবে মারা গেছে কিছুদিন আগে। সত্যি?’

ঠান্ডায় জমে যাওয়া খাসির রেজালা দ্বিতীয়বার গরম করে এনে সামনে রাখা হয়েছে। বাটির দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলেন শামস আঙ্কেল, ‘কে বলল? শার্লি নিশ্চয়ই?’

মাথা ঝাঁকাল আবির।

‘মা বলেছে, ভাইয়া গাধা টাইপের, যা শোনে তাই বিশ্বাস করে।’ আরিফের কণ্ঠে নির্ভেজাল আনন্দের ছোঁয়া।

ছোট ভাই বদের হাড্ডিটাকে চোখের অদৃশ্য আগুনে কিছুক্ষণ ঝলসে দিতে চাইল আবির। ক্লাস ফোরে পড়া কোনো বাচ্চা এ রকম ত্যাঁদড় হতে পারে, কল্পনাও করা যায় না।

‘শার্লির বাস অন্য আরেক জগতে, বুঝলে। ওর কথা আর তিমি মাছের কথা সমান।’ খাসির হাড় মুখে পুরে দিয়েছেন শামস আঙ্কেল। চোখ বুজে এসেছে আবেশে।

‘ভাইয়া তিমি মাছের কথা বোঝে।’ ফিক করে হেসে ফেলল আরিফ।

‘চুপ।’ হিসিয়ে ওঠে আবির। আশপাশে কেউ না থাকলে আরিফের কানটা ইচ্ছেমতো মলে দিত ও।

বিকেল ৪টা।

লেকের জলে ছোট ছোট রঙিন নৌকা বাইছে একদল ছেলেমেয়ে। একটু মিষ্টি রোদ উঠেছে। বাতাসে ভেসে আসছে কী একটা ফুলের ঘ্রাণ। মাথা ঝিমঝিম করে বেশিক্ষণ এই ঘ্রাণ নিলে।

এই নৌকা চালানোকে বলে কায়াকিং। শার্লি বেশ পটু। দক্ষ হাতে নৌকা বাইছে। একটু সিটিয়ে আছে আবির, মেয়েটা এমনিতেই একটু পাগলাটে। বাকি দুই নৌকায় জায়গা না পেয়ে আবির শার্লির সঙ্গেই উঠেছে বাধ্য হয়ে।

পাশাপাশি আরও দুটি নৌকার একটায় বসেছে লিলি আর রবিন। এখানেই ওদের বাড়ি। রিটায়ার্ড মেজর ইকরামের দুই সন্তান। আরেক নৌকায় রয়েছে ওদের চেয়ে বয়সে একটু বড় দুটি ছেলে। নাম জানা হয়নি। শার্লির সমবয়সী হবে। খুব ভালো বন্ধু বলেই মনে হলো।

‘এইটাকে আবার কোত্থেকে আমদানি করলি শার্লি?’ লম্বামতো ছেলেটা পাশের নৌকা থেকে প্রশ্ন করে। ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন আর ঠোঁটে চালিয়াতের মতো হাসি।

‘লেকের জলে এটাকে স্যাক্রিফাইস করব।’ গম্ভীর মুখ বলে শার্লি।

মুখে বসন্তের দাগ আর লালচে চুল যে ছেলেটা, আবিরের মুখের দিকে সে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। কী যেন ভাবছে। এরপর ওকে চমকে দিয়ে আচমকা হেসে উঠল হো হো করে।

‘বেচারা মন খারাপ করছে। বাদ দাও না।’ লিলি বলে সবার উদ্দেশে। বেচারির মনটা বোধ হয় নরম।

চোখে পানি এসে যাচ্ছিল আবিরের। কিন্তু দ্রুত সামলে নিল ও। মেয়েদের সামনে কাঁদতে চায় না মোটেও।

‘এই যে এটা হলো আমাদের দ্বীপ।’ গর্বভরা কণ্ঠে ঘোষণা করে মুখে বসন্তের দাগওয়ালা ছেলেটা। ওর নাম মুবিন। ক্লাস টেনে পড়ে। ফাইনাল ইয়ার। একটু আগেই জেনেছে আবির।

উহ! ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়।’ আবির লক্ষ করে শার্লির কণ্ঠে কী যেন আছে। মুবিনের ঘটনা বলতে গিয়ে কেমন যেন শোনাল ওর গলাটা। কারণ কী? উত্তর পেল না আবির। কেবল অনুভব করল কিসের যেন একটা তীব্র আঁচে ওর কান দুটি গরম হয়ে আসছে।

দ্বীপটা আসলে লেকের বুকেই এক টুকরা জংলা জায়গা। লেকের ঠিক মাঝ বরাবর না হলেও তার কাছাকাছিই হবে। নিস্তব্ধ জায়গাটায় পা রেখে ঘুরেফিরে দেখে আবির। রাজ্যের গাছপালায় প্রায় অন্ধকার আর কেমন একটা বুনো ঘ্রাণ বাতাসে। ওরা নাকি এখানে প্রায়ই আসে।

‘এই দ্বীপের মালিকানা কীভাবে পেতে হয় শুনতে চাও?’ দুই পা ফাঁক করে আবিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে মুবিন। ওদের ঘিরে আছে বাকিরা।

‘আহ দরকার কী। ও এসেছেই কদিনের জন্য। মালিকানা দিয়ে ও করবে কী?’ বিরক্তি ঝরে পড়ে শার্লির কণ্ঠে। আজও লাল চাদরে মুড়ে রেখেছে নিজেকে। তবে আজ কী মনে করে চুল আঁচড়েছে।

‘শাটআপ,’ এক হাত তুলে বলে ওঠে রাজীব। মুবিনের সঙ্গে এই ছেলেটাই ছিল আরেক নৌকায়, ‘পরশু দিন শুক্রবার। সেদিন ভোরবেলা ফজরের আজান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেকের জেটি থেকে এখানে সাঁতরে আসতে হবে। তবেই আমরা ধরে নেব তুমি,’ ওর তর্জনী এসে থেমেছে আবিরের বুকে, ‘এই দ্বীপের মালিকানায় আমাদের সমকক্ষ। নইলে যে কদিন এখানে আছ, আমাদের থেকে দূরেই থাকতে হবে তোমাকে।’

আবিরের দিকে চেয়ে ভুরু নাচায় এবার মুবিন, ‘কি, রাজি?’

নিজের স্লিংয়ে ঝোলানো হাতখানা দেখায় আবির ইশারায়, ‘আমার তো…’

‘ওহ আল্লাহ, বোঝা গেছে, এখন শুরু হবে নাকি কান্না,’ বিচিত্র ভঙ্গি করে মুখ বাঁকায় মুবিন। ন্যাকা ন্যাকা কণ্ঠে বলতে শুরু করে, ‘মা, আমার ন্যাপিটা বদলে দিতে হবে। প্যান্ট ফ্যান্ট সব মেকে ফেনেচি…’

রবিন, লিলি, রাজীব একযোগে হো হো করে হেসে ওঠে সবাই।

লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে মন চাইল আবিরের। দেখল, শার্লির লাল চাদরে মোড়া দেহটাও একটু একটু কাঁপছে হাসির দমকে।

‘মানুষ মরে গেলে ভূত হয়।’

‘আমিও শুনেছি।’

‘যেসব মানুষ কষ্ট পেয়ে মরে বা মনে করো মরার জন্য প্রস্তুত না, হুট করে মরে গেল। এরাই নাকি ভূত হয়।’

‘শুনে তো সত্যই মনে হচ্ছে। আচ্ছা কে বলল তোমাকে এ রকম কথা? কোনো বইয়ে পড়েছ নাকি?’

‘নাহ, এ রকম হুট করে যারা মরে, এরা আমাদের আশপাশেই থাকে। ঘুরে বেড়ায়। কথা বলতে চায়। আমরা দেখতে পাই না বটে। তবে এরা আছে।’

‘বলো কী!’ একটু একটু ঘাবড়ে যায় আবির। শার্লি মেয়েটা আসলে অতটা অহংকারী না, এটা সত্য। তবে একটু চাপা স্বভাবের। দুদিনে বন্ধুত্বটা শক্ত হয়েছে দুজনের।

ভূতবিষয়ক এই কথা হচ্ছিল আইভরির পেছনে পুকুরঘাটে বসে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে একটু আগেই, কিন্তু আকাশ এখনো লাল। গোলাপি লাল।

‘হঠাৎ হঠাৎ দেখবে, মনে হয় কে যেন দেখছে তোমাকে। কিন্তু আশপাশে কেউ নেই। বুঝবে তখন ও রকমই কেউ…’

‘আচ্ছা থাক। বুঝেছি আমি।’ ভয় পেয়েছে সেটা গোপন করতে চাইছে আবির প্রাণপণে। কিন্তু পারছে না।

‘কাল শুক্রবার। সাহস দেখাতে গিয়ে আবার সকাল সকাল লেকে নেমে পোড়ো না। সাহসের যা ছিরি দেখতে পাচ্ছি! শেষে আমার মান ইজ্জত যাবে।’ একটা ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে ডগায় কামড় দেয় মেয়েটা।

‘আমাকে খুব ভিতু মনে করলে নাকি?’ অপবাদ জিনিসটা সইতে পারে না আবির। মা প্রায়ই মানুষের কাছে গল্প করেন আবিরের নাকি বয়সের তুলনায় আত্মসম্মানবোধ বড় বেশি। এ জন্য মা গর্বও করেন, সেটা আবির টের পায়।

হাত দিয়ে মুখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে ওর দিকে তাকাল শার্লি, ‘হয়েছে হয়েছে আর বড় সাজতে হবে না। আমাদের মধে৵ মুবিনের সাহসই সবচেয়ে বেশি। একমাত্র সে-ই পেরেছিল সাঁতরে ওখানে যেতে। তা–ও কাকডাকা ভোরে। উহ! ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়।’ আবির লক্ষ করে শার্লির কণ্ঠে কী যেন আছে। মুবিনের ঘটনা বলতে গিয়ে কেমন যেন শোনাল ওর গলাটা।

কারণ কী? উত্তর পেল না আবির। কেবল অনুভব করল কিসের যেন একটা তীব্র আঁচে ওর কান দুটি গরম হয়ে আসছে।

‘সাহস করে একটা কাজে নেমে পড়লেই ভয়টা আর গায়ে লাগে না। দেখেছি আমি।’

‘লেকটা ভালো না। একবার আমি, লিলি আর আরও কয়েকজন সাঁতার কাটছিলাম। কে যেন পানির নিচ থেকে আমার পা টেনে ধরেছিল।’ দুই হাতে মুখ ঢাকে শার্লি, কেঁপে ওঠে একবার ওর পিঠটা। হয়তো ভয়ে। নাকি ঠান্ডায়, ‘গায়ের জোরে টেনে আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিল পানির নিচে। শেষে আমার চেঁচামেচিতে সবাই মিলে টেনে তুলেছে আমাকে।’

ঢোঁক গিলল আবির।

শার্লি ওর মাথায় হালকা একটা চাটি মেরে উঠে চলে গেল ভেতরে।

আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে তিন দিকে। কেবল আবিরের নাক বরাবর পুকুরের ওপারে জংলা কিছু গাছের মাথার ওপর দিয়ে মনে হচ্ছে কয়েক সেন্টিমিটার আকাশ এখনো লালের মায়া ছাড়তে পারেনি। শার্লির গায়ের চাদরের মতো দেখাচ্ছে আকাশটুকু।

আবিরের মন আরও ব্যাকুল আর চঞ্চল হলো আচমকা যখন সন্ধ্যার হিম শীতল বাতাস একটা নাম না জানা পাখির বিষণ্ন করুণ সুর ভাসিয়ে এনে আছড়ে ফেলল ওর কানে, বুকে। মন শক্ত করে ফেলেছে আবির। প্রমাণ করবে নিজেকে।

যুদ্ধে বোমার আঘাতে উড়ে যাওয়া হাত নিয়ে এক জার্মান সৈনিক এক হাতে সাঁতরে নদী পার হয়েছিল। সিনেমাটা দেখেছে আবির সামার ভ্যাকেশনেই। নামটা মনে নেই।

নিজের স্লিংয়ে ঝোলানো হাতটা আবির তুলে আনে চোখের সামনে…

সকাল থেকেই একটা পাখি আকাশের অনেক ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। চিল হতে পারে। অন্য কোনো পাখি হওয়াও বিচিত্র নয়। কিন্তু নিঃসঙ্গ সে। কোনো শব্দ করছে না সে। নীরবে হয়তো খুঁজে ফিরছে সঙ্গীসাথি কাউকে। কিন্তু আজ গোটা মহামায়া বড্ড ফাঁকা।

সূর্য ওঠেনি সারা দিনে একবারও। বরং কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে বাতাসের সঙ্গে। গুঁড়ি গুঁড়ি। দূরে মেঘ ডেকেছে কোথায় যেন।

হু হু বাতাসে জেটিসুদ্ধ উড়িয়ে নিতে চাইছে খানিক পরপর। সোঁদা মাটির ঘ্রাণ সেই বাতাসে। বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে দুটি নারীদেহ এগিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট হোন্ডা গাড়িটার দিকে। আবিরের পছন্দের রং কালচে নিল। সেই রঙেরই গাড়িটা।

পেছনের সিটে বসে আছে আরিফ। নাহ, বিচ্ছু আরিফ না। স্বভাববিরুদ্ধ আরিফ। চোখ দুটি স্থির তার গাড়ির জানালায়। এক ফোঁটা বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে কাচ বেয়ে। হাত দুটি নিশ্চল পড়ে আছে কোলের ওপর।

ব্যাংকার কামাল সাহেব গাড়িখান নীরবে চালিয়ে এনে থামিয়েছেন এক জায়গায়। সতেজ সবুজ ঘাসে ছাওয়া এক টুকরা ছোট্ট টিলা এখানে ঢালু হয়ে এসে মিশেছে লেকের জলে। কালচে সবুজ জল। টিলার ঢালে ছোট ছোট এক জাতের ফুল ফুটে আছে। কী রঙিন! দুলছে বাতাসে মৃদু মৃদু। মনে হয় প্রজাপতি। এক্ষুনি উড়াল দেবে ছুঁতে গেলেই।

ঢালটার গায়েই এই এলাকার গোরস্তান। ব্যক্তিগতভাবে এখানকার বাসিন্দারাই তৈরি করেছিল একসময়।

দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না লিজা। বসে পড়েছেন হাঁটু ভাঁজ করে। তার গর্বের পুত্র, এত সাধের আবিরকে এখানেই কবর দেওয়া হয়েছে।

ছেলেটা ভাঙা হাত নিয়ে কেন যে মহামায়া পার হতে গেছিল…আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইতেই এক ফোঁটা ব্লেডের মতো ধারালো বৃষ্টির ফোঁটা লিজার কান্নাভেজা চোখে পড়েছে।

*

জেটিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে শার্লি।

লাল চাদরটা কষে জড়িয়েছে গায়ের সঙ্গে। পা ডুবে আছে লেকের বরফশীতল জলে। কালচে সবুজ জল। বাতাসে চুল এলোপাতাড়ি উড়ছে। কিন্তু মাথা ঘামাচ্ছে না মেয়েটা। আনমনে চেয়ে আছে দূরে কোথাও।

ফুলে ওঠা নীল লাশটা চোখের সামনে ভাসছে কেবল…আজ দুটো দিন ধরে। এই দৃশ্য মনে হয় না মরণের আগপর্যন্ত ভুলতে পারবে ও।

একবার কী মনে করে পেছন ফিরে চাইল। গোটা তল্লাটে আজ কেউ বাড়ি ছেড়ে বের হয়নি। আরেক ঝলক বাতাসে কানসুদ্ধ জমিয়ে দিয়ে গেল ওর। ঠিক তক্ষুনি মনে হলো কে যেন ওর নাম ধরে ডেকেছে…ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না। মেয়েটা প্রাণপণে চেষ্টা করে পেছনে না তাকাতে।

‘নাহ, এ রকম হুট করে যারা মরে, এরা আমাদের আশপাশেই থাকে। ঘুরে বেড়ায়। কথা বলতে চায়। আমরা দেখতে পাই না বটে। তবে এরা আছে।’

………

‘হঠাৎ হঠাৎ দেখবে মনে হয় কে যেন দেখছে তোমাকে। কিন্তু আশপাশে কেউ নেই। বুঝবে তখন ও রকমই কেউ…’

দুই হাতে কান চাপা দেয় মেয়েটা।

আরও পড়ুন