বানরের পিঠা কতখানি মিঠা

অলংকরণ: এস এম রাকিব

খুব খিদে পেয়েছে বানরের। বাসায় কিছু নেই। না খাবার, না টাকাপয়সা। ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি বের করল। পিঠা বানাবে। তার জন্য জিনিসপাতি চাই। অন্যদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে আনতে হবে। বেশ ভালো বুদ্ধি। নিজেকে নিজেই তারিফ করল সে। আহা, সময়মতো চমত্কার একটা বুদ্ধি এসে গেছে মাথায়। ঠিকঠাকমতো কাজ হলে কোনো ভাবনা নেই। খাওয়াদাওয়ার ভালো ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

সবার আগে বানর গেল মুরগির খোঁয়াড়ে। তার কাছে পিঠা বানানোর সাজসরঞ্জাম চাইল। মুরগির মনটা নরমসরম। সে কিছু জিনিসপাতি দিয়ে দিল চাওয়ার পর পরই। বানর বলল তাকে,

আগামীকাল বেলা একটায় আমার বাড়ি চলে এসো তুমি। দুজনে মিলে আরামসে পিঠা খাওয়া যাবে।

মুরগি মাথা নেড়ে সায় দেয়।

আচ্ছা চলি তাহলে। কাল দেখা হচ্ছে আমাদের।

এই বলে বিদায় নেয় বানর।

এরপর কোথায় যাওয়া যায়। ওহো, শিয়ালের গর্ত তো এই সামনেই। বেশি দূরে না। হানা দেওয়া যাক তার আস্তানায়। শিয়াল বাড়িতেই ছিল। বানর মোলায়েম কণ্ঠে মিনতি জানায়,

বন্ধু শিয়াল ভায়া, ভালো আছ তো। বলছিলাম কি, পিঠা বানাব বলে ঠিক করেছি। কিছু মালমসলা চাইছি তোমার কাছ থেকে। পেলে বড় উপকার হয়।

তা শিয়াল দিল। গদগদ খুশিতে বানর তাকে বলে,

বেশ, বেশ। আগামীকাল বেলা দুটোয় সোজা চলে আসবে আমার বাড়ি। গপ্পসপ্প হবে। মজা করে পিঠা খাওয়া যাবে। দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছি তোমায়। কী, আসছ তো?

হুক্কা হুয়া। তা এমন করে যখন বলছ, যেতে তো হয়ই। আচ্ছা, দেখা হবে কাল। বেলা ঠিক দুটোয় তো।

শিয়াল উত্তর দেয়।

মুরগি ও শিয়ালের কাছ থেকে ভালো পরিমাণ জিনিস পাওয়া গেছে। বানর সেগুলো বাড়িতে রেখে আসে।

অভিযান তার শেষ হয়নি। আরও, আরও কিছু জোগাড় করা লাগবে।

যে-ই ভাবা সে-ই কাজ।

আবার শুরু হলো অভিযান। খানাদানা জোগাড়ের চেষ্টা।

এবার যাওয়া যাক কুকুরের বাড়ি। গেল বানর। হাঁক দিল,

ও কুকুর ভায়া, বাড়ি আছ নাকি? কত দিন দেখাসাক্ষাৎ নেই। আড্ডাবাজি নেই। দেখাসাক্ষাৎ, আড্ডা, গল্পগুজব না হলে কি ভালো লাগে বলো?

কুকুর বেরিয়ে আসে।

ঘেউ ঘেউ। তা কী মনে করে এলে? অনেক দিন তো দেখা পাই না তোমার। বনবাদাড়ে গাছপালায় থাকো দিনরাত। তাও ভালো যে এলে, খোঁজখবর নিলে।

বানর এবার আসল কথাটি তোলে।

বলছিলাম কি, অনেক দিন ধরে ইচ্ছা, কিছু পিঠা বানাব। তোমার সঙ্গে দু’দণ্ড বসে আড্ডা দেব। তারিয়ে তারিয়ে পিঠা খাব। একলা একলা খাওয়াদাওয়া করার মধ্যে কোনো মজা নেই। বুঝলে না ব্যাপারটা?

হুম। তা তো বুঝলাম। মন্দ বলোনি। তা, আমার কাছে কী চাও তুমি?

এই তো, বিশেষ কিছু না। সামান্য ব্যাপার। পিঠা বানাতে কিছু সাজসরঞ্জাম, উদ্যোগ–আয়োজন তো এক–আধটু লাগেই। তুমি তো বাপু সবই জানো। নতুন করে আর বলব কী!

প্রশংসা শুনে কুকুর গলে যায়। বলে,

ঘেউ ঘেউ। তাই হোক। জম্পেশ আড্ডা হবে। খানাদানা হবে জোশ। এই নাও, আমার তরফ থেকে কিছু উপহার।

বানর ধন্যবাদ জানিয়ে বলে,

তুমি আসলেই খুব ভালো মনের একটা প্রাণী। তা এক কাজ করো ভায়া। আগামীকাল বেলা তিনটার দিকে চলে এসো আমার বাড়ি। পেট পুরে পিঠা খাবে, গল্প করবে। এখন তাহলে আসি ভায়া। অনেক অনেক কাজ পড়ে আছে তো। হাত লাগাতে হবে।

কুকুর খুশিতে লেজ নাড়ায়। বিদায় দেয় বানরকে।

বেশ, বেশ এসো। কাল দেখা হবে নিশ্চয়। খাওয়াদাওয়া, ফুর্তি, আড্ডা সব হবে।

এখন বাকি রইল বাঘের আস্তানা। ধীরেসুস্থে সেদিকে পা বাড়ায় বানর। বাঘের গুহার কাছে পৌঁছে গেল সে। মোলায়েম কণ্ঠে দরদ ঢেলে বলল,

বাঘ মামা, ও বাঘ মামা। ভাগনে এসেছে তোমার খোঁজখবর নিতে। ভালো আছ আশা করি।

বাঘ হুংকার দিয়ে বলে,

কে রে তুই? একটু আরামের কথা ভাবছি, এ সময় কে এলি জ্বালাতন করতে!

আমি তোমার বানর ভাগনে, মামা। তুমি হলে গিয়ে আমাদের সবার রাজা। একটু–আধটু আবদার তো আমরা সক্কলে তোমার কাছেই করব। প্রজা বলে কথা! ভুলচুক যদি কিছু করে থাকি, মাফ করে দিয়ো নিজ গুণে।

ইনিয়েবিনিয়ে কী বলছিস রে? তা কী চাস? সোজাসাপটা বলে ফ্যাল।

কাঁচুমাচু হয়ে বানর মিনতি করে,

আমার অনেক দিনের শখ, একটু পিঠা বানাব। তোমার সঙ্গে গল্পগুজব করব আর পিঠা খাব। কিছু জিনিসপত্তর লাগবে যে সেই কাজে।

হালুম। ও, তাই বল। তা নিয়ে যা কিছুমিছু।

বানরের চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। বাঘকে নিয়ে ভয় ছিল খুব। আচমকা যদি উল্টো দৌড়ানি দেয়, তাহলে কম্ম কাবার। নাহ্, মামার সুমতি হয়েছে। ভয় নেই আর। বানর বলে,

মামা গো, অশেষ ধন্যবাদ জানাই তোমাকে। দাওয়াত নাও গো এবার। আগামীকাল বিকেল চারটা নাগাদ আমার ডেরায় চলে এসো। পিঠাপুলি খাইয়ে বরণ করব তোমায়।

বাঘ এক গাল হেসে বলে,

তা বেশ। তা বেশ। ঠিক আছে, কাল সময়মতো গিয়ে হাজির হব, দেখে নিস।

দুই.

অভিযান শেষ। বাড়ি ফিরে এল বানর। মন দিয়ে পিঠা বানাল। পরিমাণে অনেক। পেট পুরে খেলো। ঠেসে ঠেসে। একদম গলা পর্যন্ত। পিঠা এত বেশি যে ফুরানো গেল না। এবার ঘুমানো যাক। দিনভর যা ধকল গেছে আজ। ক্লান্তিতে হাত-পা যেন খুলে খুলে আসছে।

পরদিন সকালে, দুপুরে আবার সেসব পিঠা খাওয়া গেল। খানাদানা শেষে মাথায় একটা পট্টি বেঁধে চাদর জড়িয়ে শুয়ে থাকল বানর। ভাবখানা এমন যে শরীর খুবই খারাপ তার।

বেলা একটা বাজে। মুরগি এসে হাজির। এ সময়টাতেই তার আসার কথা। এসেই দরজায় কড়া নাড়ল সে।

চিঁ চিঁ করে বানর বলে,

মুরগি বোন, এসো, ভেতরে এসো। দরজা খোলাই আছে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছি গো। দরজার কাছে গিয়ে যে তোমাকে ভেতরে এনে বসাব, সেই জো নেই। সারা শরীরে ব্যথা। খুব কষ্ট পাচ্ছি।

আহা রে বানর ভায়া। কষ্ট করে উঠতে হবে না আর। দোয়া করছি, যেন খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে পারো।

আফসোসের সুরে বলল মুরগি।

বেলা দুটো বেজেছে। হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া। শিয়ালের গলা শোনা যাচ্ছে। শুনে মুরগি ভয়ে জড়সড়। কী করবে, ভেবে পায় না।

বানর বলে,

জলদি আমার খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ো। কোনো শব্দ কোরো না। ঝটপট লুকোও গিয়ে।

মুরগি তা–ই করে।

বানর কাতর গলায় মিনমিন করে বলে,

এসো, শিয়াল ভায়া। ভেতরে এসে বোসো। হঠাৎই অসুখে পড়লাম। ঠিকমতো কথাও বলতে পারছি না। গলায় ব্যথা। খুবই দুঃখিত আমি।

শিয়াল আহা উহু করে। সান্ত্বনা দেয় বানরকে।

ও নিয়ে ভেবো না। অসুখবিসুখ তো যেকোনো সময়ই হতে পারে। বিশ্রাম নাও। ভালো হয়ে যাবে তুমি।

তিনটা বেজে গেল এরই মধ্যে। এ সময়ে কুকুরের আসার কথা। এসেও গেছে। সময় মেনে চলে সে। কখনো এদিক বা ওদিক হয় না।

ঘেউ ঘেউ। কই হে বানর ভায়া, কোথায় তুমি? বাড়িঘর যে এত সুনসান। বলি ব্যাপারটা কী, আছ নাকি বাড়িতে?

কুকুরের শব্দ পেয়ে শিয়াল তো মহা ভয় পেয়ে গেছে। এখন উপায় কী হবে। অসহায় চোখে সে তাকায় বানরের দিকে। বানর ইশারা দিয়ে ফিসফিস করে বলে,

হাঁ করে দেখছ কী? জলদি ঢুকে পড়ো খাটের নিচে। আপাতত জানটা বাঁচাও। কুকুর তোমাকে দেখলে খবর আছে। পালানোর পথ পাবে না।

শিয়াল তা–ই করে। না করে উপায় নেই। কুকুর দরজায় কড়া নাড়ছে।

বানর কঁকাতে কঁকাতে সাড়া দেয়।

আর বোলো না ভাই। হঠাৎই অসুখে কাবু হয়ে পড়েছি। বড় শরমের ব্যাপার। তোমাকে দাওয়াত দিয়ে এসেছি। বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছি না। এতই খারাপ অবস্থা আমার।

কুকুর সান্ত্বনা দিয়ে বলে,

আহা, আহা! অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? লজ্জারই–বা কী আছে। অসুখবিসুখ তো সবারই হয়। আমি নিজেও গত সপ্তাহে জ্বরে ভুগলাম। টানা চার দিন ছিলাম এক্কেবারে শোয়া।

এরপর বাজল চারটা। চারদিক কাঁপিয়ে হুংকার ছেড়ে বাঘ মামা এল।

হালুম হুলুম শব্দ শুনে কুকুর ভয়ে জড়সড়। রীতিমতো কাঁপছে সে। বাঘের সামনে পড়লে বারোটা বেজে যাবে। বানর ঝটপট পরামর্শ দেয়, কুকুর ভায়া, চট করে লুকিয়ে পড়ো তুমি। এক্ষুনি খাটের নিচে ঢোকো। বাঘ মামা যদি তোমাকে দেখে, তাহলে সর্বনাশ।

কুকুর তা–ই করে। খাটের নিচে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। বুক কাঁপছে দুরুদুরু। কঁকিয়ে কঁকিয়ে মিনমিন করে বানর বাঘকে ভেতরে আসতে বলে।

মামা গো, কী আর বলব! আমার কপাল মন্দ। তোমাকে দাওয়াত দিলাম। তুমি এলে। আমি ধন্য হলাম। গরিবের ঘরে তুমি পায়ের ধুলা দিয়েছ। কী সৌভাগ্য আমার। কিন্তু কী জানো মামা, গত রাত থেকেই আমি ভীষণ অসুস্থ। শরীর এতটাই খারাপ যে নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারছি না।

বাঘের মন গলে না। বানরের কাকুতিমিনতি কানেই তোলে না সে। হুংকার ছেড়ে বলে,

ওরে বানর! তুই একটা বজ্জাত। সব সময় ধান্দা করিস। এসব ধানাইপানাই ছাড়। পিঠার দাওয়াত দিয়ে এসেছিস। ভালোয় ভালোয় সব পিঠা এনে হাজির কর। নইলে তোর একদিন কি আমার একদিন।

বানর কী জবাব দেবে এ কথার? ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভয় পেয়ে যায় ভীষণ। তীরে এসে তরি বুঝি ডুবল এবার। এখন কী হবে!

বাঘ একটুও টলে না। খাটের ওপর উঠে দাপাদাপি শুরু করে দেয়। এই সুযোগে বানর দৌড়ে পালায়। বাড়ির কোনায় উঁচু একটা গাছের মগডালে উঠে পড়ে। পাতার আড়ালে লুকিয়ে রাখে নিজেকে।

বাঘের ভারী ওজনে খাট ভেঙে পড়ে। খাটের নিচে কে কে লুকিয়েছিল, আমরা তা আগে থেকেই জানি। মুরগিকে খেয়ে ফেলে শিয়াল। কুকুর কেড়ে নেয় শিয়ালের প্রাণ।

তারপর? কুকুরকে প্রাণ হারাতে হয় বাঘের কাছে।

বাঘের রাগ কিন্তু যায়নি।

বানরকে সে খুঁজে ফিরছে।

হাতের নাগালে পেলেই তার দফা রফা করবে। আর তখন থেকেই বানর গাছে গাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আরও পড়ুন