দ্য ওপেন উইন্ডো গল্পের অনুবাদ—খোলা জানালা
মূল নাম: দ্য ওপেন উইন্ডো
লেখক পরিচিতি: ‘সাকি’ নামটি মূলত ছদ্মনাম। লেখকের আসল নাম ‘হেক্টর হিউ মুনরো’। জন্ম ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ ভারতে। ১৮৯৬ সালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন তিনি। তাঁর অতিপ্রাকৃত ছোটগল্পগুলো বেজায় জনপ্রিয়। ছদ্মনামে লিখতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মান স্নাইপারের গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।
‘আমার ফুফু একটু পরেই নিচে নামবেন,’ মৃদু হেসে বলল মেয়েটা, ‘আপনি বসুন। উনি না আসা পর্যন্ত আমার সঙ্গেই নাহয় একটু গল্প করুন, কেমন?’
একদৃষ্টে কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল ফ্রামটন নাটেল। মেয়েটার বয়স পনেরোর বেশি হবে না, ওকে বেশ বুদ্ধিমতীই মনে হলো ফ্রামটনের। কিন্তু ওর সঙ্গে কী নিয়ে গল্প করবে ফ্রামটন? মেয়েটা বা ওর ফুফু সম্পর্কে বলতে গেলে তেমন কিছুই জানে না ফ্রামটন। আর তা ছাড়া নতুন এই পরিবেশে কারও সঙ্গে আলাপ করার মতো মানসিক অবস্থাও তার নেই।
মন বেজায় বিষণ্ন ফ্রামটন নাটেলের। বেশ কিছুদিন ধরে স্নায়বিক দুর্বলতায় ভুগছে সে। সে জন্যই বাড়ি ছেড়ে কদিনের জন্য সে এই গ্রামাঞ্চলে এসেছে। কিছুদিন এখানে থাকলে হয়তো শরীর আর মন খানিকটা ঝরঝরে হবে। গ্রামটা বেজায় নির্জন, শহরের মতো ভিড় এখানে নেই।
ফ্রামটন এই গ্রামে আসবে শোনার পর ওর বড় বোন ওকে বলেছিল, ‘তুমি ওখানে গিয়েও গোলমাল বাধাবে। কারও সঙ্গে তো ঠিকমতো কথাই বলতে পারো না। অমন নির্জন জায়গায় গিয়ে তোমার মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে। হুম...শোনো, ওই গ্রামের কয়েকজন মানুষকে আমি চিনি। কতগুলো চিঠি লিখে তোমাকে দিচ্ছি। ওই গ্রামে আমিও একবার গিয়েছিলাম তো। যাদের কাছে চিঠি লিখছি, তাদের সঙ্গে তুমি দেখা করবে, তারপর চিঠিগুলো দেখাবে ওদের। তাহলেই তারা তোমায় আপন করে নেবে। কথা বলার অনেকগুলো মানুষ পেয়ে যাবে, কেমন?’
ফ্রামটন নাটেল এখন বসে রয়েছে মিসেস স্যাপলটনের বাড়ির বসার ঘরে। ওর বোন যে কজন মানুষের কাছে চিঠি লিখেছে, তাঁদের মধ্যে এই মহিলাও রয়েছেন।
চুপচাপ বসে রয়েছে ফ্রামটন। ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে অল্পবয়সী মেয়েটা। ফ্রামটন বুঝতে পারছে না যে মেয়েটার সঙ্গে কীভাবে আলাপ শুরু করা যায়।
প্রায় কয়েক মিনিট বাদে অবশেষে মেয়েটা বলে উঠল, ‘আপনি কি এই অঞ্চলে আর কাউকে চেনেন?’
‘নাহ’, দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফ্রামটন, ‘আমার বোন এখানকার এক আশ্রমে বেশ কিছুদিন ছিল। সে প্রায় চার বছর আগের কথা। এখানকার অনেককেই চেনে ও। কতগুলো চিঠি লিখে দিয়েছে আমায়...যাতে সহজে এখানকার মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি। প্রথমেই মিসেস স্যাপলটনের সঙ্গে দেখা করতে এলাম।’
‘তার মানে সম্ভবত আপনি আমার ফুফু সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না, তাই না?’ কেমন যেন অদ্ভুত কণ্ঠে বলল মেয়েটা।
‘নাম বা ঠিকানা ছাড়া আর তেমন কিছুই জানি না’, মাথা নাড়ল ফ্রামটন। ঘরের আশপাশে তাকাল ফ্রামটন। মিসেস স্যাপলটনের স্বামী কি মারা গেছেন? না, এখনো বেঁচে আছেন? ঘরের আসবাব দেখে মনে হচ্ছে এই বাড়িতে অন্তত একজন হলেও পুরুষমানুষ থাকে।
‘তিন বছর আগে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা গ্রাস করে আমার ফুফুর জীবনটাকে। আপনার বোন সম্ভবত সেই ব্যাপারে কিছুই জানেন না,’ মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল মেয়েটা।
‘দুর্ঘটনা? কী দুর্ঘটনা?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ফ্রামটন। গ্রামের এমন সুন্দর আর শান্ত পরিবেশেও তাহলে দুর্ঘটনা ঘটে!
‘অক্টোবর মাস চলছে। ঠান্ডাটাও বেশ বেড়েছে...এমন আবহাওয়ার মধ্যে ওই বড় জানালাটা খোলা কেন বলুন তো?’ এই বলে আঙুল তুলে উঠানের দিকের গরাদহীন বড় জানালাটা দেখাল মেয়েটা। অবাক হয়ে সেদিকে তাকাল ফ্রামটন। জানালাটা বেশ বড়, খুব সহজেই ওটা দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক কোনো মানুষ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে।
‘ঠান্ডা তো এখনো তেমন পড়েনি,’ মাথা নাড়ল ফ্রামটন, ‘তা ওই জানালার সঙ্গে তোমার ফুফুর জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কী সম্পর্ক?’
‘আচ্ছে, সম্পর্ক আছে,’ বেশ গম্ভীর গলায় বলল মেয়েটা, ‘তিন বছর আগে ওই খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়েই আমার ফুফা আর ফুফুর ছোট দুই ভাই শিকারে গিয়েছিল...তারা আর ফেরেনি। সামনের বড় মাঠটা পেরিয়ে বনের ওদিকে পাখি শিকার করতে গিয়েছিল ওরা। বনটাতে ঢোকার আগে একটা জলাভূমি পড়ে। সেই জলাভূমির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শেওলায় ঢাকা একটা গর্তে পড়ে যায় ওরা তিনজন...বেশ গভীর ছিল গর্তটা। পচা পানিও জমেছিল ভেতরে...পরে ওদের মৃতদেহ আর পাওয়া যায়নি। সেটা ছিল গ্রীষ্মকালের এক বিষণ্ন দুপুরের ঘটনা...কী ভয়ানক, তাই না?’ কেঁপে উঠল মেয়েটার কণ্ঠ।
একটু থামল সে, তারপর বলে চলল, ‘বেচারি ফুফু এখনো বাস্তবতা মেনে নিতে পারেননি। উনি মনে করেন যে ওনার স্বামী আর ছোট দুই ভাই একদিন ঠিকই ফিরে আসবে। ওদের সঙ্গে ফিরবে বাড়ির পুঁচকে স্প্যানিয়েল কুকুরটা...যেটা ওদের সঙ্গেই ডুবে মরেছিল। ফুফুর ধারণা, একদিন ওরা সবাই আবার ওই জানালা দিয়েই বাড়িতে প্রবেশ করবে...শিকার শেষে এভাবেই তো ওরা বাড়িতে ঢুকত। সে জন্যই অন্ধকার নেমে আসার আগপর্যন্ত জানালাটা খোলা রাখা হয়। জানেন, ওরা যেদিন চলে যায়...সেদিনের সবকিছু নিখুঁতভাবে মনে আছে ফুফুর। মাঝেমধ্যেই আমাকে সে কথা বলেন তিনি। শুনতে শুনতে আমারও মুখস্থ হয়ে গেছে। ফুফার কাঁধের ওপর ছিল ওনার সাদা ওয়াটারপ্রুফ কোটটা...ফুফুর ছোট ভাই রনি সুর করে গাইছিল “বার্টি, তুমি কেন এত লাফাও!” আসলে “বার্টি দ্য বাউন্ডার” গানটা খুবই অপছন্দ ফুফুর। তাই ফুফুকে বিরক্ত করার জন্য বারবার ওনার সামনে গানটাই গাইত রনি...জানেন, এমন নির্জন সন্ধ্যাগুলোতে আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। মনে হয় সত্যি সত্যিই ওরা ফিরে আসবে পরলোক থেকে...ঢুকে পড়বে ওই খোলা জানালাটা দিয়ে! আবার বাস করতে শুরু করবে এই বাড়িটাতে...’
কেঁপে উঠল মেয়েটার শরীর, দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেজায় ভয় পেয়েছে ও। কেমন যেন একটা অদ্ভুত অস্বস্তি পেয়ে বসল ফ্রামটনকে।
ঠিক তখনই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলেন মিসেস স্যাপলটন। ফ্রামটন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মহিলাকে দেখে।
‘দুঃখিত, অনেক দেরি করে ফেললাম,’ মৃদু হেসে বললেন মহিলা, ‘ভেরার সঙ্গে কথা বলে আশা করি অনেক মজা পেয়েছেন আপনি।’
‘হুম’, মাথা নাড়ল ফ্রামটন, ‘ও অনেক সুন্দর করে কথা বলে।’
‘ওই বড় জানালাটা খোলা থাকাতে আপনার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? আসলে আমার স্বামী আর ছোট দুই ভাই জলাভূমির ওদিকে পাখি শিকার করতে গেছে। শিকার থেকে ফিরে ওরা সব সময় এই জানালা দিয়ে ভেতরে ঢোকে। বাড়ির গালিচায় যাতে কাদা না লাগে, সে জন্য সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে চায় না ওরা। কিন্তু তারপরও গালিচায় একটু-আধটু কাদা লেগেই যায়। একটু পরিষ্কার কোনো জায়গায় শিকারে গেলে হয় না? বলুন তো! ওদের নিয়ে আর পারি না!’
মহিলার কথা শুনে বুকটা কেঁপে উঠল ফ্রামটনের। তাহলে ভেরা ঠিকই বলেছে! উনি আসলেই আশা করেন যে ওনার স্বামী আর দুই ভাই ওই খোলা জানালা দিয়ে ফিরে আসবে!
মহিলা বলে চলেছেন, ‘এটাই নাকি পাখি শিকার করার মৌসুম। তারপর শীত একটু বাড়লে ওরা যাবে বুনো হাঁস শিকারে...’
পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করল ফ্রামটনের। না না, মহিলাকে আর ওই বিষয়ে কথা বলতে দেওয়া যাবে না। বাধ্য হয়ে নিজের অসুখের কথা বলতে শুরু করল সে। এবার খানিকটা কাজ হলো। মহিলা চুপ করে শুনতে লাগলেন ওর কথা। কিন্তু মাঝেমধ্যেই তিনি তাকাচ্ছিলেন খোলা জানালাটার দিকে।
উনি কি আসলেই বিশ্বাস করেন যে ওনার মৃত স্বামী আর দুই ভাই ফিরে আসবে? এই অশুভ বাড়িটাতে কেন এল ফ্রামটন? এখানে থাকলে তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে ও।
আরও জোরে জোরে নিজের অসুখের কথা বলতে লাগল সে, ‘ডাক্তার সাহেব আমায় সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলেছেন। কোনোভাবেই উত্তেজিত হওয়া যাবে না...কারণ, যেকোনো ধরনের মানসিক উত্তেজনাই আমার জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমও করা যাবে না। তবে হ্যাঁ, খাওয়াদাওয়া নিজের ইচ্ছেমতোই করতে পারি...সে ব্যাপারে তেমন কোনো ঝামেলা নেই...’
‘তাই না?’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিসেস স্যাপলটন। তারপর আবার জানালার দিকে তাকালেন তিনি। ফ্রামটনের কথাগুলো একদমই মন দিয়ে শুনছেন না তিনি।
হুট করেই মহিলার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘অবশেষে ওরা এসে গেছে,’ বেশ জোরেই বলে উঠলেন তিনি, ‘যাক...চা খাওয়ার সময়েই এল ওরা। আহা কী অবস্থা হয়েছে ওদের...চোখ-মুখ পর্যন্ত কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে!’
এইবার খানিকটা বিরক্ত হলো ফ্রামটন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেরার দিকে তাকাল সে। একি! ভেরাও অবাক চোখে চেয়ে রয়েছে জানালার দিকে। ওর দৃষ্টিতে খেলা করছে রাজ্যের আতঙ্ক!
বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধক করে উঠল ফ্রামটনের। ভয়ে ভয়ে জানালার দিকে তাকাল সে।
গোধূলির লালচে আলোতে ও স্পষ্ট দেখতে পেল তিনটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে জানালার দিকে। ওদের মধ্যে একজন বয়স্ক, বাকি দুজনের বয়স কম। ওদের সবার হাতে বন্দুক, বয়স্ক লোকটার কাঁধে একটা কোট। একটা স্প্যানিয়েল কুকুর হেঁটে আসছে ওদের সঙ্গে!
ধীরে ধীরে বাড়ির একদম কাছে চলে এল ওরা। তখনই কে যেন কর্কশ গলায় গেয়ে উঠল, ‘ও বার্টি...ও বার্টি...তুমি কেন এত লাফাও!’
আর সহ্য করতে পারল না ফ্রামটন! দ্রুত নিজের হ্যাট আর ছড়িটা নিয়ে একছুটে সদর দরজা দিয়ে উঠানে চলে এল সে। তারপর ফটক পেরিয়ে উঠে গেল বড় রাস্তায়। প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল সে। সাইকেলে করে একটা লোক যাচ্ছিল, আরেকটু হলেই তার গায়ে গিয়ে পড়ছিল ফ্রামটন। একদম শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়ে রাস্তার একপাশে সরে গেল লোকটা। ওদিকে ফ্রামটন নাটেলের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই...সে ছুটে চলেছে।
বড় জানালাটা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন বয়স্ক লোকটা। তারপর কাঁধের কোটটা একপাশে রেখে মিসেস স্যাপলটনকে বললেন, ‘যাক, একদম চা খাবার সময়েই বাড়িতে এলাম, কী বলো? বেশ আরামেই শিকার করেছি আজ...বনের ভেতরের পথঘাট ধীরে ধীরে শুকাচ্ছে। তা ওই লোকটা কে? ওভাবে বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল কেন ও?’
‘ওটা হলো মি. নাটেল,’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিসেস স্যাপলটন, ‘অদ্ভুত মানুষ বটে। অনেকক্ষণ ধরে আমায় নিজের অসুখের কথা শোনাল...তারপর তোমাদের দেখে পালাল! এ আবার কেমন কথা? ওর ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন ভূত দেখেছে! আরে বাবা, যাওয়ার আগে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে গেলেও তো পারতি, তাই না? অভদ্র কোথাকার।’
‘আমার মনে হয় ও স্প্যানিয়েল কুকুরটা দেখে ভয় পেয়েছে,’ ঠান্ডা গলায় বলল ভেরা, ‘ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছি ফুফু আসার আগে। আমায় বলেছে যে কুকুর দেখে নাকি ও বড্ড ভয় পায়। ভারতে ছিল নাকি ও বেশ কয়েক বছর। গঙ্গা নদীর কাছে একটা জায়গায় এক রাতে ওকে একদল বুনো কুকুর তাড়া করে...কুকুরের তাড়া খেয়ে বেচারা ঢুকে পড়ে একটা কবরস্থানে। নতুন খোঁড়া একটা কবরের মধ্যে সারা রাত লুকিয়ে ছিল ও আর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছিল কুকুরগুলো। লোকটা যতবার উঠতে গেছে...কুকুরগুলো ততবারই ওকে কামড়াতে এসেছে! অবশেষে একদম ভোরের দিকে চলে যায় কুকুরগুলো...তারপর কবর থেকে বেরিয়ে আসে বেচারা। সেই থেকে কুকুর সহ্য করতে পারে না ও। আমার তো মনে হয়, ওই রাতের পর থেকেই ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
খুব অল্প সময়ের মধ্যে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা গল্প বলার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল মেয়েটির।