শিবব্রত বর্মনের গল্প— মল্লিকদের বাড়ি
আমি ভূতে বিশ্বাস করি। তবে এখন পর্যন্ত আমি ভূত দেখিনি। আমার পরিচিতজনেরাও কেউ দেখেনি।
আমার জীবনে একটা ঘটনা আছে, যেটাকে ভূত দেখা বলা যাবে না কিছুতেই, তবে ভূত না দেখা বলাও কঠিন। এই ঘটনা আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। জগতের সব বস্তুকে আমি এখন ভিন্ন চোখে দেখি।
ঘটনাটা বলি।
বাসা বদল করা নিয়ে আমরা সেবার একটা গ্যাঁড়াকলে পড়েছিলাম। আমরা চিরকাল ভাড়া বাসায় থেকেছি। বাবা তাঁর সব জমানো টাকা দিয়ে শেষ জীবনে একটা ফ্ল্যাট কিনলেন আদাবরের দিকে। দুই বেডরুমের ছোট ফ্ল্যাট। সাড়ে সাত শ স্কয়ার ফুট। ব্যাংকের মর্টগেজ–সংক্রান্ত কী এক ঝামেলা আছে, বিধায় প্রায় অর্ধেক দামে পাওয়া গেল। ফ্ল্যাট মোটামুটি রেডি। জুলাই মাসে উঠতে পারব। তার মানে আমরা এবার ভাড়া বাসা ছেড়ে দেব।
বাসা ছেড়ে দেওয়া খুব সহজ কাজ। দুমাস হাতে রেখে মে মাসেই শেওড়াপাড়ার ভাড়া বাসার মালিককে জানিয়ে দিলাম, জুলাইতে বাসা ছাড়ছি। বাড়িওয়ালা ‘টু-লেট’ টাঙিয়ে দিল। কয়েকটা পরিবার বাসা দেখতে এল। দুপুর বা বিকেলের অবেলায় এসে তারা গম্ভীর মুখে আমাদের লুঙ্গি শুকাতে দেওয়া বারান্দা, বদনা উল্টে থাকা বাথরুম আর বাসনকোসন ডাঁই করে রাখা তেল-চিটচিটে রান্নাঘর ঘুরে দেখে গেল।
বাসা অনায়াসে ভাড়া হয়ে গেল। কিন্তু জুনের তৃতীয় সপ্তাহে জানা গেল, আমাদের কেনা ফ্ল্যাট রেডি নয়। আরও তিন মাস সময় লাগবে। কারণ, ভবনে লিফট লাগেনি।
বাবা গলার রগ ফুলিয়ে কোম্পানির সঙ্গে চেঁচামেচি করলেন। আমাকে অবাক করে কিছু অশ্লীল গালিও দিলেন কোম্পানির লোককে। বাবা উপনিষদ পড়া লোক। সংস্কৃত শ্লোক পড়ে আমাকে তার মানে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাঁর মুখে অশ্লীল গালি শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এ দেশে কথার বরখেলাপ বড় অপরাধ নয়। কোম্পানির লোকটা নির্লিপ্তভাবে ‘সরি’ বলে গেল।
এখন কী করা?
যে বাসায় আছি, জুলাইয়ের এক তারিখে সেটা ছাড়তেই হবে। ভাড়া হয়ে গেছে। আমাদের এখন নতুন বাসা ভাড়া নিতে হবে। কয়েক মাসের জন্য।
জুলাই মাসে ওঠার জন্য জুনের তৃতীয় সপ্তাহে বাসা খুঁজতে বের হওয়া এক বিড়ম্বনা। শেওড়াপাড়ায় কোনো বাসাই পেলাম না। শুধু শেওড়াপাড়া নয়, কাজীপাড়া, সেনপাড়া—কোথাও কোনো বাসা খালি নেই। রীতিমতো অসহায় বোধ করতে থাকলাম। চারপাশের বাড়িঘরের দিকে তাকিয়ে আমার কেন জানি এক দূরসম্পর্কের মামার কথা মনে পড়ে যেতে লাগল, যার নাম শাজাহান। তিনি ছিলেন থ্যালাসেমিয়ার রোগী। ভীষণ রক্তস্বল্পতায় ভুগতেন। প্রতি মাসে তাঁর রক্ত বদলাতে হতো। এক ব্যাগ করে রক্ত লাগত। প্রতি মাসে। সেটা জোগান দেওয়া কোনো কোনো মাসে কঠিন হয়ে যেত। তখন শহরময় গিজগিজ করা রক্তে ভরপুর লোকজনের দিকে শাজাহান মামা কী দৃষ্টিতে তাকাতেন, সেটা আমি যেন অনুভব করতে শুরু করলাম। মহল্লার রাস্তা, লেন, বাই-লেন, অলিগলির দুই পাশে সারিবদ্ধ সুউচ্চ ভবনগুলোর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আমার মনে হতে লাগল, এত বাড়ি, বাড়ির ওপরে বাড়ি, তার ওপরে বাড়ি, কিন্তু আমাদের থাকার কোনো জায়গা নেই! আমি আর আমার বাবা কি শেষে রাস্তায় থাকব?
পুরোনো আমলের ভবন। এক ফ্লোরে একটি করে ফ্ল্যাট। ফলে বেশ বড় বাসা। ঘরগুলো বড়। তিন বেডরুম, দুই বাথরুম, দুটি টানা বারান্দা। মেঝেতে পুরু ধুলা।
রাস্তায় থাকার কথা ভাবতেই আমার মুনতাসীরের কথা মনে পড়তে লাগল। কিন্তু...এই যে এইটাই আমার সমস্যা। এক কথা ভাবতে গিয়ে সম্পর্কহীন আরেকটা কথা মনে পড়ে।। বেশি বেশি সাহিত্যপাঠের কারণে নাকি আমার এ রকম হয়েছে।
বাসা খুঁজে পেতেই হবে। নীলক্ষেতে আমি যে পাইরেট বইয়ের দোকানে কাজ করি, তার মালিক মোসাদ্দেক বললেন, মিরপুরে মেট্রোরেল হয়েছে বলে ভাড়াটের চাপ। মোহম্মদপুরে খোঁজ নাও। কাজেই দোকান থেকে আগাম ছুটি নিয়ে মোহাম্মদপুরের দিকে ছুটলাম।
২৯ জুন মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডের এক গলিতে একটা পুরোনো চারতলা ভবনে বাসা খালি পেয়ে গেলাম।
‘ব্যাচেলর ভাড়া দেব না,’ দোতলায় দুই পাল্লার দরজার একটা পাল্লা খুলে আমাকে দেখেই বাড়িঅলা বললেন।
‘আমি ব্যাচেলর না,’ আমি বিনীতভাবে বললাম।
‘কে কে থাকবেন?’
‘আমি আর আমার বাবা।’
‘মা?’
‘উনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’
ভদ্রলোকের চোখে আফসোসের চাহনি দেখে বুঝলাম, উনি ভেবেছেন মা মারা গেছেন। আমি এতে স্বস্তিই বোধ করি। অস্বস্তিকর পারিবারিক ইতিহাস আমাকে আর উল্লেখ করতে হয় না।
‘ভাই-বোন?’
‘এক বোন ছিল। সে–ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।’
দেখলাম এবার এই কথাটা ভদ্রলোক কী অর্থে নেবেন, বুঝতে পারছেন না। আমি সরল ভাষায় বলি, ‘বোন অসুখে মারা গেছে।’
‘বাবাকে নিয়ে এলেন না কেন?’
‘আর্থ্রাইটিসের কারণে ওনার হাঁটাচলার সমস্যা।’
বাড়িঅলা স্যান্ডো গেঞ্জির ওপর একটা হাফহাতা শার্ট চাপিয়ে চাবি হাতে চারতলায় উঠে দরজা খুলে আমাকে বাসা দেখালেন।
পুরোনো আমলের ভবন। এক ফ্লোরে একটি করে ফ্ল্যাট। ফলে বেশ বড় বাসা। ঘরগুলো বড়। তিন বেডরুম, দুই বাথরুম, দুটি টানা বারান্দা। মেঝেতে পুরু ধুলা।
আমার বাসা দেখার কিছু নেই। দুদিন পর জুলাই মাসের এক তারিখে রাস্তায় থাকতে না হলেই হলো। ভাড়া যা–ই হোক, নিতে হবে। কয়েক মাসের ব্যাপার।
ভাড়া আমার অনুমানের চেয়ে অনেক কম হলো।
রাজি হয়ে গেলাম। এমনকি কিছু টাকা অ্যাডভান্সও করে দিলাম।
ভবন থেকে বেরিয়ে দেখি, ঝিরঝির বৃষ্টি নেমেছে। এমন বৃষ্টি গুরুত্বও দেওয়া যায় না, আবার উপেক্ষাও করা যায় না। হেঁটে গিয়ে গলির মুখে মুদির দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। এক মধ্যবয়সী লোক এসে একটা লাকি সেভেন সিগারেট কিনে ধরিয়ে বলল, ‘এখানে কার কাছে এসেছেন?’
‘বাসা ভাড়া নিতে।’
‘কোন বাসা?’
‘ওই যে চারতলা বাড়িটা।’
‘অ। মল্লিকদের বাসা। কয় তলায়?’
‘চারতলায়।’
‘ভাড়া নিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
একতলায় কেউ থাকে না। সেখানে একটা স্ক্রিনপ্রিন্টের ফ্যাক্টরি। ছবির ফ্রেমও তৈরি করে। তাতে স্যান্ডো গেঞ্জি পরা কিশোর বয়সী কয়েকটি শ্রমিক কাজ করছে।
লোকটা একবার আড়চোখে তাকাল আমার দিকে। তারপর প্রায় স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করে বলল, ‘পারবেন থাকতে?’
আমি একটু অবাক হলাম। বললাম, ‘কেন?’
‘দুর্নাম আছে। ভাড়াটিয়া টেকে না,’ বলে লোকটা সিগারেট হাতে হালকা বৃষ্টির মধ্যে নেমে চলে গেল।
আমি অস্বস্তিতে পড়লাম। সন্দেহ নেই, লোকটা অভব্য। অচেনা কারও সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে না। অন্তত গায়ে পড়ে এ রকম তথ্য দেয় না। হতে পারে লোকটা হিংসুটে প্রতিবেশী। হয়তো মল্লিকদের সঙ্গে এই লোকের কোনো বিরোধ আছে। সেটা কী রকম বিরোধ হতে পারে, এ বিষয়ে আমার কল্পনার ঘোড়া ছুটতে শুরু করার আগেই রাশ টেনে ধরলাম।
দোকানের শেডে দাঁড়িয়ে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পুরোনো ধাঁচের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মল্লিকদের বাড়ি। বাড়িওয়ালার নাম কি মল্লিক? জিজ্ঞেস করা হয়নি। কলাপসিবল গেটের এক পাশে একটা বরই, আরেক পাশে একটা নারকেলগাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গলির শেষ মাথার বাড়িটা। বৃষ্টির কারণে সন্ধ্যার আগেই আলো নিভে আসছে।
একবার মনে হলো, বাড়িটাও যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
অস্বস্তি লাগল।
কল্পনাপ্রবণ হওয়ার কারণেই হয়তো আমি বেশ ভিতু প্রকৃতির। সবকিছুতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকি। কোথাও প্যাঁচ-পয়জারের আঁচ পেলে এড়িয়ে চলি। বুঝলাম, সিগারেট খাওয়া অভব্য লোকটার কথা আমার ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। গা ঝাড়া দিলাম। এগুলোকে এখন মোটেও পাত্তা দেওয়া যাবে না। বাসা নিয়ে সমস্যা যদি কিছু থেকে থাকে, পরে দেখা যাবে। তা ছাড়া দু-এক মাসেরই তো ব্যাপার।
রিকশায় ফিরতে ফিরতে দেখলাম, মনের ভেতরের খচখচানি কিছুতেই যাচ্ছে না। বাসার ভাড়া এত কম কেন? আর একটা কথা তো জিজ্ঞাসাই করা হয়নি। বাসা খালি কেন? মেঝেতে যে পরিমাণ ধুলা দেখলাম, বোঝা যায়, বেশ কিছুকাল ধরে বাসা ফাঁকা। কেন?
১ জুলাই আমরা নতুন ভাড়া বাসায় উঠলাম।
বাসাবদলের একটা বিষাদময় দিক আছে। সেটা শুধুই চেনা মহল্লার দেয়াল-নর্দমা, চেনা দোকান থেকে সাবান কেনার অভ্যস্ততা থেকে উৎখাতের কারণে নয়। এক বাসা থেকে আরেক বাসায় স্থানান্তরিত হওয়ার মাঝখানে একটা ভাসমান পর্ব থাকে, যখন খোলা ট্রাকে বাসার যাবতীয় ফার্নিচার তোলা হয়—খাটপালঙ্ক, সোফা সেট, ড্রেসিং টেবিল, আলনা, ট্রাংক, বইয়ের আলমারি, রান্নাঘরের বাসনকোসন। সিলিং ফ্যানের পাখাগুলোকে খুলে কাগজে মোড়া হয়, খাটগুলোও খুলে ফেলা হয়, আলাদা করে ফেলা হয় ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ার। সবকিছু এমনভাবে স্তূপ করা হয়—একটার ফাঁকে আরেকটা ঠেসে দিয়ে, কখনো কাত বা উল্টো করে—যাতে খোলা ট্রাকের ওইটুকু পরিসরে সব এঁটে যায়। সেই ট্রাক যখন শহরের প্রধান সড়ক বেয়ে ছুটে যেতে থাকে, ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়ায়, অপেক্ষা করে, তখন প্রথমবারের মতো গৃহস্থ মানুষ বিস্ময়ে অনুধাবন করে, তার এত দিনের ছড়িয়ে থাকা প্রশস্ত সংসারটা কেমন এঁটে গেছে একটা চলমান বাহনের সংক্ষিপ্ত পরিসরে। হাতের তালুর চাপে একটা হাওয়াই মিঠাই যেভাবে চুপসে মার্বেল সাইজের হয়ে যায়, সে রকম। আর সেই চুপসানো সংসারটাকে শহরের ব্যস্ত সড়কের মধ্য দিয়ে গড়িয়ে যেতে দেখে গৃহস্থের অসহায় লাগে। বাসাবদলের এইটাই সবচেয়ে বিষাদময় দিক। ট্রাকের পেছনে নাইলনের রশি দিয়ে বাঁধা সংসারটাকে দেখতে পাওয়া। এত দিনকার এত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, স্মৃতি-অভিমান—সব যেন ঠেসে দলা পাকিয়ে নাইনলের দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
উবার নিয়ে ট্রাকের পেছন–পেছন যেতে যেতে ভাবছিলাম, দুই বাসার মধ্যবর্তী এই ভাসমান পর্বটি সংক্ষিপ্ত হলেও তা কত তীব্রভাবে বাস্তব। আর তখন বার্দো নামে একটা বৌদ্ধবিশ্বাসের কথা মনে পড়ল। আমার বন্ধু মাহবুবের কাছ থেকে শুনেছিলাম কথাটা। বৌদ্ধরা জন্মান্তরে বিশ্বাস করে। মানুষ মরে গেলে পৃথিবীতেই তার আবার জন্ম হয়। ভিন্ন কোনো রূপে। ভিন্ন পরিচয়ে। কিন্তু মারা যাওয়ামাত্রই তো আর পুনর্জন্ম ঘটে না। দেহহীন আত্মার একটা অপেক্ষা পর্ব থাকে। এক দেহ থেকে বেরিয়ে আরেক দেহে প্রবেশের মাঝখানে আত্মার এই অপেক্ষমাণ ত্রিশঙ্কু দশাটির নাম বার্দো। আত্মা তখন এ জগতেই আছে, আবার এ জগতে নেই।
ট্রাক থেকে যখন আসবাব নামাচ্ছি, তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ঘনাদার মতো প্রশস্ত কপালের একটা শুকনো লোক এসে কিছুক্ষণ কৌতূহলী চোখে দাঁড়িয়ে থেকে জানতে চাইল, আমাদের পরিবারে মনিমুল হক নামে কেউ আছে কি না।
‘না। কেন বলুন তো?’
লোকটা কোনো জবাব না দিয়ে চলে গেল।
পুরো মহল্লাই কেমন যেন, উদ্ভট স্বভাবের লোকে ভরা।
একতলায় কেউ থাকে না। সেখানে একটা স্ক্রিনপ্রিন্টের ফ্যাক্টরি। ছবির ফ্রেমও তৈরি করে। তাতে স্যান্ডো গেঞ্জি পরা কিশোর বয়সী কয়েকটি শ্রমিক কাজ করছে। দোতলায় বাড়িঅলা থাকেন। ধরে নিলাম তাঁর নাম মল্লিক। তার ওপরে তিনতলায় একটা পরিবার থাকে। তাদের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আর চারতলায় আমরা উঠছি।
নতুন বাসা আমাদের আগের বাসার চেয়ে অনেক বড়। বাবা টানা প্রশস্ত বারান্দা দেখে বললেন, কাপড় শুকাতে সুবিধা হবে। আর আমার মনে হলো, এখানে একটা দারুণ টব-বাগান করা যাবে। আর বলামাত্র, কী আশ্চর্য, বারান্দা থেকে দেখি, পাশে একটা একতলা প্লট। সেখানে একটা একতলা টিনের বাড়ি। উঠানে একটা মধ্যবয়স্ক লোক টুলে বসে প্যাডেল হুইল চালিয়ে টব বানাচ্ছেন। ওপর থেকে দৃশ্যটা অপূর্ব লাগল। আমি কখনো সামনাসামনি ঘুরন্ত হুইলে পটারির কাজ দেখিনি। নরম কাদামাটির দলায় হাতের তালু আর আঙুল ছুঁইয়ে কুমার কেমন ম্যাজিশিয়ানের মতো নানান অবয়বের পাত্রকে অস্তিত্বশীল করে তুলছেন, তা শুধু নাটক-সিনেমার পর্দাতেই দেখেছি। শুনেছি, উর্বর মস্তিষ্কের কোনো কোনো দার্শনিক বলেন, কাদামাটির দলার ভেতরে পৃথিবীর সব মৃৎপাত্রের অবয়ব নাকি লুকানো থাকে। আগে থেকে। সম্ভাবনা আকারে।
আমি উঠে ফ্যানের সুইচ আবার চালু করলাম। ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। বাবার দরকার হতে পারে ভেবে আমি ঘরের দরজা লাগাই না। ভেজানো থাকে। পাল্লা খুলে বাইরে ডাইনিং স্পেসে পা রাখলাম।
একতলা বাড়ির উঠানে একটা চালতা আর একটা শরিফাগাছ। কালচে সবুজ এক আমগাছ টিনের চালটাকে ছায়া করে রেখেছে। বাড়ির লোকজন দেখছি, মুরগি পালে। ঢাকা শহরে এখনো বাসায় মুরগি পালন কেবল জাকির হোসেন রোডেই সম্ভব।
আমি একা একা গোছগাছ করতে হাঁপিয়ে গেলাম। এক দিনে সব কার্টন খোলা সম্ভব হলো না। বেশির ভাগ জিনিস অগোছালো রেখে চা চড়িয়ে দিলাম। আর তখন মল্লিক সাহেব এলেন। লুঙ্গি আর কুর্তা পরা। তিনি অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে সকাল থেকে হাসপাতালে ছিলেন, তাই খোঁজখবর নিতে পারেননি। এখন বাসায় ফিরেই খোঁজ নিতে এসেছেন, সব ঠিকঠাক আছে কি না। তাঁকেও চা দেওয়া হলো এবং বারান্দায় বসে একসঙ্গে চা খেতে খেতে বুঝলাম, এ রকম অমায়িক বাড়িঅলা পুরো শহরে দ্বিতীয়টা হয় না। তিনি বসে থাকা অবস্থায় দুবার বললেন, ‘কোনো সমস্যা দেখা দিলে বলবেন। জানাবেন।’ চলে যাওয়ার সময় চৌকাঠে পা দিয়ে তিনি যখন একই কথা তৃতীয়বার বললেন, তখন আমার মনে হলো, কথাটা শুধু নবীন ভাড়াটের প্রতি যত্নবান বাড়িঅলার ভদ্রতাসূচক বাণী নয়, এর ভেতরে কোথাও একটা উদ্বেগ লুকিয়ে আছে। খুব সূক্ষ্ম।
ইলেকট্রিশিয়ান লোকটা ফ্যান আর লাইট লাগিয়ে চলে গেল। কলমিস্ত্রিও সিংক ও বাথরুমের কলের প্যাঁচ টাইট দিয়ে দিল।
রাত নয়টা নাগাদ ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, ফ্যান ঘুরছে না। কারেন্ট চলে যায়নি, নিশ্চিত। কারণ, ফ্রিজের শব্দ পাচ্ছি। ফ্যানটা কোনো ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে, নতুবা কেউ বন্ধ করে দিয়েছে। বাবা? বিছানায় উঠে বসতেই টের পেলাম, লাইট বন্ধ থাকলেও আমি ঘরের সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। একটা কমলা রঙের আলোর আভায় ঘর আলোকিত হয়ে আছে। কোথা থেকে এই আলো আসছে, বুঝতে পারলাম না। এক পাশের জানালা খোলা। কিন্তু বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আমি উঠে ফ্যানের সুইচ আবার চালু করলাম। ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। বাবার দরকার হতে পারে ভেবে আমি ঘরের দরজা লাগাই না। ভেজানো থাকে। পাল্লা খুলে বাইরে ডাইনিং স্পেসে পা রাখলাম। ডাইনিং স্পেসেও সেই একই রকম কমলা রঙের আলো। যেন একটা অদৃশ্য ডিম লাইট জ্বলছে। সেই সঙ্গে একটা পোড়া গন্ধ নাকে লাগল। খুব হালকা। যেন কোথাও কাগজ পুড়ছে। আমি উদ্বিগ্ন হলাম। ইলেকট্রিক শর্টসার্কিট হচ্ছে কি না কোথাও। অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিরাট একটা খটকা লাগল। ফ্রিজটা জায়গামতো নেই। রান্নাঘরের দরজার পাশে ফ্রিজ রাখা হয়েছিল, আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেইটাই সবচেয়ে যৌক্তিক জায়গা। কিন্তু এখন ফ্রিজটা লিভিং স্পেসের দেয়ালে ঠেস দেওয়া। যেহেতু একটা ফ্রিজ নিজে থেকে জায়গা বদল করবে না এবং যেহেতু বাবার পক্ষে রাতের বেলা সেটা সরিয়ে আরেক জায়গায় টেনে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব, কাজেই ধরে নিলাম, আমার স্মৃতিই ভুল করছে। আমিই ফ্রিজটা ওখানে রেখেছি।
বাবার রুমের দরজাও ভেজানো থাকে। সে ঘরে উঁকি দিয়ে প্রথমবারের মতো চমকে উঠলাম। বাবার বিছানাটা ঠিক জায়গায় নেই। সেটা উত্তর–দক্ষিণে পাতা হয়েছিল। এখন তা পুব-পশ্চিমে হয়ে আছে।
বাবা ঘুমাচ্ছেন। আমি তাঁকে ডাকলাম না।
দরজা ভেজিয়ে ডাইনিং চেয়ারে এসে বসলাম। ডাইনিং টেবিলে একটা পরিপাটি অয়েলক্লথ। তার ওপর ভাত-তরকারি ঢেকে রাখা। পানির জগে অর্ধেক পানি। তার পাশে সাজানো এক সার কাচের গ্লাস, উল্টে রাখা। এগুলো কোথা থেকে এল? গ্লাস-থালা-বাটি কিছুই তো প্যাকেট থেকে বের করা হয়নি। রান্নাঘরে কার্টনে এখনো সেগুলো বেঁধে রাখা।
আমি আর বিছানায় ফিরে গেলাম না। সব লাইট জ্বেলে দিয়ে সারা রাত ডাইনিং টেবিলে বসে থাকলাম।
সকালে নীলক্ষেতে যাওয়ার জন্য বের হয়ে দোতলায় মল্লিক সাহেবের বাসায় নক করলাম। কাজের মেয়েটি জানাল, সাহেব সাতসকালে আবার হাসপাতালে দৌড়েছেন।
পরের রাতে একই ঘটনা। ঘুম ভেঙে দেখি ফ্যান ঘুরছে না। কমলা আলোর আভায় সারা বাড়ি আলোকিত। পোড়া গন্ধটা আজ আরও বেড়েছে।
আজ আর আলো জ্বাললাম না। সারা বাসা ঘুরে দেখতে লাগলাম, চমকে যাওয়ার মতো কী কী অপেক্ষা করছে। আসবাব এবং অন্য জিনিসপত্র যে তাদের অবস্থান আবারও বদল করেছে, সেটা বোঝা গেল। পাশাপাশি আরেকটা নতুন জিনিস চোখে পড়ল: আমাদের নিজেদের আসবাবের পাশাপাশি এমন আরও কিছু আসবাব এখানে আছে, যেগুলো আমাদের নয়। আর এই আসবাবগুলো শুধু রাতের বেলাতেই হাজির হচ্ছে, যখন আলো নেভানো থাকছে আর কমলা আলোয় বাসাটা ভরে যাচ্ছে। বৈদ্যুতিক আলো জ্বাললে এগুলো থাকছে না।
এ মুহূর্তে আমি একটা আস্ত ডিনার ওয়াগন দেখতে পাচ্ছি দক্ষিণ দেয়ালে ঠেস দেওয়া। আমাদের কোনো ডিনার ওয়াগন নেই। ফলে সেটার ভেতরের কোনো বাসনকোসন আমাদের নয়। আমি বাসনগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতে থাকলাম। কিছু চায়নিজ টি-পট আমি হাতে তুলে নিলাম ডিনার ওয়াগনের দরজার পাল্লা খুলে। নেড়েচেড়ে দেখলাম সেগুলোর ফুলতোলা ডিজাইন। ভালো করে দেখতে হলে আলো জ্বালতে হবে। কিন্তু আমি জানি, আলো জ্বালানোমাত্র এগুলো গায়েব হয়ে যাবে।
সবচেয়ে বিস্মিত হলাম এ রকম পরিস্থিতিতে আমার নিজের প্রতিক্রিয়া দেখে। আমি প্রবল ভিতু মানুষ। অথচ সামান্য গা–ছমছম শিরশিরে অনুভূতি ছাড়া আমার মধ্যে কোনো তীব্র ভয় বা দম বন্ধ করা আতঙ্ক তৈরি হলো না। যেন এসব আমার নিজের জীবনে ঘটছে না। আমার অভিজ্ঞতার সীমানার বাইরে এগুলো ঘটছে। যেন আমি সিনেমা হলের আসনে বসে কোনো ভয়ের সিনেমা দেখছি। আরও অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এই বিদঘুটে ব্যাখ্যাহীন ঘটনাগুলো আমার মধ্যে আতঙ্কের চেয়ে কৌতূহলই যেন বেশি তৈরি করছে। কারণ টের পাচ্ছি, প্রতিদিনই নতুন কিছু অপেক্ষা করছে আমার জন্য। কেউ যেন আমাকে একটু একটু করে ভাঁজ খুলে খুলে একটা নকশাদার পোশাক দেখাচ্ছে, যেভাবে দোকানদার জামদানি শাড়ি দেখায়।
ফলে তৃতীয় ও চতুর্থ দিন সিঁড়িতে ও সামনের রাস্তায় যখন মল্লিক সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো এবং তিনি আমাকে ‘সব ঠিকঠাক তো?’ জিজ্ঞেস করলেন, আমি নিজেকে অবাক করে মৃদু স্বরে বললাম, ‘হ্যাঁ। সব ঠিক আছে।’ আমার মনে হলো, তিনি যেন আরও কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
পঞ্চম রাতে আমি সব আলো জ্বালিয়ে রেখে ঘুমাতে গেলাম। ঘুম ভাঙল সেই একই কমলা আলোর আভায়। কেউ সুইচগুলো সব নিভিয়ে দিয়েছে। আমি জানতাম তা–ই ঘটবে। ঘর থেকে বেরিয়ে আমি ড্রয়িংরুমে এমন একটা সোফায় বসলাম, যেটা আমাদের নয় এবং যেটা আলো না জ্বালানো পর্যন্ত অস্তিত্বশীল থাকবে। আজ দেখি এক কোনায় একটা চুপসানো ফুটবল পড়ে আছে। বসার ঘরে দেয়ালে একটা টেলিভিশন। সেটাও আমাদের নয়। আমাদের টেলিভিশনটা বাবার ঘরে। উনি সেটায় বাংলা সিরিয়াল আর ক্রিকেট দেখেন।
আমি উঠে গিয়ে পশ্চিম দেয়ালের সেই বন্ধ জানালাটার সামনে দাঁড়ালাম, যেটা সেখানে থাকার কথা নয়। তৃতীয় রাত থেকে এটা এখানে আছে। তিন পাল্লার কাঠের জানালা। আমি ছিটকিনি তুলে পাল্লা খুলে দিলাম। বাইরেও চরাচরজুড়ে সেই একই কমলা আলো। এখান থেকে রাস্তার একটা অংশ দেখা যায়।
সকালবেলা নাশতা খেতে খেতে বাবাকে বললাম, ‘তুমি আমাকে উপনিষদের একটা শ্লোক বলেছিলে অনেক দিন আগে। সেটা কি আরেকবার বলবে?’
বাবা বললেন, ‘কোনটা?’
‘সেই যেটায় ন হন্যতে কথাটা আছে।’
‘ও আচ্ছা। অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরানো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। এটা?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘গীতার শ্লোক।’
‘মানে কী?’
‘মানে হলো, আত্মা চিরন্তন, শাশ্বত এবং পুরাতন। শরীরের মৃত্যু হলেও আত্মার মৃত্যু হয় না। ন হন্যতে মানে হলো হত হয় না, অর্থাৎ নিহত হয় না।’
‘তো নিহত না হলে আত্মার কী হয় তাহলে?’
‘পুনর্জন্ম হয়। আত্মা ফিরে ফিরে আসে।’
আমার তখন মাহবুবের কথা মনে পড়ল। সে–ও প্রায় একই কথা বলত। বার্দোর কথা। এক জন্ম থেকে আরেক জন্মে যাওয়ার আগে, এক দেহ থেকে আরেক দেহে প্রবেশের মাঝখানে আত্মার ওয়েটিং রুম। মাহবুব গল্প-উপন্যাস লেখার চেষ্টা করত। এখন ইতালিতে থাকে। ফুটপাতে চামড়ার মানিব্যাগ, চাবির রিং, ফ্রিজের ম্যাগনেট বিক্রি করে।
আলুভাজি দিয়ে রুটি খাওয়া শেষে বাবা হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, ‘তুই কি বাসাটা বদলাবি ভাবছিস?’
আমি অবাক হয়ে তাকালাম তাঁর দিকে।
বাবা বললেন, ‘বাসাটায় সমস্যা আছে, টের পাচ্ছি। প্রথমে ভেবেছিলাম, শুধু আমারই হচ্ছে। হ্যালুসিনেশন। বার্ধক্যের ফল। ওষুধের এফেক্ট। সেটাই ভেবেছিলাম।’
আমি বললাম, ‘তোমার ফ্ল্যাট কবে রেডি হবে?’
‘দেখি, খোঁজ নিই।’
আমি বুঝতে পারছি, চাইলেও বেশি দিন এ বাসায় থাকা যাবে না। প্রতি রাতে পোড়া গন্ধের তীব্রতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে উত্তাপ। চিটপিটে গরম লাগে। ফ্যান চালিয়েও গরম যায় না। রীতিমতো আঁচ লাগে গরমের।
ফ্ল্যাট রেডি হতে বেশি দেরি হলো না। দ্বিতীয় মাসে আমরা এই বাসা থেকে ভাসানটেকের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলাম। আবার সেই সংসার বেঁধে ট্রাকে তোলা। আমি জানি, ট্রাকে উঠছে কেবল আমাদের নিজস্ব আসবাবগুলোই। ওই চুপসানো ফুটবল কিংবা ওই চায়নিজ টি-পট উঠবে না। ওঠার কোনো উপায় নেই। সেগুলো এই বাসাতে থেকে যাবে। কতকাল? আমি জানি না।
আমাদের ভাড়া বাসার জীবন শেষ হলো। নিজস্ব ফ্ল্যাটে উঠলাম। এ এক অন্য রকম অনুভূতি।
মল্লিকদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আমি ইতালিতে মাহবুবকে ফোন দিই। হোয়াটসঅ্যাপে। সে তখন পুলিশের তাড়া খেয়ে তড়িঘড়ি ফুটপাতের দোকান গোটাচ্ছে। আমাকে বলল, ‘কী বলবি, জলদি বল।’
নীলক্ষেতে যে দোকানে আমি সেলসম্যানের কাজ করি, সেটা পাইরেটেড বই বিক্রি করে। যেসব বইপত্র জনপ্রিয় হয়, সেগুলোর নকল কপি তৈরি করে বিক্রি করা হয়। একদিন দেখি মৈত্রেয়ী দেবীর একটা উপন্যাস নকল হয়ে এসেছে। নাম ন হন্যতে। তখন বাবার বলা সেই সংস্কৃত শ্লোকটা মনে পড়ল। আর সেই সূত্রে মনে পড়ল মল্লিকদের বাড়িটার কথা। আমার মাথা এভাবেই কাজ করে। একটা কথার সূত্র ধরে সম্পর্কহীন আরেকটা কথা আসে। একটা স্মৃতির সূত্র ধরে আসে যোগসূত্রহীন আরেকটা স্মৃতি।
সেদিন বাসায় ফেরার পথে ঘুরপথে জাকির হোসেন রোডে মল্লিকদের সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। চারতলাটা এখনো খালি। আমরা চলে যাওয়ার পর আরেকটা পরিবার উঠেছিল। তারাও ছেড়ে দিয়েছে।
এখন আমার কাছে আর কোনো রহস্য নেই। এখন আমি সবই জানি। চারতলা এ বাড়ির চতুর্থ তলায় আগুন লেগেছিল। আমরা ওঠার বেশ কয়েক বছর আগে। রাতের বেলা গ্যাসের চুলা অথবা বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে আগুন। কেউ মারা যায়নি বা আহত হয়নি। কারণ, বাসায় তখন কেউ ছিল না। কোথাও দাওয়াত খেতে গিয়েছিল। পুরো বাসা পুড়ে গেছে। দরজা-জানালা কিছুই রক্ষা করা যায়নি। শুধু চারতলাটাই পুড়েছে। বাড়ির ছেলেটার ফুটবল, খেলনা সাইকেল, ডিনার ওয়াগন, টিভি-ফ্রিজ, সোফা সেট চিটপিট শব্দ করে পুড়েছে। পরে চারতলাটা রেনোভেট করা হয়। কাঠের পাল্লা আর চৌকাঠের বদলে দেওয়া হয় লোহার গ্রিল। পুড়ে যাওয়া দেয়ালের ইট বদল করা হয়।
মাহবুব বলে, মানুষের মৃত্যু হলেও তার আত্মার মৃত্যু হয় না। তারা থেকে যায় একটা মধ্যবর্তী, ত্রিশঙ্কু অবস্থায়, যেটাকে বার্দো বলে। তারপর সেখান থেকে তারা ফিরে আসে।
মল্লিকদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আমি ইতালিতে মাহবুবকে ফোন দিই। হোয়াটসঅ্যাপে। সে তখন পুলিশের তাড়া খেয়ে তড়িঘড়ি ফুটপাতের দোকান গোটাচ্ছে। আমাকে বলল, ‘কী বলবি, জলদি বল।’
আমি বলি, ‘পরে বলব।’
যে কথাটা মাহবুবকে বলতে গিয়ে বলা হলো না, তা হলো, একটা বাড়ি যদি পুড়ে গিয়েও নিঃশেষ হয়ে না যায়, যদি সেটা মাঝখানে একটা ত্রিশঙ্কু অবস্থায় থেকে যায়, আমরা কি বলতে পারব, সেটা বার্দো অবস্থায় আছে?
একটা বাড়ির কি আত্মা থাকতে পারে?