অলৌকিক রহস্যসন্ধানী শিপলুর গল্প— পাতালপুরী

বিখ্যাত অলৌকিক রহস্যসন্ধানী আর্দশির শাপুর শিপলুর এ গল্পটাও বরাবরের মতো প্রকাশিত হয়েছিল মাসিক হালচাল পত্রিকার নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের একটা সংখ্যায়। মূল কাহিনির পরে অলৌকিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া ছিল। এখানে কেবল মূল ঘটনাটা তুলে ধরা হলো।

অলংকরণ: তনি সুভংকর

আমি আর্দশির শাপুর শিপলু, বয়স ছাব্বিশ, পেশায় সাংবাদিক, নেশায় অলৌকিক রহস্যসন্ধানী। মাসিক হালচাল পত্রিকার পাঠকদের তা এত দিনে জানতে বাকি নেই নিশ্চয়ই। আমি কীভাবে কোনো রহস্যের সন্ধান পাই, সেটাও প্রতিটি প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লেখ করতে ভুলি না। বেশির ভাগ সময় আমার অফিসের ঠিকানায় চিঠি বা ফোন আসে, আবার অনেক সময় সশরীরও হাজির হয়ে যান অলৌকিক সমস্যায় ভুগতে থাকা কেউ। আবার নিজেই হুট করে গিয়ে পড়ি রহস্যের ভেতর, এমন ঘটনাও কম নয়।

গিয়েছিলাম মিটফোর্ড হাসপাতালে, একটা রোগী দেখতে। আত্মীয়ের হাতে ফলমূলের থলে ধরিয়ে দিয়ে, তাঁর রোগের বিবরণ শুনে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে যখন বেরিয়ে এলাম, তখনো সন্ধ্যা নামেনি। এমনিতে অন্যদিন পত্রিকা অফিস থেকে বেরই হই এই সময়, কিন্তু আজ কাজের চাপ ছিল না তেমন। সম্পাদক হিফজুর রহমান সাহেবের থেকে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে সমস্যা হয়নি।

লোকজনের ভিড় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে। সেটা এড়িয়ে হাসপাতালের প্রধান ভবন ঘুরে চলে এলাম পেছন দিকটায়। ঢাকা শহর বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত—মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় পড়া লাইন। শেষ বিকেলের আলোয় ঝলমল করছে বুড়িগঙ্গার পানি। কালচে, দুর্গন্ধযুক্ত; তবু মনোহারিণী।

ধাপে ধাপে বানানো পাকা ঘাটে এসে দাঁড়ালাম। সারি সারি ডিঙি ভাসছে নদীর বুকে, সঙ্গে কয়েকটা মালবাহী বড় বোট। অফিস ছুটির সময়, বহু লোক ফিরছে নদীর ওপারে নিজের বাসায়। ওপারের একতলা–দোতলা বাড়িঘর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

ব্যস্ত নগরজীবন আর নদীর পানির নাচন দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম খানিকটা। বাদানুবাদের শব্দে চমক ভাঙল। কী ভেবে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম।

ঘাটে ভেড়া একটা ডিঙি ঘটনার কেন্দ্রস্থল। টাকমাথা দাড়িওয়ালা বুড়ো মাঝি উত্তেজিতভাবে কিছু বলছে, তাকে ছাপিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে ডিঙিতে রয়ে যাওয়া একমাত্র যাত্রী, ১২-১৩ বছরের এক সদ্য কিশোর। ‘আমি কী করি, সেটা আমার ব্যাপার! আপনার কাজ নৌকা চালানো, আপনি নৌকা চালান!’

‘আর কয়বার ঘুরবা বাপজান? সইন্ধা নাইমা যাইতাছে। বাড়িত যাও। তুমার বাড়ি কনে?’ বুড়ো হাল ছাড়ার পাত্র নয়।

তর্কটা ভাড়া নিয়ে হচ্ছে না এবং সেটাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ছেলেটা—বেশ শুকনো চেহারা, একমাথা চুল, শ্যামলা চেহারা, হাফহাতা শার্ট আর হাফপ্যান্ট পরনে— বলছে, ‘ভাড়া তো দিচ্ছি। আমি নৌকায় ঘুরলে আপনার সমস্যা কী?’

যেকোনো ঝামেলায় নাক গলানো সাংবাদিকদের কাজ। আমিও তা–ই করলাম। কাছে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বললাম, ‘কী হইছে চাচা?’

একজন সম্ভাব্য সমর্থক পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে বুড়ো মাঝি বলতে শুরু করল, ‘দেহেন বাবাজি...এই পুলাটা দুই ঘণ্টা ধইরা আমার নৌকায় খালি এপার–ওপার করতাছে। নামেও না, কিছু না। বাড়িও যাইব না। বাড়ি থাইকা পালাইছে মনে অয়। অর ভালোর লাইগা কইতাছি বাড়ি যাইতে।’

আমি কিছু বলার আগেই গোঁয়ারের মতো বলল ছেলেটা, ‘আমি নামব না।’

মাথা ওপর–নিচ করল রুকু। ‘কিন্তু...আমার কথা বিশ্বাস হবে না আপনার। ভাববেন, বাসায় না ফেরার জন্য বানিয়ে বলছি।’

‘কেন ভাইয়া?’ নরম গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি। বাড়ি পালিয়েছে—এই অভিযোগের বিরুদ্ধে যে সে কিছু বলেনি, তা নজর এড়ায়নি আমার।

সরাসরি আমার দিকে তাকাল ছেলেটা। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, কিন্তু কালি পড়েছে নিচে। বলল, ‘প্রথম কারণ, আমার বাড়ি এই পারে না। ওই পারে।’

***

নদীর ওপাড় মানেই কেরানীগঞ্জ। সেখানকার একটা হোটেলে ছেলেটার উল্টো দিকে বসে আছি আমি। ছেলেটা—যে তার নাম বলেছে রুকু—গোগ্রাসে গিলছে মোগলাই পরোটা। আমি চায়ে চুমুক দিচ্ছি।

আমার সব সময়ের সঙ্গী মোটরবাইকটা সঙ্গেই ছিল, হাসপাতালের পার্কিংয়ে। সেটায় চড়ে বুড়িগঙ্গার ওপরে সদ্য নির্মিত বাবুবাজার ব্রিজ পেরিয়ে কেরানীগঞ্জ চলে এসেছি রুকুকে পেছনে বসিয়ে। ছেলেটার খিদে লেগেছে, সেটা শুকিয়ে যাওয়া মুখ দেখলেই বোঝা যায়, তাই ওকে চটজলদি কিছু খাওয়ানোর ব্যবস্থা।

রুকুর সঙ্গে টুকটাক কিছু কথা হয়েছে আমার। নিজের পরিচয় দিয়েছি, আইডি কার্ডও দেখিয়েছি; না হলে সে অপরিচিত কারও মোটরবাইকে চড়বে কেন? বয়সের তুলনায় পরিপক্ব ছেলেটার বুঝতে বিলম্ব হয়নি যে আমি ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি।

খাওয়া প্রায় শেষ রুকুর। ঢকঢক করে পানি খেল এক গ্লাস। আমি কিছু বলছি না, জানি সময় হলে নিজেই মুখ খুলবে সে।

হলোও তা–ই। মুখ মুছে রুকু বলল, ‘শিপলু ভাইয়া, ঘাটের মাঝির দোষ ছিল না। সে ঠিকই ধরেছে, আমি বাড়ি ফিরতে চাইছি না। এটাকে বাড়ি থেকে পালানো বলা যেতে পারে।’

বেশ গোছানো কথাবার্তা। আমি কোনো মন্তব্য না করে সহানুভূতি মাখানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

‘আমরা এদিকে নতুন। আমাদের গ্রামের বাড়ি বরিশাল, বাবার চাকরিসূত্রে ঢাকায় থাকি। একটা সরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন বাবা। আমার জন্ম ঢাকার মিরপুরে, ছোটবেলা থেকে সেখানেই মানুষ। কিছুদিন আগে বাবার বদলি হয় কেরানীগঞ্জের শাখায়। সপরিবার এখানে চলে আসি আমরা। নতুন একটা বাসায় উঠি...’

বলতে বলতে বুজে গেল রুকুর কণ্ঠ। চেহারা ফ্যাকাশে। কাঁপা হাতে পানি খেল আরেক গ্লাস।

‘তোমার সমস্যাটা নিশ্চয়ই নতুন বাসাসংক্রান্ত?’ নরম কণ্ঠে বললাম আমি।

মাথা ওপর–নিচ করল রুকু। ‘কিন্তু...আমার কথা বিশ্বাস হবে না আপনার। ভাববেন, বাসায় না ফেরার জন্য বানিয়ে বলছি।’

‘তোমাকে তো বলেইছি, রুকু, বাস্তবের বাইরের জগতের সঙ্গে আমার কারবার। তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পারো।’ চায়ের কাপটা শেষ করে নামিয়ে রাখলাম আমি।

রুকু যা বলল, সেটা ওর জবানিতেই তুলে দিচ্ছি।

আরও পড়ুন

***

নতুন এলাকায় এসেছি দিন সাতেক হয়েছে। সত্যি বলতে কি, ভীষণ মন খারাপ ছিল আসার সময়।

শুধু যে মিরপুরের বাসা আর পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে আসতে হয়েছে, তা নয়; সেখানকার স্কুল আর বন্ধুদেরও ছেড়ে এসেছি আমি। বাবা–মা অবশ্য অনেক সান্ত্বনা দিয়েছেন, ‘সরকারি চাকরিটাই এমন রে! দেশের এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ানো। তা–ও তো আমরা ঢাকাতেই আছি, হোক শহরের বাইরে। এখানেও ভালো স্কুল আছে। দেখিস, নতুন বন্ধু হয়ে যেতে সময় লাগবে না। আর এখানকার পরিবেশ খোলামেলা, খেলাধুলা করতে পারবি অনেক।’

মিরপুর থেকে সব গুছিয়ে নিয়ে ট্রাকে করে এখানকার বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা গড়িয়েছে সেদিন। সপ্তাহখানেক আগের কথা বলছি। নতুন বাসায় জিনিসপত্র গোছগাছ করা হচ্ছে, মা–বাবা আর কুলি–মজুরদের হাঁকডাকে বাড়ি সরগরম

আপনি তো কেরানীগঞ্জের এদিকটা চেনেনই, শিপলু ভাইয়া, আপনাকে আর কী বলব। বুড়িগঙ্গার তীরটা ঘিঞ্জি, কিন্তু সেটা ছাড়িয়ে এলেই শহরের কোলাহল দূরে হারিয়ে যায়। ঘিঞ্জি কেরানীগঞ্জের শেষ মাথায় আমাদের নতুন ভাড়া বাড়িটা, এরপরই ছোট ছোট বাড়িঘর, বাগান, খেলার মাঠ, একটা–দুটো খেত। প্রচুর জমি পতিত, সেগুলোতে গাছপালা আর বাঁশঝাড়। স্কুল থেকে ফিরে মাঠে চলে যাই খেলতে, নাহয় একা একা ঘুরে বেড়াই এদিক–সেদিক।

ভালো লাগেনি যে জিনিসটা, সেটা আমাদের নতুন বাড়ি।

আমাদের কাছে নতুন হলেও বাড়িটা আসলে বেশ পুরোনো। চুন–সুরকির বাড়ি, নির্ঘাত ব্রিটিশ আমলের। বাবাও তেমনটা বললেন। গাছপালার আড়ালে লুকানো বাড়িটার উঠানে দিনের বেলায়ও রোদ পড়ে না। টালির ছাদ। গায়ের পলেস্তারা এখানে–ওখানে খসে পড়েছে।

মা মৃদু আপত্তি করেছিলেন, এমন পুরোনো বাড়ি কেন ভাড়া করতে গেলেন বাবা! পাশের বাসার একজন এসে ইতিমধ্যেই আকার-ইঙ্গিতে বলেছে, বাসাটায় কী যেন সমস্যা, কেউ বেশি দিন থাকতে পারে না। তবু সবাই চনমনে। আসল কারণটা কিন্তু আমি জানি, ওনারা আমার সামনে না বললেও মিরপুরের ফ্ল্যাটবাড়ির কোলাহলে হাঁপিয়ে গিয়েছিলেন ওনারা আসলে। এখানে একটু খোলামেলা পেয়ে বাবা–মায়ের মুখেও চাপা হাসি, আর আমার ছোট ভাই রিংকু তো ছোটাছুটি করে কূল পাচ্ছিল না, আনন্দে আটখানা। আমার বড় বোন রুনা আপু এসএসসি পাস করে বড়দের দলে যোগ দেওয়ার পর বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে, কথাটথা অত বলে না, কিন্তু ওরও যে পছন্দ হয়েছে, সেটা মুচকি হাসিতেই পরিষ্কার।

কিন্তু প্রথম দিনই তলকুঠুরিটা দেখে ফেলার পরে আমার আর ভালো লাগেনি বাড়িটাকে।

মিরপুর থেকে সব গুছিয়ে নিয়ে ট্রাকে করে এখানকার বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা গড়িয়েছে সেদিন। সপ্তাহখানেক আগের কথা বলছি। নতুন বাসায় জিনিসপত্র গোছগাছ করা হচ্ছে, মা–বাবা আর কুলি–মজুরদের হাঁকডাকে বাড়ি সরগরম, আর আমি এই ফাঁকে হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম এদিক-ওদিক। আমার একটা ছোট বুকশেলফ আছে, তিন গোয়েন্দা আর ফেলুদার বইয়ে ভর্তি, সেটা কোথায় রাখব, সেটাই খুঁজছিলাম। পছন্দসই জায়গা মিলছিল না। রান্নাঘরের পাশের দরজাটা ভাঁড়ার ঘর ভেবে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম, কী মনে হতে হাত বাড়িয়ে ঠেলা দিলাম পাল্লায়। দেখি, এক সারি সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে হারিয়ে গেছে অন্ধকারে।

তলকুঠুরি! বেজমেন্ট! চনমনিয়ে উঠলাম আমি। মাটির নিচের এই ঘর বাংলাদেশে কমই দেখা যায়। বাইরের দেশের বেশির ভাগ বাসার নিচেই অবশ্য থাকে এই জিনিস, বাড়তি জিনিস রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়—বইয়ে পড়েছি। এখানে কী রেখেছে? এই বাড়ি বানিয়েছে যে ব্রিটিশ, সে কী রাখত?

হাতড়ে দেখলাম, কোনো লাইটের সুইচ দেখা যাচ্ছে না। দ্বিধা করলাম একমুহূর্ত। নিচে কি যাব? যাওয়া উচিত?

এসব কঠিন ভাবনা নিয়ে বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করলাম না অবশ্য। যেসব মালপত্র খোলা হয়েছে, ভাগ্যক্রমে সেগুলোর মধ্যে পাওয়া গেল আমাদের টর্চটা। সেটা নিয়ে আবার তলকুঠুরির দরজায় হাজির হতে সময় লাগল না।

টর্চের আলোয় দেখলাম, সিঁড়ির ধাপ নিচে নামছে তো নামছেই। মেঝে দেখা যাচ্ছে না।

ফিরে যাওয়া দরকার, মনের ভেতরে বলে উঠল কে যেন। ফেরার জন্য ঘুরতামও হয়তো, কিন্তু সিঁড়ি শেষ হয়ে গেছে সামনে। একটা অন্ধকার ঘরের ফোকর হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে।

কখন সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়েছি, আর কখন এক এক ধাপ করে নামতে শুরু করেছি, নিজেও জানি না। দরজাটা নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে পেছনে, যেন একটা অদৃশ্য হাত বুজিয়ে দিয়েছে পাল্লা, সেটাও যেন খেয়াল করলাম না। ভেতরে অসম্ভব নিস্তব্ধতা, যেন বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। নিজের পায়ের শব্দ নিজের কানেই বড় বেশি হয়ে বাজছে।

কতগুলো ধাপ নেমেছিলাম, খেয়াল নেই। সংবিৎ ফিরল ঠান্ডায়। হাত–পা যেন জমে যাচ্ছে। চুন-সুরকির নয়, পাথরের দেয়াল এখন আমার চারপাশে। স্যাঁতসেঁতে, ভেজা। নিশ্চয়ই মাটির অনেকটা নিচে আমি এখন।

ফিরে যাওয়া দরকার, মনের ভেতরে বলে উঠল কে যেন। ফেরার জন্য ঘুরতামও হয়তো, কিন্তু সিঁড়ি শেষ হয়ে গেছে সামনে। একটা অন্ধকার ঘরের ফোকর হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে।

ঘরটা ছোট। একটা বাথরুমের চেয়ে সামান্য বড় হবে। ফাঁকা, কিছুই নেই। দেয়ালের পাথরে বেশ কয়েকটা ফোকর ছাড়া দেখার আর কিছু নেই। এই ঘর কেনই–বা বানানো হয়েছে, মাটির এত নিচে কেন, সেটা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না। মেঝের ধুলোমাটিতে কী যেন একটা চকচক করে উঠেছে। ঝুঁকে দেখি, বোতলের ভাঙা কাচ। এডগার অ্যালান পোর ‘আমান্টিলেডোর পিপে’ গল্প মনে পড়ে গেল। এটা আসলে ছিল ওয়াইন সেলার, পানীয়র বোতল ঠান্ডা রাখতে ব্যবহার করা হতো।

হুট করে কী যেন হলো, জানি না শিপলু ভাইয়া—একটা অজানা আতঙ্ক প্রাণপণে গ্রাস করতে শুরু করল আমাকে। কোনো শব্দ পাইনি, কোনো ছায়াও দেখিনি...তবু কেন ও রকম পাগল হয়ে গেলাম ভয়ে, জানি না। মনে হলো, পুরো ঘরটা যেন একটা জীবন্ত প্রাণী, সব কটি দেয়ালে যেন সারি সারি চোখ, আমার দিকে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ চোখে। কুটিল হাসি হাসছে, আমাকে বাগে পাওয়ার হাসি। এই যে, এখনই গ্রাস করবে আমাকে চিরদিনের মতো।

পা যেন গেঁথে গেছে মাটিতে, তবু কোনোমতে ছুটতে শুরু করলাম সিঁড়ি বেয়ে ওপরে।

পথ যেন শেষই হয় না। একসময় হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে, দরজা ঠেলে। হাঁপাতে শুরু করেছি, কপালে ঘাম ফুটেছে। বাবা-মা দেখে ফেললে নির্ঘাত বকা খাব, তাই তলকুঠুরির সিঁড়ির দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিয়ে কেবল টর্চটা পকেটে পুরেছি, দেখি মা কয়েকটা চিনামাটির পাত্র হাতে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে ফেললেন তিনি।

‘রুকু! কোথায় গেছিলি? হাঁটতে? ঘেমে তো শেষ হয়ে গেছিস। তা বাইরে যাবি ভালো কথা, আমাদের বলবি তো? ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল, কোনো সাড়া নেই। রাত হয়ে গেছে।’

আবার রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন বলে আমার চেহারার বিস্ময়টা দেখতে পেলেন না মা। কী বললেন, ঘণ্টাখানেক পার হয়েছে? মানে কী?

আরও পড়ুন

এটাই যদি সবচেয়ে ভয়ের ঘটনা হতো, তাহলে আমি বাড়ি থেকে পালাতাম না, শিপলু ভাইয়া। আমি দ্বিতীয়বারের মতো আতঙ্কে জমে গেছি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।

চেহারা আমার মায়ের মতো, কথার ভঙ্গিও, শাড়িটাও। কিন্তু কিছুই পুরোপুরি মিলছে না। আমার মায়ের চেহারাটা যেন নকল করার চেষ্টা করেছে কেউ, কিন্তু পুরোপুরি পারেনি। মেকি একটা পুতুলের মতো মানুষের দিকে তাকিয়ে আছি আমি, যে আমার মা নয়, হতেই পারে না। আর ওই চোখ, ওই জ্বলজ্বলে আগুনের মতো চোখ!

আতঙ্কে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলাম ওই ঘর থেকে। আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়তাম বাবার ওপর। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে যাব মায়ের মতো দেখতে জিনিসটার ব্যাপারে, কিন্তু বলতে পারলাম না একটা শব্দও। কারণ, বাবার চেহারার দিকে চোখ পড়েছে তখন আমার।

বাবার মতো দেখতে খানিকটা, কিন্তু ওটা বাবা নয়। কাপড়ের দোকানে সাজিয়ে রাখা পুতুলের যেমন একটা মেকি চেহারা হয়, প্লাস্টিকের ছাঁচে ঢেলে বানানো, তেমন দেখাচ্ছে ওনাকে। কেউ যেন মোম ঢেলে বানিয়েছে চেহারাটা। আর সেই গনগনে আগুনের মতো চোখ! রক্ত হিম করে দেওয়া।

‘কোথায় গেছিলে, রুকু?’ আমার বাবার চেহারার আশি ভাগ নকল করতে পারা জিনিসটা বলল। ‘তলকুঠুরিতে? যাও যাও, আবার যাও। খুব সুন্দর জায়গা না?’

দিগ্‌বিদিক জ্ঞান হারিয়ে বাড়ি থেকে ছুটে বেরোনোর সময় বারান্দার দোলনায় চোখ পড়ল। রুনা আপু আর ছোট ভাই রিংকু বসে আছে। দোল খাচ্ছে না—যেন দুটো পুতুল বসে আছে। চেহারাও সে রকমই, পুতুলের মতো, মেকি। খালি চোখজোড়া বাদে।

ছুটতে ছুটতে হয়তো ঢাকা শহরেই চলে আসতাম, কিন্তু উঠোন পেরিয়ে বেরোনোর আগেই কার সঙ্গে যেন বেমক্কা ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। কোনোমতে সামলে নিলাম। লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি, জিনিসপত্র সাজানোয় সাহায্য করা মজদুরদের একজন। আমাদের সঙ্গে ট্রাকে করে এসেছে।

‘কী হইছে বাবু?’ লোকটা অবাক হয়ে বলল। ‘দৌড়াইতেছ কেন আচানক?’

‘এই রুকু? কী হলো?’ পেছন থেকে একটা উদ্বেগমাখা চেনা স্বর ভেসে এল।

ঘুরে দেখি, বাবা-মা, রুনা আপু আর রিংকু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আরেকবার ছোটার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, কিন্তু ততক্ষণে তাদের চেহারার দিকে নজর পড়েছে আমার। কোথায় সেই হাড়হিম করা অশুভ কৃত্রিম আদল, কোথায় সেই জ্বলন্ত চোখ! আমার চিরচেনা পরিবার দাঁড়িয়ে আছে, চিন্তিত।

বাবা–মায়ের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি, দরজা বন্ধ। ফ্যান চলার শব্দ আসছে। ঘুমিয়ে পড়েছেন ওনারা। তলকুঠুরিতে সবাই মিলে নেমে আমাকে ডাকার প্রশ্নই আসে না।

সেদিন কোনোমতে সামাল দিয়েছিলাম পরিস্থিতি। বাসার ভেতরে বেশ ভয় ভয় করছিল, কিন্তু ভাগ্যিস আর কোনো উল্টোপাল্টা ঘটনা ঘটেনি। রাতটা কেটে গেছিল নির্বিঘ্নে।

পরের সকালটা স্বাভাবিক। আমি কিন্তু প্রচুর মাথা ঘামিয়েছি সেদিন, কী দেখেছি তা নিয়ে। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তে এসেছিলাম, পুরো জিনিসটাই চোখের ধাঁধা। তলকুঠুরিতে ওঠানামা করার ক্লান্তিতেই বোধ হয়, ভুলভাল দেখেছি আমি।

পরের দিনটা ভালোই কাটল। বাসার আশপাশে ঘুরে দেখলাম, নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে এলাম বাবার সঙ্গে, জিনিসপত্র গোছানোয় সাহায্য করলাম। রুনা আপুর সঙ্গে সাপলুডু খেললাম। সবকিছু স্বাভাবিক—সেদিন রাতের আগপর্যন্ত।

নতুন ঘরে শুয়েছি। একা ঘরে একাই একটা বিছানায়। রুনা আপুর ঘর আলাদা, আর রিংকু এখনো বাবা–মায়ের সঙ্গে ঘুমায়। একটা বই শেষ করে শুধু মশারি খাটিয়েছি, তখন কানে এল ডাকটা। মা ডাকছেন আবছা গলায়।

পরের দিন নতুন স্কুলে প্রথম ক্লাস। ভাবলাম, সেটা নিয়েই হয়তো কিছু বলবেন। ‘আসছি’ বলে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।

আবার কানে এল ডাকটা। ‘রুকু...রুকু...’ এবার ডাকছেন বাবা।

এগিয়ে গেলাম শব্দটার দিকে। কয়েক পা এগিয়ে থমকে গেলাম। ততক্ষণে খেয়াল করেছি, ডাকটা আসছে তলকুঠুরির দিক থেকে।

কোনো ভুল নেই। তলকুঠুরির দরজা বন্ধ, সেটার আড়াল থেকে এবার শোনা যাচ্ছে রুনা আপুর গলা, ‘রুকু...নেমে আয় নিচে...’

‘ভাইয়া...’ ডাকছে রিংকুও। আমার পুরো পরিবার তলকুঠুরিতে!

এক পা এক পা করে পিছিয়ে এলাম। কোনোমতে কাঁপা গলায় বললাম, ‘তোমরা আসল নও। তোমরা আসল নও—চুপ করো!’

‘কী বলছিস, রুকু? ঘুমাসনি এখনো?’ বিরক্ত একটা কণ্ঠ ভেসে এল। ঘুরে দেখি, রুনা আপু। ওর ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাবা–মায়ের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি, দরজা বন্ধ। ফ্যান চলার শব্দ আসছে। ঘুমিয়ে পড়েছেন ওনারা। তলকুঠুরিতে সবাই মিলে নেমে আমাকে ডাকার প্রশ্নই আসে না।

***

‘সেদিন থেকে এমন ঘটনা ঘটছেই প্রতিদিন। আমার কথা কেউই বিশ্বাস করছে না, হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে। বেশি বলারও সাহস পাচ্ছি না, কারণ ওনারা হয়তো ধরে নেবেন আমার মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু ওই অভিশপ্ত বাড়িতে টিকতে পারছি না, শিপলু ভাইয়া। প্রতিদিন রাতেই অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে ওখানে, অবশ্য দিনের বেলা সব ঠিকঠাক। আরও আশ্চর্য ব্যাপার কি জানেন—রাতে স্বপ্নের মধ্যে তলকুঠুরিটা ডাকছে আমাকে। বলছে, কোনো ভয় নেই। আয়, আমার ভেতরে এসে ঢোক। কী ভয়ংকর, চিন্তা করতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। প্রতিটা রাতেই ওই স্বপ্ন!...আমার পক্ষে ওখানে থাকা সম্ভব নয়। অশুভ কোনো অস্তিত্ব আছে ওই তলকুঠুরিতে, আমি নিশ্চিত। ওটাই সব নষ্টের গোড়া।...কী করব বুঝতে না পেরে ফেরিঘাটে এসে নৌকায় বসে ছিলাম। আমার এক দূরসম্পর্কের খালা পুরান ঢাকায় থাকেন, আর কোনো আত্মীয় নেই। খালু এদিকেই কোথাও চাকরি করেন। ওনার দেখা পাওয়ার আশাতেই বসে ছিলাম নৌকায়। বাকিটা তো আপনি দেখলেনই।’

আমার মোটরসাইকেলের পেছনে বসে বলছে রুকু। মোটরসাইকেল চালাচ্ছি আমি ধীরে, এগোচ্ছি রুকুদের বাসার দিকে। সূর্য দিগন্তে বিলীন, পশ্চিম আকাশে আবিরের ছটা। সন্ধ্যা নামছে।

‘মনে হয়—’ বলতে শুরু করেছিলাম কেবল, কিন্তু তার আগেই আবছা আওয়াজটা কানে এসেছে আমার। কে যেন ডাকছে। বাড়ির অনেক ভেতর থেকে আসছে কণ্ঠটা, প্রায় শোনা যায় কি যায় না।

রুকু প্রথমে যেতেই চাচ্ছিল না ওর বাসার দিকে। আমি বাধ্য হয়ে জোরাজুরি করছিলাম। বুঝতে পারছি অলৌকিক কিছু ঘটছে ওখানে, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা তলিয়ে না দেখলে কিছু বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আর তা ছাড়া সবার আগে ওর বাবা–মায়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার। ওর বাবা-মার প্রসঙ্গেই শেষমেশ রাজি হয়েছে সে। নিজে তো পালিয়ে এসেছে, কিন্তু ওর পরিবার কী করছে সেই ভয়ংকর বাড়িতে? তাদের ভালোর জন্যই আমার সঙ্গে রওনা হয়েছে রুকু।

একটা বাজার পেরিয়ে আসতেই পাতলা হতে শুরু করল বাড়িঘর। এক-দুটো ফাঁকা মাঠ আর খেত দেখা যাচ্ছে। গাছপালার ঘনত্ব বেড়েছে। রুকু আঙুল তুলে দেখাল কোন দিকে যেতে হবে। চারপাশে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, তার মাঝখানে গাছের আড়ালে প্রায় লুকোনো একটা চুন-সুরকির পুরোনো বাড়ি। সেদিকে মোটরসাইকেল ঘোরালাম আমি।

‘লাইট জ্বলছে ভেতরে,’ বাড়ির লোহার গেটের সামনে ব্রেক কষতে কষতে বললাম আমি। চুপ করে রয়েছি এখন দুজনেই। অস্বাভাবিক রকম নিস্তব্ধ এদিকটা। আশ্চর্য, বেশ অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দ শুনে কেউ বেরোয়নি বাইরে।

‘আ-আমাদের কি ভেতরে যাওয়া উচিত?’ কাঁপা গলায় বলল রুকু। এটুকু বলতেই যে কী পরিমাণ সাহসের দরকার হয়েছে ওর, সেটা আঁচ করতে পারছি।

‘হ্যাঁ, কিন্তু সেটা করতে হবে সাবধানে।’ মোটরবাইকটা এক পাশে পার্ক করে রাখতে রাখতে বললাম আমি। ‘বিদঘুটে কিছু দেখলেই বেরিয়ে আসব।’

ঠেলা দিতেই খুলে গেল লোহার গেটটা। প্রাচীরঘেরা গাছে-ছাওয়া উঠানের কোনায় কোনায় জমাট অন্ধকার। অবশ্য বাড়িটাকে দেখে খুব অশুভ কিছু মনে হচ্ছে না আমার কাছে। বারান্দার বাতি জ্বলছে, সবকিছু স্বাভাবিক।

রুকু শক্ত করে আমার একটা কবজি ধরে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। জানি না কতটুকু আশ্বস্ত করতে পারলাম ওকে।

‘বাড়িটা না নেওয়ার ব্যাপারে প্রতিবেশীরা সাবধান করেছিল, বলেছিলে না?’ রুকুকে জিজ্ঞেস করলাম আমি। আসলে কথায় ব্যস্ত রাখতে চাইছি ওকে।

আরও পড়ুন

‘আমি ঠিকমতো শুনিনি, কেবল দু-একটা কথা মনে আছে। প্রথম যে সাহেব এই বাড়িটা করেছিলেন, তিনি এখানেই মারা যান—কিন্তু সেটা সম্ভবত বয়সের কারণে, রিটায়ার করেছিলেন আগেই। পরে স্থানীয় একজনের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। তার পর থেকে কেউই আর বেশি দিন থাকতে পারেনি এখানে, কিন্তু কেন থাকতে পারেনি সেটা কেউ জানে না। বেশির ভাগ সময় খালিই পড়ে ছিল বাড়িটা। এলাকার মানুষও ভাসা-ভাসা জানে, বেশি না।’ রুকু বলল।

আমরা বারান্দায় উঠে এসেছি। রুকু কোনোমতে ডাকল দুবার, ‘বাবা! মা! রুনা আপু!’

কেউ বেরিয়ে এল না বাইরে।

‘মনে হয়—’ বলতে শুরু করেছিলাম কেবল, কিন্তু তার আগেই আবছা আওয়াজটা কানে এসেছে আমার। কে যেন ডাকছে। বাড়ির অনেক ভেতর থেকে আসছে কণ্ঠটা, প্রায় শোনা যায় কি যায় না।

আমি কিছু বলার আগেই রুকু প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল, ‘মা! কোথায় তোমরা?’

সব চুপচাপ। তারপর, আবার শোনা গেল মৃদু কণ্ঠ, ‘বাবা রুকু...’

‘রুকু, ওনারা বাইরে আসছেন না কেন?’ একটা সন্দেহ ঢুকতে শুরু করেছে আমার মনের ভেতর।

আমার কথা খেয়ালই করল না রুকু। ‘কোথায় তোমরা?’ বলে চেঁচিয়ে উঠে দরজা পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে শুরু করল সে।

আমি হাত বাড়ানোর সময়ও পেলাম না। বসার ঘরে ঢুকে পড়েছে রুকু, এদিক-ওদিক চাইছে ডাকতে ডাকতে। বাধ্য হয়ে পিছু নিলাম আমি।

‘রুকু...এদিকে এসো তো বাবা চট করে...’ এবার শোনা গেল একটা পুরুষকণ্ঠ। রুকুর বাবাই হবেন। অবাক কাণ্ড, এই কণ্ঠটা আসছে নারীকণ্ঠের ঠিক বিপরীত দিক থেকে। এবারে চট করে সেদিকে ঘুরল রুকু। ‘বাবা! কোথায় তোমরা? বেরিয়ে এসো না!’

আরেকটা নারীকণ্ঠ এবার আরেক দিক থেকে বলল, ‘রুকু....আমার ঘরে আয় তো একটু...অঙ্ক বুঝিয়ে দিই...’

‘রুনা আপু! দেখো, কাকে এনেছি সঙ্গে করে। এই বাড়িটা ভালো না আপু...বেজমেন্টটায় কোনো একটা সমস্যা আছে। আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না, শিপলু ভাইয়া পারবে। কই...’ বলতে বলতে নতুন কণ্ঠটার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল রুকু।

এবারে খপ করে ওর একটা হাত চেপে ধরলাম আমি।

আরও পড়ুন

রুকুর চোখে অপার বিস্ময়। ‘কী হলো ভাইয়া? হাত ছাড়ুন। সারা দিন বাসায় ছিলাম না, সবাই চিন্তা করছে।’

‘চলো। বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের এখনই।’ চাপা গলায় বললাম আমি।

‘কী বলছেন আপনি, ভাইয়া? আমার পরিবারের সবাই বাড়ি আছেন...চলুন, তাদের সঙ্গে কথা বলি আগে।’

আমাকে কোনো উত্তর দিতে হলো না। কড়াৎ করে কান ফাটানো একটা শব্দ হলো—বাড়িটার সব দরজা-জানালার পাল্লা একসঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে। জিনিসটা বুঝতেই যতক্ষণ। সব কটা বাতি নিভে গিয়ে বাড়িটা কালিগোলা অন্ধকারে ডুবে গেল।

একটা শিশুকণ্ঠের খিলখিলে হাসি যেন ভেঙে খানখান করে দিল সেই জমাট অন্ধকার। চারপাশের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলছে হাসিটা, যেন এক হাজার বাচ্চা ঘিরে ধরেছে আমাদের।

‘র-রিংকু! ওভাবে হাসছিস কেন—’ প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা রুকুর।

‘ওটা রিংকু নয়। ওরা কেউই তোমার পরিবারের নয়।’ রুকুর পরিবারের বাকিদের কী হয়েছে, সেটা ভাবতে চাইছি না আমি। এখন নিজেদের বাঁচানোর সময়। ‘এদিকে এসো, রুকু।’

‘দরজাটা কোন দিকে?’

‘দরজা দিয়ে বেরোতে পারব না হাজার চেষ্টা করলেও। সময় নষ্ট হবে কেবল।’ আমার পকেটে একটা ছোট টর্চ থাকে সব সময়, সেটা বের করে জ্বাললাম আমি। ‘ওটা কোন দিকে, রুকু?’

‘কো-কোনটা?’

‘তলকুঠুরিটা।’ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছি আমি। প্রতিটা মুহূর্ত এখন দামি। বেশি দেরি করলে আমরাও ওদের মতো হয়ে যাব। পুতুলমুখো, আঁধারে লুকিয়ে ডাকতে থাকা কোনো অশরীরী অস্তিত্ব।

‘আমাদের রাতটা এখানে কাটাতে হবে, রুকু। তোমার কাহিনি শুনে বুঝেছি, অশুভ ঘটনাগুলো এই বাড়িতে শুধু রাতেই ঘটে। সকালে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারব আমরা।’

‘শিপলু ভাইয়া! কী বলছেন আপনি! ওই তলকুঠুরি—ওই বেজমেন্টই তো সবকিছুর মূলে। ওটার খোঁজ করছেন কেন?’ রুকুর চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া।

কোনো কিছু বোঝানোর সময় নেই। ‘আমার ওপরে বিশ্বাস রাখো, রুকু।’ ওর কবজি এক হাতে আর অন্য হাতে টর্চটা ধরে এদিক-ওদিক ক্ষীণ রশ্মি ফেলছি আমি। ধকধক করছে বুকটা। এখনই ‘ওদের’ কেউ হাজির হতে পারে সামনে।

ওই যে, ডাইনিংয়ের দরজা ওটা নিশ্চয়ই। রুকু কিছু বলার আগেই ওকে নিয়ে এগোলাম সেদিকে। ডাইনিং পেরিয়ে আধখোলা একটা দরজা, রান্নাঘরের, আর সেটা পেরিয়ে আরেকটা সরু বন্ধ দরজা।

তলকুঠুরিটা!

‘রুকু, আমার প্লিজ আমার কথা শোনো। এখন ওই তলকুঠুরিতে ঢুকব আমরা। আমি অনেক দেখেছি এসব—আমি জেনেশুনে বিপদের মাঝে ঢুকব না।’ গলাটা যতটা সম্ভব শান্ত রেখে বললাম আমি।

ভাগ্যিস, একমুহূর্ত চুপ থেকে মাথা ওপর নিচ করল রুকু। ওর মন চাইছে না কোনোভাবেই, কিন্তু ওর মগজ বলছে আমাকে বিশ্বাস করতে। ওর সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ওই তলকুঠুরিতে ওকে নিয়ে যাচ্ছি আমি, সেটাও মেনে নিচ্ছে ও, কারণটা না জেনেই।

ঠেলা দিতেই অনায়াসে খুলে গেল দরজাটা। হু হু করে একঝলক ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল আমাদের ওপর দিয়ে। সিঁড়িটা ঠিক তেমনই যেমনটা রুকু বলেছিল। ধাপে ধাপে কত নিচে নেমে গেছে কে জানে। শেষ মাথায় অন্ধকার।

নামতে শুরু করলাম আমরা। প্রথমে আমি, পেছন পেছন রুকু। দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলাম। হোক।

আরও পড়ুন

নামার গতি বাড়িয়ে দিয়েছি আমরা। সিঁড়ি যেন শেষই হয় না। দেয়ালটা এখন পাথরের, স্যাঁতসেঁতে, পানি চুইয়ে পড়ছে কোথাও কোথাও। এই জুন মাসেও হাড়হিম করা শীত এখানে।

সিঁড়িটা শেষ হয়েছে অবশেষে। ছোট একটা ঘরে হাজির হয়েছি আমরা। এই সেই সেলার, তলকুঠুরি। দিব্যি স্বাভাবিক লাগছে জায়গাটা, কোনো মানুষের চেহারা নকল করা প্রাণী ঘাপটি মেরে নেই এখানে।

‘এবারে আমরা কী করব, শিপলু ভাইয়া?’ রুকু চোখ মুছে প্রশ্ন করল।

‘আমাদের রাতটা এখানে কাটাতে হবে, রুকু। তোমার কাহিনি শুনে বুঝেছি, অশুভ ঘটনাগুলো এই বাড়িতে শুধু রাতেই ঘটে। সকালে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারব আমরা।’

‘কিন্তু এই তলকুঠুরিটাই তো সব নষ্টের মূল! এখানে আমি প্রথমবার নামার পরই তো সব গড়বড় হয়ে গেল। স্বপ্নেও আমাকে ডাকে এটা!’ রুকু প্রতিবাদ করল জোর গলায়।

‘তুমি বুঝতে পারছ না, রুকু, বাড়িটাই অভিশপ্ত, তলকুঠুরিটা নয়!’ বলে উঠলাম আমি। ‘প্রথমবার তুমি যখন নেমেছ এখানে, তখন ঠিক সন্ধ্যা। বাড়িটাতে অশুভ কী আছে, জানি না, কিন্তু তোমার বাড়ির বাকি সবাই সেটার শিকার হয়েছে তখনই। তুমি এই বাড়ির একমাত্র নিরাপদ জায়গা, এই তলকুঠুরিতে ছিলে দেখে বেঁচে গেছ। তোমার বাবা-মা, ভাই-বোনের চেহারা ধারণ করা জিনিসগুলো দিনের বেলা মানুষের মতোই থাকে, রাত হলেই ফিরে আসে নিজের চেহারায়। বাড়িটাই ওদেরকে দিয়ে এসব করায়।’

থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুকু। পুরো ব্যাপারটা এবার ঢুকতে শুরু করেছে ওর মাথায়।

আমার রুমালটা এক কোনায় বিছিয়ে দিলাম আমি। ‘বসে পড়ো, রুকু। রাতটা কোনোমতে কাটাতে হবে।’

নিঃশব্দে আমার কথামতো কাজ করল রুকু। আমি আরেকখানে ধুলা ঝেড়েঝুড়ে বসে পড়লাম দেয়ালে হেলান দিয়ে। টর্চটা নিভিয়ে দিলাম ব্যাটারি বাঁচাতে। জমাট নিস্তব্ধতা চারদিকে, যেন এই ঘরের বাইরে বাকি পৃথিবীর কোনো অস্তিত্ব নেই।

কতক্ষণ পেরিয়েছে জানি না। একটু ঝিমুনির মতো এসেছিল মনে হয়। আমার রেডিয়াম লাগানো হাতঘড়িটা চোখের সামনে মেলে ধরলাম। সকাল সাতটা! কীভাবে এত দ্রুত কেটে গেল সময়!

মাটির এত নিচে সেই একই রকম আঁধার। টর্চটা জ্বেলে দেখি, কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে রুকু। আমি ডাকতেই চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল।

‘চলো, রুকু। সকাল হয়ে গেছে। আর ভয় নেই।’ বললাম আমি।

সত্যিই তাই। ওপরে উঠে এলাম যখন, আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। বাড়িটা দিব্যি স্বাভাবিক, ভয় লাগছে না একটুও। কোথাও কেউ নেই, এটাই কেবল খটকা লাগে।

রুকুর চোখ ছলছল করছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার বাড়ির সবার কী হয়েছে, শিপলু ভাইয়া?’

সেটার উত্তর আমিও জানি না। ‘চলো, রুকু। তোমার ওই খালার বাড়ি খুঁজে বের করতে হবে এখন। চিন্তা কোরো না, তোমার বাড়ির সবাইকে ওদের খপ্পর থেকে মুক্ত করব আমি। আজই আবার ফিরব এখানে।’

এগিয়ে চললাম আমি। পেছনে পড়ে রইল অজানা শক্তির আধার বাড়িটা, আর তার একমাত্র নিরাপদ জায়গা সেই পাতালপুরী তলকুঠুরি।

আরও পড়ুন