২৮৮৯ সালের একদিন

অলংকরণ: ফাহিম আনজুম রুম্মান

উনত্রিংশ শতাব্দীতে মানুষ বসবাস করছে এক নিরবচ্ছিন্ন রূপকথার রাজ্যে। তারা সেটা জানে বলে মনে হয় না। বিস্ময় আর আশ্চর্য দেখে এখন আর তাদের মনে কোনো কিছু রেখাপাত করে না। এই বিস্ময়কে তাদের কাছে একঘেয়ে লাগে। প্রতিদিন বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে সবই কেমন চেনা আর অভ্যস্ত লাগে তাদের কাছে। নিঃসাড়ভাবে তারা ওসব দেখে, শোনে কিন্তু তাজ্জব হয় না। সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হয়।

অতীতের সঙ্গে তুলনা করতে চাইলে অন্তত এটা জেনে নেওয়া উচিত যে আমাদের সভ্যতা এখন কোথায় এসে পৌঁছেছে, আর এখানে এসে পৌঁছাতে কত দীর্ঘ পথ তাকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে। তাহলেই বুঝতে পারবে, কত সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে আমাদের এসব আধুনিক শহর। ১০০ গজ চওড়া রাস্তা, হাজার ফুট উঁচু উঁচু দালান। তাপমাত্রা সব সময়ই নাতিশীতোষ্ণ। আকাশে ছুটে বেড়াচ্ছে এয়ারোকার আর এয়ারোবাস। একেকটি শহরের জনসংখ্যা হয়তো কোটি ছাড়িয়ে গেছে। হাজার বছর আগের লন্ডন, নিউইয়র্ককে গ্রাম মনে হয় না।

আজকের শহরবাসীদের যদি মনে পড়ে যেত স্টিমার অথবা রেলের অবস্থা, সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না, মুখোমুখি সংঘর্ষ লেগে যেত একটা আরেকটার সঙ্গে, আর কী শম্বুকগতিতে সেগুলো চলত, তাহলে আজকের যাত্রীরা এয়ারোরেলকে উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করতে পারত। বিশেষ করে প্রশংসা করত পাতাল টিউবগুলোর, সেই নিউম্যাটিক টিউবগুলোর, যেগুলো সমুদ্রের তল দিয়ে ঝোড়োগতিতে চলছে এখান থেকে সেখানে, ঘণ্টায় হাজার মাইল যাদের গতি। হয়তো তারা বুঝতে পারত টেলিফোনের মাহাত্ম্য। টেলিফোটোর কথা বাদই দিলাম, বুঝতে পারত আমাদের পূর্বপুরুষেরা কী অদ্ভুত টরেটক্কা নিয়ে সব যোগাযোগ সারত। নাম তার টেলিগ্রাফ। সত্যি বড় অদ্ভুত ব্যাপার। এসব বিস্ময়কর রূপান্তর যেসব সূত্রের ওপর নির্ভর করে সম্ভব হয়েছিল, সেসব সূত্র কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের ভালোই জানা ছিল। অথচ তারা সেগুলোর কোনো সদ্ব্যবহার করেনি। তাপ, বাষ্প, বিদ্যুৎ মানবজাতির বয়সেরই সমান। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিজ্ঞানসাধকেরা কি ঘোষণা করেননি যে ভৌত আর রাসায়নিক শক্তির মধ্যে তফাত হলো ইথারীয় বস্তুকণার বিশেষ তরঙ্গ কম্পনহারে?

এর ফলেই সম্ভব হয়েছে এই বিপুল অগ্রগতির। এসব শক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের স্বরূপটাকে বোঝার পরও, এটা অকল্পনীয় মনে হয় যে কম্পনমাত্রার তারতম্যের হার কী, সেটা বের করতেই কিনা এতগুলো বছর লেগে গেল! বিস্ময়কর ব্যাপারটা হলো, এই যে একটা শক্তি থেকে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হতে এবং কোনো কিছু না থাকলেও অন্যটা থেকে তাকে বের করে নিয়ে আসতে যে প্রযুক্তি ও পদ্ধতিকে কাজে লাগানো হয়, সেটা আবিষ্কৃত হলো এই সেদিন, অতি সম্প্রতি।

২৭৯০ সালে, মাত্র ১০০ বছর আগে সুবিখ্যাত অসওয়াল্ড নিয়ের সফল হলেন তাঁর গবেষণায়। যার ফলে ঘটনাগুলো পরপর ঘটে গেল।

মানবজাতির যথার্থ উপকার করেছেন অসওয়াল্ড নিয়ের। তাঁর উদ্ভাবন ও সাফল্য ছিল পরবর্তী সব উদ্ভাবনেরই উৎস। তাঁর পরই পরপর এলেন প্রতিভাবান সব উদ্ভাবক, প্রায় একসঙ্গে, যাঁদের শীর্ষে ছিলেন অসাধারণ বিজ্ঞানী জেমস জ্যাকসন। তাঁর কাছেই আমরা ঋণী নতুন সব অ্যাকুমুলেটরের জন্য, যেগুলো সৌররশ্মির শক্তিকে পুঞ্জীভূত করে রাখতে পারে। কয়েকটি শোষক কোষ ভূগোলকের কেন্দ্রস্থিত তড়িৎশক্তিকে সঞ্চয় করে রাখতে পারে। তারপর এল নতুন নতুন আবিষ্কার, জলপ্রপাত থেকে নিংড়ে আনা শক্তি, হাওয়া থেকে ছিনিয়ে আনা শক্তি, এমনকি নদী থেকে শক্তি সংগ্রহ করার উপায়গুলোও পরপর জানতে পারা গেল। তাঁর কাছ থেকেই আমরা পেয়েছি সর্বশক্তিসম্পন্ন সেই ট্রান্সফরমার, যার একটা সুইচ টিপলেই আজ আমরা পেয়েছি তাপ, আলো, বিদ্যুৎ অথবা যান্ত্রিক শক্তি।

এই দুটি যন্ত্র যেদিন আবিষ্কৃত হলো, সেদিন থেকেই বলতে গেলে মানবজাতির বিজয় অভিযান শুরু। এই দুটো যন্ত্রই মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে অসীম শক্তির ভান্ডার। শীতের কনকনে দিনগুলোয় এনে দিয়েছে বসন্তের রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া। বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে কৃষিকর্মে। আকাশযানগুলোর শক্তি জুগিয়ে তারা রাতারাতি বদলে দিয়েছে বাণিজ্যের চেহারা। কোনো ব্যাটারি বা যন্ত্র ছাড়া আমরা অবিরাম বিদ্যুৎ পেয়ে যাচ্ছি, তা–ও সম্ভব হয়েছে এসব আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে। কোনো বাল্ব ছাড়া আলো পাচ্ছি কিছু না জ্বালিয়ে। আর পেয়েছি অফুরন্ত শক্তি, যার ফলে শিল্পোৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে গেছে শতগুণ।

এসব কর্মকাণ্ড দেখতে চাইলে সোজা চলে যান আর্থ হেরাল্ড–এর সদর দপ্তরে, সম্প্রতি যার উদ্বোধন হলো ১৬৮২৩ অ্যাভিনিউয়ে। নিউইয়র্ক হেরাল্ড–এর প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন বেনেট আজ যদি দ্বিতীয়বার জন্ম নিতেন, তাহলে তিনি নিজের চোখে দেখতে পেতেন যে তাঁরই উত্তরসূরি, ফ্রান্সিস বেনেটের এই সৃষ্টি। মার্বেল পাথর আর স্বর্ণখচিত এই বিশাল প্রাসাদ দেখে তিনি কী বলতেন? পরপর কেটে গেছে ৩০টি প্রজন্ম, নিউইয়র্ক হেরাল্ড চিরকালই থেকে গেছে বেনেট পরিবারেরই সম্পত্তি। ২০০ বছর আগে, যখন ইউনিয়নের গভর্নমেন্ট ওয়াশিংটন থেকে সেনট্রোপলিসে স্থানান্তরিত হলো, তখন এই খবরের কাগজও সরকারকে অনুসরণ করেছিল। অবশ্য এর উল্টোটাও হতে পারত। সংবাদপত্রটিকে অনুসরণ করেই সরকার চলে আসতে পারত সেনট্রোপলিসে। আর তখনই জায়গা বদলের সঙ্গে সঙ্গে খবরের কাগজের নাম পাল্টে নতুন নাম নিয়েছিল আর্থ হেরাল্ড।

আরও পড়ুন

ভুলেও এ কথা কেউ যেন না ভাবে যে ফ্রান্সিস বেনেটের প্রশাসনে এই কাগজের কোনো অবনতি হয়েছে। বরং তার নতুন পরিচালক টেলিফোনিক সাংবাদিকতার প্রবর্তন করে এতে নতুন প্রাণশক্তি ও চালনাশক্তি সঞ্চার করেছেন।

এখন তো সবাই জানে যে ব্যবস্থাটা টেলিফোনের অবিশ্বাস্য উন্নতির কারণে সম্ভব হয়েছে। অতীতে প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজে ছাপা হতো খবর। এখন আর্থ হেরাল্ড কথা বলে যায় ঘরে ঘরে। প্রতিবেদক, রাজনৈতিক নেতা কিংবা ধরা যাক কোনো বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথোপকথনের মারফত গ্রাহকেরা জেনে নিতে পারবেন শেষ সংবাদ। অসংখ্য ফোনোগ্রাফিক ক্যাবিনেটের মাধ্যমে গ্রাহকেরা কয়েক সেন্টের বিনিময়ে যেকোনো মুহূর্তে দিনের সব খবর জেনে নিতে পারবেন।

ফ্রান্সিস বেনেটের এই উদ্ভাবন পুরোনো খবরের কাগজকে নতুন প্রাণ দিয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যেই এটির গ্রাহকসংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে আট কোটিতে। পরিচালকের মুনাফা ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে ক্রমে বেড়ে চলেছে। বিপুল সম্পত্তির বলেই তিনি তাঁর নতুন অফিসটি নির্মাণ করতে পেরেছেন। বিশাল এক দালান, চার অংশে বিভক্ত, যার প্রতিটি পাশ দুই মাইল লম্বা। ছাদে উড়ছে পঁচাত্তরটি তারা আঁকা কনফেডারেশনের পতাকা। ফ্রান্সিস বেনেট দুই আমেরিকারই সম্রাট হতে পারতেন, অবশ্য আমেরিকানরা আপত্তি করত না। বিশ্বাস হচ্ছে না? কিন্তু সব দেশেরই রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী তাঁর কাছে ধরনা দেন। তাঁরা চান ফ্রান্সিস বেনেটের সম্মতি বা স্বীকৃতি অথবা পরামর্শ। সব শেষে তাঁর এই সর্বশক্তিমান গণমাধ্যমটির সমর্থন। কত বিজ্ঞানীকে তিনি উৎসাহ জোগান, কত শিল্পীকে তিনি কাজে নিয়োগ দিয়েছেন। কত প্রযুক্তিবিদকে তিনি অর্থ জুগিয়েছেন তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। তাঁর রাজত্বে নিশ্বাস ফেলারও ফুরসত বোধ হয় নেই। ভাগ্যিস আজকাল লোকের শরীর অনেক শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান। সেটা সম্ভব হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি, ব্যায়ামবিজ্ঞান ও খাদ্যতত্ত্বের উন্নতির ফলেই। মানুষের জীবনের গড় আয়ু ৩৭ থেকে ৬৮–তে পৌঁছেছে। সেই সঙ্গে ধন্যবাদ জানাতে হয় জীবাণুমুক্ত খাদ্যব্যবস্থাকে। পরিবেশ দূষিত নয় বলে বাতাসও এখন যে পুষ্টি জোগায়, তা–ও এককালে অকল্পনীয় ছিল। নিশ্বাস নিলেই পুষ্টি! এরপর নতুন কী আসবে! যা আসবে, তা কীভাবে যে মানুষের জীবনকে আরও অনায়াস ও স্বচ্ছন্দ করে দেবে!

আর্থ হেরাল্ড–এর পরিচালকের একটা দিনের সব ঘটনা জানতে চান? তাহলে আসুন, তাঁকে আমরা ছায়ার মতো অনুসরণ করি। আজ ২৫ জুলাই ২৮৮৯ সাল।

সকালে ফ্রান্সিস বেনেটের যখন ঘুম ভেঙেছে, তখন মেজাজটা তার তিরিক্ষি ছিল। ৮ দিন হলো তাঁর স্ত্রী ফ্রান্সে গেছেন, আর তাই নিঃসঙ্গ লাগছে তাঁর। ১০ বছর হয়ে গেল তাঁদের বিয়ে হয়েছে। এই প্রথম মিসেস এডিথ বেনেট স্বামীর কাছছাড়া হয়েছেন। দুই-তিন দিনের জন্য অবশ্য তিনি প্রায়ই যান ইউরোপে। বিশেষ করে যান প্যারিসে, টুপি কিনতে।

ঘুম ভাঙতেই ফ্রান্সিস বেনেট সুইচ টিপলেন তাঁর ফোনোটেলিফোটের, যার তারগুলো সরাসরি জুড়ে দেওয়া আছে প্যারিসে তাঁর নিজস্ব ভবনে।

টেলিফোনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে টেলিফোট—এই দুই মিলে তৈরি হয়েছে আমাদের শতাব্দীর আরও একটা বিজয়স্তম্ভ। ত্বরিত ধ্বনি পাঠানোর ব্যবস্থা তো সেই কবে থেকেই চলে আসছে, কিন্তু সম্প্রতি তার সঙ্গে পাঠানো যায় ছবিও। দুর্দান্ত এই আবিষ্কার। আর এই আবিষ্কারের ফলে সুইচ দেওয়ামাত্র এডিথ বেনেট এসে আবির্ভূত হয়েছেন টেলিফোটিক স্ক্রিনে।

দেখেই মন ভরে গেল। আহা কী সুন্দর দৃশ্য! গত রাতের থিয়েটার কিংবা নাচের আসরে গিয়েছিলেন, এখন একটু ক্লান্ত। মিসেস বেনেট এখনো শুয়ে আছেন তাঁর বিছানায়। এখন তিনি যেখানে আছেন, সেখানে প্রায় দুপুর। তাঁর ছোট্ট মাথাটা বালিশে গোঁজা। একটু নড়লেন। পাশ ফিরলেন বোধ হয়...ঠোঁট দুটো নড়ছে...সন্দেহ নেই, এডিথ বেনেট কোনো স্বপ্ন দেখছেন...অস্ফুটে বেরিয়ে এল একটি নাম তাঁর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে—‘ফ্রান্সিস...’

সুমধুর কণ্ঠে নিজের নাম শুনেই ফ্রান্সিস বেনেটের মেজাজ ভালো হয়ে এল। ঘুমন্ত স্ত্রীকে না জাগিয়ে ফ্রান্সিস বেনেট লাফিয়ে নামলেন তাঁর বিছানা ছেড়ে, তারপর ঢুকলেন তাঁর যান্ত্রিক প্রসাধনকক্ষে।

দুই মিনিট বাদে, ফিটফাট অবস্থায় বেরিয়ে এলেন, প্রসাধনযন্ত্রটি তাঁকে গোসল করাল, দাড়ি কামিয়ে দিল, পোশাক পরিয়ে দিল। লাগিয়ে দিল জামার সব কটা বোতাম। তারপর তাঁকে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিল তাঁর অফিসের গেটে। অফিসের প্রাত্যহিক কাজ শুরু হতে চলেছে।

প্রথমে এসে ঢুকলেন ধারাবাহিক ঔপন্যাসিকদের ঘরে। ঘরটা লম্বা, আর মাথার ওপর বিশাল একটি স্বচ্ছ গোলাকৃতি গম্বুজ, যার মাধ্যমে আলো এসে ঘরে ঢোকে, কিন্তু বাইরে থেকে ঘরটা দেখা যায় না। এক কোণে রয়েছে সারি সারি টেলিফোনিক যন্ত্র, যার মাধ্যমে আর্থ হেরাল্ড–এর ১০০ লেখক ১০০টা রোমান্স কাহিনি ১০০টা অধ্যায় বর্ণনা করছে উদ্বেলিত জনসাধারণকে।

আরও পড়ুন

একজন ঔপন্যাসিক তখন পাঁচ মিনিটের একটি বিরতি নিচ্ছিলেন। তাঁকে দেখে বেনেট বললেন, ‘চমৎকার! দুর্দান্ত হয়েছে আপনার শেষ পরিচ্ছেদটা। সহজ–সরল গ্রাম্য যুবকটি তার অনুরক্ত ভক্তের সঙ্গে অতীন্দ্রিয় দর্শন নিয়ে আলোচনা করছে, এটা বলে দেয় মনস্তত্ত্বে আপনার কী গভীর দখল, কী সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণক্ষমতা। গ্রামের লোকেদের সরল জীবনযাত্রার ধরন এর আগে এমন করে কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। আর্চিবন্ড, চালিয়ে যান। আর আপনার প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইল। আপনারই জন্য গতকাল দশ হাজার নতুন গ্রাহক বেড়েছে আর্থ হেরাল্ড–এর।’

‘মিস্টার জন লাস্ট’, অন্য এক সহকারীর দিকে তাকিয়ে বললেন ফ্রান্সিস বেনেট, ‘আপনার কাজে আমি কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আপনার গল্পের মধ্যে জীবনের স্পন্দন কোথায়? কেমন যেন নিষ্প্রাণ গল্প। আপনি যেন এক্ষুনি গল্পের শেষটা বলে দেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করে এগিয়ে যাচ্ছেন। আপনার রচনার পেছনে তথ্যের ভার কই? মনোবিশ্লেষণ চাই। আজকাল তো আর কলম দিয়ে কেউ লেখে না, লেখে স্ক্যালপেলের সাহায্যে। বাস্তব জীবনের প্রতিটি ঘটনা আসলে ধাবমান চিন্তাপরম্পরার ফলশ্রুতি। জীবন্ত মানুষ তৈরি করে দেওয়ার জন্য সেই সব ধাবমান চিন্তাকে খুব সাবধানে ফুটিয়ে তুলতে হবে, অনেক যত্ন নিতে হবে। আর ইলেকট্রিক্যাল হিপনোটিজমের চেয়ে সহজ আর কী উপায় আছে? যা তার বিষয়কে চার গুণ বড় করে দেখায়, আর স্পষ্ট ভাগ করে দেখায় তার দ্বৈতসত্তাকে। আপনি নিজের দিকে একবার খেয়াল করে দেখুন, জন লাস্ট। আর কিছু না হলে অন্তত আপনার সহকর্মীর অনুকরণ করুন। নিজে সম্মোহিত হয়ে যান। কী বললেন? আপনি ইলেকট্রিক্যাল হিপনোটিজম ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছেন?...এখনো তাতে কোনো ফল হয়নি, আরও হওয়ার দরকার।’

ছোট্ট উপদেশটা দিয়ে ফ্রান্সিস বেনেট ঘুরে ঘুরে সব দেখে চললেন। তারপর গিয়ে হাজির হলেন প্রতিবেদকদের ঘরে। পনেরো হাজার প্রতিবেদক বসে আছের পনেরো হাজার টেলিফোনের সামনে, গত রাতে বিশ্বের চারদিক থেকে যেসব খবর এসে পৌঁছেছে, সেসব তাঁরা পৌঁছে দিচ্ছেন গ্রাহকদের কাছে।

এই অতুলনীয় সংবাদ সংগঠনের বর্ণনা এর আগে অনেকেই করেছেন। টেলিফোন ছাড়া প্রত্যেক প্রতিবেদকের সামনে থাকে কমিউটেটর। যার ফলে মুহূর্তের মধ্যেই তিনি টেলিফোটের সঙ্গে নিজের লাইন জুড়ে দিতে পারেন। তাতে গ্রাহকেরা খবরটা যে শুধু শুনতে পান তা–ই নয়, ঘটনাটাকে চাক্ষুষ দেখতে পান। যখন বিবিধ তথ্যের পালা আসে, অর্থাৎ বর্ণনার সময় যেগুলো এর মধ্যেই বাসি হয়ে গেছে, তখন শুধু তাদের প্রধান প্রধান পর্যায়গুলোই জানিয়ে দেওয়া হয়। আর সেগুলো জানানো হয় স্থিরচিত্রের মাধ্যমে।

আজকাল জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল প্রচণ্ড বেড়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ১০ জন সাংবাদিকের মধ্যে একজনকে বেছে নিলেন ফ্রান্সিস বেনেট। ‘তারপর ক্যাশ, আজ কী পেলে?’

‘শুক্র গ্রহ থেকে কতগুলো ফোটোটেলিগ্রাম এসেছে। মঙ্গল আর বুধ গ্রহেরও কিছু খবর আছে।’

‘মঙ্গলের ফোটোটেলিগ্রামটা নিশ্চয় কৌতূহলোদ্দীপক?’

‘নিশ্চয়ই। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে। প্রতিক্রিয়াশীল উদারনৈতিকদের সঙ্গে রক্ষণশীলদের মধ্যে লড়াই চলছে।’

‘প্রায় আমাদেরই মতো দেখছি। আর বৃহস্পতির খবর কী?’

‘এখনো কোনো খবর আসেনি। যেসব সিগন্যাল পাঠাচ্ছে, আমরা এখনো তার কোনো মর্মোদ্ধার করতে পারিনি। হয়তো আমাদের সিগন্যালগুলো তাদের কাছে গিয়ে এখনো পৌঁছায়নি।’

‘সিগন্যাল পাঠানোর কাজটা কিন্তু আপনার, মিস্টার ক্যানা।’ অত্যন্ত বিরক্ত হয়েই ফ্রান্সিস বেনেট গেলেন বিজ্ঞান বিভাগের সম্পাদকদের ঘরে।

কম্পিউটারের ওপর ঝুঁকে পড়ে, ৩০ জন বিজ্ঞানী পঁচানব্বইতম ডিগ্রির কী একটা সমীকরণ নিয়ে তন্ময়। কেউ কেউ খেলা করছিলেন বীজগণিতের অসীমের সূত্রগুলো নিয়ে, কেউ কেউ ব্যস্ত ২৪তম ডাইমেনশন নিয়ে। যেন বাচ্চা ছেলের দল গণিতের চারটি নিয়ম, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ নিয়ে খেলা করছে।

ফ্রান্সিস বেনেট তাঁদের মাঝে এসে পড়লেন একটা বিস্ফোরকের মতো, বললেন, ‘একি শুনছি আমি? বৃহস্পতি থেকে কোনো জবাব পাওয়া যাচ্ছে না? বারবার একই অবস্থা শুনতে হচ্ছে। দেখুন কার্লি, কুড়ি বছর ধরে আপনি শুধু এই গ্রহটাকে খুঁচিয়েই চলেছেন।’ ‘আপনি তাহলে কী আশা করেন স্যার?’ বিজ্ঞানী জবাব দিলেন, ‘আমাদের অপটিক্যাল সায়েন্সের এখনো তেমন উন্নতি হয়নি। দুই মাইল লম্বা টেলিস্কোপগুলোর সাহায্যে...

‘কথাটা শুনলেন পিয়ার?’ কার্লিকে শেষ করতে না দিয়েই কার্লির পাশের জনকে বললেন ফ্রান্সিস বেনেট, ‘অপটিক্যাল সায়েন্সের নাকি অনেকটা বাকি...সেটা তো আপনার সাবজেক্ট, পিয়ার? চোখে ঠুলি আঁটুন, নাকি এ–ও আবার বলে দিতে হবে?’

তারপর কার্লির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বৃহস্পতি না হয় বাদ যাক, আপনি কি চাঁদ থেকেও কিছু জানতে পারছেন না?’

‘এখনো কিছু পাইনি, মিস্টার বেনেট।’

‘হুম, এবার তো আর অপটিক্যাল সায়েন্সের ঘাড়ে সব দোষ চাপাতে পারবেন না। চাঁদ তো মঙ্গলের চেয়ে ১০০ গুণ কাছে, অথচ আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা মঙ্গলের সঙ্গে নিয়মিত খবর আদান–প্রদান করে চলেছে। নিশ্চয়ই চাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে জোরালো টেলিস্কোপের দরকার হচ্ছে না।’

‘না, এবার গোলমাল পাকাচ্ছে তার বাসিন্দারাই।’ দুর্বোধ্য হাসি হেসে জবাব দিল কার্লি।

‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, চাঁদে কেউ থাকে না, তাই জবাব পাচ্ছেন না?’

‘চাঁদের যে দিকটা আমাদের দিকে রয়েছে, সেদিকটায় কেউ থাকে না, মিস্টার বেনেট। অন্যদিকটায় থাকে কি না, তাই–বা কে জানে?’

‘সেটার একটা সহজ উপায় আছে।’

‘উপায়টা কী?’

‘চাঁদটাকে ঘুরিয়ে দেওয়া।’

সেদিনই বেনেটের বিজ্ঞানীরা একটা যন্ত্র বানানোর কাজে লেগে গেলেন। এমন একটা যান্ত্রিক ব্যবস্থা, যার ফলে চাঁদকে তার অক্ষের ওপর একটা পাক খাওয়ানো যাবে।

আরও পড়ুন

সব মিলিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো অনেক কারণ ছিল ফ্রান্সিস বেনেটের। আর্থ হেরাল্ড–এর একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সদ্য বের করেছেন, নতুন গ্রহ গানডিনি কী কী উপাদান দিয়ে তৈরি। গানডিনি গ্রহ ১২,৮৪১, ৩৪৮, ২৮৪,৬২৩ মিটার ও ৭ ডেসিমিটার দূরে, সূর্যকে ঘুরে আসতে সে যে পাক খায়, তাতে তার লাগে ৫৭২ বছর ১৯৪ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট ৯.৮ সেকেন্ড।

এমন সূক্ষ্ম গাণিতিক হিসাব শুনে ফ্রান্সিস বেনেট বেশ আনন্দিত হলেন। বললেন, ‘বেশ এখনই সাংবাদিকদের খবরটা জানানোর ব্যবস্থা করুন। আপনারা তো জানেনই জনসাধারণের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের এসব প্রশ্ন সম্বন্ধে কী কৌতূহল রয়েছে। আমি চাই, আজকের সংখ্যাতেই খবরগুলো বের হোক।’

সাংবাদিকদের ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আরেকটা ব্যাপার নিয়ে কথা বললেন ফ্রান্সিস বেনেট। সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞদের যে দলটা আছে, তাঁদের ভেতর একজন ছিলেন নামীদামিদের সাক্ষাৎকার নিতে ওস্তাদ। তাঁকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

প্রেসিডেন্ট উইলকক্সের ইন্টারভিউটা নিয়েছেন?

‘হ্যাঁ, মিস্টার বেনেট। আমি এই খবরটা প্রকাশ করছি যে সত্যি সত্যি তাঁর পাকস্থলী ফুলেছে, নতুন অন্ত্র আর নালি বসানো হচ্ছে ফোলাটাকে কমাতে।’

‘বেশ! বেশ! আর ওই যে খুনিটা, কী যেন নাম, চ্যাপমান, তার ব্যাপারটাই–বা কী হলো? জুরিদের সঙ্গে কি কোনো কথা বলেছেন?’

‘হ্যাঁ, জুরিরা সবাই একমত, চ্যাপমান খুনি। এটা নাকি প্রমাণ হয়ে গেছে যে শেষ পর্যন্ত জুরিদের পরামর্শ নাকি না–ও চাওয়া হতে পারে। রায় বের হওয়ার আগেই তার ফাঁসি হয়ে যাবে।’

‘চমৎকার।’

পরের ঘরটা ছিল প্রায় সিকি মাইল লম্বা একটা গ্যালারি। পাবলিসিটি ঘর এটা। আর এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, আর্থ হেরাল্ড–এর মতো সংবাদপত্রের ঢাকঢোল পেটানোর আয়োজনটা কী রকম হবে। বিজ্ঞাপন বিভাগের একেক দিনের আয় গড়ে তিন কোটি ডলার। মাথা খাটিয়ে, সত্যি, এমন অনেক বিজ্ঞাপন বের হয়, যা একেবারে অভিনব। এখন যে পন্থায় প্রচারযন্ত্র চালু রয়েছে, তার মূল আবিষ্কারক মারা গেছেন অনাহারে। মাত্র তিন ডলারের বিনিময়ে তিনি আর্থ হেরাল্ড বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেটা কিনে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টিটাকে পেটেন্ট করে নেওয়া হয়েছিল। এখন তা থেকে রোজ আয় হচ্ছে। বিশাল সব ছবি ফেলা হয় মেঘে, এতই বড় যে দেশের সব জায়গা থেকে তা দেখা যায়। ওই গ্যালারি থেকে, ১০০টি প্রজেক্টর সারাক্ষণ ছবি ফেলে চলেছে আকাশে, আর সেই ছবি ফুটে উঠছে মেঘের গায়ে। বিজ্ঞাপন বিভাগ এভাবেই প্রচার করে থাকে।

সেদিন ফ্রান্সিস বেনেট যখন বিজ্ঞাপন বিভাগে ঢুকলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন, প্রযুক্তিবিদেরা বসে আছেন নিশ্চল প্রজেক্টরগুলোর সামনে। ব্যাপারটা কী, তিনি জানতে চাইলেন। একজন আঙুল তুলে আকাশটা দেখালেন। একফোঁটা মেঘ নেই আকাশে।

‘বাহ্‌, আবহাওয়াটা বেশ চমৎকার!’ বিড়বিড় করে বললেন ফ্রান্সিস বেনেট, ‘এর মানে আকাশে বিজ্ঞাপন পাঠানো যাবে না। কী করা যায়? বৃষ্টি না হলে তো আমরা বৃষ্টি বানাতে পারি। কিন্তু আমরা চাই মেঘ। বিজ্ঞাপনগুলো তো ফেলতে হবে মেঘেই।’

‘হ্যাঁ, একেবারে ধবধবে সাদা মেঘ চাই!’ প্রধান প্রযুক্তিবিদ বললেন। ‘মিস্টার সাইমন মার্ক, আপনি বরং বিজ্ঞাপন বিভাগের সম্পাদকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, বলুন যে, আবহাওয়াবিদদের সাহায্য চাও। আমার হয়ে আপনি ওদের জানিয়ে দিতে পারেন যে ওরা যেন এক্ষুনি কৃত্রিম মেঘ বানানোর কাজে লেগে যায়। চমৎকার আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে থাকলে তো আমাদের চলবে না।’

বিভিন্ন বিভাগ পরিদর্শন করে ফ্রান্সিস বেনেট সোজা চলে গেলেন তাঁর অভ্যর্থনাকক্ষে। গিয়ে দেখেন তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছেন মার্কিন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা। তাঁরা এসেছেন এই সর্বশক্তিমান ডিরেক্টরের কাছ থেকে নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতে। তিনি ঘরে ঢুকতেই শুনতে পেলেন মান্যগণ্যরা কী নিয়ে যেন উত্তেজিতভাবে আলোচনা করছেন।

‘এক্সকিউজ মি ইয়োর এক্সেলেন্সি’, ফরাসি রাষ্ট্রদূত রুশ রাষ্ট্রদূতকে বলছিলেন তখন। ‘কিন্তু আমি তো ইউরোপের মানচিত্রে এমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, যেটা এখনই বদলানো জরুরি। উত্তর দিকটা স্লাভদের কবজায় রয়ে গেছে, এটা মানি। কিন্তু দক্ষিণ তো আছে লাতিনদের দখলে। আমাদের দুই অংশের সীমান্ত এখনো রাইন নদী, আর তাতে কোনো অসুবিধা দেখছি না আমি। রোম, মাদ্রিদ, ভিয়েনার সদর দপ্তরগুলোর বিরুদ্ধে কিছু করা হলে আমরা কিন্তু সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করব।’

‘চমৎকার বলেছেন’, ফ্রান্সিস বেনেট আলোচনার মাঝে ঢুকে পড়লেন, ‘কী, রুশ রাষ্ট্রদূত আপনারা আপনাদের ওই অত বড় সাম্রাজ্যটা নিয়ে খুশি নন বুঝি। রাইনের তীর থেকে একেবারে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত আপনাদের সাম্রাজ্য। এত বিশাল সাম্রাজ্য, যার একদিকে আছে মেরুসাগর আর অন্যদিকে আছে আটলান্টিক, কৃষ্ণসাগর, বসফরাস ও ভারত মহাসাগর।’

‘তা ছাড়া ভয় দেখিয়ে কী লাভ? আমাদের আধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব হবে? অ্যাসফিক্সিয়েটিং বোমাগুলো তো শত শত মাইল দূরের পাল্লায় যেতে পারে। আর ওই সব বিদ্যুৎ-ঝলক, সে তো একেকটা ৬০ মাইল লম্বা। একঝলকে পুরো একটা সৈন্যবাহিনী হাওয়ায় উড়ে যাবে। আর ওই সব প্রজেকটাইল মিসাইল যেগুলোর মধ্যে আছে প্লেগ, কলেরা, হলুদ জ্বরের জীবাণু, একেকটা জাতিকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উজাড় করে দিতে পারে।’

‘সবই জানি, মিস্টার বেনেট’, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘কিন্তু অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার স্বাধীনতা আমাদের আছে নিশ্চয়ই। পুব দিকে চীনাদের কাছ থেকে তাড়া খাওয়ার পর আমাদের এখন যেভাবেই হোক, পশ্চিমে একটা কিছু করতে হবে।’ ‘ব্যস এই?’ ফ্রান্সিস বেনেট তোয়াজ করার সুরে বললেন, ‘শুধু এইটুকুই চাচ্ছেন আপনারা? শুনুন, এই চীনারা যে হারে সংখ্যায় বাড়ছে, সেটা সারা বিশ্বের পক্ষেই এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আমাদের যে করেই হোক তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ করতেই হবে তাদের। বলতে হবে এর চেয়ে বেশি সন্তান যার জন্মাবে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।’ ‘আপনি বলুন’, আর্থ হেরাল্ড–এর পরিচালক ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতকে বললেন, ‘বলুন, এ সেবায় লাগতে পারি?’

‘অনেক কিছু করতে পারেন, মিস্টার বেনেট’, ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘আপনার কাগজে আমাদের হয়ে একটা প্রচার চালাতে হবে।’

‘কী বিষয়ে?’

‘প্রতিবাদ জানাতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র যেন গ্রেট ব্রিটেনকে দখল করে না নেয়।’

‘ব্যস এইটুকু?’ ফ্রান্সিস বেনেট কথাটা শুনে তাঁর কাঁধ ঝাঁকালেন, ‘সে তো দেড় শ বছর আগেই ইংল্যান্ড আমেরিকারই অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু আপনারা এটা কেন মেনে নিতে পারছেন না যে অতীব ন্যায়সংগত ঘটনাচক্রেই আপনাদের দেশ মার্কিনদের একটা উপনিবেশ হয়ে গেছে। এখন আপনারা এ নিয়ে খেপে আছেন। এ তো ছেলেমানুষি। নাকি পাগলামি? আচ্ছা, আপনাদের সরকার কী করে এটা ভাবতে পারল যে আমি এ রকম একটা স্বদেশবিরোধী আন্দোলনে নামব!’

‘কিন্তু ইংল্যান্ড তো আমেরিকা নয়, সে আমাদের একটা উপনিবেশ। ভুলেও ভাববেন না যে আমরা ইংল্যান্ডকে কখনো আমাদের আওতা থেকে বেরিয়ে যেতে দেব।’

‘আপনি তাহলে রাজি নন?’

‘না। তবে আপনি যদি জোর করেন, তাহলে আমাদের কোনো সাংবাদিকের কাছে একটা সাক্ষাৎকার দিন, আপনাদের দাবি হিসেবে সেটা প্রকাশ করা যাবে, যদিও সেই দাবিতে আমাদের কোনো সায় থাকবে না।’

‘এই আপনার শেষ কথা?’ ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ভীষণ মুষড়ে পড়েছেন। যুক্তরাজ্য, কানাডা আর নিউ ব্রিটেন—সবই এখন আমেরিকার। ইন্ডিয়া গেছে রুশদের খপ্পরে। আর অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আছে যার যার নিজের মতো। ‘এককালের গ্রেট ব্রিটেনের কী রইল? কিছুই না।’

‘কিছুই না মানে?’ ফ্রান্সিস বেনেট ফোড়ন কাটলেন, ‘কেন জিব্রাল্টার কোথায় গেল?’ ঠিক তখনই ঢং ঢং করে ঘড়িতে ১২টা বাজল। আর্থ হেরাল্ড–এর ডিরেক্টর ভেঙে দিলেন সভা। তারপর তিনি একটা চলমান আরামকেদারায় বসলেন। কয়েক মিনিট পরই পৌঁছে গেলেন খাবারঘরে, আধা মাইল দূরে, অফিসের এক কোণে।

টেবিল সাজানোই ছিল। তিনি গিয়ে নিজের আসনটায় বসলেন। তাঁর হাতের নাগালের মধ্যেই ছিল পরপর সাজানো কতগুলো কল বসানো ছোট ছোট পিপা। সামনেই পড়ে আছে একটা ফোনোটেলিফোটের পর্দা, যার ওপরে এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে প্যারিসে তাঁর প্রাসাদের খাবারঘর। মিস্টার আর মিসেস বেনেট কাঁটায় কাঁটায় একসময়েই মধ্যাহ্নভোজ সারবেন বলে ঠিক করেছিলেন। দূরত্ব সত্ত্বেও মুখোমুখি বসে খেতে খেতে ফোনোটেলিফোটের মাধ্যমে কথা বলার চেয়ে সুখকর আর কীই–বা থাকতে পারে? কিন্তু প্যারিসের খাবারঘরে তখনো কেউ আসেনি।

‘এডিথের যে দেরি হচ্ছে’, আপনমনেই বললেন ফ্রান্সিস বেনেট।

আরও পড়ুন

আজকাল তো জীবনযাপনের সবকিছুই খুব সহজ ও স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছে। বাড়িতে রান্নাবান্নার কোনো ব্যবস্থা রাখেননি ফ্রান্সিস বেনেট। বাড়িতে বাড়িতে খাদ্য সরবরাহ করার জন্য একটি কোম্পানি আছে, তিনি তারই গ্রাহক এবং পৃষ্ঠপোষক। বায়ুচালিত নলের মধ্য দিয়ে তারা বাড়িতে বাড়িতে হাজার রকমের খাবার সরবরাহ করে। ব্যবস্থাটা ব্যয়সাপেক্ষ, সন্দেহ নেই। তবে এদের রান্নার কোয়ালিটি ভালো। মুখরোচকই শুধু নয়, পুষ্টিকর। তা ছাড়া এই ব্যবস্থা নারী-পুরুষ সবাইকেই বাঁচিয়ে দিয়েছে। পাচক-পাচিকাদের দাপটও কমেছে। তাই মন খারাপ করেই আজ ফ্রান্সিস বেনেট একা একাই মধ্যাহ্নভোজ সারছেন। তিনি যখন কফিতে চুমুক দিয়েছেন, ঠিক তখনই মিসেস বেনেটকে দেখা গেল টেলিফোটোর স্ক্রিনে। মাত্র বাড়ি এসে পৌঁছেছেন। ‘কোথায় ছিলে তুমি?’ ফ্রান্সিস বেনেট জানতে চাইলেন।

‘এর মধ্যে তোমার খাওয়া শেষ?’ জবাবে বললেন মিসেস বেনেট। ‘আজও দেরি করে ফেলেছি। গিয়েছিলাম ফ্যাশন দোকানে। এ বছর এমন দারুণ সব টুপি বানিয়েছে, কী বলব তোমাকে, টুপি তো নয় যেন একেকটা বিশাল গম্বুজ। এত ধরনের গম্বুজ আর বুরুজ যে আমি আর তাল রাখতে পারিনি, তাই সময়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।’

‘তা অবশ্য গিয়েছিলে। এতটাই সময় নষ্ট করেছ যে আমার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে।’

‘খাওয়া শেষ হয়ে গেলে খামাখা আর বসে থেকে কী করবে, কাজে চলে যাও’, মিসেস বেনেট জবাব দিলেন, ‘আমাকে আবার একবার বের হতে হবে। টেইলারের কাছে যেতে হবে।’

টেইলার আর কেউ নয়, ফ্যাশনেবল পোশাক নির্মাতা।

টেলিফোটের স্ক্রিনেই স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন ফ্রান্সিস বেনেট। তারপর এগিয়ে গেলেন জানালার দিকে। সেখানে এয়ারোকার অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য।

‘কোথায় যাবেন স্যার?’ জিজ্ঞেস করল এয়ারো ড্রাইভার।

‘হাতে সময় আছে যখন, তখন নায়াগ্রাতে আমার অ্যাকুমুলেটর ফ্যাক্টরিতে নিয়ে চলো।’ এয়ারোকার আধুনিক যন্ত্রযুগের এক চমকপ্রদ সৃষ্টি। এটা তৈরি হয়েছে বাতাসের চেয়েও ভারী উড্ডয়নের পরিকল্পনাটির সূত্র মেনে নিয়ে। আকাশে ওটা ছুটে চলে ঘণ্টায় চার শ মাইলের চেয়েও দ্রুতবেগে। তার নিচে ছড়িয়ে আছে কত জনপদ, তাদের চলন্ত ফুটপাতসমেত, যে রাস্তাগুলো পথিকদের নিয়ে অবিশ্রাম ছুটে চলেছে। লোকালয়গুলো পরপরই থাকে খেতখামার, গ্রাম, বিশাল কোনো মাকড়সা জালের মতো ছড়িয়ে আছে অগুনতি ইলেকট্রিক তারের জাল।

আধঘণ্টার মধ্যে ফ্রান্সিস বেনেট নায়াগ্রায় তাঁর কারখানায় পৌঁছে গেছেন। জলপ্রপাতের প্রচণ্ড গতিকে সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে শক্তি উৎপাদনের কাজে, আর সেটাই তিনি তাঁর খদ্দেরদের কাছে হয় ভাড়া দেন, নয়তো বিক্রি করেন। কারখানাটা ঘুরে দেখার পর ফ্রান্সিস বেনেট যখন ফিলাডেলফিয়া, বস্টন, নিউইয়র্ক হয়ে সেনট্রোপলিসে ফিরে এসেছেন, তখন বিকেল পাঁচটা বাজে।

আর্থ হেরাল্ড–এর ওয়েটিং রুমটায় তখন গিজগিজ করছে লোকে। তাঁর দৈনন্দিন সভার জন্য ফ্রান্সিস বেনেট কখন এসে হাজির হয়, সে জন্য সাগ্রহে সবাই অপেক্ষা করে ছিল সেখানে। ওয়েটিং রুমেই তিনি প্রার্থী ও আবেদনকারীদের সঙ্গে দেখা করেন প্রতিদিন। আর যারা আবেদন নিয়ে আসে, তাদের মধ্যে থাকে এমন সব বিনিয়োগকারী, যাদের খাই খাই কখনোই মেটে না। তা ছাড়া আছে যারা নতুন নতুন কোম্পানি গড়তে চাচ্ছে কিংবা নতুন নতুন সংস্থার পুঁজি বাড়ানোর জন্য যারা সাধারণ মানুষের পকেটে হাত দিতে চাচ্ছে, এমন সব কোম্পানির মালিক যে নিজে কোনো টাকা দেয় না, অন্যদের কাছে শেয়ার বেচেই নিজে মালিক হয়ে বসে। এদের বিভিন্ন প্রস্তাব আর আবেদন রোজ নিয়ম করে শোনেন ফ্রান্সিস বেনেট। যে প্রস্তাবগুলো মনঃপূত হয় না, সেগুলো তখনই বাতিল করে দেওয়া হয়। যেসব প্রকল্পের সাফল্য সন্দেহজনক তুলনায় তাদের একটু বেশি সময় দিয়ে তিনি খুঁটিয়ে দেখেন আর সাদরে স্বাগত জানান সেই প্রস্তাবগুলোকে, যেখানে লাভের অঙ্কটা বেশি।

বাজে প্রস্তাবগুলো বাতিল করতে আজ তাঁর প্রায় কোনো সময়ই লাগেনি। একটা প্রস্তাব ছিল মুদ্রণশিল্পকে আগের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা। ছাপার ব্যাপারটা এখন এমনই অপ্রচলিত একটা জিনিস যে মিইয়েব আনহেলুস সেদিন বিক্রি হয়ে গিয়েছিল মাত্র ১৫ ফ্রাঙ্কে, নিছক অ্যানটিক হিসেবে প্রচারব্যবস্থার প্রতি নিতান্ত আবেগবশত বিংশ শতাব্দীর শেষে জাপানিরা রঙিন ফোটোগ্রাফির ব্যাপারটায় এমন বিপ্লব এনেছিল যে মুদ্রণের কোনো মানেই থাকল না। এখন এসব ছাপাখানা ফিরিয়ে এনে কী লাভ? আরেকটা বাজে প্রস্তাব ছিল, মানবদেহে নতুন এক ব্যাসিলাস বীজাণু ফুঁড়ে দিয়ে নাকি মানুষকে অমর করে দেওয়া যাবে। একজন রসায়নবিদ এসে দাবি করেছেন, তিনি নাকি নতুন কী একটা জিনিস আবিষ্কার করেছেন, নিহিলিয়াম, যার ১ গ্রামের দাম নাকি ৩ কোটি ডলার। আরেকজন, তিনি এক পদার্থবিদ, তিনি এসে দাবি করেছেন, তিনি নাকি সর্দি সারানোর একটা ওষুধ বের করেছেন।

তাঁদের সবাইকে অবশ্য তখনই চলে যেতে বলা হলো। কয়েকজনকে আবার সাদরে অভ্যর্থনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ছিল এক তরুণ যুবক, যার চওড়া কপাল আর ঝোপের মতো জোড়া ভুরু দেখে মনে হচ্ছিল সে তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী।

‘স্যার’, সে বলতে শুরু করল, ‘আপনি তো জানেন এককালে লোক হিসাব করে দেখেছিল মৌলিক পদার্থের সংখ্যা ৭৫। যদিও এখন আমরা জানি যে আসলে মৌলিক পদার্থের সংখ্যা হচ্ছে মাত্র ৩?’

‘হ্যাঁ, সে তো সবাই জানে’, উত্তর দিলেন ফ্রান্সিস বেনেট।

‘কিন্তু আমি এখন ওই তিনকেও কমিয়ে একটিমাত্র মৌলিক উপাদানে রূপান্তরিত করে দিতে পারব। আমার পুঁজি যদি শেষ না হয়ে যেত, তবে তিন সপ্তাহে আমি পদ্ধতিটা বের করে ফেলতে পারতাম।’

‘তারপর?’

‘তারপর পাব সত্যিকারের অ্যাবসলিউট।’

‘এই আবিষ্কারের ফলাফলটা কী হতো?’

‘তাতে সব বস্তু নির্মাণের ব্যাপারটা সহজ হয়ে আসত। অর্থাৎ শিলাপাথর, কাঠ, ধাতু, ফাইব্রিন।’

‘তার মানে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে মানুষও বানিয়ে দিতে পারবেন?’

‘নিশ্চয়ই, তবে সে মানুষ থাকবে না, আত্মা।’

‘ও, মাত্র এটাই বাকি থাকবে?’ ফ্রান্সিস বেনেটের বিদ্রূপাত্মক বাক্যটা ছিল এটাই। কিন্তু তরুণ যুবকটিকে তিনি আর্থ হেরাল্ড–এর সায়েন্টিফিক অডিটরিয়াম ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিলেন।

দ্বিতীয় একজন উদ্ভাবক, উনবিংশ শতাব্দীর কয়েকটি ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্ট ব্যবহার করে দাবি করেছেন, তিনি নাকি আস্ত শহরকে একেকটি খোপে পুরে এখান থেকে ওখানে চালান করে দিতে পারবেন। তিনি দাবি করছেন, দৃষ্টান্ত হিসেবে সমুদ্র থেকে পনেরো মাইল দূরে সাফ নামে যে শহরটি আছে, তাকে তিনি রেলগাড়িতে করে সমুদ্রতীরে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রতীরের সুন্দর শহরে বদলে দিতে পারবেন। শহরটা তখন পর্যটকদের আকর্ষণ হয়ে উঠবে। তাতে যে জমিতে এখন কিছু তৈরি হয়ে গেছে, সে জমি ফাঁকা হয়ে যাবে। আর সেখানে নতুন কিছু তৈরি করা যাবে।

আইডিয়াটা মনে ধরেছে ফ্রান্সিস বেনেটের। তিনি তাঁর অধিক শেয়ার কিনে নিতে রাজি হয়েছেন।

তৃতীয় উদ্ভাবক বললেন, ‘আমাদের যে সৌর বা পার্থিব শক্তি সঞ্চয় করে নেওয়ার উপায়গুলো আছে, যত রকম অ্যাকুমুলেটর আর ট্রান্সফরমার, তার সাহায্যে আমরা ঋতুদের এক রকম করে দিতে পেরেছি। তীব্র ঠান্ডাও এখন পড়ে না, দুর্দান্ত গরমও পড়ে না। ঋতুগুলো সব পরস্পরের খুব কাছাকাছি হয়ে এসেছে। আমাদের হাতে যত উত্তাপ আছে, তা আমরা পাঠিয়ে দিতে পারব মেরুদেশে এবং বরফ গলিয়ে দিতে পারব।’

‘আপনার পরিকল্পনা রেখে যান’, ফ্রান্সিস বেনেট তাকে বললেন, ‘এক সপ্তাহ পর এসে খোঁজ নেবেন।’

সবশেষে চতুর্থ একজন উদ্ভাবক এসে বললেন, ‘যে প্রশ্নটা এত দিন ধরে সারা বিশ্ব উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছিল, আজ সন্ধ্যাবেলায় তার সমাধান পাওয়া যাবে।’

খবরটা অবশ্য সবাই জানেন। এক শতাব্দী আগে ডা. ন্যাথানিয়েল ফেইথবার্ন যে দুঃসাহসী গবেষণাটি শুরু করেছিলেন, সেটা সারা বিশ্বে দুর্দান্ত আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। সাপের মতো ঘুমিয়ে নিষ্ক্রিয়ভাবে থেকে শীত কাটিয়ে দেওয়ার নাম হাইবারনেশন। ডা. ফেইথবার্ন বিশ্বাস করতেন যে মানুষও তেমনি শীতে ঘুমিয়ে কাটাতে পারে, তারপর জেগে উঠতে পারে বসন্তে, অর্থাৎ তার জীবনী শক্তিকে সাময়িকভাবে থামিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ বাদেই তাকে আবার জাগিয়ে দেওয়া যাবে। ডা. ন্যাথানিয়েল ফেইথবার্ন তাঁর উদ্ভাবনটিকে নিজের ওপরই প্রয়োগ করে দেখবেন বলে স্থির করেছিলেন। নিজের হাতে তিনি তাঁর উইল লিখে গিয়েছিলেন, এ জন্য পরে কাউকে ঝামেলায় পড়তে না হয়। সেই হলোগ্রাফ উইলে তিনি লিখে গিয়েছিলেন, ১০০ বছর পর কীভাবে কী কী পদ্ধতি ব্যবহার করে আবার তাঁকে বাঁচিয়ে দেওয়া যাবে, আর আজই হলো সেই দিন। নিজেকে তিনি শূন্যের নিচে ১৭২ সেন্টিগ্রেড, অর্থাৎ ২৭৮ ফারেনহাইট ঠান্ডায় রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, অর্থাৎ প্রায় একটা মমির মতো হয়ে থাকবেন সেই ঠান্ডায়। সেই ব্যবস্থা করে ১০০ বছরের জন্য তিনি ঢুকে পড়েছিলেন একটি কফিনের মধ্যে।

আজ ২৫ জুলাই, ২৮৮৯। সেই ১০০ বছর কাঁটায় কাঁটায় কেটে যাবে। ফ্রান্সিস বেনেট সদ্য সদ্য একটা আমন্ত্রণ পেয়েছেন, আর্থ হেরাল্ড–এর একটা অফিসে গিয়ে নিজের চোখে সেই পুনরুজ্জীবন দেখার জন্য। লোকে যার জন্য এত দিন ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। জনসাধারণকে আর্থ হেরাল্ড–এর মাধ্যমে এই পুনরুত্থানের ধারাবিবরণী দেওয়া যাবে।

প্রস্তাবটা লুফে নিয়েছেন ফ্রান্সিস বেনেট। যেহেতু পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়া শুরু হবে রাত ১০টায়, সব রকম প্রস্তুতির জন্য হাতে এখন বেশ খানিকটা সময়ও আছে। ফ্রান্সিস বেনেট নিজেকে এলিয়ে দিলেন বসার ঘরে একটি আরামকেদারায়। তারপর সুইচ টিপে তিনি সেন্ট্রাল কনসার্টের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।

সেন্ট্রাল কনসার্ট রুমে সবাই জানে, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংগীতকারদের রচনা এক দারুণ উপভোগ্য স্বরসংগতিনির্ভর বীজগণিতের সূত্র মারফত বাজিয়ে শোনায়। সারা দিনের খাটুনির পর সেই সংগীত একটু পরেই অবসন্ন শরীরকে আবার সতেজ করে দেয়।

প্রায় অন্ধকার ঘরে ফ্রান্সিস বেনেট এক ভাবের তন্দ্রায় ডুবে গেলেন। ফ্রান্সিস বেনেট এমনকি নিজেকেও যেন আর দেখতে পারছিলেন না। কিন্তু হঠাৎ একটা দরজা খুলে গেছে কনসার্ট রুমের।

হাতের নিচেই বসানো একটা কমিউটেটরের সুইচ টিপে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে ওখানে?’

সঙ্গে সঙ্গে ইথারের ওপর বিদ্যুতের প্রভাব দেখা গেল যেন। ঘরের বাতাস যেন প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠল।

‘ওঃ, আপনি ডাক্তার?’ জিজ্ঞেস করলেন ফ্রান্সিস বেনেট।

‘হ্যাঁ, আমি’, উত্তর দিলেন ডা. স্যাম, তিনি প্রতিদিনের মতো বেনেটকে চেকআপ করতে এসেছেন, তার জন্য অবশ্য একটা বার্ষিক ফি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ‘কেমন আছেন?’

‘ভালো।’

‘ফাইন... দেখি জিবটা দেখি ...’

একটা মাইক্রোসকোপ দিয়ে তিনি জিবটা খুঁটিয়ে দেখলেন।

‘চমৎকার...এবার হাতটা দিন তো, পালসটা দেখি।’

একটা পালসোগ্রাফ দিয়ে তিনি নাড়ি দেখলেন। দেখতে প্রায় সিসমোগ্রাফের মতোই।

‘চমৎকার। খিদের খবর কী?’

‘মোটামুটি। পাকস্থলী ভোগাচ্ছে...সেটা খুব ভালো চলছে না, পুরোনো হয়ে গেছে এবার সেটা বদলানো উচিত।’

‘দেখা যাক।’ ফ্রান্সিস বেনেট বললেন, ‘ডাক্তার, আমার সঙ্গে খেতে বসবেন তো!! খাবার সময় ফোনোটেলিফোটিক যোগাযোগ করা হলো প্যারিসের সঙ্গে। মিসেস বেনেটও তখন নৈশভোজে বসেছিলেন, আর ডাক্তার স্যামের রসাল টীকা-টিপ্পনীতে ভোজটা বেশ উপভোগ্যই হয়ে উঠেছিল। খাওয়া শেষ হতে না হতেই ফ্রান্সিস বেনেট জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা এডিথ, তুমি কবে সেনট্রোপলিসে ফিরবে বলে ভাবছ?’

‘এক্ষুনি রওনা হচ্ছি।’

‘টিউব, না এয়ারোট্রেনে?’

‘টিউবে।’

‘কখন পৌঁছাবে?’

‘রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে।’

‘প্যারিসের সময়?’

‘না না সেনট্রোপলিসের সময়।’

‘তা হলে এখন রাখছি। দেখো ‘টিউব মিস না করো।’

পাতাল টিউবগুলো দিয়ে প্যারিস থেকে সেনট্রোপলিসে এসে পৌঁছাতে লাগে ২৯৫ মিনিট। এয়ারোট্রেনের চেয়ে সাবমেরিন টিউবগুলোয় যাতায়াত করতে অনেক সুবিধা। এয়ারোট্রেন ঘণ্টায় ৬০০ মাইল যায়।

ডাক্তার ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছেন, যাওয়ার আগে বলে গেছেন তাঁর সহযোগী ন্যাথানিয়েল ফেইথবার্নের পুনরুজ্জীবনের সময় তিনি আবার ফিরে আসবেন। দিনের রোজগারের হিসাব নিতে ফ্রান্সিস বেনেট গিয়ে ঢুকলেন তাঁর ব্যক্তিগত অফিসে। রোজ ৮ লাখ ডলারের হিসাব রাখা কম কথা নয়। ভাগ্যিস, আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা এই জমা-খরচের হিসাবের ব্যাপারটা অনেক সহজ করে দিয়েছে। পিয়ানো-ইলেকট্রিক-কম্পিউটারের সাহায্যে হিসাব শেষ করতে বেশি সময় লাগেনি ফ্রান্সিস বেনেটের। এদিকে সময় হয়ে গেছে। টোটালিস্টেরটার শেষ সুইচটা সবে টিপেছেন, সঙ্গে সঙ্গে আর্থ হেরাল্ড–এর গবেষণাগারে তাঁর ডাক এল। তৎক্ষণাৎ সেখানে গিয়ে হাজির হলেন তিনি। একদল বিজ্ঞানী তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। এর মধ্যে ডা. স্যামও এসে যোগ দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

ঘরের ঠিক মাঝখানটায় কফিনে ন্যাথানিয়েল ফেইথবার্নের ঠান্ডা শরীরটা শোয়ানো। টেলিফোটের সুইচ অন করা হয়েছে। এখন সারা বিশ্ব পুরো প্রক্রিয়াটির প্রতিটি মুহূর্ত দেখতে পাবে।

কফিনের ডালা খোলা হলো। ন্যাথানিয়েল ফেইথবার্নের শরীর বের করে আনা হলো কফিন থেকে। এখনো শরীরটা মমির মতো হলুদ কঠিন, শুকনা কাঠের মতো আওয়াজ এল শরীর থেকে। আস্তে আস্তে উত্তাপ সঞ্চার করা হলো শরীরে। বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হলো, না, কোনো সাড়া নেই। ও হ্যাঁ, এটাকে তো সম্মোহিত করে রাখা হয়েছিল। সম্মোহন ভাঙানোর জন্য তাঁর কাছে পাঠানো হলো নানা ইঙ্গিত। কিন্তু কিছুতেই গতি সঞ্চার করা গেল না আড়ষ্ট দেহে।

‘কী মনে হয়, ডাক্তার স্যাম?’ জিজ্ঞেস করলেন ফ্রান্সিস বেনেট।

ডাক্তার স্যাম শরীরটার ওপর ঝুঁকে পড়লেন। অত্যন্ত যত্ন নিয়ে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন ন্যাথানিয়েল ফেইথবার্নের শরীর। শেষে একটি হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ দিয়ে তিনি বিখ্যাত খয়েরি–নীল সঞ্জীবনীর কয়েকটা ফোঁটা শরীরে পুশ করলেন। নতুন করে এই ওষুধ আবার চালু হয়েছে এ যুগে। মমি যেন আরও মমিভূত হয়ে গেল এখন।

ডা. স্যাম বললেন, ‘নিশ্চয়ই হাইবারনেশনের কালটা বেশি প্রলম্বিত হয়ে গিয়েছিল।’ ‘তার মানে?’

‘ন্যাথানিয়েল ফেইথবার্ন আর বেঁচে নেই।’

‘মারা গেছেন?’

‘যেমন সবকিছুই একদিন মারা যায়?’

‘কিন্তু কতক্ষণ হয় মারা গেছেন?’

‘মনে হয় এক শ বছর আগেই। অর্থাৎ বিজ্ঞানকে ভালোবেসেই তিনি নিজের শরীরটাকে ঠান্ডায় জমাতে চেয়েছিলেন।’

‘তা হলে পদ্ধতিটা আরও নিখুঁত করা দরকার।’ ফ্রান্সিস বেনেট বললেন।

‘নিখুঁত করা যায়নি, এটা ঠিক’, ডা. স্যাম বললেন।

বিজ্ঞানীরা কফিনে করে আবার ন্যাথানিয়েল ফেইথবার্নের দেহটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ডা. স্যামকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিস বেনেট নিজের ঘরে ফিরে এলেন। সারা দিন এত ব্যস্ততার মধ্যে কাটানোর পর তাঁকে এখন খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন শুতে যাওয়ার আগে আবার একবার গোসল করে নিতে।

‘আপনি ঠিকই বলেছেন ডাক্তার। গোসল করলে আবার তরতাজা লাগবে।’

‘নিশ্চয়ই, মিস্টার বেনেট। আপনি যদি চান তো আমি যাওয়ার সময় গোসলের ব্যবস্থা করতে বলে দিয়ে যাব।’

‘তার দরকার হবে না, ডাক্তার। আমার অফিসে সব সময়ই গোসলের ব্যবস্থা থাকে। আমাকে গোসল করতে হলে বাথরুমে যেতে হয় না। এই যে সুইচটা দেখছেন, এটাকে টিপলেই বাথটাবটা এ ঘরে চলে আসতে শুরু করে পঁচাত্তর ডিগ্রি গরম পানি নিয়ে।’

ফ্রান্সিস বেনেট সবে সুইচটা টিপছেন, অমনি শুরু হয়ে গেল একটা খরখর আওয়াজ। কিছু যেন গড়িয়ে আসছে। আওয়াজটা ক্রমে বেড়ে চলেছে। কাছে এগিয়ে আসছে। একটা দরজা খুলে গেল আপনা–আপনি। একটা বাথটাব এসে হাজির হলো রেললাইনের ওপর গড়িয়ে।

পরদিন ২৬ জুলাই ২৮৮৯ সাল। আর্থ হেরাল্ড–এর ডিরেক্টর যথাসময়ে শুরু করেছেন তাঁর নিজের অফিসে বারো মাইলব্যাপী সরেজমিন সফর। সন্ধ্যায় তাঁর হিসাবযন্ত্র গুনে দেখাল যে সেদিন মুনাফা হয়েছে মোট আড়াই লাখ ডলার। আগের দিনের চেয়ে পঞ্চাশ হাজার ডলার বেশি।

কাজটা ক্লান্তিকর হলেও উনত্রিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এর চেয়ে ভালো আর কী করতে পারেন একজন সাংবাদিক!