অধ্যাপক ও এক পোকার গল্প
ডেনমার্ককে বলা হয় রূপকথার দেশ। কারণ, দেশটিতে জন্মেছিলেন হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন নামের এক গল্পের জাদুকর। আবার ডেনমার্কের প্রাচীন ঘরবাড়ি ও দুর্গগুলো দেখেও মনে হয়, দেশটি সত্যিই এক রূপকথার রাজ্য। দুনিয়ার নানা প্রান্তের পাঠককে মুগ্ধ করে রেখেছে হান্সের লেখা দেড় শতাধিক রূপকথা। তাঁর জন্ম ১৮০৫ সালের ২ এপ্রিল, আর মৃত্যু ১৮৭৫ সালের ৪ আগস্ট। অর্থাৎ আজ হান্সের মৃত্যুর দেড় শ বছর পুরো হচ্ছে। তাঁর লেখা ‘মৎস্যকন্যা’, ‘কদাকার হাঁসছানা’, ‘রাজার নতুন জামা’ কিংবা ‘থাম্বেলিনা’র মতো গল্পগুলো তো তোমাদের পড়াই আছে। ড্যানিশ ভাষায় লেখা এসব গল্প প্রায় প্রতিটি দেশের স্থানীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এখানে তোমাদের জন্য রইল তাঁর শেষ জীবনে লেখা অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত একটি গল্প। ‘অধ্যাপক ও এক পোকার গল্প’ রূপকথাটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ সালের এপ্রিলে। গল্পটি তোমাদের জন্য অনুবাদ করলেন নিজাম বিশ্বাস।
অনেক দিন আগের কথা, তখনো বিমান আবিষ্কার হয়নি। বেলুনে করে আকাশে উড়ে বেড়াত মানুষ। সে সময় এক বেলুনচালক ছিল। ছেলেকে নিয়ে বেলুন চালাত। তাদের বেলুন ওড়ানো দেখে খুব মজা পেত লোকজন। বেলুন নিয়ে তারা যখন আকাশ থেকে নামত, হাততালিতে চারপাশ মুখর করে তুলত মানুষ। শুধু হাততালি দিয়েই থেমে থাকত না, পকেট থেকে বের করে দিত
সোনা–রুপার মুদ্রা। এই করেই বাবা-ছেলের দিন কেটে যাচ্ছিল।
অন্য সব দিনের মতো সেদিনও তারা আকাশে বেলুন নিয়ে উড়ল। হঠাৎ মাঝআকাশে বেলুনটা গেল ফেটে। তড়িঘড়ি ছেলের কাঁধে প্যারাস্যুট বেঁধে দিল বাবা। কিন্তু নিজে আর প্যারাস্যুট বাঁধার সময় পেল না। তাই ছেলেটি নিরাপদে মাটিতে নামতে পারলেও বাপ আকাশ থেকে পড়ে গেল ধপাস করে। তাকে আর বাঁচানো গেল না।
ছেলেটি তার বাবার কাছ থেকে বেলুন চালানো শিখেছিল। কিন্তু তাদের ছিল একটাই বেলুন। নতুন বেলুন কেনার মতো অর্থকড়িও তার ছিল না। তাই বাবার মতো সে আর বেলুনচালকও হতে পারল না। কিন্তু কিছু একটা তো করে খেতে হবে। তাই সে জাদু দেখানো আর সার্কাসের নানা কলাকৌশল শিখে নিল। এমনকি ভেন্ট্রিলোকুইজমও শিখে ফেলল, অর্থাৎ ঠোঁট না নাড়িয়ে কথা বলা।
দেখতে দেখতে ছেলেটি যুবক হয়ে উঠল। খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারত আর পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরে সব সময় পরিপাটি হয়ে থাকত। একদিন এক তরুণী জাদু দেখতে এসে তার প্রেমে পড়ে গেল। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা বিয়েও করে ফেলল।
যুবকটির স্বপ্ন, সে একদিন তার বউকে নিয়ে বেলুনে উড়বে। এর জন্য তো অনেক টাকাপয়সার প্রয়োজন। তাই তারা আরও বেশি টাকা উপার্জনের জন্য পাড়ি জমাল ভিনদেশে।
নতুন দেশে এসে নিজেকে অধ্যাপক বলে পরিচয় দিতে শুরু করল যুবক। তার কথাবার্তা আর পোশাক–পরিচ্ছদ দেখে সবাই তাকে অধ্যাপক হিসেবেই মেনে নিল। কিন্তু অধ্যাপক একান্তই শখের বশে এই জাদুর খেলা দেখায়। আর তার বউ সেই খেলার টিকিট বিক্রি করে। টিকিট বিক্রি হয়ে গেলে সে–ও স্বামীর সঙ্গে জাদুর খেলায় অংশ নেয়।
এভাবেই তাদের দিন কেটে যাচ্ছিল। একদিন তাদের কোলজুড়ে এল এক পুত্রসন্তান।
অধ্যাপক এখন তার বউ আর সন্তানকে দিয়েও জাদুর খেলা দেখায়। কিন্তু তাদের আয়রোজগার আর আগের মতো নেই। তাই তার বউ খুব চিন্তিত।
একদিন সন্ধ্যায় অন্য সব দিনের মতোই অধ্যাপক জাদু দেখাচ্ছিল। একটা বড় টেবিলের ড্রয়ারে স্ত্রী-পুত্রকে ঢুকিয়ে অদৃশ্য করে ফেলার খেলা। কিন্তু এবার সত্যি সত্যি তারা অদৃশ্য হয়ে গেল! মঞ্চের পেছনে, নিচে, এমনকি ঘরের ভেতরেও তাদের আর খুঁজে পাওয়া গেল না। তাকে ছেড়ে তারা চলে গেছে।
স্ত্রী–সন্তান চলে যাওয়ার পর অধ্যাপক বেকার হয়ে পড়ল। এখন আর সে জাদুর খেলা দেখায় না। তার সেই রংচঙা জাদুকরের জামাটিও পুরোনো হয়ে গেছে। কাকে দিয়েই–বা এখন খেলা দেখাবে! স্ত্রী–সন্তান চলে যাওয়ার পর তার কাছে আছে শুধু একটি বড় পোকা।
অধ্যাপকেরও থাকার সুব্যবস্থা হলো। তার জন্য হাতির চোখ, জিরাফের মাংসসহ নানা রকম খাবারের আয়োজন ছিল। কিন্তু অধ্যাপক তো ভ্রমণপিপাসু মানুষ, এভাবে বসে থেকে হাঁপিয়ে উঠল। আবার রাজকন্যাও তার পোকাটিকে ফেরত দিচ্ছে না। পোকাটি না নিয়ে কোথাও যেতেও পারছে না।
পোকাটি অনেক দিন ধরেই পুষছিল। তাই সেই পোকাটিকে এখন নানা ধরনের খেলা শেখাতে শুরু করল। অল্প সময়ের মধ্যে পোকাটিও মানুষের মতো বেশ কিছু খেলা শিখে ফেলল। গাড়ি টানা, কামানের গোলা ফাটানোসহ অনেক রকম খেলা। তাকে নিয়েই এখন দেশে দেশে খেলা দেখিয়ে বেড়ায় অধ্যাপক।
সেই পোকার নামডাক ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। পত্রপত্রিকায় খবর বের হলো। আজ এই দেশ, কাল ওই দেশ করে করে অধ্যাপকের বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল। পোকার খেলা দেখার জন্য রাজপ্রাসাদ থেকেও নিমন্ত্রণ আসতে শুরু করল। আয়রোজগারও হচ্ছিল ভালো। তবু সেটা বেলুন বানানোর মতো যথেষ্ট ছিল না। অধ্যাপকের যে একটাই ইচ্ছা—আবারও বেলুনে চড়ে দেখবে পৃথিবীটাকে।
আশপাশের প্রায় সব দেশই ঘোরা হয়ে গেছে। এখন বাকি শুধু একটাই দেশ। সেই দেশে গহিন জঙ্গল। দেশের শাসক ছয় বছর বয়সী এক রাজকন্যা। দীর্ঘ ভ্রমণের পর অধ্যাপক তার পোকাটিকে নিয়ে অবশেষে সেই দেশে এসে পৌঁছাল।
রাজপ্রাসাদ থেকে নিমন্ত্রণ এল। রাজকন্যাকে পোকার নানা রকম খেলা দেখাল অধ্যাপক। পোকার খেলা দেখে রাজকন্যা বেজায় খুশি। এই পোকা তার চাই-ই চাই। তাই সে পোকাটিকে একটা চুল দিয়ে চুড়ির সঙ্গে বেঁধে নিল, যেন সব সময় সেটি তার সঙ্গে থাকে।
অধ্যাপকেরও থাকার সুব্যবস্থা হলো। তার জন্য হাতির চোখ, জিরাফের মাংসসহ নানা রকম খাবারের আয়োজন ছিল। কিন্তু অধ্যাপক তো ভ্রমণপিপাসু মানুষ, এভাবে বসে থেকে হাঁপিয়ে উঠল। আবার রাজকন্যাও তার পোকাটিকে ফেরত দিচ্ছে না। পোকাটি না নিয়ে কোথাও যেতেও পারছে না।
দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিল। কিছুতেই রাজকন্যার কাছ থেকে পোকাটি নেওয়া যাচ্ছে না। অধ্যাপক তাই একটা বুদ্ধি আঁটল। রাজকন্যা ও প্রাসাদের গণ্যমান্য লোকদের জানাল, সে কামান বানাতে পারে। এ কথা শুনে প্রাসাদের লোকজন দারুণ খুশি। সেই রাজ্যে কোনো কামান ছিল না, তাই কামান বানানোর জন্য যা যা দরকার, সবকিছু তাকে দেওয়া হলো।
অধ্যাপক কামান বানানোর নাম করে একটা মস্ত বড় বেলুন বানানোর মতলব আঁটল। সে দেশের মানুষ আগে কখনো বেলুনও দেখেনি, তাই শুরুতে তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। দিনের পর দিন চলল সেই কাজ। তারপর বেলুন বানানো শেষে অধ্যাপক গিয়ে বসল সেই বেলুনের নিচে ঝুলে থাকা বাক্সে।
বেলুনের ভেতরে গরম হাওয়ার ব্যবস্থা করে তবেই তা আকাশে ওড়াতে হয়। তাই বেলুনের সঙ্গে বাঁধা আগুন জ্বালানোর চুল্লিকে লোকজন নতুন একধরনের কামান ভেবেছিল। এখন কামানে আগুন ধরানোর সময় হয়েছে। অধ্যাপক বলল, এ কাজে তার একজন সহকারী চাই। আর পোকাটিই পারবে তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে। কিন্তু রাজকন্যা কিছুতেই পোকাটিকে হাতছাড়া করবে না। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজকন্যাকে রাজি করানো গেল।
বেলুনের নিচে ঝুলে থাকা বাক্সে পোকাকে নিয়ে বসে আছে অধ্যাপক। চুল্লিতে আগুন ধরানো হলো। সবাই ভাবল, কামানে আগুন দেওয়া হয়েছে। গরম হাওয়ায় বেলুনটি ফুলে উঠল। রাজ্যের কেউ এমন জিনিস আগে কখনোই দেখেনি। সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। ধীরে ধীরে বেলুনটি উঠে গেল শূন্যে। লোকজন দারুণ মজা পেল। কিন্তু বেলুনটি একসময় আকাশের অনেক ওপরে উঠে গেল, একেবারে মেঘের ওপরে। তখন সবাই ভাবল, এই নতুন কামানের গোলা শেষ হলেই তারা আবার নেমে আসবে। কিন্তু তারা আর নেমে এল না।
অধ্যাপক পোকাটিকে সঙ্গে নিয়ে বেলুনে চড়ে তার নিজের দেশে চলে গেল। তার বেলুন ওড়ানোর স্বপ্ন অবশেষে সত্যি হলো।
(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)