রাফাত শামসের সায়েন্স ফিকশন—বিকল্পী
আমি হতাশ চোখে সারি সারি সুন্দরীর দিকে তাকলাম।
এই অনিন্দ্যসুন্দর আকৃতিগুলো আদতে মানুষ নয়, রোবট। সবার বিশেষ ফটোসেলের চোখগুলো বর্তমানে নির্জীব হয়ে আছে। তাদের চালু করলে অবশ্য সেখানে জীবনের সঞ্চার হয়। চপলতা, দুষ্টুমি, কৌতুক বা অভিমান—সব ধরনের আবেগ সেখানে খেলা করে। বিজ্ঞান অন্তত এই পর্যন্ত এসেছে।
আমি বর্তমানে এই রোবট তৈরির কোম্পানিতে কাজ করছি। বছরখানেক হয়েছে এখানে যোগ দেওয়ার পর। সত্যি বলতে, আমার নিজের কাজ খারাপ লাগে না। সামান্য একঘেয়েমি চলে এসেছে বটে। তবে আমার কর্মক্ষেত্রের মানুষজন, এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থকড়ি ও অন্যান্য সুবিধায় বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে বলা যায়।
মাঝেমধ্যে অবশ্য কাজের চাপ একদম তুঙ্গে উঠে যায়। এই যেমন এখন।
এই সারি সারি রোবট কিন্তু বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, ফেরত এসেছে ওয়ারেন্টি–সংক্রান্ত কারণে। তাদের মধ্যে একটা উদ্ভট সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এই নিয়ে আজ সারা দিন মিটিং-কনফারেন্স করে একদম নাজেহাল অবস্থা আমার। সভা বসেছিল অন্য বিভাগগুলোর সঙ্গে। এ রকম দামি, অভিজাত, মানুষসদৃশ রোবট তৈরির বেশ অনেকগুলো প্রক্রিয়া আছে। একটা বিভাগ মানুষের ত্বকের কাছাকাছি পলিমারের ব্যবস্থা করে। সেটা দেখা ও ছোঁয়ার সময় প্রায় ফারাক করা যায় না আর দশটা মানুষের চামড়ার সঙ্গে।
এই বিশেষ পলিমার অন্য এক কোম্পানি প্রস্তুত করে থাকে, আমরা তাদের কাছ থেকে কিনি। নানা আইনি জটিলতা আছে এই প্রক্রিয়ায়। আজ সেই কোম্পানির দুজন প্রতিনিধিও ছিলেন সভায়। চামড়া ছাড়া আরও ছিল তড়িৎকৌশল, যন্ত্রকৌশল, জীবকৌশল ইত্যাদি বিভাগের প্রতিনিধিরা। মোট সত্তরটা বিভাগে বিভক্ত আমরা, সবাই-ই ছিলাম।
চুলচেরা বিশ্লেষণ চলল, কেন রোবটগুলোর মধ্যে ত্রুটির আবির্ভাব? যদিও বাহ্যিক কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি, তবু কাঠামো তৈরির সঙ্গে জড়িত প্রতিনিধিরাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সবার আগে তাঁদের ছুটি হলো। কাঠামোগত কোনো সমস্যা নেই। রোবটের ত্বকের পেলবতা, রং, চাকচিক্য, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা—সব ঠিক আছে।
সমস্যাটা দেখা দিতে পারে সম্ভাব্য দুই জায়গায়; কোনো একটা ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশে সমস্যা অথবা প্রোগ্রামিংয়ের গলদ।
নিবিষ্টমনে তাকিয়ে ছিলাম স্ক্রিনের দিকে। একের পর এক কোড দেখছিলাম। টিনার কণ্ঠ শুনে মুখ তুলে তাকালাম। টিনা আমার অধস্তন। বিজ্ঞানবিশেষজ্ঞ। রোগা-পটকা মেয়ে, কাজপাগল। তীক্ষ্ণ নীল চোখ তার।
প্রোগ্রামিংয়ের মধ্যেও আবার ফারাক আছে। এখানে আবার সভার সবাই প্রায় একত্রে ভ্রুকুটিসহ তাকিয়েছিল আমার দিকে। কারণ, আবেগের প্রোগ্রামিং করার দায়িত্ব আমার বিভাগের ওপর ন্যস্ত।
মিটিং শেষ করে আমি এসেছি সেলস ডিপার্টমেন্টে। এখানে ফেরত আসা রোবটগুলো সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এখান থেকে কয়েকটি নমুনা নিয়ে চলে যাব আমার বিভাগে। দুটো নির্বাচন করলাম। বিশেষ একটা যানে তোলা হলো সেগুলো। আমি উঠে বসলাম প্যাসেঞ্জার কেবিনে। নিঃশব্দে আমার বিভাগের দিকে চলতে শুরু করল যান।
আমি ও আমার দলের অন্যরা শত চেষ্টা চালিয়েও কোনো ত্রুটি বের করতে পারলাম না। কালঘাম ছুটে যাওয়া বোধ হয় একেই বলে। সব ঠিক আছে, রোবটের ব্যবহারাদি এমনটা হওয়ার কোনো কারণই নেই।
ওহ, বলতে ভুলে গেছি মূল সমস্যাটা।
তার আগে এসব রোবট কী উদ্দেশ্যে তৈরি হয়, সেদিকে আলোকপাত করি। এরা মূলত বিকল্প ব্যবস্থা। এর প্রবর্তন হয়েছিল আরও প্রায় ত্রিশ বছর আগে। এ ধরনের রোবটের একটা সুন্দর নামও আছে, বিকল্পী।
বিকল্পী প্রজেক্ট আমাদের কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মহামতি ডিওর মাথায় আসে তাঁর স্ত্রীর অপমৃত্যুর পর। গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন তিনি। অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক প্রকল্প চালাচ্ছিলেন তিনি ও তাঁর পরিবার। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন, সন্তানের তিন বছর বয়সে আন্তগ্রহ ভ্রমণের সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাঁর স্ত্রী গত হন।
দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন ডিও। সন্তানকে মায়ের অভাব ভুলিয়ে রাখতে পরিবারের কেউ কোনো ত্রুটি রাখল না। তবু মহামতি ডিওর মন মানল না। ‘মা চলে আসবে, আসছে’ ধরনের মিথ্যা আশ্বাস তিনি আর দিতে পারছিলেন না শিশুটিকে।
সেখান থেকেই বিকল্পীর যাত্রা শুরু। ছেলেকে মায়ের অভাব ভোলানো এই প্রকল্পের লক্ষ্য। এখানে পরিবারের সমর্থনও পেয়েছিলেন ডিও। সমন্বিত হয়েছিল বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলীরা।
তাঁদের সফল নিবেদন ছিল প্রথম বিকল্পী, বি ১। মহামতি ডিওর স্ত্রীর আদলে তৈরি। তাঁর মতোই কথাবার্তা, চালচলন, হাসি আর কান্না। এমনকি কণ্ঠস্বরটাও একই রকম। ভদ্রমহিলার গোটা জীবনের স্মৃতি উদ্ধার করতে অনেক হ্যাপা পোহাতে হয়েছিল মহামতি ডিওকে।
সেই বি ১–এর কাছেই মানুষ হয়েছে মহামতি ডিওর ছেলে জিম। বর্তমানে তিনি কোম্পানিতে ডিরেক্টর পদে আছেন।
চারদিকে হইচই ফেলে দিয়েছিল বি ১। অন্যান্য গ্রহ থেকেও সাংবাদিকেরা এসে ভিড় জমাতে লাগল। লম্বা লম্বা টক শো হলো। কেউ এই বিকল্পীর ঘোর বিরোধী, তো কেউ পক্ষে। হাজার রকম আইনি জটিলতা তৈরি হলো। তখন একটা প্রশ্নকে বেশ খেলো মনে হয়েছিল, এ রকম মানুষসদৃশ রোবট যদি একদিন মানুষের জায়গা দখল করে নেয়?
তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। হাজার বছর আগের সব বস্তাপচা সায়েন্স ফিকশন ছায়াছবি দেখে এসব প্রশ্নকারীর মতিভ্রম হয়েছে। এত সহজ নাকি সব? প্রতিটা কোডের লাইন তৈরি করা হয় নিবিড় যত্নে। প্রতিটা অঙ্গ-নাটবল্টু বানানো হয় কঠোর অবস্থায়। এর মধ্যে রোবটরা ঘোঁট পাকিয়ে বিদ্রোহ করে ফেলবে? বললেই হলো?
আমি এখনো মনে করি না এই ‘রোবট বিদ্রোহ’ হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। তবে আমাদের বিকল্পীতে হওয়া সমস্যাটা আমার কপালে কিছু চিন্তার রেখা ফুটিয়েছে।
সমস্যাটা সবার আগে ধরা পড়ে একটি স্কুল ডিস্ট্রিক্টে। আমাদের বিকল্পীর একদম সর্বশেষ মডেলের একটি নমুনা স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরছিল। বিকল্পীরা গাড়ি চালানোর ব্যাপারে খুব দক্ষ। এমনকি যদি কোনো দুর্ঘটনার কবলেও পড়ে, ওদের প্রথম কাজ হয় সঙ্গে থাকা মানুষদের রক্ষা করা। সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পায় শিশুরা। বিকল্পীর সঙ্গে শিশুদের ভিন্ন এক বন্ধন তৈরি হয়। একবার এক বিকল্পী নিজের দেহের বেশ খানিকটা ক্ষতি করে অগ্নিকাণ্ড থেকে তার মালিকের সন্তানকে বাঁচিয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল সেই খবর। আমাদের কোম্পানির স্টকের দাম হু হু করে বেড়ে চলেছিল। সেই বিকল্পীর নাম ছিল দ্বীপা। রাতারাতি দ্বীপার নামে ফ্যানপেজ খুলে যায়, জুটে যায় লাখ লাখ অনুসারী। আমাদের কোম্পানি বিনা মূল্যে দ্বীপাকে মেরামত করে দিয়েছিল।
আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। অভিযুক্ত বিকল্পী বাড়িতে ফেরার পথে আচমকা মাঝরাস্তায় গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়। রাস্তার এক পাশে গাড়ি রেখে নেমে যায় সে। তারপর শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সড়কের এক প্রান্তের দিকে।
সঙ্গে থাকা শিশুটা ভয় পেয়ে যায়। বিকল্পীকে কয়েকবার ডাকে। সাড়া দেয় রোবট। আবার গাড়িতে উঠে বসে, এরপর বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যায় বাড়িতে।
এর পর থেকে সেই বিকল্পীর মধ্যে কেমন যেন একটা পরিবর্তন আসে। তাকে প্রশ্ন করলে উত্তর আসতে সময় নিতে থাকে। চোখে ফুটে ওঠে রাজ্যের বিষণ্নতা। বিকল্পীদের মেজাজের একটা মিটার থাকে ব্যবহারকারীদের কাছে। সেখানেও জ্বলে আছে লাল আলো। বিকল্পী বিষণ্ন হয়ে আছে।
এ রকম আরও অভিযোগ আসতে থাকে। কারও বিকল্পী শপিং মলে আচমকা ব্রেক কষেছে, তো কারওটা সুইমিংপুলে। সৌভাগ্যবশত এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এত বিষণ্নতার মধ্যেও তারা তাদের সঙ্গে থাকা শিশুর প্রতি কোনো অবহেলা দেখায়নি।
তবে এ রকম দামি রোবটের জন্য এই ত্রুটিও অনেক। এতক্ষণে চাউর হয়ে গেছে খবরটা। ‘অনুভূতিবিহীন রোবট’-এর পক্ষের লোকজন আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ তো আমাদের একদম মুণ্ডুপাত করছে।
অফিসে সুরাহা করতে পারলাম না কোনো। সব ঠিক আছে। সব ধরনের কোড ঠিক আছে। কীভাবে সাড়া দেবে, কীভাবে কাজ করবে, কাকে অগ্রাধিকার দেবে—সব একদম ঠিকঠাক। কয়েকবার সিমুলেশন চালানো হলো। কোনো ভুল ধরা পড়ল না।
‘ডক্টর?’
নিবিষ্টমনে তাকিয়ে ছিলাম স্ক্রিনের দিকে। একের পর এক কোড দেখছিলাম। টিনার কণ্ঠ শুনে মুখ তুলে তাকালাম। টিনা আমার অধস্তন। বিজ্ঞানবিশেষজ্ঞ। রোগা-পটকা মেয়ে, কাজপাগল। তীক্ষ্ণ নীল চোখ তার।
‘কিছু পেলে?’
‘না, ডক্টর। সব কোড একদম ঠিক আছে। কোথাও কোনো সমস্যা পাচ্ছি না।’
‘সমস্যা না থাকলে তো এ রকম মন খারাপ করে বসে থাকার কথা নয় রোবটগুলোর, তাই না?’ চড়া গলায় বলে বসলাম। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। টিনার তো কোনো দোষ নেই। কাজে বেশ তুখোড় মেয়েটা। এই দুর্যোগের সময় খামাখা ধমক খেলে বরং কাজের স্পৃহা আরও হারিয়ে ফেলতে পারে।
‘দুঃখিত। তোমার ওপর ওভাবে খেঁকিয়ে ওঠা ঠিক হয়নি আমার।’ অনুশোচনা ভরা কণ্ঠে টিনাকে বললাম আমি।
‘না, না। আমি কিছু মনে করিনি। আপনি প্রচণ্ড চাপে আছেন।’
‘চাপে থাকি আর যা–ই থাকি, সেটা দুর্ব্যবহার করার কৈফিয়ত হতে পারে না।’ বলে মৃদু হাসলাম। টিনাও হাসল। আড়মোড়া ভেঙে চুলে আঙুল চালালাম। আচমকা একটা ব্যাপার মনে হলো।
‘আচ্ছা টিনা, চাপে থাকলে বিকল্পীরা কীভাবে কাজ করবে, সেই কোডগুলো দেখেছ?’
মহামান্য ডিওকে আমি আবিষ্কার করলাম একটা গোলাকার বসার ঘরে। আসবাবের কোনো আধিক্য নেই। তবে যা আছে, সেসব অত্যন্ত রুচিশীল, দামি ও আরামদায়ক।
প্রশ্নটা করেই বুঝলাম, বোকার মতো কিছু বলে ফেলেছি। যদিও বিচিত্র ব্যবহার করার সময় কোনো বিকল্পীই চাপে ছিল না। তাদের এই আচমকা আনমনা হয়ে যাওয়াটা হয়েছে একদম দৈনন্দিক কোনো কাজের ফাঁকেই। তবু বেশ কয়েকবার এই মানসিক চাপের অংশটা দেখা হয়েছে। আমি দেখেছি, টিনা দেখেছে। অন্যরাও দেখেছে। বলা বাহুল্য, কিছুই পাওয়া যায়নি।
টিনা অবশ্য কোনো বিরক্তি বা অভক্তি প্রদর্শন করল না। হাসিমুখে বলল, ‘হয়েছে, ডক্টর। আপনি বাড়িতে যাবেন না?’
সহসা স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে চারপাশে তাকালাম। বর্তমানে কোডের একটি টার্মিনালে বসে আছি আমি। আশপাশের টার্মিনালগুলো ফাঁকা। সবাই ক্লান্ত দেহে একে একে অফিস ত্যাগ করেছে। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছে অবশ্য। অমনোযোগীভাবে মাথা নেড়ে তাদের সবাইকে বিদায়ও জানিয়েছি। এরপর কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে ভুলে গেছি বেমালুম।
টিনা রয়ে গেছে।
‘তুমি যাও। আমি আর কিছুক্ষণ দেখব।’
টিনা কথা বাড়াল না। উচ্চতর কর্মকর্তার আদেশ বিনা বাক্যে মেনে নিল। ব্যাগ গুছিয়ে, বিদায় নিয়ে, ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল বিশাল কামরাটা থেকে।
আমি একবার দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালাম। সুবিশাল, জনশূন্য ঘরটাকে ভুতুড়ে লাগল আমার কাছে। আবার ধপ করে বসে পড়লাম।
মাথা কাজ করতে চাচ্ছে না। সারা দিনের ধকল যেন একসঙ্গে পেয়ে বসল আমাকে।
কড়া এক কাপ চা নিয়ে নিলাম মেশিন থেকে। এবার আর টার্মিনালে গেলাম না, বিশাল হলঘরের একদম শেষ মাথায় নিজের অফিস কামরায় গিয়ে ঢুকলাম। চায়ে একটা চুমুক দেওয়ার পর একটু চাঙা লাগল। মাথার ভেতর পোকার মতো গুঁতাচ্ছে। কেন এই উদ্ভট ব্যবহার?
দুবার তুড়ি দিয়ে আমার সামনে উদয় হলো একটি ভার্চ্যুয়াল বোর্ডের। সেখানে একে একে লিখতে লাগলাম যা যা জানি।
কর্তব্য পালনে গাফিলতি নেই।
যান্ত্রিক/শারীরিক কোনো সমস্যা নেই।
কণ্ঠস্বরে বিষাদ ভর করে।
অন্যমনস্কতা শুরু হয়।
সবকিছু টুকে রেখে পাশে একটা বিশাল বৃত্ত আঁকলাম। তার মধ্যে লিখলাম: মূল সমস্যা।
রোবট কেন আনমনা হবে? এমন কোনো কোড তো কোথাও দেখলাম না! কিছু কোড নতুন করে লেখা হয়েছে। তবু সমস্যা যায়নি।
এই সমস্যার সমাধান করতে হলে একদম গভীরে যেতে হবে। একদম মূলে।
সহসা মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল।
দুদ্দার করে দৌড়ে বের হলাম। ছুটে গেলাম টার্মিনালে। লগইন করলাম শক্তিশালী কম্পিউটারে।
বিশেষ একটা ফাইলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। আচরণ বিভাগের প্রধান হওয়ায় প্রায় সব ফোল্ডারে আমার আসা-যাওয়া করার অনুমতি আছে। কোম্পানির অনেক অধস্তন এসব ফোল্ডারে ঢুকতে পারে না।
তবে আমার নাগালের বাইরেও কিছু ফোল্ডার আছে। সেটা বুঝলাম সার্ভারের বিশেষ একটা ফোল্ডারে ঢুকতে গিয়ে।
দু-তিনবার চেষ্টা করার পরও গোটা গোটা অক্ষরে স্ক্রিনে ফুটে উঠল যে আমাকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
আমার ফোনটা বেজে উঠল। কোম্পানির নিরাপত্তাবিষয়ক বিভাগ থেকে ফোন। এক কর্মকর্তা গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ওই বিশেষ ফোল্ডারে আমি ঢোকার চেষ্টা করছি কি না।
অস্বীকার করার জো নেই। করলামও না।
‘আমি মহামতি ডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই।’
নিরাপত্তা কর্মকর্তা চমকে উঠল। এই অনুরোধ সে আশা করেনি, বলা বাহুল্য।
‘আমি জানি, এই ক্ষমতা আপনার নেই। আমি নিজেও কোম্পানিতে চাকরি করি। আমি জানি, নিরাপত্তা বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মকর্তার এখতিয়ার আছে যেকোনো অবস্থায় মহামতি ডিওর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার। আপনি দয়া করে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিন।’
‘প্রধান কর্মকর্তা একমাত্র জরুরি অবস্থায় যোগাযোগ করতে পারেন...’
‘এটা জরুরি অবস্থাই।’ কিছুটা চড়া গলায় বললাম আমি। ‘দেখুন, প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু আপনাকে কোনো শাস্তি দেওয়া হবে না। কিন্তু যদি কাজটা আপনি না করেন, তাহলে কোম্পানির যে ক্ষতি থাকে, তার জন্য কিন্তু আপনাকে দায়ী করা হবে।’
এবার বেচারা মানল। বলা বাহুল্য, নম্র-ভদ্র বৈজ্ঞানিক কারও কাছ থেকে এ রকম শক্তপোক্ত কথা আশা করেনি।
যোগাযোগ হলো প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার সঙ্গে। ভদ্রলোক বাড়িতে ছিল এবং আমার ফোন পেয়ে মোটেও খুশি হয়নি।
তবে সে আমার অনুরোধ রাখল।
আমি যথেষ্ট উচ্চ পদে আছি কোম্পানিতে। তারপরও একদম সরাসরি ফোনে মহামতি ডিওর সঙ্গে আমার এই প্রথম কথা বলা। ত্রিশ সেকেন্ড কথা হলো।
সেখান থেকে চোখ কপালে তোলার মতো এক ঘটনা ঘটল।
পাঁচ মিনিট পর অফিস ভবনের সামনে একটা বিশাল কালো গাড়ি এল। সেই গাড়ি আমাকে নিয়ে ছুটল মহামান্য ডিওর বাসভবনের দিকে।
মহামান্য ডিওকে আমি আবিষ্কার করলাম একটা গোলাকার বসার ঘরে। আসবাবের কোনো আধিক্য নেই। তবে যা আছে, সেসব অত্যন্ত রুচিশীল, দামি ও আরামদায়ক।
মহামতি ডিওকে দেখলে তাঁর বয়স বোঝা যায় না। ছোটখাটো মানুষ, কিন্তু অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। ঘরে ঢোকার পর আমাকে স্পষ্টকণ্ঠে বসতে বললেন।
‘আপনার ওপর দিয়ে বেশ ধকল গেছে বুঝলাম, ডক্টর শামস।’ স্মিত হেসে, মৃদু কণ্ঠে বললেন ডিও।
‘না, স্যার। তেমন কিছু নয়।’
‘বিনয়ের প্রয়োজন নেই।’ হালকা মাথা দুলিয়ে বললেন ডিও, ‘চা খাবেন? আমি খুব খুশি হব, যদি...।’
‘জ... জি। ঠিক আছে।’
চা এল। চায়ের সঙ্গে এল মুচমুচে একধরনের পেস্ট্রি। খেয়ে চমকে উঠলাম। এ রকম স্বাদু খাবার অনেক দিন খাইনি।
‘পেস্ট্রি আরও কিছু নেবেন?’ মোলায়েম কণ্ঠে বললেন মহামতি ডিও।
‘ন...না। থাক। স্যার, আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’
‘সে বুঝতে পেরেছি। বলুন কী বলবেন।’
লম্বা একটা দম নিলাম। এরপর বলা শুরু করলাম, ‘আমাদের এই নতুন মডেলের বিকল্পীতে কোনো খুঁত নেই। একগাদা মেধাবী, তুখোড় মানুষ আজ সারা দিন এই অস্তিত্ববিহীন খুঁত খুঁজে পায়নি।’
‘খুঁত না থাকলে এই আনমনা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? আমি যদ্দুর বুঝতে পারছি, আপনার কাছে একটা ব্যাখ্যা আছে।’
‘আছে।’ সামান্য হেসে বললাম, ‘ব্যাখ্যা আছে। এই আনমনা হওয়ার ব্যাপারটা আসলে কোডের ভুলের জন্য নয়। এটা একটা অব্যক্ত অনুভূতির ছাপ।’
‘বলে যান।’
‘স্যার, বিকল্পীর মতো এ রকম যুগান্তকারী আবিষ্কারের খুঁটিনাটি একান্ত গোপনীয় বিষয়। সেটা আমরা জানি। আমি নিজেও শত পাতার ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্টে সই করেছি। কিন্তু আমিও কিছু বিষয় জানি না। না জানলেও, আঁচ করতে পারি।’
মহামতি ডিও কিছু বললেন না।
‘আপনার প্রথম বিকল্পীকে তৈরি করেছিলেন ম্যাডামের আদলে। ব্যবহার করেছিলেন ম্যাডামের স্মৃতি। অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে মৃত মানুষের স্মৃতি আহরণে। এরপরে বিকল্পী প্রজেক্ট অনেক এগিয়ে গেল। কিন্তু প্রতিটি বিকল্পীর মধ্যে ছাপ রয়ে গেল একেকজন ম্যাডামের। প্রযুক্তি এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে ম্যাডামের অন্য আঙ্গিকগুলোও শিখে নিতে লাগল ডিপ মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে...’
হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন ডিও।
‘তো এই বিকল্পীরা এমন কিছু দেখেই আনমনা হচ্ছে যা দেখে জিনিয়া আনমনা হতো, তা–ই তো?’
ম্যাডামের নাম যে জিনিয়া, ভুলে গিয়েছিলাম। এক সেকেন্ড পর বুঝলাম।
‘জি, স্যার। এখন যদি ম্যাডামের স্মৃতির অ্যাকসেস পাই, তাহলে খুঁজে বের করবই, স্যার...’
আবার আমাকে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন মহামতি ডিও, মুখে বিষণ্ন হাসি। চোখ বুজে কী যেন ভাবলেন, তারপর হাতের ইশারায় শূন্যে ফুটিয়ে তুললেন একটি ছবি। হাসপাতালের ছবি, সদ্য ভূমিষ্ঠ একটি শিশুর।
‘স্যার, এটা কি আমাদের ডিরেক্টর স্যার?’
‘না। এটা ওর বড় ভাই, জিও।’ নিচু কণ্ঠে বললেন ডিও।
‘বড় ভাই...’ বিস্মিত কণ্ঠে বললাম আমি।
‘হ্যাঁ। একে আপনারা দেখেননি। কারণ, জন্মের কয়েক মাস পরই মারা যায় ও। নিউমোনিয়া। প্রাগৈতিহাসিক রোগ। আমাদের ভাগ্যেই জোটে। সে যাক, জিওকে হারানোর বেদনা কখনোই সামলে উঠতে পারেনি জিনিয়া। নিউমোনিয়ার মতো তুচ্ছ রোগে আমার সন্তান মারা গেছে, এই খবর চাউর হতে দেয়নি আমার পরিবার। আমাদের বিরাট ওষুধের ব্যবসা। স্টকের দাম লাটে উঠবে। তাই ধামাচাপা দেওয়া হলো। জিনিয়া কখনোই মেনে নেয়নি সেটা। আমি নিশ্চিত, যদি খোঁজ নেন, দেখবেন জিওর বয়সী কোনো শিশুকে দেখেই বিকল্পীরা থমকে গেছে।’