বারবার ফোনের নোটিফিকেশন চেক করলে স্মৃতিশক্তির কী ক্ষতি হয়
অনেকের কাছে এখন ফোন চেক করা অনেকটা নিশ্বাস নেওয়ার মতো। খুব স্বাভাবিক একটি প্রতিক্রিয়া। সকালে ঘুম ভাঙার পর অনেকের প্রথম কাজ হলো ফোন চেক করা। ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত এটা শতবার হয়ে যায়। আমরা হয়তো ভাবি, দিনে কয়েকবারই ফোন চেক করি। কিন্তু গবেষণা বলছে, বাস্তবতা অনেক ভয়ানক। ফোনের দিকে প্রতিনিয়ত নজর রাখায় প্রভাবিত হচ্ছে আমাদের মনোযোগ আর স্মৃতিশক্তি।
যুক্তরাজ্যের নটিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কেইমিয়ং ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে যাঁরা গড়ে প্রায় ১১০ বার বা বেশি ফোন চেক করেন, তাঁদের জন্য বিষয়টি সমস্যার। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ল্যারি রোজেন আট বছরের গবেষণায় লক্ষ করেছেন, কিশোর ও তরুণেরা ১০ থেকে ২০ মিনিট পরপর ফোন আনলক করেন। মানে দিনে ৫০ থেকে ১০০ বারেরও বেশি।
মজার বিষয় হলো, বেশির ভাগ মানুষই জানেন না তাঁরা আসলে কতবার ফোন হাতে নিচ্ছেন। ইউগভের এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বেশির ভাগই ধারণা করেছিলেন, তাঁরা দিনে মাত্র ১০ বার ফোন দেখেন। অথচ বাস্তব তথ্য বলছে, একেবারেই ভিন্ন কথা। অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএস—দুটি সিস্টেমেই এখন ‘পিকআপ’ বা কতবার ফোন ধরা হয়েছে, তার হিসাব দেখা যায়। সেই হিসাব দেখলে অনেকেই চমকে যান।
এ অভ্যাসের পেছনে কাজ করছে আমাদের মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড বা পুরস্কারব্যবস্থা। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মনোরোগ ও আসক্তি বিশেষজ্ঞ আনা লেম্বকে বলেছেন, ‘ফোন ও ডিজিটাল মিডিয়া মস্তিষ্কে ঠিক একই রিওয়ার্ড বা পুরস্কারের অনুভূতি দেয়, যেটা মাদক বা অ্যালকোহল করে। ফলে আমরা না ভেবেই ফোন চেক করি, আর ফোন হাতে না থাকলে অস্বস্তি বা অস্থিরতা তৈরি হয়।’
এই প্রভাব শুধু দিনে নয়, রাতেও কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ফোন বিছানার একদম পাশে রাখেন। ৬৬ শতাংশ মানুষ ঘুম থেকে ওঠার ১০ মিনিটের মধ্যেই ফোন দেখেন। ৬২ শতাংশ ঘুমানোর ঠিক আগেও অন্তত একবার ফোন চেক করেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কেউ কেউ রাতে ঘুমের মধ্যেও কয়েকবার ফোন হাতে নিচ্ছেন।
ফোন বারবার হাতে নিলে আসল ক্ষতিটা হয় মনোযোগে। সিঙ্গাপুর ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফোন চেক করার মতো ছোট ছোট বাধা দিনে যত বেশি ঘটে, মনোযোগ হারানো আর স্মৃতিভ্রংশের ঘটনা তত বেশি ঘটে। মোট স্ক্রিন টাইমের চেয়ে ফোন কতবার চেক করা হচ্ছে, এটাই মনোযোগ হারানোর জন্য দায়ী।
বারবার ফোন আনলক করার মানে, মস্তিষ্ককে বারবার কাজ বদলাতে বাধ্য করা। এই দ্রুত টাস্ক-সুইচিং বা কাজ পাল্টানো মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা ক্ষয় করে। বহু বছর আগেই কম্পিউটারবিজ্ঞানী জেরাল্ড ওয়েইনবার্গ সতর্ক করেছিলেন, একসঙ্গে অনেক কাজ করা বা ঘন ঘন কাজ বদলালে উৎপাদনশীলতা প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
এই অভ্যাস এখন সামাজিক জীবনেও ঢুকে পড়েছে। ইউগভের জরিপ অনুযায়ী, অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর সময়, একসঙ্গে খাওয়ার সময় বা বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গেলেও একাধিকবার ফোন দেখেন। কর্মক্ষেত্রেও পরিস্থিতি আলাদা না। মাত্র ৩০ মিনিটের মিটিংয়ে চারজনের একজন অন্তত একবার ফোন চেক করেন। আর প্রতিবার এমন বিঘ্ন ঘটলে আগের কাজে পুরো মনোযোগ ফিরে পেতে গড়ে ২৫ মিনিটেরও বেশি সময় লাগে। এমন দাবি করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষক গ্লোরিয়া মার্ক।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নোটিফিকেশনের বন্যা। মেসেজ, ই–মেইল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালার্ট, সব মিলিয়ে সারা দিনে ফোনের অসংখ্য জিনিস আমাদের মনোযোগ টানে। ল্যারি রোজেন বলেন, এই চাহিদা মস্তিষ্কে কর্টিসলের মতো উদ্বেগ বাড়ানো রাসায়নিক তৈরি করে, যা আমাদের দিনে শতবার ‘চেক ইন’ করতে তাড়না দেয়।
এটা শুধু তরুণদের সমস্যা নয়। ২০০৭ সালে প্রথম আইফোন আসার পর জীবনযাত্রা আমূল বদলে গেছে। এখন প্রায় সব প্রাপ্তবয়স্কের হাতেই স্মার্টফোন। সবাই মোটামুটি আসক্ত হয়ে পড়েছে।
জার্মানির হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৭২ ঘণ্টা স্মার্টফোন ছাড়া থাকলে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ এমন রূপ নেয়, যা অনেকটা আসক্তি ছাড়ার সময় দেখা যায়। তবে এই বিরতিই কিছু উপকারও করতে পারে।
সমাধান খুব জটিল নয়। অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ করা, দরকার নেই এমন অ্যাপ মুছে ফেলা, ফোন গ্রেস্কেলে রাখা, ব্যবহার না করলে বন্ধ করে রাখা, এসব ছোট অভ্যাস ফোনকে কম আকর্ষণীয় করে তোলে। মাঝেমধ্যে ফোন ছাড়া বাইরে যাওয়া দরকার, শুধু নিজেকে মনে করিয়ে দিতে যে ফোন ছাড়াও পৃথিবী চলে।
আসল কথা হলো, ফোনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত না হয়ে ফোনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট