পানিশূন্যতায় ইলেকট্রোলাইট কতটা দরকারি
বছর দুয়েক আগেও যেখানে শরীর ঘেমে গেলে বা পেট খারাপ হলে স্যালাইন খাওয়ার প্রচলন ছিল, এখন তার জায়গা দখল করেছে ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস। খেলাধুলা বা ব্যায়াম করলে প্রচুর ঘাম হয়, আর ঘামের সাথে শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যায়। আগে এই পরিস্থিতিতে স্যালাইন খাওয়ার কথা বলা হলেও, এখন বিজ্ঞাপনসহ সবখানে ইলেকট্রোলাইটকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এমনকি জ্বর বা দুর্বলতাতেও অনেকে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসকে সমাধান মনে করছেন। বাজারে ইলেকট্রোলাইটের ছড়াছড়ি এবং ব্যাপক বিজ্ঞাপন দেখে মনে হতে পারে এটি যেন এক ম্যাজিক পানীয়। ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে ইলেকট্রোলাইট পানীয়ের বাজার প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ছিল, যা এর জনপ্রিয়তারই প্রমাণ।
ইলেকট্রোলাইটের পণ্যগুলোর বিজ্ঞাপনে মাঝেমধ্যে দাবি করা হয়, এগুলো ব্যায়ামের সময় পান করলে শরীরকে ভালোভাবে আর্দ্র থাকে, স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়। এমনকি ব্যায়াম না করলেও এটি নাকি প্রতিদিনের পানির চাহিদা পূরণে সাহায্য করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঘামের সাথে আমাদের দেহ যে ইলেকট্রোলাইট হারায়, সেগুলো কি ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস খেয়ে সত্যিই পূরণ করার প্রয়োজন আছে?
ইলেকট্রোলাইট হলো কিছু খনিজ পদার্থ, যেমন: সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম। এগুলো ইলেকট্রিক চার্জ বহন করে এবং শরীরে তরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। কোষের ভেতরে ও বাইরে তরল চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও, রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন, পেশি ও স্নায়ুর কার্যকারিতাও এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও ইলেকট্রোলাইট সাপ্লিমেন্ট বা ড্রিংকসে পাওয়া যায়, তবে আমাদের প্রতিদিনের খাবারেই কিন্তু পর্যাপ্ত ইলেকট্রোলাইট থাকে। যেমন, কলা থেকে আমরা প্রয়োজনীয় পটাশিয়াম পাই।
ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে পানির সাথে ইলেকট্রোলাইটও বেরিয়ে যায়। যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণে তরল শরীর থেকে বেরিয়ে যায়, যেমন: প্রচুর ঘাম বা ডায়রিয়া হলে, তখন শরীর পানিশূন্য বা ডিহাইড্রেটেড হয়ে পড়তে পারে। বেশি ঘেমে গেলে রক্তের পরিমাণ কমে যায়, ফলে হৃদপিণ্ডকে বেশি শক্তি খরচ করে রক্ত সঞ্চালন করতে হয়। যদি কারও শরীর থেকে অস্বাভাবিকভাবে প্রচুর পরিমাণে পানি এবং ইলেকট্রোলাইট বেরিয়ে যায়, যেমন তীব্র ডায়রিয়া বা বমি হলে, তখন ডাক্তাররা পেডিয়ালার মতো রিহাইড্রেশন সলিউশন খাওয়ার পরামর্শ দেন। সাধারণত সাধারণ স্পোর্টস ড্রিংকের চেয়ে এতে বেশি সোডিয়াম এবং পটাশিয়াম থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিয়মিত ব্যায়ামের সময় স্পোর্টস ড্রিংকস নেওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনকি যদি কঠিন ব্যায়ামও হয় বা গরম আবহাওয়া থাকে, তবুও তৃষ্ণা পেলে শুধু পানি পান করে শরীরকে আর্দ্র রাখা যথেষ্ট। অনেক স্পোর্টস ড্রিংকসে থাকা চিনি এবং কার্বোহাইড্রেট প্রতিযোগিতামূলক খেলায় শরীরে শক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করলেও, ইলেকট্রোলাইটের প্রভাব এতে সামান্য। ১৯৯০-এর দশকে চিকিৎসকদের পরামর্শ ছিল যে এক ঘণ্টার বেশি ব্যায়াম করলে খেলোয়াড়দের সোডিয়াম-সমৃদ্ধ পানীয় পান করা উচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো দেখা গেছে, ঘাম এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে সোডিয়াম হারালেও আমাদের শরীর রক্তে সোডিয়ামের ঘনত্ব বজায় রাখে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, এমনকি ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পাঁচ ঘণ্টা দৌড়ানোর পরেও ক্রীড়াবিদরা পানি এবং ইলেকট্রোলাইটযুক্ত পানীয়তে কোনো পার্থক্য অনুভব করেননি। অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পোর্টস ডায়েটেটিক্সের সহযোগী অধ্যাপক রিকার্ডো ডা কস্টা বলেছেন, ‘কমপক্ষে এক দশক ধরে এটা সুপ্রতিষ্ঠিত যে ইলেকট্রোলাইট পারফরম্যান্সের জন্য খুব বেশি কিছু করে না। কিন্তু স্পোর্টস ড্রিংকস কোম্পানিগুলোর বিপণন কৌশল গবেষকদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।’
অধিকাংশ সময় তৃষ্ণা পেলে শুধু পানি পান করাই যথেষ্ট। সবাই মনে করে যে তাদের অবিলম্বে হারানো ইলেকট্রোলাইট পূরণ করতে হবে, কিন্তু আসলে তা দরকার নেই। সাধারণ খাবারের মাধ্যমেই আমাদের শরীর প্রয়োজনীয় ইলেকট্রোলাইট পূরণ করে ফেলে। তবে, যদি কেউ কয়েক দিন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরমে বাইরে ঘোরে এবং মাথা ঘোরার মতো পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে একটি ইলেকট্রোলাইট ড্রিংক বা সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে যদি খাদ্যে পর্যাপ্ত ইলেকট্রোলাইট না থাকে। খেলোয়াড়রা লম্বা সময় ধরে খেলার সময় অনেক বেশি তরল পান করেন, এতে তাদের রক্তে ইলেকট্রোলাইটের পরিমাণ কমে যেতে পারে। তবে বেশিরভাগ ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকসে এমন অবস্থা প্রতিরোধ করার জন্য পর্যাপ্ত সোডিয়াম থাকে না।
ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস গ্রহণ করার আগে আমাদের ভেবে দেখা উচিত। এই ড্রিংকসগুলোর দাম বেশি। যতক্ষণ কেউ সুস্থ আছেন, ততক্ষণ অতিরিক্ত ইলেকট্রোলাইটের আসলে প্রয়োজন নেই। তবে এর মিষ্টি স্বাদের কারণে পানি খেতে ইচ্ছা করতে পারে। সবশেষে, বাজারে থাকা সব ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস বিএসটিআই অনুমোদিত নয়, এমনকি এগুলোর কারখানাগুলোও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হলে এই ড্রিংকে দূষণ মিশে যেতে পারে। তাই, বিচিত্র বিজ্ঞাপন দেখেই ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস পান করার আগে ভালোভাবে যাচাই করা উচিত যে আমাদের শরীরে সত্যিই ইলেকট্রোলাইটের প্রয়োজন আছে কিনা।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস