সঙ্গেই আছি, কিশোর আলো
দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে তখন। চারুকলায় একটি বিষয়েরই পরীক্ষা দিতে হয় পাঁচ দিন। একটানা পরীক্ষায় হাঁপিয়ে যাই সবাই। তেমনই এক পরীক্ষার শেষ দিন কোনোরকমে খাতা জমা দিয়েছি। ওয়াশবেসিনে হাত ধুয়ে আয়নায় তাকাতেই চমকে গেলাম। আমার পেছনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। ওকে আমি চিনি, আমাদেরই জুনিয়র। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসতেই মেয়েটা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপু, তুমি কি কিশোর আলোতে ছিলে?’
প্রশ্নটা আমি বহুবার শুনেছি। স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিয়েবাড়িতে, ট্রেনে, বাসে। কিন্তু এই একটি প্রশ্নে আমি কখনো বিরক্ত হই না। বরং ‘কিশোর আলো’ শব্দটা শুনলে যেন মাথার ভেতর হাই পাওয়ারের কয়েকটি আলো জ্বলে ওঠে। সেই আলোয় আমি নিজেকে দেখতে পাই—কিশোর আলোর মিটিং রুমে বসে আছি। এক্সট্রোভার্ট হওয়ার কারণে শ খানেক বন্ধু পাতিয়ে বসে আছি ঢাকার আনাচকানাচে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো মফস্সলে বড় হওয়া আমার কাছে কিশোর আলোর সভা ছিল আকাশকুসুম কল্পনা। কিশোর আলোর পাতায় যখন প্রতি মাসে কিআড্ডার খবর পড়তাম, আমার মনে হতো কবে আমি যাব সেখানে! বর্ষপূর্তিতে যখন ‘কিআনন্দ’ হতো, তখনো মুখিয়ে থাকতাম পরের মাসের কিআতে আয়োজনের ছবি দেখতে।
২০১৭ সালে আমি প্রথম কিআড্ডায় যাই। সে বছরই যোগ দিই কিশোর আলো বুক ক্লাবে। এক মাসে দুই আড্ডা। আমাকে আর পায় কে! সে বছরই কিআ বুক ক্লাবের সহসমন্বয়ক হওয়া আর কিআনন্দর ভলান্টিয়ার হওয়া ছিল আমার কাছে স্বপ্নের মতো।
বুক ক্লাবের সভার খবর লিখতে লিখতে আমার কিআতে লেখার জার্নিটা শুরু হয়। কিশোর আলোর পাতায় ছাপা অক্ষরে নিজের নাম! সভায় যাওয়া, কিশোর আলোর বিভিন্ন ইভেন্টে যাওয়া, বুক ক্লাব থেকে বিভিন্ন আয়োজন করা, কিশোর আলোর প্রুফ রিডিং, কিআনন্দ—সব মিলিয়ে ঝলমলে কৈশোর।
ঝলমলে দিনগুলো পেছনে ফেলে এসেছি। হঠাৎ সেদিন কাঠখোট্টা একটা অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে বসে মনে হলো, কী হতো যদি আমি কখনো কিশোর আলো না পড়তাম? কিআড্ডায় না যেতাম? ভাবতে ভাবতে দেখি একটা বানানে আটকে গেছি। মনে পড়ল, কিশোর আলোর প্রুফ রিডিংয়ের ভলান্টিয়ার হিসেবে যখন যেতাম, তখন টাইপিং ভুল, অদ্ভুত বানান নিয়ে কত হাসাহাসি করতাম। কিশোর আলোয় ভুল খুঁজে বের করাটাও যে একটা আনন্দের ব্যাপার হতে পারে, আগে কখনো ভাবিনি।
২০২০ সালে কোভিডের লকডাউনে যখন ঘরবন্দী, তখন পাভেল মহিতুল আলম ভাই কিআ অনলাইন সংস্করণের জন্য লিখতে বললেন। ঘরে বসেই টুকটুক করে লিখতাম, রাতভর রিসার্চ করতাম একটা লেখার জন্য। ভুল বানানে লিখে পাঠিয়ে দিতাম পাভেল ভাই কিংবা আদনান মুকিত ভাইকে। তারপর অপেক্ষা করতাম লেখা প্রকাশ হওয়ার। প্রকাশিত হলে নিজের পাঠানো লেখাটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতাম কোন কোন বানান প্রুফে গিয়ে ঠিক হয়েছে, কোন বাক্য আরও সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে।
কিশোর আলো আমার কাছে শুধু একটা ম্যাগাজিন নয়। জীবনে চলার পথে যা প্রয়োজন, তা আমি কিশোর আলো এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের কাছ থেকে শিখেছি। কিআড্ডা ও বুক ক্লাবের সভায় অনেক গুণী মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। ভলান্টিয়ার হিসেবে হাজার মানুষের ভিড় সামাল দেওয়া থেকে শুরু করে লেখকদের–শিল্পীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া—কোনোটাই বাদ যায়নি। আমার জীবনের ‘প্রাইমটাইম’ কিশোর আলোর সঙ্গে কেটেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ঝলমলে দিনগুলো হারিয়ে গেলেও কিশোর আলোর প্রভাব যে আমার মধ্যে আছে, সেটা প্রতিনিয়তই টের পাই। কিআ থেকে পাওয়া সব তালিম যেমন এখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কাজে লাগছে; আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তা চাকরি এবং তার পরবর্তী জীবনেও কাজে দেবে।
তাই সেদিন ওয়াশবেসিনের সামনে জুনিয়র মেয়েটা যখন জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি কিশোর আলো ছেড়ে দিয়েছ?’ আমি অকপটে উত্তর দিলাম, ‘না।’ খুব বেশি ক্লিশে শোনালেও বারো পেরিয়ে তেরোয় পা দেওয়া টিনএজার কিআর এক শ পেরোলেও আমি কিশোর আলোর সঙ্গেই আছি।