লুডু যেভাবে সর্বকালের জনপ্রিয় বোর্ড গেম হয়ে উঠল

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আসা শিক্ষার্থীরা দাবা-লুডু খেলছে৷ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কখনো কি লুডো বা সাপ লুডো খেলেছ? একসঙ্গে চারজন খেলোয়াড় লাল, নীল, সবুজ ও হলুদ এই চার রঙের ঘর থেকে খেলা শুরু করে। লুডোতে প্রতি রঙে চারটি করে মোট ১৬টি ঘুঁটি থাকে। খেলা শুরুর নিয়ম খুব সহজ—ছক্কা ঘুঁটি চেলে যদি কেউ ছয় ওঠাতে পারে, তবেই তার ঘুঁটি ঘর থেকে বের হয়। আর তাই সবাই অধীর আগ্রহে ছক্কা ফেলার অপেক্ষায় থাকে। খেলার মূল নিয়ম এই ছক্কা ব্যবহার করে ঘুঁটিগুলোকে বোর্ডের মাঝখানে থাকা ‘হোম’ বা গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো। কে কার ঘুঁটি খাবে, আর কে সবার আগে নিজের সব ঘুঁটি হোমে নিয়ে বিজয়ী হবে, এই নিয়েই চলতে থাকে লুডোর লড়াই।

লুডো বোর্ডের উল্টো দিকেই খেলা যায় সাপ লুডু। এ পাশে সাপের ছবি ও মই বা সিঁড়ির ছবি দিয়ে প্রায় এক শ ঘর আঁকা। এই খেলা শুরু করতে ছক্কা ঘুঁটিতে এক ফেলতে হয়। তবে এখানে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের মাত্র একটি করে ঘুঁটি থাকে। সাপ লুডোর মূল আকর্ষণ মই আর সাপের বিপদ। মই বা সিঁড়ি পেলে একবারে অনেক ওপরে উঠে যাওয়া যায়। আবার ঘুঁটি কোনো সাপের মুখে পড়লে নেমে একেবারে নিচের কোনো ঘরে চলে যেতে হয়।

খেলাটি অনেক সহজ মনে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু এই সাধারণ খেলার মধ্যেই আছে মজার কিছু কৌশল, যা খেলার মোড় যখন–তখন ঘুরিয়ে দিতে পারে। আসলে এই খেলার সরলতা আর কৌশলই লুডোকে করে তুলেছে সর্বকালের জনপ্রিয় বোর্ড গেম। আর এ কারণেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লুডো মানুষের অবসর সময় কাটানোর প্রধান সঙ্গী হয়ে আছে।

আরও পড়ুন

তোমাদের মধ্যে যারা জেন–জি, তারা হয়তো এই খেলাটির সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু যারা জেন আলফা, তারা হয়তো লুডুর আসল বোর্ড গেমটি সেভাবে খেলার সুযোগ পাওনি। তবে তোমাদের অনেকেই লুডো বলতে হয়তো ফোনের ‘লুডো কিং’ গেমটিকেই চেনো। আমার মনে আছে, গরমের ছুটিতে যখন গ্রামের বাড়িতে যেতাম, তখনই এই খেলার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। গ্রামে লুডো সবচেয়ে জনপ্রিয়। বাড়িতে কোনো অতিথি এলে তো খেলাটা আরও জমে ওঠে।

তবে লুডো খেলাটা কিন্তু শুধু আমাদের দেশেই জনপ্রিয়, এমনটা নয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে একটি। এমনকি পুরো বিশ্বেই এর দারুণ পরিচিতি আছে। কিন্তু এই সাধারণ লুডোর ইতিহাস কিন্তু বেশ মজার। আর সেই কারণেই শত শত বছর পরেও লুডো এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় বোর্ড গেমগুলোর মধ্যে একটি হয়ে আছে।

লুডোর ইতিহাস বেশ পুরোনো। ইতিহাসবিদদের মতে, লুডো আসলে একটি প্রাচীন ভারতীয় খেলা থেকে এসেছে, যার নাম ছিল ‘পাশা’ বা (Pachisi)। খেলাটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে, ভারতে প্রচলিত ছিল বলে মনে করা হয়। পাশা ছিল মূলত একটি চালভিত্তিক খেলা, যা অনেকটা লুডোর মতোই বোর্ডের ওপর খেলা হতো। ইতিহাসবিদেরা বলেন, মুঘল সম্রাট আকবরও নাকি খেলাটা খেলতে খুব পছন্দ করতেন।

আরও পড়ুন

পরে প্রাচীন ভারতীয় এই খেলাটি ব্রিটিশদের চোখে পড়ে। ব্রিটিশরা তখন এই খেলার নিয়মগুলো কিছুটা পরিবর্তন করে ইউরোপে সেটিকে চালু করে। তখন কড়ি বা ঝিনুকের বদলে ব্যবহার শুরু হয় ডাইস কাপসহ একটি ঘন ছক্কার।

এরপর ১৮৯৬ সালে ইংল্যান্ডের আলফ্রেড কলার এই নতুন সংস্করণটির নাম দিলেন ‘লুডো’ (Ludo) এবং এটি পেটেন্ট করে নিলেন। ‘লুডো’ শব্দটি কিন্তু একটি লাতিন শব্দ, যার অর্থ ‘আমি খেলি’। আলফ্রেড কলার পরে এটি ‘রয়্যাল লুডো’ নামে বিক্রি শুরু করেন। সেখান থেকে এর জনপ্রিয়তা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ নৌবাহিনী বা রয়্যাল নেভির মধ্যে খুব জনপ্রিয় একটি বোর্ড গেম ‘উকার্স’ (Uckers), সেটিও এই লুডুর ধারণার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি। এভাবেই প্রাচীন ভারত থেকে যাত্রা শুরু করে ব্রিটিশদের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে খেলাটি আবারও দক্ষিণ এশিয়ায় ফিরে আসে। লুডোর সহজ নিয়ম, তাড়াতাড়ি শিখে ফেলার ক্ষমতা ও পরিবারের সবাই মিলে খেলার সুযোগ খেলাটিকে বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে।

একসময় লুডো ছিল শুধুই বোর্ড, ঘুঁটি আর ছক্কার খেলা। পরে নতুন প্রজন্মের জন্য ২০১৬ সালের দিকে আসে মোবাইল গেম ‘লুডো কিং’ (Ludo King)। অ্যাপটি পুরোনো খেলার আনন্দ ধরে রেখে মানুষের কাছে আনে নতুন রূপে। তবে গেমটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায় করোনা মহামারির সময়ে। যখন সবাই ঘরে বন্দী ছিল, তখন এই গেমটিই বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের এক জায়গায় জড়ো না হয়েও একসঙ্গে খেলার সুযোগ করে দেয়। ফলে গেমটি দেড়শ কোটির বেশি বার ডাউনলোড হয়েছে। ভয়েস চ্যাটের মতো সুবিধার কারণে ‘লুডো কিং’ এখনো অত্যন্ত জনপ্রিয়। আর এভাবেই পুরোনো এই খেলা ডিজিটাল যুগেও সাফল্যের সঙ্গে টিকে আছে।

আরও পড়ুন

অনেকেই হয়তো ভাবো লুডু শুধুই ভাগ্যের খেলা। কিন্তু লুডু কিন্তু শুধু ভাগ্যের খেলা না। এটি আসলে দাবা খেলার মতোই একটি দারুণ মানসিক অনুশীলনের খেলা। এখন যখন ছোটরা মোবাইল গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে, তখন তাদের বাবা–মায়েরা আবার পুরোনো বোর্ড গেমের দিকে ঝুঁকছেন। কারণ, তাঁরা চান শিশু-কিশোররা যেন মোবাইলের স্ক্রিন থেকে দূরে থাকে। আর এই সুযোগে লুডুর মতো বোর্ড গেমগুলো নতুন করে ফিরে আসছে বাজারে। তবে এবার আরও আকর্ষণীয় ডিজাইন ও ঝকঝকে ঘুঁটি নিয়ে।

তাহলে আর দেরি কেন? পরীক্ষা শেষ হলেই একবার খেলে দেখতে পারো এই মজার লুডু। কেমন লাগল খেলতে বা লুডু খেলার মজার স্মৃতি নিয়ে চিঠি লিখে জানাতে পারো কিআতে।

আরও পড়ুন