আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে টেস্ট খেলুড়ে দেশের যেসব বোলাররা নিয়েছেন ১০০ উইকেট
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মানেই যেন চার-ছক্কার ফুলঝুরি, ব্যাটসম্যানদের ধুন্ধুমার ব্যাটিং আর রানের পাহাড়। এই মারকাটারি ফরম্যাটে বোলারদের কাজটা খুব কঠিন। একটু এদিক-ওদিক হলেই বল বাউন্ডারির বাইরে! কিন্তু এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও কিছু বোলার নিজেদের নিয়ে গেছেন কিংবদন্তি পর্যায়ে। ব্যাট হাতে সেঞ্চুরি তো অনেকেই করেন, কিন্তু বল হাতে উইকেটের সেঞ্চুরি করা চাট্টিখানি কথা নয়! একটা পরিসংখ্যান বললেই বিষয়টা আরও ভালো বোঝা যাবে। মাত্র সেদিন ভারতের প্রথম বোলার হিসেবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে আন্তর্জাতিক উইকেট পেলেন আর্শদীপ সিং। অর্থাৎ, টি-টোয়েন্টিতে উইকেটের সেঞ্চুরি করা সহজ কাজ নয়! এটি এমন এক অভিজাত ক্লাব, যেখানে সদস্য সংখ্যা হাতেগোনা।
এই ক্লাবের দরজা প্রথম খুলে দিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি পেসার লাসিথ মালিঙ্গা। তার অদ্ভুত বোলিং অ্যাকশন আর আগুনে ইয়র্কারে ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস উঠত। তিনিই প্রথম বোলার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে উইকেটের সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন। যদিও তিনি এখন অবসরে, কিন্তু এই ফরম্যাটে বোলারদের জন্য যে নতুন দিগন্ত তিনি খুলে দিয়েছিলেন, তা ভোলার নয়।
নিউজিল্যান্ড: পেস আর স্পিনের দারুণ মেলবন্ধন
এই অভিজাত ক্লাবে সবচেয়ে বেশি সদস্য রয়েছে নিউজিল্যান্ডের। দলটির পেস আক্রমণের পুরোধা টিম সাউদি শুধু এই ক্লাবের সদস্যই নন, বর্তমানে তিনি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। প্রায় ১৬ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি দেড়শরও বেশি উইকেট নিয়ে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ১০১তম ম্যাচে তিনি তার শততম উইকেটটি তুলে নেন। সাউদির সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর অভিজ্ঞতা আর সুইং। এই শক্তির সাহায্যে তিনি যে কোনো সময় ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন।
নিউজিল্যান্ডের গল্পে শুধু পেস নয়, স্পিনেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। লেগ স্পিনার ইশ সোধি এবং বাঁহাতি স্পিনার মিচেল স্যান্টনারও এই ক্লাবের সদস্য। সোধি তাঁর গুগলির জালে ব্যাটসম্যানদের বোকা বানাতে ওস্তাদ। মাত্র ৮৪ ম্যাচেই তিনি ১০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন। অন্যদিকে স্যান্টনার তাঁর নিখুঁত লাইন-লেংথ আর বৈচিত্র্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে আটকে রাখেন। এই তিন বোলারের দাপটেই নিউজিল্যান্ড টি-টোয়েন্টিতে শক্তিশালী দল।
বাংলাদেশ: দুই মহাতারকার দাপট
ব্যাটসম্যানদের এই যুগে বাংলাদেশের দুজন বোলার নিজেদের জাত চিনিয়েছেন। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান এই ক্লাবের অন্যতম সেরা সদস্য। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৮৪তম ম্যাচে শততম উইকেট শিকার করে তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে এই ক্লাবে প্রবেশ করেন। বর্তমানে তার উইকেট সংখ্যা ১৪৯। টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় সাকিব আছেন চতুর্থ স্থানে।
সাকিবের সঙ্গী হিসেবে এই ক্লাবে জায়গা করে নিয়েছেন কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা ‘দ্য ফিজ’ তাঁর রহস্যময় কাটার আর স্লোয়ারে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছেন। মাত্র ৯১ ম্যাচ খেলেই তিনি উইকেটের সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন। এটা তাঁর ধারাবাহিকতারই প্রমাণ।
বাংলাদেশের আরেক গতিতারকা তাসকিন আহমেদের উইকেট সংখ্যা ৯৯টি। শিকারির এশিয়া কাপেই তিনি এই এলিট ক্লাবের সদস্য হয়ে যাবেন। দরকার আর মাত্র একটি উইকেট। তাসকিন তাঁর ১১ বছরের ক্যারিয়ারে মোট ম্যাচ খেলেছেন ৮১টি। ২৪ সেপ্টেম্বর ভারতের বিপক্ষেই হয়ে যেতে পারে তাঁর উইকেটের সেঞ্চুরি!
আফগানিস্তান: স্পিনের দুই জাদুকর
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা যেন আফগানিস্তানের বিস্ময় বালক রশিদ খানের জন্যই তৈরি হয়েছে। রেকর্ড বই ওলটপালট করে দেওয়া এই লেগ স্পিনার মাত্র ৫৩ ম্যাচেই ১০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলেন। এখন পর্যন্ত তিনি সবচেয়ে দ্রুত টি-টোয়েন্টিতে ১০০ উইকেট নিয়েছেন। প্রায় আট বছরের ক্যারিয়ারে তার উইকেট সংখ্যা ১৭৩। গুগলির ভেলকিতে বিশ্বের সেরা সেরা ব্যাটসম্যানদেরও তিনি বোকা বানিয়ে ছাড়েন। টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিকও রশিদ খান।
রশিদের মতোই আরেক স্পিনার মোহাম্মদ নবী। বল ও ব্যাটে সমান ক্ষুরধার। ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে ১৩৯ ম্যাচ খেলে তুলে নিয়েছেন ১০২ উইকেট।
শ্রীলঙ্কা: স্পিন ও পেসের রাজা
রশিদের মতোই আরেক স্পিন জাদুকর শ্রীলঙ্কার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা। লেগ স্পিনের পাশাপাশি তাঁর ব্যাটিংটাও দলের বড় ভরসা। মাত্র ৬৩ ম্যাচেই তিনি উইকেটের সেঞ্চুরি পূরণ করেছেন। রশিদ খানের পরই দ্রুততম হিসেবে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন এই তালিকায়। বর্তমানে তাঁর উইকেট সংখ্যা ১৩৬।
লাসিথ মালিঙ্গার ব্যাপারে তো শুরুতেই বলেছি। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ১০০ টি-টোয়েন্টি উইকেটের মালিক তিনি। তাঁর মোট উইকেট ১০৭।
পাকিস্তান: গতি আর ঘূর্ণির যুগলবন্দী
পাকিস্তান থেকে বরাবরই বিশ্বমানের বোলার উঠে আসে। দেশটির তিনজন বোলার এই ক্লাবে জায়গা করে নিয়েছেন। গতি তারকা হারিস রউফ তাঁর আগুনে গতির জন্য পরিচিত। মাত্র ৭১ ম্যাচেই তিনি ১০০ উইকেট শিকার করে পাকিস্তানের প্রথম বোলার হিসেবে এই ক্লাবে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গী লেগ স্পিনার শাদাব খান। ৯২ ম্যাচে শততম উইকেট পাওয়া শাদাব শুধু বল হাতেই নন, ব্যাট হাতেও দলের ভরসার নাম। পিছিয়ে নেই শাহিন শাহ আফ্রিদিও। ৮৯ ম্যাচে তিনি তুলে নিয়েছেন ১১১ উইকেট।। হ্যারিস রউফের উইকেট সংখ্যা ১২৮, সাদাব খানের ১১২ এবং আফ্রিদির ১১১।
ইংল্যান্ড: প্রায় হারিয়ে যাওয়া নায়ক
ইংল্যান্ডের হয়ে এই কীর্তি গড়েছেন দুজন। লেগ স্পিনার আদিল রশিদ এবং পেসার ক্রিস জর্ডান। আদিল রশিদের লেগেছিল ৯৯ ম্যাচ, আর ডেথ ওভার স্পেশালিস্ট হিসেবে পরিচিত ক্রিস জর্ডানের লেগেছিল ৯৬ ম্যাচ। এত এত নামের ভিড়ে জর্ডান যেন প্রায় হারিয়েই গেছেন। ম্যাচে প্রভাব রাখলেও সেভাবে আলোচনায় আসেননি কখনো।
যেসব দেশের একমাত্র প্রতিনিধি এই ক্লাবে
ক্রিকেটের বড় দলগুলোর সদস্য এই ক্লাবে খুব কম। ভারতের মতো শক্তিশালী দলের একমাত্র প্রতিনিধি পেসার অর্শদীপ সিং। প্রায় চার বছরের ক্যারিয়ারে ৬৪তম ম্যাচে তিনি এই মাইলফলক স্পর্শ করেন। তবে শিগগিরই এই ক্লাবে যুক্ত হতে পারে ভারতের আরও তিন বোলার হার্দিক পাণ্ডিয়া, যুবেন্দ্র চাহাল ও জাসপ্রিত বুমরা। তাঁদের উইকেট সংখ্যা যথাক্রমে ৯৭, ৯৬ ও ৯২।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে এই ক্লাবের একমাত্র সদস্য হলেন লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা। প্রায় নয় বছরের ক্যারিয়ারে তিনি তার দেশের সর্বোচ্চ টি-টোয়েন্টি উইকেট শিকারি। ১০৩ ম্যাচে নিয়েছেন ১৩০ উইকেট।
নবাগত টেস্ট খেলুড়ে দেশ আয়ারল্যান্ডের জন্য বড় গর্বের কারণ হয়েছেন পেসার মার্ক অ্যাডায়ার। দেশের প্রথম বোলার হিসেবে তিনি এই অভিজাত ক্লাবে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর উইকেট সংখ্যা বর্তমানে ১২৮।
অবাক করার মতো বিষয় হলো, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো টি-টোয়েন্টির পাওয়ারহাউস দলগুলোর কোনো বোলার এখনো এই ক্লাবের সদস্য হতে পারেননি। তবে টেস্ট খেলুড়ে দেশের হিসেব বাদ দিলে এই ক্লাবের সদস্য পাওয়া যাবে আরও অনেক। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ২৫ জন খেলোয়াড় আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে পেয়েছেন ১০০ উইকেট। টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে না ধরলে এই তালিকায় জায়গা পেতেন হংকংয়ের এহসান খান (১২৯), বাহরাইনের রিজওয়ান বাট (১২২), কেনিয়ার শেম এনগোচে (১২০), উগান্ডার হেনরি সেনিওন্ডো, নেপালের সন্দ্বীপ লামিচানে (১১৭) ও করন কেসি (১০৩), ওমানের বিলাল খান (১১০) এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের জুনায়েদ সিদ্দিক (১০৯)।
২০ ওভারের এই ঝোড়ো ক্রিকেটে বোলারদের কাজটা সবসময়ই কঠিন। কিন্তু এই কিংবদন্তিরা দেখিয়েছেন, মেধা আর কৌশল থাকলে ব্যাটসম্যানদের শাসন করা অসম্ভব নয়। বল হাতে তাঁদের এই কীর্তি ক্রিকেটের ইতিহাসে লেখা থাকবে।