একসময়ের বিশ্ব কাঁপানো দল এখন দেউলিয়া

রোনালদো, বেনজেমা, কান্তেরা যখন একে একে সৌদি আরবে ভিড়তে শুরু করলেন ফুটবল ভক্তদের অনেকেরই দ্যেজা ভ্যু হয়েছিল। এমন ঘটনা নতুন কিছু ছিল না ফুটবল ইতিহাসে। কিন্তু এক দশকের মধ্যেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে অবাক হয়েছিলেন অনেকে। ইউরোপিয়ান খেলোয়াড় ভিড়িয়ে দেশের ফুটবলকে সমৃদ্ধ করার পরিকল্পনা প্রথম হাতে নিয়েছিল চীন। আর যে দলকে দিয়ে শুরু হয়েছিল সেই পরিকল্পনা, সেই দলই আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে এই বছর। 

‘গুয়াংজু এভারগ্রান্দে’ নামটা শুনলে অনেক ফুটবলভক্ত একটু নস্টালজিয়ায় পড়ে যেতে পারে। আজ থেকে বছর দশেক আগে এই দলটা রীতিমত ঝড় তুলেছিল ইউরোপিয়ান ফুটবল। হুট করে কোত্থেকে এসে দলবদলের বাজারকে উত্তপ্ত করে দিয়েছিল চাইনিজ দলটি। শুধু গুয়াংজু নয়, তাদের সঙ্গী ছিল আরও কয়েকটি দল। এই দলগুলোতে যোগ দেওয়া তারকাদের তালিকাও ছিল সমৃদ্ধ। সৌদি আরবের মতো নিভে যাওয়া তারকা নয়, বরং তাদের হাতে ছিল উঠতি তারকাদের মেলা। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে আলো মেলতে শুরু করা অস্কার, পাউলিনহো, হাল্ক। বেলজিয়ামের ইয়ানিক কারাস্কো, অক্সেল উইটসেলের মতো তরুণ তারকাদের দিয়ে ক্লাব ফুটবলকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল চীন। 

আরও পড়ুন
ভক্তরা এখনও আশা ছাড়েনি।
ছবি: এক্স

এর মধ্যে গুয়াংজু এভারগ্রান্দে নামটা একটু স্মরণীয় বেশি। কারণ তারা শুধু খেলোয়াড় নয়, নিজেদের তৈরি করতে নিয়ে গিয়েছিল নামকরা কোচদেরও। ফুটবল মানেই যে শুধু টাকার খেলা নয়, বরং নিজেদের তৈরি করার খেলা, সেটা শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিল তারা। ১৯৫৪ সালে জন্ম নেওয়া ফুটবল ক্লাব দ্বিতীয় বছরেই দেখা পেয়েছিল শিরোপার। যদিও সেটা ছিল দ্বিতীয় বিভাগের। কিন্তু টানা প্রথম বিভাগ খেলার খুব একটা সুযোগ হয়নি তাদের কখনই। ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিরতে যখন দলের অবস্থা টালমাটাল, তখন এভারগ্রান্দে রিয়েল স্টেট কোম্পানি কিনে নেয় ক্লাবটি। গুয়াংজু এফসি পরিণত হয় গুয়াংজু এভারগ্রান্দে ক্লাবে। সেই মৌসুম থেকে পরবর্তী ১০ মৌসুমে ৮ বারই শিরোপা জিতেছে গুয়াংজু। বাকি দুইবার রানার্স-আপ। চাইনিজ লিগের রাজা ছিল গুয়াংজু এভারগ্রান্দে। 

২০১৩, ২০১৫ সালে দুইবার জিতেছে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগ। ক্লাব বিশ্বকাপে দুইবারই শেষ করেছে চতুর্থ স্থানে থেকে। ব্রাজিলিয়ান তারকা পাউলিনহো, রবিনহো, কলম্বিয়ান জ্যাকসন মার্তিনেজদের নিয়ে বানানো দল সামলাতেন মার্সেলো লিপ্পি, ফ্যাবিও ক্যানাভারো, লুইস ফিলিপে স্কলারির মতো কোচ। কিন্তু সব স্বর্ণযুগ তো আর থাকে না। চীন যখনই ফুটবলে নিজেদের গড়ছিল, তখনই আসে সরকারের বাধা। 

আরও পড়ুন
কোচ মার্সেলো লিপ্পির অধীনে গুয়াংজু এভারগ্রান্দে।
ছবি: এক্স

দেশের এত টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে বলে অদ্ভুত এক নিয়ম প্রস্তাব করে কর্তৃপক্ষ। যত টাকা দিয়ে বিদেশি খেলোয়াড় কিনবে তারা, সেই পরিমাণ টাকা চাইনিজ ফুটবল ফেডারেশনেও দিতে হবে তাদের। ফলে কমে যায় বিদেশি খেলোয়াড়দের আনাগোনা। আর যতই বিদেশি খেলোয়াড় আসুক, দেশে যদি নতুন খেলোয়াড় না কেনা হয়, তাহলে তো আর দেশের ফুটবল এগোবে না। ফলে আস্তে আস্তে মিইয়ে যেতে শুরু করে চাইনিজ সুপার লিগ।

আরও পড়ুন
গুয়াংজু এভারগ্রান্দের সবচেয়ে বড় তারকা পাওলিনহো।
ছবি: এক্স

কিন্তু কফিনের শেষ পেরেক ছিল কোভিড-১৯। চাইনিজ ক্লাবগুলোর মালিক ছিল বড় বড় রিয়েল স্টেট কোম্পানি। কোভিডের ধাক্কায় অনেকেরই ব্যবসাই ঠেকে যায় তলানিতে। ফলে ক্লাবগুলোও অচল হয়ে পরে। নিয়ম নীতি মানতে না পারায় একে একে খড়্গ উঠতে শুরু করে ক্লাবগুলোর ওপরে। ফলে নিষেধাজ্ঞায় অনেক ক্লাব অবনমিত হয়, অনেকে বিক্রি করে দেয়। করোনার পর পর ক্লাব বিক্রির চেষ্টা করে এভারগ্রান্দে গ্রুপ। ফিরে আসে পুরানো নাম। কিন্তু নতুন মালিকানায় গিয়েও আর নিজেদের ধারদেনা শোধ করতে পারেনি তারা। দ্বিতীয় ডিভিশনে নেমে যায় গুয়াংজু। অতঃপর ২০২৪ মৌসুম শেষে দেনা শোধ করতে না পারায় দেউলিয়া ঘোষণা করা হয় দলকে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের লাইসেন্স। নিজেদের ক্লাব গুছিয়ে ফিরতে না পারলে আর কখনই পেশাদার পর্যায়ে খেলা হবে না তাদের। শেষ হয়ে যাবে ৭১ বছরের স্মৃতি। চাইনিজ ফুটবলের এক সময়ের রাজা শুধু থাকবে স্মৃতিতে।

আরও পড়ুন