১৬ বছর পর যেভাবে বিশ্বকাপে প্যারাগুয়ে

একটি পয়েন্ট, ৯০ মিনিট সময়। মাত্র একটি পয়েন্টের অপেক্ষা। দেল চোকো স্টেডিয়ামের ভেতরে ৪০ হাজার মানুষ, বাইরে ৩০ হাজার মানুষ—একটা বাঁশির অপেক্ষায়। হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা হয়ে যেন এলেন রেফারি, ৯৫ মিনিটে সেই বাঁশির শব্দ পৌঁছে গেল ৭০ লাখ মানুষের ঘরে ঘরে। আনন্দে, উল্লাসে সবাই নেমে এলেন রাস্তায়। সারি সারি আতশবাজি ফুটল, আনন্দে শামিল হলেন ছেলে–বুড়ো সবাই। কারণ? ১৬ বছর পর আবারও বিশ্বকাপের টিকিট পেয়েছে প্যারাগুয়ে।

অনেক দিন আগে থেকে ফুটবল দেখা মানুষজনদের কাছে প্যারাগুয়ে নামটা বেশ পরিচিত। এই শতাব্দীর শুরুতে প্যারাগুয়ে ছিল লাতিন আমেরিকার ডার্ক হর্স। আর্জেন্টিনার মতো দলকে আটকে দিত, ব্রাজিলকেও লড়াই করে বের করে আনতে হতো পয়েন্ট। সেনালি সময়টা পার হয়ে যাওয়ার পর প্যারাগুয়েও হারিয়ে গেছে বিশ্ব ফুটবল থেকে। কালেভদ্রে নাম উঠে আসে দু–একজনের, কিন্তু সবার সামনে আর আসা হয় না তাদের। ৪৮ দলের বিশ্বকাপ যেন আবারও তাদের এনে দিল সুযোগ, পুরো বিশ্বের সামনে নিজেদের আরেকবার প্রমাণ করার।

আরও পড়ুন
প্যারাগুয়েকে পাল্টে দেওয়া কোচ গুস্তাভো আলফারো।
ছবি: এক্স

প্যারাগুয়েকে রাতারাতি বদলে দেওয়ার কারিগর হিসেবে আসবে কোচ গুস্তাভো আলফারোর নাম। ৬৩ বছর বয়সী এই আর্জেন্টাইন কোচ গত বছর বুঝে নিয়েছিলেন প্যারাগুয়ের দায়িত্ব। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই যেন হারতে ভুলে গেছে দলটা। অথচ এর আগে জয়ের সঙ্গে যেন দা-কুমড়ো সম্পর্ক ছিল তাদের। একটা ভঙ্গুর দলের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছিলেন কোচ গুস্তাভো। ২০২৪ কোপা আমেরিকায় তিন ম্যাচে ৮ গোল হজম করে বাদ পরেছিল গ্রুপ পর্ব থেকে। এরপর দলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে। গুস্তাভো যেন জাদুর ছোঁয়ায় বদলে ফেলেছেন প্যারাগুয়ের চিত্র। ১১ ম্যাচ ধরে আছেন দায়িত্বে, হেরেছেন মাত্র ১টি ম্যাচে! টানা ৯ ম্যাচ ছিলেন অপরাজিত, এর মধ্যে হারিয়েছেন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের মতো দলকে। হারটাও এসেছে গত জুনে ব্রাজিলের কাছে। সাও পাওলোতে ১-০ গোলে না হারলে এখনো অপরাজিতই থাকতেন গুস্তাভো।

কিন্তু এত দিন ধরে হারের বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া দলকে কীভাবে বদলে দিলেন গুস্তাভো? ম্যাচ বাই ম্যাচ অ্যাপ্রোচ। প্যারাগুয়ের স্বর্ণযুগ আর নেই। তবে তারকারা ঠিকই আছেন। দরকার শুধু সবাইকে একসুতোয় গাঁথা। ডিফেন্সে অধিনায়ক গুস্তাভো গোমেজের সঙ্গে রয়েছেন তরুণ ওমর আলদারিত। দীর্ঘদিন ধরে খেলছেন স্প্যানিশ লিগে, এই মৌসুমে যোগ দিয়েছেন সান্ডারল্যান্ডে। মাঝমাঠে যেমন মিগুয়েল আলমিরন আর র‍্যামোন সোসার মতো ইউরোপে দীর্ঘদিন খেলা অভিজ্ঞ খেলোয়াড় আছে। তেমনই সদ্য ইউরোপে পা দেওয়া ডিয়েগো গোমেজের মতো তরুণ তারকারাও আছেন। আর আক্রমণভাগে আন্তোনিও সানাব্রিয়া তো বড় হয়েছেন লা মাসিয়ায়। কয়েক মৌসুম ধরে নাম কামাচ্ছেন ইতালিয়ান লিগে। আছেন প্রিমিয়ার লিগ খেলা তরুণ জুলিও ইনসিসো। গুস্তাভো সেই রিসোর্সকে এক করেছেন শুধু।

আরও পড়ুন
আনন্দে কাঁদছেন অধিনায়ক গুস্তাভো গোমেজ।
ছবি: এক্স

‘আক্রমণ জেতায় ম্যাচ আর ডিফেন্স জেতায় শিরোপা’—মন্ত্রকে মনেপ্রাণে ধারণ করেছেন কোচ গুস্তাভো। বড় দলের সঙ্গে আক্রমণে গিয়েও পারবেন না, সেটাও খুব ভালোভাবে জানা তাঁর। ফলে একটাই উপায় আছে। ডিফেন্স শক্ত করো আর সেট–পিসে বাজিমাত করো। সঙ্গে সুযোগ পেলেই দূরপাল্লার শট। প্যারাগুয়ে সেটাই করেছে। তাঁর অধীনে ১১ ম্যাচের ৬টিতে ছিল ক্লিন শিট। ডিফেন্স শক্ত রেখেই এগিয়েছে আক্রমণে। যে কারণে ২ গোলের বেশি কোনো ম্যাচেই করতে পারেনি তারা। সেট–পিসে তাদের সবকিছু যেন মাপা। কর্নার থেকে শুরু করে ফ্রি–কিক, সবকিছু জায়গামতো গিয়ে পরে তাদের। আর্জেন্টিনাকে সেভাবেই কাবু করেছিল তারা। ব্রাজিলকে হারিয়েছিল দূরপাল্লার শটে। সবকিছুর ফলাফল, বিশ্বকাপ।

মিগুয়েল আলমিরনের হাসিই বলে দেয় কত প্রতীক্ষায় পাওয়া এই জয়।
ছবি: এক্স

তবে কয়েকজনের কথা না বললেই নয়। শুরুতে আসবে মিগুয়েল আলমিরনের কথা। কয়েক বছর ধরে প্যারাগুয়ের একমাত্র তারকা যেন ছিলেন তিনি। প্যারাগুয়ের দুঃসময়ে দলটাকে ধরে রেখেছেন আপন করে। মাঝমাঠে এখনো তাদের প্রাণভোমরা আলমিরন। এরপরই আসবে টনি সানাব্রিয়া আর হুলিও এনসিসোর কথা। গোল করার দায়িত্বটা থাকে তাঁদের দুজনের ওপর। বাছাইপর্বে দুই স্ট্রাইকার মিলে করেছেন ৭ গোল। দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁরাই। আর দলকে পেছন থেকে ধরে রেখেছেন অধিনায়ক গুস্তাভো গোমেজ ও ৩৭ বছর বয়সী গোলরক্ষক গাতিতো ফার্নান্দেস। ডিফেন্সকে অপ্রতিরোধ্য বানানোর কারিগর এই দুজন। ২৬ বিশ্বকাপের টিকিট তো নিশ্চিত, এখন এই তরুণ দলকে নিয়ে কী চমক দেখান কোচ গুস্তাভো আলফারো সেটির অপেক্ষায় সবাই।

প্যারাগুয়ে বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়ায় দেশব্যাপী ছুটি ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার। ১৬ বছর পর বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছে দেশটি। এর থেকে বড় আনন্দের দিন আর কী-ইবা হতে পারে? মজার ব্যাপার হলো পরবর্তী বিশ্বকাপের জন্যই সিট তৈরি আছে তাদের। প্যারাগুয়েতে বিশ্বকাপের একটি ম্যাচ হওয়ায় ২০৩০ বিশ্বকাপে সরাসরি সুযোগ পাবে তারা।

আরও পড়ুন
প্যারাগুয়ের হয়ে বাছাইপর্বে সর্বোচ্চ গোলদাতা টনি সানাব্রিয়া।
ছবি: এক্স

বিশ্বকাপে অনিয়মিত হলেও চমক দেখাতে ভুল করে না তারা। এখন পর্যন্ত খেলা প্রতিটি বিশ্বকাপেই একটি ম্যাচে জয় আছে তাদের (১৯৫০ বিশ্বকাপ বাদে)। তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য এসেছে শেষ খেলা ২০১০ বিশ্বকাপে। সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল স্পেনের কাছে। এরপর ফুরিয়ে গেছে স্বর্ণযুগ, তারকারা একে একে খসে পড়েছেন, বিশ্বকাপ আর খেলা হয়নি। এবার এসেছে নতুন সময়, ২৬ বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত। এখন এই তরুণ দলকে নিয়ে কী চমক দেখান কোচ গুস্তাভো আলফারো—সেটির অপেক্ষায় সবাই।

আরও পড়ুন