বার্সার গোলরক্ষক সমস্যার সমাধান কি করতে পারবেন হোয়ান গার্সিয়া
ডিফেন্সের শেষ লাইন, ফুটবল মাঠে গোলরক্ষকের পরিচয় দিন শেষে এটাই। পুরো মাঠের সবাই যখন আশা ছেড়ে দেয়, তখন ভক্ত, সমর্থক থেকে শুরু করে দলের খেলোয়াড়েরা পর্যন্ত ভরসা রাখেন একজনের কাঁধে—দলের গোলরক্ষক। গোলরক্ষক শুধু ম্যাচের গতি পাল্টে দেন না, পাল্টে দেন ম্যাচের ফলও। ২০১০ বিশ্বকাপ ফাইনালে ক্যাসিয়াস কিংবা ২০২২ বিশ্বকাপের এমি মার্তিনেজ যেমন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বার্সেলোনা যেন এত বছর ধরে সেই চক্রেই ঘুরপাক খাচ্ছিল।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বার্সেলোনার গোলবারের নিচে আছেন মার্ক–আন্দ্রে টার স্টেগান। জার্মান এই গোলরক্ষককে মাত্র ২২ বছর বয়সে দলে ভিড়িয়েছিলেন কোচ লুইস এনরিকে। ইচ্ছা ছিল তাঁর ওপর গোলরক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া। তখন গোলবারের নিচে অভিজ্ঞ ক্লদিও ব্রাভো থাকায় সেই সুযোগ হয়নি। ব্রাভোর বিদায়ের পর পাকাপাকিভাবে সে দায়িত্ব এসে পড়ে টার স্টেগানের হাতে। গোলরক্ষক হিসেবে স্টেগান কখনোই খারাপ ছিলেন না। বরং বার্সেলোনাকে বড় বড় ম্যাচে বাঁচানোর রেকর্ডও আছে তাঁর। কিন্তু ক্যারিয়ারের বিশাল সময় ধরে তাঁর সঙ্গী ছিল চোট।
বার্সেলোনার হয়ে অভিষেকের আগেই তাঁর সঙ্গী হয় চোট। নইলে দলে এসেই মূল গোলরক্ষকের দায়িত্ব পেতে পারতেন তিনি। কিন্তু নিয়মিত চোটের কারণে তাঁকে খেলতে হতো চ্যাম্পিয়নস লিগ আর কোপা দেল রের ম্যাচে। লিগে গোলবারের দায়িত্ব থাকত ব্রাভোর ওপর। ব্রাভো ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে কখনো লড়াই করতে হয়নি স্টেগানকে। বরং লড়াই করতে হয়েছে চোটের সঙ্গে। প্রতি মৌসুমেই একটা সময়ের জন্য তাঁকে মাঠে পেত না বার্সেলোনা। আর তাঁর বেশির ভাগ চোটই ছিল হাঁটুতে।
টার স্টেগান ছোটবেলা থেকে গড়ে উঠেছেন জার্মান খেলার ধাঁচে। আধুনিক সুইপার-কিপার বলতে যা বোঝায়, স্টেগান ছোটবেলা থেকেই সেই দীক্ষায় রপ্ত। বল পায়ে ডিফেন্ডারদের সাহায্য করা, সামনে এসে ডিফেন্সেও কিছুটা হাত লাগানো, আক্রমণের সূচনা করা—সবটাই টার স্টেগানের হাতের আওতায়। কিন্তু বেরসিক চোটের কারণে তার কোনোটাই ঠিকমতো করতে পারতেন না।
সবচেয়ে বড় আঘাতটা এল ১৮-১৯ মৌসুমে। হাঁটুর চোটে প্রায় এক মাস ছিলেন মাঠের বাইরে। আর তখন থেকেই খেলার ধরন আর পারফরম্যান্সে পড়তে শুরু করল ভাটা। ২০-২১ মৌসুমে দুই দফায় মাঠের বাইরে ছিলেন ছয় মাসেরও বেশি সময়। করোনা–পরবর্তী সেই শরীর চোটের ধাক্কা কাটাতে পারেনি। ফলে টার স্টেগান বার্সার গোলবারের নিচে হয়ে ছিলেন একটা কাঁটার মতো। চোটের কারণে হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজের স্বাভাবিক খেলা। বার্সেলোনার কলঙ্কিত ২-৮ গোলের সময় গোলবারের সামনে ছিলেন তিনি। মেসি-পরবর্তী বার্সেলোনা দলের অধিনায়ক তিনি, তাঁকে সরানোও মুশকিল। আবার এমন বাজে পারফরম্যান্সও দিচ্ছেন না যে তাঁকে পত্রপাঠ বিদায় বলে দেওয়া যায়। আর টাকাপয়সার ব্যাপারটা তো আছেই। সব মিলিয়ে স্টেগানকে নিয়ে বেশ বিপত্তিতে ছিল বার্সা।
এর মধ্যেই আবারও মাঠের বাইরে বেরিয়ে গেলেন স্টেগান। ২৩-২৪ মৌসুমে পিঠের চোটে বাইরে ছিলেন তিন মাস। সে সময় গোলবার সামলাতেন লা মাসিয়ার ইনাকি পেনা। তরুণ গোলরক্ষক হিসেবে মন কাড়লেও পারফরম্যান্স ঠিক বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের মতো ছিল না। এর মধ্যেই শাপেবর হয়ে গেল গত মৌসুমের চোট। মৌসুমের প্রথম ম্যাচেই লিগামেন্ট ছিঁড়ে ফেলেন স্টেগান। পুরো মৌসুমের জন্য বিদায় বলতে হয় ফুটবলকে। তাঁর জায়গায় তড়িঘড়ি করে নিয়ে আসা যায় সদা ফুটবল থেকে অবসর নেওয়া ভয়চেক সেজনিকে। ফ্রিতে পাওয়া গোলরক্ষক বদলে দেন বার্সেলোনার চিত্র। বয়সটা ৩৫ হলে কী হবে, একের পর এক সেভ যেন বার্সা–ভক্তদের জানিয়ে দেয় এত দিন ঠিক কী মিস করছিলেন তাঁরা। চোট থেকে ফিরেও তাই দলে মূল জায়গাটা খুঁজে পাননি স্টেগান। আর সেখানেই দাবার সঠিক ঘুঁটি চালল বার্সা বোর্ড।
এত দিন ধরে যে গোড়াতেই গলদ হয়ে রয়েছে, তা চোখে পড়ল তাদের। আতশি কাচের নিচে গিয়ে অনেকেই স্টেগানের সমস্যা ধরিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু দলের বাকি সমস্যার তুলনায় তা ছিল নগণ্য। কিন্তু এখন যখন বাকি সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে তখন গোলরক্ষক সমস্যার সমাধানে নামল বার্সা। সেই সমাধানের নাম? হোয়ান গার্সিয়া।
২৪ বছর বয়সী গোলরক্ষক বড় হয়েছেন এস্পানিওলের জার্সিতে। যুব দল থেকে শুরু মূল দল, বার্সেলোনার নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী এস্পানিওলের হয়েই তার খেলা। এস্পানিওলকে দ্বিতীয় ডিভিশন থেকে প্রথম ডিভিশনে আনার পেছনেও ছিল তাঁর বড় অবদান। তবে হোয়ান গার্সিয়া নজর কেড়েছিলেন গত মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে। এক ম্যাচে সাতটি সেভ করে নজর কাড়েন তিনি। পান ‘লা লিগা সেভ অব দ্য মান্থ’ পুরস্কারও। স্প্যানিশ ফুটবলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টানা দুই মাসে একই গোলরক্ষক পান এই পুরস্কার। গত মৌসুমে বাঘা বাঘা গোলরক্ষককে পেছনে ফেলে সর্বোচ্চ সেভের রেকর্ড গড়েন গার্সিয়া। তখনই সবাই বুঝেছিল, এই খেলোয়াড় আর বেশি দিন এস্পানিওলের থাকছে না।
অন্য কেউ নজর দেওয়ার আগেই তাঁকে কেড়ে নেয় বার্সেলোনা। দলবদলের মৌসুম শুরু হতে না হতেই রিলিজ ক্লজ ২৫ মিলিয়ন ইউরো পরিশোধ করে তাঁকে দলে টানে বার্সেলোনা। ছয় বছরের চুক্তিতে গার্সিয়া এখন পাকাপাকিভাবে বার্সার মূল গোলরক্ষক। বার্সেলোনা যদিও চেয়েছিল টার স্টেগানকে বিদায় বলে দিতে। কিন্তু ঠিকঠাক না মেলায় এখনো অধিনায়ক হিসেবে টিকে আছেন তিনি। কিন্তু গার্সিয়ার পারফরম্যান্সে কত দিন থাকতে পারেন, সেটাই এখন প্রশ্ন। কেন বলছি? বার্সেলোনা আর রায়ো ভায়েকানোর ম্যাচটাই তার প্রমাণ।
ম্যাচের ফলাফল থেকে বোঝার উপায় অবশ্য নেই। রায়ো ভায়েকানোর মাঠে ১-১ গোলে ড্র করেছে বার্সা। পেনাল্টি পেয়েও বার্সা জিততে পারেনি, পারফরম্যান্স তো দল হিসেবে অবশ্যই খারাপ। কিন্তু যারা ম্যাচ দেখেছে তারাই বলতে পারবে, এক মৌসুম আগে হলেও এই ম্যাচে অন্তত তিন গোল হজম করত বার্সা। হোয়ান গার্সিয়ার দুর্দান্ত গোলকিপিং বাঁচিয়ে দিয়েছে তাদের। পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সেভ করে শুধু ১ পয়েন্ট এনে দেননি, সঙ্গে জিতে নিয়েছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারও। রীতিমতো বার্সেলোনার ডিফেন্সকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন পর্যন্ত তিন ম্যাচে মাঠে নেমেছেন, তিন ম্যাচেই তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স চোখে পগেছে দর্শকদের। ভক্তরাও আশা খুঁজছেন তাঁর মধ্যেই। এত দিনে এসে যেন বার্সার সমর্থকেরা গোলবারের নিচে একজন অতন্দ্র প্রহরী খুঁজে পেল। টার স্টেগানের হুটহাট করে ফেলা ভুল যেন আর সইতে হবে না তাদের। এখন দেখার বিষয় হোয়ান গার্সিয়া সেই দায়িত্ব কতটা মনোযোগ দিয়ে পালন করতে পারেন?