সালাহ-লিভারপুল মুখোমুখি কেন

লিভারপুলের জার্সিতে সালাহরয়টার্স

লিভারপুলের সময়টা ভালো যাচ্ছে না অনেক দিন ধরেই। আর্নে স্লট প্রথম মৌসুমে যে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উবে গেছে তা। নতুন খেলোয়াড়েরা নিজেদের মেলে ধরতে পারছেন না। সব দিকেই যখন করুণ অবস্থা, তখন নিজ দলের সেরা তারকার সঙ্গে দা-কুমড়া সম্পর্ক লিভারপুলের। মোহাম্মদ সালাহর সঙ্গে সম্পর্ক এতটাই শীতল যে মৌসুমের মধ্যেই দল ছাড়তে পারেন তিনি।

মোহাম্মদ সালাহ লিভারপুলের জন্য ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। ২০১৭ সালে তাঁকে রোমা থেকে লিভারপুলে এনেছিলেন তৎকালীন কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। এর বছর তিনেক আগে চেলসিতে খেলা সালাহকে কেনা নিয়ে অনেকেই সে সময় চিন্তিত ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ‘ব্যর্থ’ হয়ে ফিরে যাওয়া খেলোয়াড় লিভারপুলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবেন কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল অনেকের। মোহাম্মদ সালাহ সেসব প্রশ্নের উত্তর থামিয়ে দিয়েছেন নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে।

আরও পড়ুন

গত আট মৌসুমের পাঁচ মৌসুম ছিলেন ব্যালন ডি’অরের শীর্ষ সাতে। একবার হয়েছেন ১১তম। একবার ছিলেন না সংক্ষিপ্ত তালিকায়, আরেকবার করোনার কারণে দেওয়া হয়নি ব্যালন ডি’অর পুরস্কারই। মোহাম্মদ সালাহ কতটা ধারাবাহিক ছিলেন, তার প্রমাণ বলে দিচ্ছে তাঁর পারফরম্যান্সই। বড় কোনো ইনজুরি নেই, বড় সময়ের জন্য অফ ফর্মেও ছিলেন না। সালাহ শুধু দিয়েই গেছেন লিভারপুলকে। তিন দশক পর লিভারপুলে ভিড়েছে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। প্রায় দুই দশক পর লিভারপুল হয়েছে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন। সবগুলোতেই আছে মোহাম্মদ সালাহর অবদান।

এর প্রতিদানও পেয়েছেন সমর্থকদের কাছ থেকে। নিঃস্বার্থভাবে তাঁকে ভালোবেসে গেছেন সমর্থকেরা। ভক্তদের যে ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন সালাহ, তার ছিটেফোঁটাও পাননি নিজের দলের কাছ থেকে। দল মানে সতীর্থ নয়, বরং দলের ম্যানেজমেন্ট। ম্যানেজমেন্ট বরাবরই সালাহর ব্যাপারে ছিল উদাসীন। যার প্রমাণ দেখা মিলেছিল গত মৌসুমে। সালাহ ছিলেন তাঁর চুক্তির একেবারে শেষদিকে। এমন অবস্থায় চলে গিয়েছিল যে কোনো দল চাইলে সালাহর সঙ্গে মৌখিক ও আনুষ্ঠানিক চুক্তি সেরে রাখতে পারত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দর্শকদের ক্রমাগত চাপ তো ছিলই, মোহাম্মদ সালাহ নিজেও বেশ কয়েক জায়গায় চুক্তি নিয়ে কথা বলার পর অবশেষে এপ্রিলে তাঁর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে লিভারপুল। তখন সালাহার চুক্তি শেষ হওয়ার মাত্র দুই মাস বাকি ছিল।

আরও পড়ুন
লিভারপুল তারকা মোহাম্মদ সালাহ।
ছবি: এএফপি

ক্লাবের সঙ্গে একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল ঠিক সে সময় থেকেই। বারবার ক্লাবের বাইরে গিয়ে চুক্তির কথা বলা পছন্দ ছিল না ক্লাবের। কিন্তু সালাহকে আটকানোর সাধ্য ছিল না কারও। কারণ, গত মৌসুমে লিভারপুলের লিগ জয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ঘুরেফিরে সেই মোহাম্মদ সালাহর। এই মৌসুমে এসেই চিত্রটা বদলে গেছে অনেকখানি। অনেক বছর পর লিভারপুল ফিরে এসেছে মিড টেবিলে। মাঠে দলের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক নয়। আর সেই সঙ্গে ফর্মে নেই মোহাম্মদ সালাহ। অন্তত সালাহ যে লেভেলে খেলেন, সেই পর্যায়ে নেই। ১৯ ম্যাচ শেষে মাত্র ৫ গোল। কোচ আর্নে স্লট তাই ভেবেছেন মোহাম্মদ সালাহকে ছাড়া খেললে কেমন হয়?

এরপরেই দেখা মিলল এক বিরল দৃশ্যের। এক–দুই ম্যাচ ট্যাকটিক্যাল কারণে বসে থাকা কোনো খেলোয়াড়ের জন্যই নতুন কিছু নয়। কিন্তু পরপর চার ম্যাচে তাঁকে দেখা যায়নি শুরুর একাদশে। দুই ম্যাচে খেলানোই হয়নি সালাহকে। চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তিনি ছিলেন স্কোয়াডের বাইরে। ভাবা যায়? সালাহর মতো খেলোয়াড় নেই চ্যাম্পিয়নস লিগে। যারপনাই বিরক্তি প্রকাশ করেছেন সালাহও। আর সেই সাক্ষাৎকারেই উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। সরাসরি সালাহ বলেছেন, ‘টানা তিন ম্যাচ কেন বেঞ্চে বসে আছি, তা কেউ জানে না। ক্লাবের এই খারাপ সময়ে একজন বলির পাঠা দরকার ছিল, তাই আমাকে বেঞ্চে বসানো হয়েছে। হুট করেই কোচ আমার সঙ্গে কথা বলছেন না। মনে হচ্ছে কেউ একজন চায় না আমি দলে থাকি।’

আরও পড়ুন

সালাহ যে অভিমান থেকে এ কথা বলেছেন, তা বোঝা গেছে তাঁর বক্তব্যেই। ফলাফল হিসেবে ইন্টারের বিপক্ষে স্কোয়াডেই ছিলেন না লিভারপুলের ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। ধরেই নেওয়া যায়, পরের ম্যাচগুলোতে তাঁকে মাঠে না-ও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু দলের সেরা পারফরমারকে কেন কেউ দল থেকে বাদ দিতে চাইবে? আর কে সেই ব্যক্তি? অনেকের ধারণা, এই ব্যক্তিটি আর কেউ নন, এফএসজির সিইও মাইকেল এডওয়ার্ডস। যিনি মাঠের খেলা থেকে অঙ্কের খুঁটিনাটি খুব ভালো বোঝেন।

কারণটা বেশ সাধারণ। সালাহর বয়স এখন ৩৪। তাঁর চুক্তি শেষ হবে ৩৫ বছর বয়সে। সেই সময়ে দল ছাড়তে চাইলে তাঁকে ছাড়তে হবে কোনো টাকা ছাড়াই। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁকে দলে ভেড়ানোর জন্য উৎসুক হয়েছে সৌদি আরবের দলগুলো। বিভিন্ন দল মোটা টাকার বস্তা নিয়ে আসবে লিভারপুলের কাছে, তাঁকে কিনতে। সেই সুযোগটাই হয়তো লুফে নিতে চাচ্ছেন তিনি। তাঁকে বিক্রি করার শ্রেষ্ঠ সময় যেন এখনই।

মোহাম্মদ সালাহও যেন সেটা বুঝতে পেরেছেন, সে কারণেই দলবদলের একটা ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন। বলেছেন, ফুটবলে ভবিষ্যৎ কখনো এক জায়গায় থাকে না। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই খুব একটা শঙ্কিত নন তিনি।

লিভারপুলের সাবেক খেলোয়াড়েরা অবশ্য এ ব্যাপারে দুই ভাগে বিভক্ত। কেউ বলছেন সালাহ আছেন এত দিন, পারফর্ম করছেন, তাঁকে রাখার জন্য সবটা করা উচিত। লিভারপুলের সাবেক খেলোয়াড় জেমি ক্যারেগার বলছেন, কোচ আর ক্লাবের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সালাহ যে বক্তব্য দিয়েছেন, যে কথা বলেছেন, তারপর আর কোনো কথা চলে না। সালাহকে দলে রাখার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে গেছে। এখন সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে দুজনের কোর্টেই। দেখা যাক, এত ঝামেলার পর দুজনের মিল হয় কি না। নাকি আট বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে সালাহ পাড়ে দেবেন অন্য কোনো গন্তব্যে?

আরও পড়ুন