পালমেইরাসের ‘ছোট্ট মেসি’ এস্তেভাও এখন ব্রাজিলের বড় আশা

কথায় আছে, ব্রাজিলের অলিতে গলিতে বেড়ে ওঠে ফুটবলার। এই ফুটবলারদের মধ্যে যাদের ভাগ্য খুবই ভালো, তারাই পা রাখতে পারে পেশাদার ফুটবলে। বাকিরা হারিয়ে যায় দারিদ্র্যের কশাঘাতে, জীবন আর জীবিকার টানে। এস্তেভাও সেই ভাগ্যবান তারকাদেরই একজন। মাত্র ১১ বছর বয়সে যাঁকে চিনত ব্রাজিলের প্রতিটি যুব দল। ৭ বছর পর ভিনিসিয়ুস-রাফিনহা-রদ্রিগোদের সঙ্গে ব্রাজিলের অন্যতম বড় ভরসা হয়ে উঠছেন সেই এস্তেভাও।

ছোটবেলায় এস্তেভাওকে সবাই ডাকতেন ‘মেসিনহো’ বলে। যার অর্থ ছোট মেসি। ডাকনাম হিসেবে ‘মেসিনহো’ তাঁর কখনোই পছন্দ ছিল না। একজন খেলোয়াড় বড় হবেন নিজের নামে, অন্যের সঙ্গে তুলনা কেন? এস্তেভাও তাই সবাইকে বলতেন, নিজের নামে বড় হতে চান তিনি। অন্য কারও ছোট ভার্সন হয়ে নয়। ৬৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ব্রাজিলে যোগ দেওয়া এস্তেভাও এখন জনপ্রিয় নিজের নামেই। নেইমারের চোখে তিনি ‘জিনিয়াস’, আর্লিং হল্যান্ডের মতে ‘ওয়ান্ডারকিড’, কার্লো আনচেলত্তির ভরসার পাত্র—মাত্র ১৮ বছর বয়সেই যেন সবটা নিজের করে নিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন

এস্তেভাওয়ের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ক্রুজেইরোর হয়ে। তাঁর বয়স তখন মাত্র ১০। তত দিনে ব্রাজিলের কমবেশি সবাই জেনে গেছে নতুন এক তারকার আগমনের কথা। তাঁকে নিজেদের দলে ভেড়ানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে নাইকি আর অ্যাডিডাস। ব্রাজিলের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী তারকা হিসেবে চুক্তি সই করা খেলোয়াড়ের নাম এস্তেভাও। এর সবকিছুই আলো ছড়ানোর আগেই। ফিফার নিয়ম না মেনে দলবদল করায় ক্রুজেইরোর সঙ্গে বাতিল হয়ে যায় তাঁর চুক্তি, অগত্যা যোগ দেন পালমেইরাসে। ক্যারিয়ারের মোড় ঘোরানো দলবদলের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪। চোটের কারণে তখন তিনি মাঠের বাইরে। মাঠে ফিরেই বুঝলেন ক্রুজেইরো আর পালমেইরাস এক নয়। আগের ক্লাবে যেখানে তাঁর জাদুই যথেষ্ট ছিল সবাইকে মুগ্ধ করতে, এখানে জাদুর সঙ্গে প্রয়োজন নিয়মানুবর্তিতা।

পালমেইরাসে নিজেকে নতুন করে গড়েছেন এস্তেভাও
ছবি: এক্স

প্রথম ম্যাচে মাঠে নামতেই কোচ সাফ জানিয়ে দিলেন, দলে টিকে থাকতে চাইলে ডান পায়ে তোমাকে খেলতেই হবে। মাথা দিয়ে তোমাকে হেড করতেই হবে। যত দিন পারবে না, তত দিন বেঞ্চে বসে থাকবে। অন্য কেউ হলে হয়তো খুব একটা গা করত না। কত ব্রাজিলিয়ান তারকা খামখেয়ালি করে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়েছে, এস্তেভাও সেই পথে হাঁটতে পারেন। কিন্তু কোচ আবেল ফেরেইরা অন্য কিছু দেখেছিলেন তাঁর মধ্যে। অন্য ব্রাজিলিয়ান ওয়ান্ডারকিডদের মতো ঔদ্ধত্য স্থান পায়নি তাঁর মনে। বরং কোচের কথা মেনে নিয়েছিলেন একবাক্যে। পরদিন ট্রেনিংয়ে এক নতুন এস্তেভাওকে দেখে শুধু কোচ নয়, অবাক হয়েছিলেন সতীর্থরাও। সেদিনের এস্তেভাও বদলে দিয়েছিলেন পালমেইরাস যুব দলের চিত্র।

আরও পড়ুন

১৫ বছর বয়সে সুযোগ পেয়েছিলেন অনূর্ধ্ব-১৭ দলে। টানা দুইবার অনূর্ধ্ব-১৭ কোপা ব্রাজিলিয়া জিতিয়েছেন। দ্বিতীয়বার ফাইনালে করেছেন হ্যাটট্রিক। পালমেইরাসের হয়ে অভিষেকের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর ৮ মাস। সেখান থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এস্তেভাও নিজেকে গড়েছেন নিজের আদলে। ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়দের জন্য সামনে এগোনো যতটা না সহজ, পিছিয়ে পড়া তার থেকেও হাজার গুণ সহজ। এস্তেভাও তাঁর পথ এত সহজে হারাননি। চোখের সামনে শত শত তারকাকে হারিয়ে যেতে দেখেছেন, তাই সতর্ক ছিলেন প্রতিটি মুহূর্তে।

চেলসির জার্সিতে এস্তেভাওয়ের প্রথম গোল
ছবি: এক্স

পালমেইরাসের জার্সিতে তিন বছর খেলেছেন, ৮৩ ম্যাচে গোলের সংখ্যা ২৭। ব্রাজিলিয়ান তারকাদের প্রতি আলাদা করে আগ্রহ থাকে ইউরোপিয়ান হেভিওয়েটদের। এস্তেভাও সেই স্রোতে হারাতে চাননি, ভেবেচিন্তে যোগ দিয়েছেন চেলসিতে। চেলসিতে তারকার অভাব নেই, কিন্তু ডান পাশ থেকে দুর্দান্ত গতিতে কাট ইন করা খেলোয়াড়ের বড্ড অভাব রয়েছে। এস্তেভাও জানেন, তাঁকে বেড়ে ওঠার সুযোগ যদি কেউ দেয়, তবে সেটা হবে চেলসি। অন্য কেউ নয়।

আরও পড়ুন

এস্তেভাও নিজেকে প্রমাণ করেছেন রীতিমতো নতুন দলের সামনেই। জুনের মাঝামাঝি সময়ে পালমেইরাসের সঙ্গে চুক্তি হয়ে যায় চেলসির। কিন্তু ক্লাব বিশ্বকাপের জন্য পালমেইরাস তাঁকে রেখে দেয় নিজেদের কাছে। আর কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় দুই দল। চেলসি ডিফেন্সকে রীতিমতো নাকানিচুবানি খাইয়েছেন। চেলসি যেন আরও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, ৬৭ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে ভুল খেলোয়াড়কে কেনেনি তারা।

ভিনি, রদ্রিগোর মাঝে এস্তেভাও
ছবি: এক্স

চেলসিতে যোগ দেওয়ার পর খুলে যায় জাতীয় দলের ভাগ্যও। কার্লো আনচেলত্তি তাঁকে ডেকে পাঠান দলে, ২০২৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে। ব্রাজিলের জার্সিতে এখন পর্যন্ত ৫ ম্যাচে মাঠে নেমেছেন এস্তেভাও। এর মধ্যেই করেছেন ৩ গোল। হলুদ জার্সিতে যেমন আলো ছড়িয়েছেন, চেলসির নীল জার্সিতেও ঠিক একই রকম উজ্জ্বল। এখন পর্যন্ত মাত্র ৯ ম্যাচ, সর্বসাকল্যে ৬৬৫ মিনিট। এর মধ্যে পেয়েছেন ১ গোল। কিন্তু চেলসি তাঁর কাছ থেকে যে আউটপুট চেয়েছে, তার সবটাই পেয়েছে। হলুদ জার্সিতে যা চাওয়ার তা ঠিকই আদায় করে নিয়েছেন কার্লো আনচেলত্তি।

জাপানের বিপক্ষে তাঁকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার ফল হিসেবে আসেনি কোনো গোল। দলও ছিল ছন্নছাড়া। ডিফেন্সের ভুলে এগিয়ে গিয়েও হারতে হয়েছে ব্রাজিলকে। ২৬ বিশ্বকাপকে নিয়ে কার্লো আনচেলত্তি যেভাবে দল সাজাচ্ছেন, তাতে সামনের সারিতে পরিচিত মুখদের আনাগোনা থাকার কথা। সেখান থেকে সবাইকে ছাড়িয়ে এক ১৮ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ান হয়ে উঠছেন ব্রাজিলের মূল অস্ত্র। বিশ্বকাপের মঞ্চে এই বয়সে দলকে এগিয়ে নেওয়ার মতো সম্মানের আর কী-ই বা হতে পারে?

আরও পড়ুন