কোচকে বরখাস্ত করায় মালিকের পদত্যাগ চাচ্ছেন সমর্থকেরা

কথায় আছে, জিততে থাকা দলে কখনও হাত দিতে হয় না। সেটা দল হোক কিংবা কোচ–দুই ক্ষেত্রেই সত্য। একবার যখন ব্যাটে বলে মিলে যায়, মাঠের কম্বিনেশন তৈরি হয়ে যায় — তখন সেই কম্বিনেশন ভাঙলে অনেক সময়ই ছন্দপতন ঘটতে পারে। নটিংহাম ফরেস্টের মালিকের কানে বোধহয় এই তথ্যটা যায়নি। নইলে খাল কেটে কুমির কে ডেকে আনে? দলকে ইউরোপের টিকিট দেওয়া কোচকে বরখাস্ত করার দুঃসাহস এখন তাড়া করে ফিরছে তাঁকে।

নটিংহাম ফরেস্টের ঘটনা বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে দুই মৌসুম আগে, ২০২৩-২৪ মৌসুমে। ভুলে যাওয়ার মতো একটা মৌসুম ছিল সেটা ফরেস্টের জন্য। শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরের ঘটনাতেও রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল তাদের। বহুবছর ধরেই প্রিমিয়ার লিগের নিচের সারিতে তাদের বসবাস। নিয়মিত উঠানামা তাদের নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার। সে মৌসুমেও থাকবে নাকি থাকবে না দোটানার মধ্যে বসবাস করছিল ফরেস্টের সমর্থকরা। এর মধ্যেই দুঃসংবাদ হয়ে ধরা ছিল প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষ। নিয়ম না মেনে দলবদল করায় চার পয়েন্ট কেটে নেওয়া হলো তাদের। এক ধাক্কায় পৌছে গেল অবনমনের সারিতে। একে তো পয়েন্ট ছেঁটে ফেলা, অন্যদিকে মাঠের খেলাতেও যাচ্ছেতাই অবস্থা। এমন সময় নটিংহাম ফরেস্টের ত্রাতা হয়ে এলেন নুনো এসপারিতো সান্তো। প্রিমিয়ার লিগের পোড় খাওয়া কোচ, পাড়ি জমিয়েছিলেন সৌদি আরবে। কিন্তু ডাক সামলাতে পারেননি, ঠিকই ফেরত এসেছেন আবার, প্রিমিয়ার লিগে।

ফরেস্ট ভক্তদের আস্থার পাত্র ছিলেন কোচ সান্তো।
ছবি: এক্স
আরও পড়ুন

পয়েন্ট কেটেকুটে একেবারে তলানিতে থাকা দলটাকে টেনে দিয়ে আসলেন খাদের কিনারা থেকে। শেষদিনে বার্নলিকে হারিয়ে নিশ্চিত করলেন পরের মৌসুমের টিকিট। সেদিন নুনো এসপারিতো সান্তোর প্রতি কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়েছিল সকলের কণ্ঠে। সেই কোচই পুরোপুরি বদলে দিলেন নটিংহাম ফরেস্টের চিত্র। পরের মৌসুমে তার চমক শুরু হলো লিভারপুলকে হারিয়ে। ৫৫ বছর পর কোনো টুর্নামেন্টে লিভারপুলকে হারানোর স্বাদ পেয়েছিল ফরেস্ট। শুধু ফরেস্ট না, কোচ হিসেবেও সেটা ছিল লিভারপুলের বিপক্ষে তাঁর প্রথম জয়। সেদিনই যেন নতুন কিছুর স্বপ্ন দেখেছিল ফরেস্ট। আর সেটাকেই সত্যিতে পরিণত করেছিলেন কোচ নুনো এসপারিতো সান্তো।  

আশির দশকে যে নটিংহাম ফরেস্ট ছড়ি ঘোরাতো প্রিমিয়ার লিগে, টানা দুইবার ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লিগ) জেতা দল হারিয়ে গিয়েছিল কালের গহ্বরে, সেই নটিংহাম যেন পূনর্জন্ম নিল কোচ নুনো এসপারিতো সান্তোর হাত ধরে। লিভারপুল, টটেনহাম, ইউনাইটেডকে খাবি খাইয়েছেন। ফরেস্টের বিপক্ষে জিততে ঘাম ছুটে গিয়েছে আর্সেনাল চেলসির মতো দলের। একটা সময় মনেই হচ্ছিল, চ্যাম্পিয়নস লিগে ফেরা বোধহয় ফরেস্টের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। ম্যান সিটির মতো দলকে হটিয়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছিল শীর্ষ চারে। কিন্তু শেষ কয়েক সপ্তাহে এসেই মোহভঙ্গ হলো ফরেস্টের। টানা দুই হার আর ২ ড্র, তাদেরকে ছিটকে দিল চ্যাম্পিয়নস লিগের লড়াই থেকে। শেষ ম্যাচে চেলসির কাছে হেরে মাত্র ১ পয়েন্ট পিছিয়ে থেকে বাদ পড়লেন চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে। লিগ টেবিলের ৭ নম্বরে থেকে নিশ্চিত করলেন ইউরোপা লিগের টিকিট। কোচ নুনো এসপারিতো সান্তোর সঙ্গে মালিক ইভাঞ্জোলেস ম্যারিনাকিসের দ্বন্দ্বটা শুরু এখান থেকেই।

কোচের সঙ্গে মালিকের বাদানুবাদ।
ছবি: এক্স
আরও পড়ুন

লিগের শেষদিকে এসে লেস্টার সিটির সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে ফরেস্ট। ম্যাচ শেষে মাঠে নেমে আসেন মালিক ইভাঞ্জোলেস ম্যারিনাকিস। তর্ক জুড়ে দেন কোচ নুনো এসপারিতো সান্তোর সঙ্গে। তাদের বাদানুবাদের সাক্ষী ছিল পুরো বিশ্ব। এগিয়ে থেকেও ড্র করা যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি তিনি, ফলে চড়াও হয়েছিল কোচের ওপর। সেদিন থেকেই যেন সম্পর্কটা শীতল হতে থাকে দুজনের মধ্যে। একটা সময় গিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠে, কোচের সঙ্গে আর বনিবনা হচ্ছে না মালিক পক্ষের।

কিন্তু ২৯ বছর পর ইউরোপে সুযোগ পাইয়ে দেওয়া কোচকে তো আর বরখাস্ত করা যায় না। কোচও তো আর এত লোভনীয় চাকরি সহজে ছাড়তে রাজি নন। ফলে দুইপক্ষই চুপচাপ মেনে নিয়েছে সিদ্ধান্ত। সান্তো থেকে গিয়েছেন কোচ, অন্যদিকে মালিক খুঁজে বেড়িয়েছেন অন্য কোন পথ। সেই অন্য পথটার নাম অ্যাঞ্জ পোস্তেকোগলু।

ইউরোপা লিগ জেতানো কোচ খাবি খাচ্ছেন নটিংহামে এসে।
ছবি: এক্স
আরও পড়ুন

গ্রিক এই কোচ গত বছর নাম কামিয়েছেন অবিশ্বাস্য এক ঘটনা ঘটিয়ে। ১৭ বছর পর প্রথমবারের মতো শিরোপার দেখা পেয়েছে টটেনহাম। ইউরোপা লিগের শিরোপা জেতানোর ১৭ দিনের মাথায় তাকে বরখাস্ত করেছেন টটেনহাম হটস্পার্স। কারণ? লিগে তার যাচ্ছেতাই অবস্থা। কিন্তু তার আগেই যা নাম কামানোর কামিয়ে নিয়েছেন তিনি। আর সেখান থেকেই সখ্যতা শুরু পোস্তেকোগলু আর ম্যারিনাকিসের। গ্রিসে এক পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে বিষদ আলোচনা করতে দেখা যায় তাদের। এরপর তাদেরকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছে রেস্টুরেন্টেও। সেখান থেকেই গুঞ্জন ছড়ায়, নতুন মৌসুমে কি নতুন কোচ নিয়ে শুরু করবে ফরেস্ট? এমনকি উড়ো খবর ছিল, দল নাকি আড়াল থেকে চালাচ্ছেন নতুন কোচই। তার কথামতো খেলোয়াড় কেনা-বেচা হচ্ছে, সবকিছু তৈরি হচ্ছে। পান থেকে চুন কসলেই বরখাস্ত হবেন সান্তো, সে জায়গা দখল করবেন পোস্তেকোগলু।

গুজবটা উড়িয়ে দেওয়ার মতোই ছিল। কোন মালিক কি আর সেধে নিজেদের সেরা কোচকে বিদায় বলবে? অথচ দিন কয়েক পর বোঝা গেল, ঘটনা আসলে সেটাই। কোচ সান্তো সরাসরি অভিযোগ করে বলসেন, নটিংহামের দলবদলের প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বিরক্ত। পছন্দসই খেলোয়াড় তো দূরে থাক, যাদের কেনা হচ্ছে তাদের ব্যাপারেও খুব একটা গতি নেই। ছেড়ে দিয়েছেন এলেঙ্গা, ম্যাট টার্নারের মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে। মোট দলে যোগ দিয়েছেন ১৩ জন নতুন খেলোয়াড়। এর মধ্যে ৫ জনই ডেডলাইন ডেতে। যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে সান্তোর বিদায়।

যে অনুষ্ঠান থেকে সখ্যতা শুরু কোচ অ্যাঞ্জ পোস্তেকোগলু আর মালিক ইভাঞ্জোলেস ম্যারিনাকিসের।
ছবি: এক্স
আরও পড়ুন

এবং সবাই যেটা আশা করছিল, সেটাই ঘটল। এক ম্যাচ হারতে না হারতেই বরখাস্তের চিঠি পৌঁছে গেল কোচ নুনো এসপারিতো সান্তোর হাতে। নতুন মৌসুমে টিকতে পারলেন মাত্র তিন ম্যাচ! একদিনের মাথায় নতুন কোচ হিসেবে যুক্ত হলেন ৫৯ বছর বয়সী গ্রিক কোচ অ্যাঞ্জ পোস্তেকোগলু।

এ যেন স্বপ্ন পূরণ হলো নটিংহাম ফরেস্টের মালিকের। একে তো নিজের দেশের মানুষ, তার ওপর ট্রফি জেতানো কোচ।  দলও খানিকটা তাঁর মতামতের ওপর ভিত্তি করেই সাজানো। নইলে তো আর তড়িঘড়ি করে শেষদিনে পাঁচজন খেলোয়াড়কে কেনার কথা না ফরেস্টের। কিন্তু এসেই যেন অকূল পাথারে পরলেন পোস্তেকোগলু। দায়িত্ব নেওয়ার সময় বড় মুখ করে বলেছিলেন, ‘আমাকে তো জেতার জন্যই আনা হয়েছে।’ অথচ এক মাস হয়ে গেল দায়িত্ব নিয়েছেন, একটা ম্যাচেও জয়ের দেখা পাননি তিনি।

প্রিয় কোচকে বরখাস্ত করায় মালিকের পদত্যাগ চাচ্ছেন সমর্থকেরা।
ছবি: এক্স

সাত ম্যাচ খেলে জয়ের সংখ্যা ০। ড্র করেছেন দুই ম্যাচে। লিগ তো পরের কথা, যে কাপ কম্পিটিশনের কথা ভেবে তাকে দলে ভেড়ানো, সেই ইউরোপাতেও দুই ম্যাচে এক ড্র, এক হার। হারটাও এসেছে মিডজিল্যান্ড নামের ড্যানিশ এক ক্লাবের কাছ থেকে। নতুন কোচকে দল ফিরে গিয়েছে অবনমনের লড়াইয়ে। অন্যদিকে মালিকের অবস্থাও তথৈবচ। কোচ বদলে সুফলের বদলে দুর্নাম কামাচ্ছেন। এমনকি খোদ ক্লাবের সমর্থকেরা পর্যন্ত ক্ষিপ্ত। শেষ ম্যাচে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে দুয়ো উঠেছে।

ওয়েস্ট হামের নতুন কোচ নুনো এস্পারিতো সান্তো।
ছবি: এক্স

অন্যদিকে বরখাস্ত হওয়া কোচ সান্তো? তিনিও আরেকটা চাকরি জুটিয়ে ফেলেছেন। ২০ দিনের মাথায় পেয়েছেন নতুন চাকরি, প্রিমিয়ার লিগের আরেক দল ওয়েস্ট হাম ইউনাইটেডে। যাদের কাছে হেরে চাকরিটা হারিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গেই জুটি বেঁধেছেন। প্রথম ম্যাচটা ড্র করেছেন, দ্বিতীয় ম্যাচে হার। দল সাজানো এখনও অনেকটা বাকি, অবনমনের শঙ্কায় থাকলেও সেটা কাটিয়ে উঠার সৌভাগ্য হয়তো হয়ে যাবে। হাজার হলেও তিনি এই কাজের জন্যই দক্ষ। 

আরও পড়ুন