কোথায় হারালেন সেই ভিনিসিয়ুস
ক্লাব বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচের ৮৪ মিনিট তখন। স্কোরবোর্ডে পিএসজি ৩, রিয়াল মাদ্রিদ ০। ম্যাচে রিয়ালকে নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করেছে পিএসজি। এমন সময় চোখ গেল রিয়াল মাদ্রিদের ডাগআউটে। হুট করেই কী নিয়ে যেন হেসে উঠলেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। পাশ থেকে কামাভিঙ্গার কড়া চোখ দেখে মিইয়ে গেলেন মুহূর্তেই। এই মৌসুমের ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে চাইলে এই ৩ সেকেন্ডের ক্লিপ দিয়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
ভিনিসিয়ুস রিয়াল মাদ্রিদে আছেন সাত বছর হতে চলল। রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলে সাত বছর টিকে থাকার অর্থ একটাই—অসাধারণ প্রতিভা আর প্রচণ্ড কর্মনিষ্ঠা। খেলোয়াড় এবং ফর্মের ব্যাপারে রিয়াল বরাবরই কঠোর। পান থেকে চুন খসলেই বিদায় জানায় পত্রপাঠে। ফর্মের ব্যাঘাত ঘটলে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি ঝরে পড়তে সময় লাগবে না। এমনকি ফর্মের তুঙ্গে থাকা সত্ত্বেও দলে নিজের অবস্থান নিয়ে নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে যে কারও। গঞ্জালো হিগুয়েইন, মেসুত ওজিল, আনহেল ডি মারিয়ারা তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সেই রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলে সাত বছর ধরে টিকে থাকার অর্থ একটাই, রিয়াল মাদ্রিদের স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে ভিনিসিয়ুস নামটা ঠিকঠাক মানিয়ে যায়।
সাত বছর ধরে ভিনিসিয়ুস সেটা প্রমাণও করে গেছেন। প্রথম কয়েক বছর ভিনি খেলে গেছেন বাকিদের ছত্রচ্ছায়ায়। তাঁকে একপ্রকার নিজের শিষ্য বানিয়ে নিয়েছিলেন করিম বেনজেমা। গ্যারেথ বেল, ইসকোদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই মূল একাদশের অংশ হয়ে উঠেছিলেন ভিনি। তরুণ ভিনির খেলাতেও ছিল অপরিপক্বতার ছাপ। করিম বেনজেমা পাশে থেকে সামলে নিয়েছিলেন সেটা। সান্তিয়াগো সোলারির হাত ধরে রিয়ালে থিতু হওয়া ভিনি ডানা মেলেছেন জিদানের অধীনে।
রিয়ালের ছোট্ট ‘ভিনি’ ভিনিসিয়ুস হয়ে উঠেছিলেন কার্লো আনচেলত্তির অধীনে। ইতালিয়ান কোচের অধীনে ব্রাজিলিয়ানদের ফর্মে ফেরার গল্প বহু পুরোনো। ভিনিসিয়ুসকে ধার দিয়ে নিজের প্রধান অস্ত্রে পরিণত করলেন আনচেলত্তি। আর তাঁকে ধরে রাখার দায়িত্বটা পড়ল বেনজেমার কাঁধে। মুহূর্তেই বেনজেমা-ভিনিসিয়ুস জুটি হয়ে উঠল বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ানক ডুয়ো। ইউরোপের হেভিওয়েট দলগুলোকে তুলাধোনা করে ছাড়ল বেনজেমা-ভিনি জুটি। ২১-২২ মৌসুম যেন তারই প্রমাণ। পায়ের তলায় তত দিনে ভিনিসিয়ুস মাটি খুঁজে পেয়ে গেছেন, দরকার শুধু নিজেকে প্রমাণ করার মঞ্চ। সেটা এল ২৩-২৪ মৌসুমে, ১৩ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শেষে রিয়াল ছাড়লেন করিম বেনজেমা। রিয়ালের আক্রমণভাগের সব দায়িত্ব এসে পড়ল ভিনির কাঁধে। ভিনি সেটার প্রমাণ দিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ আর লা লিগা জিতে। ৭ নম্বর জার্সির কঠিন দায়িত্ব ভিনিসিয়ুস পালন করলেন যথাযথভাবে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর যেন ৭ নম্বরে ভরসা খুঁজে পেল রিয়াল। ব্যালন ডি’অরের জন্য নামডাক শুরু হলো জোরেশোরে।
কিন্তু আগুনে পোড়া লোহার গল্প স্বর্ণ দিয়ে লেখা হলো না। ভিনিসিয়ুসের স্বর্ণালি মৌসুম থেমে গেল কোনো ব্যক্তিগত অর্জন ছাড়াই। ভিনির গল্পে পূর্ণতা লেখা বাকি ছিল আরও অনেকখানি। কিন্তু সেখানেই যেন ছেদ পড়ল ভিনির গল্পে। ব্যালন ডি’অরের স্বপ্নে মশগুল ভিনিসিয়ুস যতটা তৎপর ছিলেন, পরের ভিনি যেন ঠিক ততটাই মলিন। যেদিন ব্যালন ডি’অর হারালেন, সেদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা দিয়েছিলেন, ভিনি ফিরবেন ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী হয়ে। কিন্তু সেই ভিনি ১০ গুণ শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে হয়ে পড়েছেন দুর্বল। ব্যালন ডি’অরের আগের ভিনি আর পরের ভিনির মধ্যে যেন বিশাল তফাত। এই মৌসুমের ভিনিসিয়ুস যেন প্রথম মৌসুমের ভিনিসিয়ুস থেকেও বেশি অপরিপক্ব, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা এক ফুটবলার।
গত ৩৭ ম্যাচে ভিনিসিয়ুস গোল পেয়েছেন মাত্র ৮টি। মাঝখানে বেশ বড় একটা চোটে পড়েছিলেন, রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে এটাই তাঁর দ্বিতীয়বার চোটে পড়া। এরপর থেকেই ভিনিসিয়ুসকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। বড় দলগুলো তো বটেই, লা লিগার ছোট দলগুলোর বিপক্ষেও ভিনিসিয়ুস নিষ্প্রভ। শুধু গোলের কথা হচ্ছে না এখানে। ভিনির খেলার ধরনই বদলে গেছে এই মৌসুমে। কেউ কেউ এর দোষ চাপাচ্ছেন এমবাপ্পের ওপর। দলে একই প্রোফাইলের দুই তারকার আগমন বদলে দিতে পারে বেশ কিছু সমীকরণ। কিন্তু এমবাপ্পের আগমনে ভিনি তাঁর স্বাভাবিক খেলাটাও হারিয়ে ফেলবেন—এটা সম্ভব নয়।
গোলমুখে ভিনিসিয়ুস ভয়ংকর হয়েছেন দুই-তিন মৌসুম ধরে। এর আগেও ভিনিসিয়ুস খেলেছেন, তাঁর সিদ্ধান্তহীনতা ভুগিয়েছে দলকে। কিন্তু ভিনির মধ্যে প্রাণশক্তির কোনো অভাব ছিল না। মাঠের প্রতিটি প্রান্তে দৌড়ে খেলতেন, নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে লড়াই করতেন সাদা জার্সির হয়ে। সেই ভিনিকে এখন খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। ক্লাব বিশ্বকাপ রাতারাতি পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ শিরোপায়। সেখানে ৬ ম্যাচ খেলে ভিনির অবদান মাত্র ১ গোল আর ১ অ্যাসিস্ট। সেটাও লাইপজিগের বিপক্ষে ম্যাচ থেকে। এ তো গেল গোল-অ্যাসিস্টের হিসাব। ফুটবল খেলা গোল-অ্যাসিস্টের থেকেও অনেক বেশি কিছু। ভিনি পিছিয়ে আছেন সেখানেও।
শাবি আলানসোর নতুন রিয়াল মাদ্রিদের ট্যাকটিসের সঙ্গে এখনো মানিয়ে নিতে পারেননি ভিনি। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেখানে তাঁর প্রেসিং করে যাওয়ার কথা, সেখানে ভিনি যেন দিশাহীন হয়ে হেঁটে বেড়ান। প্রেস যে একেবারেই করেন না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু প্রেসিং থেকেও তাঁর পাসিং, ড্রিবলিং এমনকি বল কাটিয়ে ভেতরে ঢোকা—সবকিছুতেই মনোযোগের স্পষ্ট অভাব। সব মনোযোগ অন্য কোথাও, মাঠে নয়। বাঁ পাশ থেকে কাট করে ভেতরে প্রবেশ করা কিংবা বুদ্ধিদীপ্ত একটি পাসে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করা—কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না ভিনিসিয়ুসের কাছ থেকে।
২৮ অক্টোবর, ২০২৪। রদ্রির হাতে সেদিন শোভা পেয়েছিল ব্যালন ডি’অরের ট্রফি। ভিনিসিয়ুসের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল সেটি। সেদিন তাঁর জন্য প্যারিস বয়কট করেছিল পুরো রিয়াল মাদ্রিদ। পুরো দল পাশে দাঁড়িয়েছিল ভিনিসিয়ুসের। এরপর থেকেই ভিনি যেন হারিয়ে গেছেন অন্য এক জগতে। তাঁর খেলায় প্রভাব পড়েছে, মাঠের সেই আনন্দ, উদ্যাপন সব যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এরপর থেকে ৪৩ ম্যাচে নামের পাশে মাত্র ১৪ গোল আর ১১ অ্যাসিস্ট। যে খেলোয়াড় বিশ্বসেরা হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছেন, তাঁর কাছ থেকে এমন মলিন পারফরম্যান্স মানায় না।
তবু সব আশা এখনই হারিয়ে ফেললে ভুল হবে। গত মৌসুমে চোটে পড়ার আগে ভিনি ছিলেন সপ্রভ। চোটের পর এমবাপ্পের সঙ্গে ঠিক মানিয়ে উঠতে পারেননি, তাই বলে যে মানিয়ে উঠতে পারবেন না, তা নয়। নতুন কোচ এসেছেন, নতুন ট্যাকটিসের সঙ্গে পরিচিত হবেন। পুরোনো মৌসুম শেষ হলো মাত্র, নতুন মৌসুম শুরু হতে এখনো এক মাসের বেশি সময় বাকি। বিশ্রাম নেবেন, আনন্দ করবেন—এরপর আবার ফিরে আসবেন সাদা জার্সিতে। যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দর্শকদের কাছে, সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে হলে ভিনিসিয়ুসকে ফিরে আসতে হবে নতুন রূপে। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে পুরো বিশ্বের কাছে। কাজটা করতে পারলেই ভিনি ফিরে আসবেন স্বমহিমায়। রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকেরা তাঁর অপেক্ষাতেই আছেন।