এমবাপ্পেই কি তবে রিয়ালের সমস্যা?
ক্লাব বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পিএসজির কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। ৪-০ গোলের হার শুধু টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে দেয়নি, লজ্জায় ফেলেছে রিয়াল মাদ্রিদকে। নতুন কোচের অধীনে আশা ছিল দুর্দান্ত শুরুর। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের এমন হার সবার মনে প্রশ্ন তুলেছে, রিয়ালের সমস্যাটা আসলে কোথায়? ঘুরেফিরে আঙুল যাচ্ছে তাদের সবচেয়ে হেভিওয়েট তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পের দিকেই।
কিলিয়ান এমবাপ্পে রিয়াল মাদ্রিদে এসেছিলেন বহু কাঠখড় পুড়িয়ে। বছরের পর বছর ধরে পিএসজির সঙ্গে যুদ্ধ চলেছে কিলিয়ান এমবাপ্পেকে নিয়ে। পিএসজিও মাথা নত করেনি, হাল ছাড়েনি রিয়াল মাদ্রিদও। অবশেষে চুক্তির সম্পূর্ণটা শেষ করেই এমবাপ্পে ভিড়েছেন রিয়াল মাদ্রিদে। এসেই দলে সেট হয়ে গেছেন, বেনজেমার রেখে যাওয়া ৯ নম্বর জার্সি, কার্লো আনচেলত্তির অধীনে রিয়াল মাদ্রিদের মেইন ম্যান হওয়া। সবটাই তৈরি ছিল এমবাপ্পের জন্য। কিন্তু এমবাপ্পের আগমন ঠিক যতটা জাঁকজমকপূর্ণ হবে, ততটা যেন হলো না। কারণ, মৌসুম পেরিয়ে গেলেও রিয়াল মাদ্রিদের ট্রফি ক্যাবিনেট এই মৌসুমের জন্য শূন্য। আর ঘুরেফিরে আঙুল যাচ্ছে তাঁর দিকেই।
চোখের সামনে থাকা দুই আর দুই চার না মিলিয়ে তো থাকা যায় না। এমবাপ্পের বিদায়ের পর দল হিসেবে নিজেদের বেশ ভালোভাবে গুছিয়ে নিয়েছে পিএসজি। এমবাপ্পের শূন্যস্থান কোনো বড় খেলোয়াড় দিয়ে পূরণ করেননি এনরিকে।
কারণটা আছে চোখের ঠিক সামনেই। কিলিয়ান এমবাপ্পে ছেড়ে আসার পর পিএসজি বদলে গেছে পুরোপুরি। দুই বছর ধরে লুইস এনরিকের সাজানো দল যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে এমবাপ্পে চলে যাওয়ায়। পিএসজি এখন আক্রমণভাগে যেমন শাণিত, তেমনই মাঝমাঠেও রয়েছে চালিকা শক্তি। কোচ লুইস এনরিকে তো সরাসরি বলেই দিয়েছেন, ‘আমার মৌসুমে ৪০ গোল করা খেলোয়াড় লাগবে না। আমার ১৫ গোল করা ৩ জন হলেই হলো। তাঁর স্ট্রাইকাররা ঠিক সেটাই উপহার দিচ্ছেন তাঁকে। কিলিয়ান এমবাপ্পে ছেড়ে আসার পর ট্রেবল জিতেছে পিএসজি। যে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছে পিএসজি, পানির মতো টাকা ঢেলেছে, তাবৎ দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড়-কোচদের আঁতুড়ঘর বানিয়েছে পিএসজিকে। সেই পিএসজি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে এমবাপ্পের বিদায়ের পরই। কাকতালীয়? তা তো অবশ্যই।
কিন্তু চোখের সামনে থাকা দুই আর দুই চার না মিলিয়ে তো থাকা যায় না। এমবাপ্পের বিদায়ের পর দল হিসেবে নিজেদের বেশ ভালোভাবে গুছিয়ে নিয়েছে পিএসজি। এমবাপ্পের শূন্যস্থান কোনো বড় খেলোয়াড় দিয়ে পূরণ করেননি এনরিকে। বরং সবাই মিলে এমনভাবে দলকে সাজিয়েছেন, যাতে এমবাপ্পের জায়গাটা পূরণ করতে পারেন সবাই মিলে। যার ফলাফল চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা। আর এমবাপ্পেকে সাক্ষী করে রিয়াল মাদ্রিদকে ৪-০ গোলে ধরাশায়ী করা। পিএসজির জন্য এর চেয়ে মধুর প্রতিশোধ বোধ হয় কিছুই হতে পারত না।
রিয়াল মাদ্রিদ যেন আছে ঠিক মুদ্রার উল্টো পিঠে। এমবাপ্পে আসার পর রিয়াল মাদ্রিদের গ্রাফ শুধু নিচের দিকেই নেমেছে। সেটা ট্রফি হোক আর খেলার ধরনই হোক। গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ আর লা লিগা, দুটি শিরোপা ছিল রিয়ালের ক্যাবিনেটে। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে রিয়ালকে এনে দিয়েছিলেন দুটি শিরোপা। কিন্তু এই মৌসুমে ভিনিকে তেমন ফর্মে পাওয়া যায়নি। তার জায়গাটা পূরণ করার দায়িত্ব ছিল এমবাপ্পের। কাগজে–কলমে সেটা পালনও করেছেন। গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, রিয়াল ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা প্রথম মৌসুম এখন তাঁর। তবু রিয়ালের ক্যাবিনেটে নেই কোনো শিরোপা। বড় ম্যাচগুলোয় রীতিমতো পর্যুদস্ত হতে হয়েছে প্রতিপক্ষের কাছে। সেটা এমবাপ্পে মাঠে থাকার পরও। আর পিএসজির বিপক্ষে ম্যাচ যেন চোখ খুলে গেছে সবার। ৪-০ গোলে হারের ম্যাচে মাঠে হেঁটে বেড়িয়েছেন এমবাপ্পে। দলের প্রয়োজনে নিচে নামতে তো দেখাই যায়নি, বরং আক্রমণেও ছিলেন নিষ্প্রভ। এর থেকে বড় প্রমাণ ছিল ক্লাব বিশ্বকাপের আগের ম্যাচগুলো।
সেমিফাইনালের মতো হেভিওয়েট ম্যাচে যখন এমবাপ্পে ফুল ফিট, তখন তাঁকে জায়গা দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না কোচ শাবি আলানসোর। ফলে গঞ্জালো গার্সিয়া ডি-বক্স থেকে সরে গেলেন ডান পাশে।
রিয়াল মাদ্রিদ যুক্তরাষ্ট্রে পা দিয়েই মুখোমুখি হয় দুঃসংবাদের। পেটের পীড়ায় হাসপাতালে ভর্তি হন এমবাপ্পে। অগত্যা তাঁর জায়গা পূরণ করেছেন রিয়াল একাডেমির ২১ বছর বয়সী স্ট্রাইকার গঞ্জালো গার্সিয়া। শাবি আলানসো যে ভরসা রেখেছিলেন, তাঁর প্রমাণ প্রতিটি ম্যাচে দিয়েছেন গার্সিয়া। প্রথম ৫ ম্যাচে তাঁর গোল ছিল ৪টি, আরেকটি অ্যাসিস্ট। প্রতি ম্যাচেই গোলে সরাসরি অবদান ছিল তাঁর। ‘ফক্স ইন দ্য বক্স’ বলতে যা বোঝায়, গঞ্জালো গার্সিয়া ছিলেন সেটাই। ডি-বক্সের ভেতর খুবই সামান্য স্পেস কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা জানা ছিল তাঁর। বলা বাহুল্য, প্রথম ৪ ম্যাচে ছিলেন না এমবাপ্পে। কোয়ার্টার ফাইনালে ফিরলেও নেমেছেন দ্বিতীয়ার্ধে। ততক্ষণে ম্যাচ জিতে নিয়েছে রিয়াল, এমবাপ্পে শুধু ব্যবধান বাড়িয়েছেন।
সেমিফাইনালের মতো হেভিওয়েট ম্যাচে যখন এমবাপ্পে ফুল ফিট, তখন তাঁকে জায়গা দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না কোচ শাবি আলানসোর। ফলে গঞ্জালো গার্সিয়া ডি-বক্স থেকে সরে গেলেন ডান পাশে। গোলমুখে সেই ‘ফক্স ইন দ্য বক্স’কে মিস করতে শুরু করল রিয়াল। আর্দা গুলার, ভিনিসিয়ুস, বেলিংহামরা বল বানিয়ে দিলেও তা ডি-বক্সের ভেতরে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল পিএসজি ডিফেন্সের কাছে। গার্সিয়ার অনুপস্থিতি রিয়ালের আক্রমণভাগ একেবারে শূন্য করে দিয়েছিল। এমবাপ্পেও সেই ধাক্কা সামাল দিতে পারেননি।
এমবাপ্পের মূল সমস্যা গোল করা বা করানোতে নয়। এমবাপ্পের মূল সমস্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন লুইস এনরিকে। এই মৌসুমের শুরুতে এক সাক্ষাৎকারে এনরিকে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, এই মৌসুমে তিনি আরও ভালো দল পাবেন। কারণ, তার দলের ১১ জন খেলোয়াড়ই তাঁর কথা শুনবে, যেভাবে খেলতে বলবেন, খেলবে। দলের প্রয়োজন থেকে যখন একজন খেলোয়াড় বড় হয়ে ওঠেন, তখন সেই খেলোয়াড়ের জন্য ক্ষতি হয় দলের। তবে এটাও সত্য, কোচরা একজন খেলোয়াড়ের জন্য দলের কৌশল বদলে দিতে পারেন। রিয়াল মাদ্রিদে থাকাকালীন রোনালদোর কাছেও ছিল ‘ফ্রি কার্ড’। নিজের ইচ্ছেমতো মুভ করতে পারতেন, দলের খুব বেশি প্রয়োজন না হলে নেমে আসতে হতো না। বাকি ১০ জন মিলে সেই অভাবটা পূরণ করে দিতেন। তাই বলে রোনালদোও যে একেবারে নামতেন না, তা নয়। বড় ম্যাচে তাঁকে দেখা গেছে নিজ ডিফেন্সে ডিফেন্ড করতে। দলের প্রয়োজনের চেয়ে নিজের প্রয়োজন কখনো বড় হয়ে যায় না। যায় না বলেই খেলাটা ফুটবল, খেলাটা দলগত। এমবাপ্পে যেন দিন দিন সেই দলগত খেলা থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছেন। পিএসজির বিপক্ষে খেলা থেকে সেটা যেন আরও বেশি স্পষ্ট।
ব্যালন ডি’অর ইভেন্টে ভিনির দ্বিতীয় হওয়া যেমন তাঁকে ভেঙে দিয়েছে মানসিকভাবে, তেমনই এমবাপ্পে আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছেন নিজেকে প্রমাণের জন্য।
এর সঙ্গে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে ভিনি-এমবাপ্পে দ্বন্দ্ব। কথায় আছে যা রটে, তার কিছু হলেও তো ঘটে। ড্রেসিংরুম থেকে শুরু করে মাঠ—সব জায়গায় আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাঁদের দূরত্ব। এক মৌসুম হয়ে গেলেও ঠিক একসঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি দুজনে। ব্যালন ডি’অর ইভেন্টে ভিনির দ্বিতীয় হওয়া যেমন তাঁকে ভেঙে দিয়েছে মানসিকভাবে, তেমনই এমবাপ্পে আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছেন নিজেকে প্রমাণের জন্য। ফলে বল পায়ে গোলমুখে দুজনই মুখিয়ে থাকেন নিজেকে প্রমাণ করার জন্য। আর তার বাজে প্রভাব পড়ছে রিয়াল মাদ্রিদের ওপর। দলগত খেলা নষ্ট হয়ে যেতে পারে দুজনের জন্যই।
নতুন মৌসুম শুরু হতে এখনো আরও এক মাসের বেশি সময় বাকি। এমবাপ্পে, ভিনিসিয়ুস আর শাবি আলানসো—সবার হাতেই সময় আছে নিজেদের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি অবসান করার। দলের জন্য এক হয়ে খেলার। নইলে ছোটবেলা থেকে যে আশা নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদে খেলে জেতার স্বপ্ন দেখেছেন এমবাপ্পে, সেটা স্বপ্ন হয়েই থাকবে।