জাবি আলোনসো কি রিয়াল মাদ্রিদের ড্রেসিংরুম হারাচ্ছেন?
রিয়াল মাদ্রিদের কোচিং সিটকে ধরা হয় ফুটবল–দুনিয়ার সবচেয়ে উত্তপ্ত সিট হিসেবে। এখানে টিকে থাকার মন্ত্রণা একটাই—জিততে হবে। একটি ম্যাচ হারলেই শুরু হয় মাদ্রিদভিত্তিক পত্রিকাগুলোর আক্রমণ। যে আক্রমণের জোরে না চাইতেও গরম হয়ে ওঠে মাদ্রিদের ড্রেসিংরুম। আর উত্তাপ ছড়ানোর গুরুদায়িত্ব পড়ে কোচের ওপর। সেই কাজে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ একটাই—পত্রপাঠ বিদায়।
জাবি আলোনসো পড়েছেন সেই দোটানায়। কার্লো আনচেলত্তির রেখে যাওয়া দলে খুব একটা কাটছাঁটের সুযোগ পাননি তিনি। বরং রিয়াল মাদ্রিদ তাঁকে দলে এনেছিল অনেক আশা করে। রিয়াল মাদ্রিদের শেষ দুই বড় কোচ, কার্লো আনচেলত্তি ও জিনেদিন জিদান। তাঁদের কৌশলের কাছে রীতিমতো নাকানিচুবানি খেয়েছে প্রতিপক্ষ। জিদান তো টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগই জিতেছেন। আনচেলত্তিও দুই মেয়াদে রিয়ালকে জিতিয়েছেন তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ। কিন্তু প্রতিপক্ষকে আটকানোর জন্য তাঁদের কোনো নির্দিষ্ট কৌশল ছিল না। বরং তাঁদের কৌশল নির্ভর করত প্রতিপক্ষের কৌশলের ওপর। অনেক সময়ই দেখা যেত প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে না পারলে তাঁরা নির্ভর করতেন ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ওপর। ফলে জিদান ও আনচেলত্তির সময়ে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স অনেক বড় হয়ে উঠেছিল অল হোয়াইটসদের জন্য। রোনালদো, বেনজেমা, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র রীতিমতো ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের অধীনে।
জাবি আলোনসো সেদিক থেকে কিছুটা আলাদা। তাঁর নির্দিষ্ট দর্শন আছে, আছে খেলার ধরন। একক তারকা হওয়ার সুযোগ খুব কম তাঁর দলে। অন্তত লেভারকুসেনে তিনি দলকে সামলে এসেছেন সেভাবেই। জাবির দলে প্রতিটি খেলোয়াড়ের নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব থাকে, সেই দায়িত্বের বাইরে তাঁকে যেতে দেওয়া হয় না। আক্রমণাত্মক ফুটবলে তাঁর মনোযোগ, কিন্তু যত বড় তারকাই হোক না কেন, তাঁদের জায়গা ছকে এঁকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। লেভারকুসেনে সেভাবেই অপরাজিত একটি দল তৈরি করেছেন তিনি। বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে জিতেছেন বুন্দেসলিগার শিরোপা। কৌশলে পরিবর্তন আনলেও সেই পরিবর্তন হতো পজিশন ধরে, খেলোয়াড় ধরে নয়।
তাঁর এই পজেশনাল ফুটবলই এসে ধরাশায়ী হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদে। কারণ, রিয়াল মাদ্রিদে শেষ কবে এমন ফুটবল খেলা হয়েছে, তা খুঁজতে পাতা ওলটাতে হবে অনেক। হুলেন লোপেতেগি, রাফা বেনিতেজ তাঁদের কৌশলের মহড়া নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বটে, কিন্তু টিকতে পারেননি ছয় মাসও। কারণ, রিয়াল মাদ্রিদ কৌশলে খেলে না, খেলে জয়ের জন্য। আর জয়ের জন্য একটা কৌশলে পড়ে থাকলে চলে না। যে কারণে জিদান-আনচেলত্তির আমলে দেখা মিলত প্রচুর ‘জোড়াতালি’ একাদশের। দলের প্রয়োজনে টনি ক্রুস যেমন সেন্টার ব্যাক হিসেবে খেলেছেন, তেমনই ভিনিসিয়ুস জুনিয়র নেমে এসেছিলেন রাইট ব্যাকে। দলের প্রয়োজন সেখানে ট্যাকটিকসের থেকে বড় হয়ে ওঠে। নিজের কৌশলে বুঁদ হয়ে আছেন বলেই কি এখনো নিজেকে ঠিক রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হিসেবে মানিয়ে নিতে পারেননি জাবি আলোনসো?
এ তো গেল ট্যাকটিকসের কথা। কিন্তু ট্যাকটিকসের থেকে বড় হয়ে উঠেছে দলের ইগো। রিয়াল মাদ্রিদে দল সামলানোর থেকে খেলোয়াড়দের সামলানো বড়। খেলোয়াড়দের সামলাতে পারলেই দল চলবে। খেলোয়াড়দের সামলাতে না পেরে বড় বড় কোচরা ব্যর্থ হয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদে। জাবি আলোনসোও সেই ফাঁদেই পড়েছেন। রিয়াল মাদ্রিদে এখন চলছে দুই তারকার লড়াই। কিলিয়ান এমবাপ্পে আর ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। দলের সবচেয়ে সিনিয়র ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তারকাও তাঁরা। সেই তারকাদের মধ্যে ‘মেইন ম্যান’ হওয়ার বাসনা থাকাটাও স্বাভাবিক। এই জায়গায় আনচেলত্তি এক মৌসুমে বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিলেন। কিন্তু জাবি আসতেই যেন সবটা ওলট–পালট হয়ে গেল।
এমবাপ্পেকে দলের মূল তারকা হিসেবে সেট করেছেন জাবি। বিশ্বকাপজয়ী তারকাকে দলের মূল তারকা করা নিয়ে আপত্তি থাকার কথা না কারও। কিন্তু ভিনিসিয়ুস জুনিয়রও ব্যালন ডি’অরের জন্য লড়াই করা তারকা। দলকে দুইবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়েছেন, ফাইনালে গোল করেছেন। সেই অনু্যায়ী ভিনিসিয়ুসকে যেভাবে খেলানো দরকার, তাঁকে যে সম্মান দেওয়া দরকার, সেটা কি পাচ্ছেন তিনি? এল ক্লাসিকোতে দল ২-১ গোলে এগিয়ে থাকার সময় ৭০ মিনিটে তাঁকে তুলে নেওয়া হয় ম্যাচ থেকে। সেদিন তাঁকে দেখা গেছে জাবির সঙ্গে রীতিমতো রাগ করে ড্রেসিংরুমে চলে যেতে। ম্যাচ শেষেও প্রতিপক্ষের প্রতি বেশ মারমুখী ছিলেন তিনি। এর পর থেকেই ভিনি-জাবি সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। দলের প্রতিটি জায়গাতে এমবাপ্পেকে মাথা করে দিয়েছেন জাবি। এতে করে ভিনি যেমন গোল করতে পারছেন না, তেমনই দলের প্রয়োজনে যেভাবে খেলতে চাচ্ছেন, সেভাবেও পারছেন না।
কারণ, ভিনির সঙ্গে দরকার এমন একজন খেলোয়াড়, যিনি ভিনিকে সাহায্য করবেন। বিশেষ করে ডি-বক্সে থাকা একজন স্ট্রাইকার। এমবাপ্পে তা নন। নিজে বল না পেলে অনেক সময় আক্রমণ করতেই ভুলে যান তিনি। ফলাফল? ভিনি সামনে গিয়ে হয়ে যান দিশাহারা, খুঁজে পান না গোলের দেখা। ১০ ম্যাচ ধরে গোলশূন্য ভিনি। একই ঘটনা ঘটেছে রদ্রিগোর সঙ্গে, মাস্তানতুনো দলে আসার পর রদ্রিগোকে পরিকল্পনা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন জাবি। তাঁর জন্য দলও খোঁজা হচ্ছিল। রিয়ালে থেকে লড়াই করতে চেয়েছিলেন রদ্রিগো। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি, কারণ শেষ ৩০ ম্যাচ ধরে গোলের দেখা পাননি তিনি।
একই ঘটনা ঘটছে ভালভার্দের বেলাতেও। বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার তিনি। তাঁর মূল কাজই দলের যেখানে প্রয়োজন সেখানে থাকা। কিন্তু জাবির ট্যাকটিকসে এমন কারও জায়গা নেই। বরং ভালভার্দের খেলার জায়গা ছেঁটে ফেলা হয়েছে অনেকটাই। ফলে যখনই ভালভার্দে নিজের মতো খেলতে যাচ্ছেন, সম্মুখীন হচ্ছেন বাধার। আর সেই বাধা উতরে পারছেন না পারফর্ম করতে।
একজন খেলোয়াড় যখন নিজের স্বাভাবিক খেলা হারিয়ে ফেলেন, দলকে সাহায্য করতে পারেন না, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়ে দলের ওপর। ঘুরেফিরে অভিযোগের আঙুল ওঠে কোচের দিকেই। কোচের দায়িত্ব দলকে ঠিক করার, নিজের খেলোয়াড়দের সামলে নিয়ে দলকে ঠিকঠাক রাখার। জাবি ব্যর্থ সেই জায়গাতেই। ভিনিসিয়ুসকে দুর্দান্ত গোলস্কোরারে পরিণত করেছিলেন আনচেলত্তি। এমনকি এমবাপ্পের সঙ্গেও তাঁর জুটি ছিল দেখার মতো। কিন্তু সেই ভিনি হারিয়ে গেছেন অনেক কিছুর মাঝে। ভালভার্দে রদ্রিগো নেই ফর্মে। একমাত্র দলকে টেনে নিচ্ছেন এমবাপ্পে আর আর্দা গুলার। কিন্তু দুজন দিয়ে তো আর দল চলে না। ফলাফল? লিভারপুলের কাছে হার, লা লিগায় ছোট দলগুলোর বিপক্ষে লড়াই করে ড্র। জাবি আলোনসোর সামনে সুযোগ খুবই কম, খুব দ্রুত নিজেকে ঠিক করে মাঠে না ফিরে এলে হয়তো বরখাস্তের খড়্গ পড়তে পারে তাঁর ওপরেই। আশার কথা একটাই, রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের পছন্দের মানুষ জাবি আলোনসো। যে কারণে সুযোগটা তিনি পাবেন নিজেকে প্রমাণ করার।