উদ্যাপন করলেই বিপদ
নির্ধারিত নব্বই মিনিটের খেলা শেষ, চলছে যোগ করা অতিরিক্ত সময়। দুই দল সমতায়। এমন সময় উইং থেকে উড়ে এল একটি বল। কোনোমতে মাথা ছুঁইয়ে বল পাঠিয়ে দিল জালে। এরপর তোমার উদ্যাপনটা ঠিক কেমন হবে? আনন্দে জার্সি খুলে পৌঁছে যাবে দর্শকদের কাছে? সমর্থকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবে আনন্দ? তোমার নাম রিচার্লিসন হলে সেটা না করাই শ্রেয়। কারণ, যতবারই তিনি এই কাজ করেছেন, ততবারই বিপদে পড়তে হয়েছে তাঁকে।
ব্রাজিলিয়ান তারকা রিচার্লিসন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলছেন এক দশকের কাছাকাছি সময় ধরে। ব্রাজিল থেকে যোগ দিয়েছিলেন ওয়াটফোর্ডে, সেখান থেকে এভারটনে। এভারটনে গিয়েই নিজেকে চেনানো শুরু করেন রিচার্লিসন, ব্রাজিলিয়ান দলে সুযোগও আসে এভারটনে খেলার সময়। ২০২২ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত এক বাইসাইকেল কিকে গোল করে আলোচনায় আসেন। এরপরই ৬০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে তাঁকে দলে ভেড়ায় টটেনহাম। টটেনহাম তাঁর কাছ থেকে যে পারফরম্যান্স চাচ্ছিল, ঠিক সেভাবে পারফর্ম করতে পারছিলেন না রিচার্লিসন। চোট, অফ–ফর্ম মিলিয়ে বাজে একটা সময় যাচ্ছিল তাঁর। যেই–না একটু ফর্মে ফিরেছেন, নিয়মিত খেলার সুযোগ পাচ্ছেন, তখনই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে তাঁর উদ্যাপন।
এই উদ্যাপনের গল্প শুরু করতে হলে ফিরতে হবে ২০২২ সালে, যে মৌসুমে টটেনহামে যোগ দিলেন রিচার্লিসন। ফুলহামের বিপক্ষে ম্যাচ, কোচ অ্যান্তোনিও কন্তে দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ দিয়েছেন প্রথম একাদশে। পুরো ম্যাচে একটি অ্যাসিস্ট পেয়েছেন, দলও এগিয়ে আছে ২-১ গোলে। এমন সময় ডি-বক্সের ভেতরে ফাঁকা জায়গায় বল পেয়ে গেলেন রিচার্লিসন। আলতো করে বল জড়িয়ে দিলেন জালে। নতুন ক্লাবে প্রথম গোল, তাঁকে আর পায় কে? আনন্দে দৌড়ে গেলেন সমর্থকদের কাছে, জার্সি খুলে সে-কী বুনো উদ্যাপন। নতুন ক্লাবে প্রথম গোলের আনন্দ বুঝি এমনই হয়!
উদ্যাপন শেষ, রেফারিও জার্সি খোলার ‘অপরাধে’ তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন হলুদ কার্ড। এরপরই রেফারির কানে বেজে উঠল ভিএআরের কণ্ঠ। রেফারি দৌড়ে গেলেন ছোট স্ক্রিনের দিকে, সেখান থেকেই জানানো হলো, রিচার্লিসন যে বুনো উদ্যাপন করেছেন, তার ষোলআনাই মিছে। কারণ, অফসাইডের কারণে সেই গোল বাতিল! নিজের প্রথম গোলটা হয়েও যেন হলো না রিচার্লিসনের। উল্টো বুনো উদ্যাপন করতে গিয়ে প্রিমিয়ার লিগ দর্শকদের কাছে পরিণত হলেন হাসির পাত্রে। যদিও সেই ম্যাচ জিতে নিয়েছিল টটেনহাম। আর গোলের জন্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে, চার দিন পর চ্যাম্পিয়নস লিগে দুই গোল করে শুরু হয়েছিল তাঁর গোলযাত্রা।
এমন ঘটনা যেন খুঁজে খুঁজে রিচার্লিসনের কাছেই ধরা দেয়। সেই মৌসুমেরই ঘটনা, এনফিল্ডে লিভারপুলের বিপক্ষে নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ। ৯২ মিনিটের খেলা চলছে, ২-৩ গোলে পিছিয়ে টটেনহাম। হিউয়েন মিন সনের ফ্রি কিক থেকে মাথা ছুঁইয়ে বল জালে জড়ান রিচার্লিসন। ৫ মিনিট হয় মাঠে নেমেছেন, আর নেমেই পয়েন্ট ছিনিয়ে আনা গোল! সেটাও আবার লিভারপুলের মাটি থেকে, প্রথম ১৫ মিনিটে ৩ গোল হজম করার পর—রিচার্লিসনকে আর পায় কে? জার্সি খুলে, মাটিতে লুটোপুটি খেয়ে আনন্দে মেতে উঠলেন। সঙ্গে যোগ দিল পুরো দল, আর বিশ্বের আনাচেকানাচে থাকা স্পার্স ভক্তরা।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ম্যাচ শুরু হলো, গোলকিপারের বাড়ানো বল নিয়ে গোল পরিশোধ করে দিলেন দিয়োগো জোতা। বিফলে গেল রিচার্লিসনের উদ্যাপন। শেষ মিনিটের গোলে ঠিকই ম্যাচটা বের করে নিল লিভারপুল। হলুদ কার্ড, উদ্যাপন আর ব্যর্থতা—সব মিলিয়ে রিচার্লিসনের দিকে যেন ভাগ্য মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
টানা দুই মৌসুমে চোট, অফ–ফর্ম মিলে যেন সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, রিচার্লিসনের আর স্পার্সের জার্সিতে ফেরা হবে না। কিন্তু এই মৌসুমে যেন রিচা ফিরে এসেছেন নিজের রূপে। সঙ্গে তাঁর ভাগ্যও।
আন্তর্জাতিক বিরতির আগে প্রিমিয়ার লিগে নিজেদের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। তাদের অবস্থাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ে খেলা শেষ, দুই দলই ১-১ গোলের সমতায়। ডি-বক্সের ভেতর থেকে মাথার আলতো ছোঁয়ায় পেলেন নিজের গোল। ৯২ মিনিট, ম্যাচ জেতানো গোল—বুনো উল্লাস থামানোর কেউ নেই। পেপে মাতার তাঁর জার্সি খোলা থামানোর চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু রিচার্লিসনের বুনো উচ্ছ্বাসের কাছে তা নগণ্য। রিচার উল্লাস দেখল পুরো বিশ্ব। ফর্মে ফেরার যে আর্তনাদ ছিল তাঁর মধ্যে, সেটা যেন ঠিকরে উঠে এল উদ্যাপনে। হলুদ কার্ড দেখে যেই–না ফিরলেন ম্যাচে, কর্নার থেকে ইউনাইটেডকে সমতায় ফেরালেন ডি লিট। ভাগ্য এবারও রিচার্লিসনকে জিততে দিল না।
রিচার্লিসনের এই বারবার দলকে ম্যাচে ফেরানো, এরপরও জয়ের হাসি হাসতে না পারা। সেটা যতটা না দুর্ভাগ্য, তার থেকে বেশি দলের ব্যর্থতা। যার প্রভাব পড়ছে রিচার্লিসনের খেলার মধ্যেও। তবে আর যাই হোক না কেন, পরবর্তী কোনো ম্যাচে রিচার্লিসন শেষ মিনিটে গোল পেলে জার্সি খুলে উদ্যাপন করার আগে দুইবার ভাববেন, সেটা ধারণা করাই যায়।