দলবদলে নাটক, বায়ার্নে পাঠানো খেলোয়াড়কে ফেরত চায় চেলসি
দলবদল সম্পন্ন, খেলোয়াড় উঠে গেছেন বিমানে। অন্য শহরে নেমে ক্লাবের ঠিক করা গাড়িতে উঠেও পড়েছেন। বাকি শুধু চুক্তি স্বাক্ষর আর জার্সি গায়ে ফটোসেশন। এমন সময় ফোন এল। সাবেক ক্লাব আর ছাড়তে রাজি নয় খেলোয়াড়কে। রেকর্ড গড়া এক দলবদল আটকে গেল এক ফোন কলেই। নিকোলাস জ্যাকসনের বায়ার্ন মিউনিখে ধারে যাওয়ার গল্পটা এমনই চমকে ঠাসা।
মূল নাটকে আসার আগে পেছনের গল্পটা বলে নেওয়া ভালো। গ্রীষ্মকালীন দলবদলের মৌসুমজুড়ে একজন স্ট্রাইকারের খোঁজ করেছে বায়ার্ন মিউনিখ। ইংলিশ অধিনায়ক হ্যারি কেইনের ব্যাকআপ দরকার তাদের। কিন্তু পছন্দমতো স্ট্রাইকার খুঁজে পাচ্ছিল না বাভারিয়ানরা। স্টুটগার্ট তো নিক ভল্টারমেডকে বায়ার্নের কাছে বিক্রি করতে রাজিই না। তিন দফা ফিরিয়ে দেওয়ার পর তাঁকে বিক্রি করেছে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের কাছে, ৮৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। চেলসি স্ট্রাইকার ক্রিস্তোফার এনকুকু ছিলেন রাডারে, তিনিও যোগ দিয়েছেন মিলানে। শেষ পর্যন্ত একজনের সঙ্গেই বুটে-বলে মিলেছে বায়ার্নের। চেলসির আরেক স্ট্রাইকার, সেনেগালের নিকোলাস জ্যাকসন। তবে পাকাপাকিভাবে নয়, এই স্ট্রাইকারকে বায়ার্ন দলে ভেড়াতে চেয়েছিল এক মৌসুমের জন্য ধারে। আর সেটা করতেই তাদের খরচ করতে হচ্ছে ২২.৫ মিলিয়ন ইউরো! ধারে আনা খেলোয়াড়দের জন্য এ এক রেকর্ড! এক মৌসুম পর আছে পাকাপাকিভাবে কেনার সুযোগও। সে ক্ষেত্রে খরচ পড়বে মোট ৮০ মিলিয়ন ইউরো।
বায়ার্নের জন্য একেবারে খাপেখাপ মিলে যাওয়া স্ট্রাইকার ছিলেন নিকোলাস জ্যাকসন। চেলসিতে ৮১ ম্যাচে ৩০ গোল, প্রিমিয়ার লিগে ২৪টি। ডিসিপ্লিনারি ইস্যু বাদ দিলে তাঁকে পাস মার্ক পাওয়া স্ট্রাইকার হিসেবে চালিয়ে দেওয়াই যায়। অফ দ্য বল চান্স তৈরি করা, মাঝমাঠ থেকে বল টেনে এনে গোল করা—সবকিছুই পারেন জ্যাকসন। হ্যারি কেইনের ব্যাকআপ হিসেবে তিনি ছিলেন যোগ্য তারকা।
চেলসিও চাচ্ছিল জ্যাকসনকে সরিয়ে জায়গা খালি করতে। হোয়াও পেদ্রো ও লিয়াম ডিলাপকে কেনার পর থেকেই দলের বাকি স্ট্রাইকারদের বিদায় করার মিশনে নেমেছিলেন ইতালিয়ান কোচ এনজো মারেসকা। হোয়াও ফেলিক্স, আরমান্দো ব্রোহা, ক্রিস্তোফার এনকুকুর পর সেই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন নিকোলাস জ্যাকসন। তবে যাওয়ার আগে যতটুকু পকেট কাটা সম্ভব, সেটা করে নিতে চেয়েছে লন্ডনের নীল দলটি। এক মৌসুমের জন্য ধারে আনতেও এক বিশাল চুক্তি ধরিয়ে দিয়েছিল বায়ার্নের কাছে। যা চোখ কপালে তুলেছিল সবার। কী আছে সেই চুক্তিতে?
নিকোলাস জ্যাকসনের সঙ্গে বায়ার্নের চুক্তি:
নিকোলাস জ্যাকসনকে এক মৌসুমের জন্য ধারে নিচ্ছে বায়ার্ন। সে জন্য চেলসিকে ১৫ মিলিয়ন ইউরো পরিশোধ করতে হবে তাদের। এক বছরের ধার শেষে চাইলে তাঁকে পাকাপাকিভাবে কিনে নিতে পারে বায়ার্ন। সে ক্ষেত্রে তাদের আরও দিতে হবে ৬৫ মিলিয়ন ইউরো। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৮০ মিলিয়ন ইউরো! বলতে পারো, না কিনতে চাইলে তো আর এত দিতে হবে না? ব্যাপারটা তেমন সোজাও নয়। বায়ার্ন যদি না কিনতে চায় তাহলে চেলসিকে খেলোয়াড় তো ফেরত দিতে হবেই, সঙ্গে ৭.৫ মিলিয়ন ইউরো জরিমানাও জিতে হবে। এমনকি কেনার পর যদি বায়ার্ন তাঁকে বিক্রি করতে চায়, তবে সেল-অন ক্লজ হিসেবে সেই অর্থের একটা অংশ দিতে হবে চেলসিকেও। এ তো গেল চেলসির সঙ্গে বায়ার্নের চুক্তির কথা। এবার আসা যাক নিকোলাস জ্যাকসনের সঙ্গে চুক্তিতে।
বায়ার্নের হয়ে স্বাক্ষর করার জন্য জ্যাকসনকে বেশ মোটা অঙ্কের সাইনিং ফি দিচ্ছে বায়ার্ন। পুরো বেতনও বহন করছে তারা। এমনকি পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে আছে বোনাসও। সবকিছু মিলিয়ে প্রথম মৌসুমেই তাঁর পেছনে বায়ার্নের খরচ যাবে প্রায় ৩৫-৪০ মিলিয়ন ইউরো। অথচ দুই বছর আগে তাঁকে মাত্র ৩১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ভিয়ারিয়াল থেকে কিনেছিল চেলসি। লাভের গুড় পুরোটাই যেন কবজা করে নিয়েছে চেলসি। ২৪ বছর বয়সী এই নিকোলাস জ্যাকসনকে কিনতে বায়ার্ন একাডেমির অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার পল ভ্যানারকে ১৫ মিলিয়ন ইউরোতে বিক্রি করেছে বায়ার্ন। শেষ মুহূর্তে এসে হাত না গুটিয়ে খরচ করেছে দেদার। কিন্তু শেষ মুহূর্তের নাটকের জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিল না কেউই।
‘হেয়ার উই গো’ লিখে নিকোলাস জ্যাকসনের দলবদল নিশ্চিত করেছিলেন সাংবাদিক ফ্যাব্রিজিও রোমানো। বায়ার্ন-চেলসির বিশ্বস্ত সূত্র থেকেও এসেছিল খবর। দলবদল নিয়ে চাপা অস্বস্তি ছিল দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যেও। নিকোলাস জ্যাকসনের দলবদল নিশ্চিত হওয়ার পর জার্মানির বিমানে ওঠে জ্যাকসন ও তাঁর দল। অন্যদিকে প্রিমিয়ার লিগে চেলসি মুখোমুখি হয়েছিল ফুলহামের। ম্যাচের প্রথমার্ধেই চোটে পড়েন লিয়াম ডিলাপ। যে–সে চোট নয়, এক চোটে কম করে হলেও প্রায় তিন মাসের জন্য মাঠের বাইরে বেরিয়ে গেছেন তিনি। যদিও তারিখ এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। যার ওপর ভরসা করে জ্যাকসনকে ছেড়ে দিচ্ছিল চেলসি, সেই তারকাই যখন মাঠের বাইরে তখন একটা উপায়ই খোলা ছিল তাদের সামনে—জ্যাকসনকে ফিরিয়ে আনা। চুক্তিতে স্বাক্ষর করার আগে চেলসি তাই তড়িঘড়ি করে যোগাযোগ করল এজেন্টের সঙ্গে।
জ্যাকসনের এজেন্ট আর জ্যাকসন অবশ্য নিশ্চিত, তাঁরা বায়ার্নেই যেতে চান। কারণ, মৌসুমের প্রথম দুই ম্যাচে ছিলেন না বেঞ্চেও, একপ্রকার জোর করেই চেলসি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। এমন সময়ে আবার চেলসিতে ফেরত যাওয়া নিজের জন্যই অপমানজনক। কিন্তু চেলসির সঙ্গে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত চুক্তি জ্যাকসনের। বায়ার্নও তাঁকে নিয়েছে ধারে। ফলে না চাইলেও বিমানে করে ফেরত যেতে হচ্ছে জ্যাকসনকে।
বায়ার্নেও কেউ তাঁকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারছেন না। ডিরেক্টর ম্যাক্স এবার্ল সাফ জানিয়ে দিয়েছেন জ্যাকসনকে, ‘আমরা চাইলেও তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না। তোমাকে লন্ডন ফেরত যেতেই হবে, কারণ তুমি ওদের চুক্তিভুক্ত খেলোয়াড়।’ যদিও জ্যাকসনের এজেন্ট ইনস্টাগ্রামের স্টোরিতে সাফ লিখে দিয়েছেন, ‘বিমান কখনো উল্টোপথে ফেরত যায় না।’ স্ন্যাপচ্যাটে নিজের রাগ ঝেড়েছেন জ্যাকসনও। স্টোরিতে লিখেছেন, ‘পুরোনো চাবিতে নতুন দরজা খোলে না।’ দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার আগপর্যন্ত জার্মানিতেই আছেন জ্যাকসন। দলবদল হবে কি না, সেটা নিশ্চিত করতে হবে আগামী ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই। নইলে নেমে যাবে দলবদলের মৌসুমের পর্দা। জ্যাকসনকে ফিরে যেতে হবে চেলসিতে। তবে ‘রেকর্ড’ গড়া দলবদল হোক কিংবা না হোক, দলবদলের মজার ঘটনায় এটি স্থান করে নিচ্ছে তা নিশ্চিত।