ইউরোপে নিষিদ্ধ উপাদান আমেরিকায় কেন খাবারে মেশায়
সকালে নাশতায় যে নরম পাউরুটি সবাই খায়, এর ভেতরের কোনো কোনো উপাদান মানুষের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। রুটির কিছু কিছু উপাদান কীটনাশক এমনকি বিস্ফোরক তৈরির কাজেও ব্যবহার করা হয়। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও আমেরিকায় এমনই ঘটে। কিছু এমন রাসায়নিক উপাদান বা অ্যাডিটিভ আছে, যা ইউরোপের দেশগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমেরিকা এখনো সেগুলো খাবারে মেশানোর অনুমতি দেয়। কেন এমন হয়? দুটো উন্নত দেশের মধ্যে খাবারের নিরাপত্তা নীতিতে এত বড় পার্থক্য কেন?
ময়দাকে সাদা করা ও রুটি ফুলিয়ে তোলার জন্য একটি শক্তিশালী রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। যার নাম পটাশিয়াম ব্রোমেট। ইঁদুরের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, এই উপাদান শরীরে কিডনি ও থাইরয়েডে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এই ঝুঁকির কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, ব্রাজিলসহ ভারতও ২০১৬ সালে এটিকে নিষিদ্ধ করে। আর যুক্তরাজ্য তো এটিকে ১৯৯০ সাল থেকেই নিষিদ্ধ করে রেখেছে।
আরেকটি রাসায়নিক হলো অ্যাজোডিকার্বোনামাইড (এসিএ), যা প্রধানত খাদ্যশিল্পে রুটি ও অন্যান্য বেকারি পণ্যের জন্য ফোমিং এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রুটির ময়দা ও খামির তৈরিতেও এটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ওভেনে বেক করার পর এটিও ল্যাব প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা করা হয়। সেখানেও দেখা যায় যে এর সঙ্গে ক্যানসারের সম্পর্ক রয়েছে। এই ঝুঁকির কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক দশকের বেশি সময় ধরে খাবারে অ্যাজোডিকার্বোনামাইডের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে রেখেছে।
ভাবো তো, যখন বিশ্বের এতগুলো দেশ সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনা করে এসব উপাদানকে নিষিদ্ধ করেছে, তখন আমেরিকা কেন এখনো সেগুলোকে প্রতিদিনের খাবারে মেশানোর অনুমতি দেয়? বহু বছর ধরে বিভিন্ন সংস্থা আবেদন জানানো সত্ত্বেও মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) এখনো এসব রাসায়নিক উপাদানকে ‘সাধারণত নিরাপদ হিসেবে স্বীকৃত’ বা জিআরএএস (Generally Recognized As Safe) বলে মনে করে। যদিও বিশেষজ্ঞরা কিন্তু এ সিদ্ধান্তে একমত নন।
এ ব্যাপারে কনজিউমার অ্যাডভোকেসি গ্রুপ সেন্টার ফর সায়েন্স ইন দ্য পাবলিক ইন্টারেস্টের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী লিসা লেফার্টস বলেন, খাবারে উপাদান যোগ করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যে ব্যবস্থা, তা ভেঙে পড়েছে। একবার কোনো ক্ষতিকারক উপাদান যদি খাদ্য সরবরাহের ভেতরে চলে আসে, তবে এফডিএ সাধারণত পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে খুব কমই আগ্রহী হয়। এমনকি যখন সেই উপাদান যে নিরাপদ নয়, তার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও। পটাশিয়াম ব্রোমেটের ক্যানসার উদ্বেগ নিয়ে সেন্টার ফর সায়েন্স ইন দ্য পাবলিক ইন্টারেস্ট (সিএসপিআই) দুই দশক আগে এফডিএর কাছে এটি নিষিদ্ধ করার জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু এফডিএর উত্তর ছিল আরও অবাক করার মতো। তারা এক চিঠিতে জানায় যে সীমিত সম্পদ ও অন্যান্য এজেন্সির অগ্রাধিকারের কারণে তারা ক্যানসারের ঝুঁকি নিয়েও বিষয়টি পরীক্ষা করতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে গ্রাহকেরা নিজেরাই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন। জনপ্রিয় ব্লগার ভানি হারির শুরু করা একটি আবেদনের চাপের মুখে ২০১৪ সালে সাবওয়ে, ওয়েন্ডিস, ম্যাকডোনাল্ডস ও হোয়াইট ক্যাসলের মতো বড় বড় ফুড চেইন তাদের পণ্য থেকে অ্যাজোডিকার্বোনামাইড (এসিএ) সরিয়ে দেয়।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি) সেই বছরই এসিএ থাকা পাঁচ শতাধিক পণ্যের একটি তালিকা প্রকাশ করে। ভোক্তাদের আন্দোলনের ফলে আজ সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০–তে। এটি প্রমাণ করে যে সরকারের পদক্ষেপ না থাকলেও জনসচেতনতা ও সম্মিলিত চাপ কিন্তু ঠিকই কাজ করে।
এফডিএ এই ক্ষতিকর উপাদানগুলো খুব কম পরিমাণে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। কারণ, তারা মনে করে যে এই পরিমাণে ঝুঁকির মাত্রা নগণ্য। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি কোনো অ্যাডিটিভ সত্যিই মানুষের ক্যানসার সৃষ্টিকারী হয়, তাহলে কোনো পরিমাণই নিরাপদ বলে বিবেচিত হবে না। এফডিএ কাজ না করার মূল কারণে রয়েছে শিল্প সংস্থাগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারে যে তাদের রাসায়নিক অ্যাডিটিভ নিরাপদ কি না। একবার কোনো উপাদান নিরাপদ হিসেবে অনুমোদিত হলে, কোম্পানিগুলোর কাছে আর অতিরিক্ত পরীক্ষার জন্য আর্থিক প্রণোদনা থাকে না। তাই তারা আর পরীক্ষা করায় না।
অ্যাজোডিকার্বোনামাইড (এসিএ) নামের রাসায়নিকটি ১৯৫৯ সালের দিকে আবিষ্কৃত হয়। মাত্র তিন বছরের মধ্যে রুটি তৈরিতে এর ব্যবহার শুরু হয়। এর মূল উদ্বেগটি আসে যখন এটিকে বেক করার সময় তাপ দেওয়া হয়। তখন এসিএ ভেঙে দুটি নতুন রাসায়নিক তৈরি করে। সেমিকার্বাজাইড ও ইউরেথেন। মার্কিন স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী, এই ইউরেথেনকে ক্যানসার সৃষ্টিকারী বলে মনে করা হয়। যদিও এসব উপাদান নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, তবু এফডিএ জানিয়েছে যে ভোক্তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। খাদ্যে যোগ করা সব উপাদানই ফেডারেল কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত হয়।
রুটি সতেজ রাখতে বিএইচএ বিএইচটি নামের দুটি প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নে এগুলো ব্যবহার সীমিত হলেও, আমেরিকায় তা বহুল ব্যবহৃত। এদের কাজ চর্বি নষ্ট হতে না দেওয়া। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা সংস্থা (আইএআরসি) সতর্ক করেছে, ল্যাবের প্রাণীদের ওপর পরীক্ষায় দেখা গেছে যে বিএইচএর মাধ্যমে টিউমারের বৃদ্ধি হতে পারে। যদিও এফডিএ বলে, খুব কম পরিমাণে ব্যবহার করায় এটি নিরাপদ।
তবে কোম্পানিগুলো যখন বিতর্কিত উপাদান সরিয়ে ফেলে, তখন যে নতুন উপাদান যোগ করে তা-ও সব সময় নিরাপদ হয় না। অনেকেই পটাশিয়াম ব্রোমেটের বদলে পটাশিয়াম আয়োডেট ব্যবহার করে। কিন্তু এটিও ভালোভাবে পরীক্ষিত নয় এবং ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) পর্যন্ত ১৯৫৫ সাল থেকে এটি ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছে। তবু আমেরিকায় এটিযুক্ত ছয় শতাধিক পণ্যের তালিকা হয়েছে। যদিও কিছু কোম্পানি ক্ষতিকর উপাদানের ব্যবহার কমিয়েছে, তবু অনেক কোম্পানি সস্তা হওয়ার কারণে ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করে। এর মূল সমস্যা হলো বিভিন্ন সংস্থার ফাঁকফোকর ও এফডিএর অপর্যাপ্ত তদারকি।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, সিবিএস নিউজ