টিনটিনের দুনিয়া : রহস্য, অ্যাডভেঞ্চার আর অজানা ঘটনা

টিনটিন আর স্নোয়ি

কখনো আফ্রিকার জঙ্গল, কখনো বরফঢাকা পাহাড়, আবার কখনো মহাকাশযান—যেখানেই রহস্য, সেখানেই টিনটিন। সঙ্গে স্নোয়ি, ক্যাপ্টেন হ্যাডক আর গোয়েন্দাগিরির ঝোঁক। হাতে নোটবুক-কলম, চোখে কৌতূহল, চুলে ছোট্ট ঝুঁটি, পাশে সাদা কুকুর স্নোয়ি নিয়ে যেকোনো বিপদে কোনো না কোনো কাণ্ড ঘটিয়েই ফেলে টিনটিন। রহস্যের গন্ধ পেলে যাকে আর থামানো যায় না—তার নাম টিনটিন।

প্রায় এক শতাব্দী ধরে কমিকস–দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিযাত্রীদের তালিকার শীর্ষে আছে টিনটিন। ১৯২৯ সালে বেলজিয়ামের কার্টুনিস্ট জর্জ রেমি যখন তাকে প্রথম তৈরি করেন, তখন হয়তো ভাবেননি—এই তরুণ সাংবাদিক একদিন হয়ে উঠবে বিশ্বজোড়া কিশোরদের প্রিয় চরিত্র। টিনটিন সেই কল্পনার বন্ধু, যে কখনো ভয় পায় না, শুধু খুঁজে ফেরে নতুন দুনিয়া আর নতুন গল্প। এবার ‘কিশোর আলো’ তুলে এনেছে টিনটিনের অজানা কিছু গল্প।

স্নোয়ি অথবা মিলু—যে গল্পের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রেম

জানো, টিনটিনের কুকুর ‘স্নোয়ি’র নাম আসলে এসেছে জর্জ রেমির প্রথম প্রেম থেকে! জর্জ রেমি পরিচিতি পেয়েছিলেন হার্জে ছদ্মনামে। আসলে জর্জ রেমির জে আর–কে উল্টো করে লিখলে উচ্চারণ যা হয় আরকি!

১৯১৮ সালের ঘটনা। হার্জের বয়স তখন মাত্র ১১। বাবা অ্যালেক্সিস রেমির সঙ্গে তাঁর বন্ধু নামকরা স্থপতি পল ফন কুটসেমের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানেই পলের মেয়ে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীর সঙ্গে হার্জের পরিচয় হয়। নাম—মারি-লুই ফন কুটসেম।

‘কী নামে ডেকে বলব তোমাকে?’—জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে সেই কিশোরী হার্জেকে জবাব দিল, ‘মিলু। সবাই আমায় মিলু নামেই ডাকে।’

ব্যস, সেই থেকে হার্জে আর মিষ্টি চেহারার ঝুঁটিবাঁধা ছোট্ট মেয়ে মিলুর বন্ধুত্ব জমে উঠল। প্রায় সময় দুজনে মিলে বিকেলে হাঁটতে যেত। মাঝেমধ্যে রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দুই পরিবারের সবাই মিলে বোয়া দ্য লা ক্যাম্ব্রের পার্কে অথবা বেলজিয়ান সমুদ্রতটে ঘুরতে যেত। হার্জেকে মিলু ডাকত জিও বলে। একবার মিলুকে হার্জে একটা কবিতার খাতা উপহার দিল। প্রথম পৃষ্ঠায় এঁকে দিল অদ্ভুত এক ছবি—লম্বা কানওয়ালা এক খরগোশ ময়ূরের ডিম ভেঙে দিয়েছে। তাই একটি ময়ূর তাকে খুব বকা দিচ্ছে। নিচে লেখা—‘প্রেমিকা মারি-লুইয়ের জন্য, জর্জ রেমি, ১৯১৮’। কবিতার খাতা আর ছবি পেয়ে দারুণ খুশি মিলু।

আরও পড়ুন

এর দুই বছর পর ১৯২০ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে আবার মিলুর কবিতার খাতায় নতুন একটি ছবি আঁকলেন হার্জে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। তাই এবার আর খরগোশ নয়, আঁকলেন একজন সৈন্যের প্রতিকৃতি। এবার অবশ্য আঁকার নিচে মিলুকে ‘প্রেমিকা’ না লিখে লিখলেন ‘প্রিয় বন্ধু’।

হার্জে ও মিলু।
ছবি: টিনটিনোম্যানিয়া

এভাবেই সময় কাটতে লাগল দুজনের। দুই পরিবার আরও ঘনিষ্ঠ হলো পরস্পরের। কিন্তু মা–বাবা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি এই বন্ধুতার আড়ালে হার্জে আর বয়সে বড় মিলুর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মিলুর কথামতো হার্জে পত্রিকায় ছবি আঁকা শুরু করেছে। ইতিউতি বেশ নামডাকও হচ্ছে তাঁর। ১৯২৪ সালে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে হার্জে চাকরি নিলেন সংবাদপত্রের অফিসে। মিলু ঠিক করল মা–বাবাকে এবার তাঁদের সম্পর্কের বিষয়ে সব জানিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে।

ঘটনা জানতেই পল আর তাঁর স্ত্রী এরমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এক চাকরিজীবীর আঁকিয়ে ছেলের সঙ্গে তাঁদের মেয়ে বিয়ে! অসম্ভব! অথচ একসময় ভালোবাসার কারণে নিজের সামাজিক মর্যাদা বিসর্জন দিয়েছিলেন এরমা। সেই তিনিই হার্জে সম্পর্কে বললেন—‘এই ছেলে টেবিল ক্লথে ছবি আঁকারও যোগ্য না। তাঁর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’

এরপর হার্জের সঙ্গে মিলুর মেলামেশা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হলো। মিলু বাধা দিলেন না, বিদ্রোহীও হলেন না। হার্জেও তাঁকে উসকে দেননি। ১৭ বছরের এক কিশোর হিসেবে তিনি শুধু ভেতরে ভেতরে লজ্জিত আর ব্যথিত হলেন এবং নিজেকে মিলুর কাছ থেকে গুটিয়ে নিলেন।

এর কয়েক মাস পর ১৯২৪ সালের শেষের দিকে জর্জ রেমি অতীত ভুলে নতুন কিছু শুরু করতে ‘হার্জে’ নাম ধারণ করেন। ১৯২৫ সালে তিনি যোগ দেন অ্যাবে ওয়ালেজের টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি পত্রিকায়। সেখানে তাঁর সচিব ছিলেন জার্মেইন কিকেন্স—যিনি ১৯৩২ সালে হার্জের প্রথম স্ত্রী হন।

অ্যাবে ওয়ালজ হার্জেকে দায়িত্ব দিলেন ওই পত্রিকার ছোটদের ক্রোড়পত্র ল্য প্যতি ভাঁতিয়েমে এক নতুন কমিকস সিরিজ শুরু করতে। হার্জে এই কমিকস সিরিজের জন্য অনেকটা নিজের আদলে এক সাংবাদিক চরিত্র বানালেন। নাম দিলেন—টিনটিন। কিন্তু টিনটিনের সঙ্গী কে হবে? তখনই মনে এল প্রেমিকা মিলুর কথা। হার্জে তো সঙ্গী হিসেবে তাঁকে ছাড়া কাউকে ভাবতেই পারেন না। কিন্তু ছোটদের পত্রিকায় তো ওসব চলবে না। তাই ভাবলেন, টিনটিনের সঙ্গী হিসেবে একটি বিড়াল দেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিমান ও সাহসী ফক্স টেরিয়ার প্রজাতির দুধসাদা আদুরে কুকুরছানা স্নোয়ি জয়ী হয়। টিনটিনের সঙ্গী হলো স্নোয়ি। ফরাসি ভাষায় যার নাম মিলু, হার্জের কিশোরবেলার প্রথম প্রেমিকার নাম।

আর দেখা না হলেও টিনটিনের প্রতিটি বই প্রকাশের পর হার্জে নিজে এক কপি মিলুকে পাঠাতেন। তত দিনে মিলুর বিয়ে হয়েছে। হার্জেও সেক্রেটারি জার্মেইনের প্রেমে জড়িয়েছেন। ১৯৩৯ সালে স্বামীর সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা পাড়ি দিলে মিলুর সঙ্গে ধীরে ধীরে তাঁর যোগাযোগ কমে যেতে থাকে।

এরপর আবার দেখা হয়—১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫২ সালে। ব্রাসেলসের পালেস দে বো-আর্টসে শিশু দিবসের অনুষ্ঠানে। হার্জে তখন সহশিল্পী উইলি ভ্যানডারস্টিন, বব দ্য মুর ও পল কুভেলিয়েরের সঙ্গে বসে তাঁর বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন। সামনে লম্বা লাইন। লাইনে হঠাৎ একটা চেনা মুখ দেখে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। চিৎকার করে বললেন—‘মিলু!’ হ্যাঁ, দীর্ঘ ২৭ বছর পর সত্যিই সেদিন মিলু এসেছে তাঁর জিওর অটোগ্রাফ নিতে। সেদিন চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাঁর কৈশোরের প্রেমকে। তবে সেদিন তাঁরা দুজনে কী কথা বলেছিলেন—তা আর জানা যায় না।

আরও পড়ুন

এরপর ১৯৭৪ সালের ৩০ এপ্রিল হার্জের বাসায় ফোন এল—মিলু আর নেই। ব্রাসেলসে না থাকায় সেই ফোন ধরতে পারেননি হার্জে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যেতে পারেননি। ফিরে এসেই যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। শোকবার্তা পাঠালেন। কিন্তু সেই সেই চিঠি দুবার ফেরত এল। মিলুর পরিবার সেই ঠিকানা ছেড়ে অন্য কোথায় চলে গেছে। কিন্তু হার্জের শৈশবের সেই প্রথম প্রেমের স্মৃতি আজও রয়ে গেছে।

এরপর টিনটিনের আর একটাই অভিযান প্রকাশ পায়। ১৯৭৬ সালে প্রকাশ হয় হার্জের শেষ পূর্ণাঙ্গ কাহিনি ‘টিনটিন অ্যান্ড দ্য পিকারোস’। ১৯৮৩ সালে মারা যাওয়ার আগে হার্জে ‘টিনটিন অ্যান্ড আলফ–আর্ট’ কমিকসটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি, তাই এটি একটি অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি হিসেবে ছিল। ১৯৮৬ সালে পাণ্ডুলিপিটি অসমাপ্ত আকারেই প্রকাশিত হয়।

টিনটিন কোথা থেকে এল?

১৯৪১ সালে এভাবেই পত্রিকার পাতায় ছাপা হতো টিনটিন।
ছবি: টিনটিন ডটকম

১৯২৮ সালের শুরুর দিকে জুল ভার্নের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ডেনিশ সংবাদপত্র পলিটিকেন একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। প্রতিযোগিতার বিজয়ীকে জুল ভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ৮০ ডেজ–এর নায়ক ফিলিয়াস ফগের মতো পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে হবে। তবে এই প্রতিযোগিতায় শুধু কিশোরেরাই অংশ নিতে পারবে। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার শর্ত হলো—একাই পৃথিবী ভ্রমণ করতে হবে, যা শেষ করতে হবে ৪৬ দিনের মধ্যে। আর কোনো অবস্থাতেই উড়োজাহাজে ওঠা যাবে না।

এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ছোট নাক আর উজ্জ্বল লাল চুলের ১৫ বছর বয়সী কিশোর পল হুল্ড। বয়েজ স্কাউট করা হুল্ড একটি গাড়ির শোরুমের কর্মী ছিল। ওই বছরের ১ মার্চ কোপেনহেগেন থেকে যাত্রা শুরু করে সে। ট্রেন আর যাত্রীবাহী জাহাজে চড়ে পৃথিবী ঘুরে ৪৪ দিন পর হুল্ড ফিরে আসে।

এই পল হুল্ড নাকি হার্জেকে টিনটিন চরিত্র তৈরি করতে উৎসাহ দিয়েছিল। কারণ, এর পরের বছরই ব্রাসেলসের টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি পত্রিকার ছোটদের ক্রোড়পত্র ‘ল্য প্যতি ভাঁতিয়েমে’ আত্মপ্রকাশ করে এক সাহসী, বিশ্বভ্রমণকারী কিশোর সাংবাদিক—ছোট নাক, উজ্জ্বল লাল চুলের টিনটিন।

তবে এই তথ্য নিয়ে বিতর্ক আছে। এই বিতর্কের সমাধান আর কখনোই হবে না। কারণ, ১৯৮৩ সালে হার্জের মৃত্যু হয়েছে। আর তিনি নিজেই সব সময় দাবি করেছেন—‘টিনটিন! সেটা আমি নিজেই।’

আরও পড়ুন

প্রথম ছাপা হলো কমিউনিস্ট পত্রিকায়

টিনটিন প্রথম প্রকাশিত হয় ব্রাসেলসের কমিউনিস্ট টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি পত্রিকার ছোটদের ক্রোড়পত্র ল্য প্যতি ভাঁতিয়েমে। টিনটিনের প্রথম কাহিনি ছিল ‘টিনটিন ইন দ্য ল্যান্ড অব সোভিয়েতস’। এটি ছিল রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক রচনা। আঁকায় তখনো এতটা পরিপাটি না হলেও সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল টিনটিনের বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তার যাত্রা।

বাস্তব ঘটনার পূর্বাভাস দিত টিনটিনের অভিযান

টিনটিনের অনেক কাহিনি আশ্চর্যজনকভাবে বাস্তব ঘটনার পূর্বাভাস দিয়েছে। যেমন ‘দ্য শুটিং স্টার’–এ পৃথিবীর দিকে ছুটে আসা এক উল্কাপিণ্ডের কথা বলা হয়েছিল। এর কয়েক মাস পরেই ১৯৩০ সালে এমনই এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা ঘটে। আবার নাসার মহাকাশ অভিযানের বহু বছর আগে টিনটিনের ‘ডেস্টিনেশন মুন’ আর ‘এক্সপ্লোরার্স অন দ্য মুন’ অভিযানে মহাকাশযাত্রার কাহিনি উঠে এসেছে। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নীল আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদের বুকে প্রথম পা ফেলারও ১৬ বছর আগে এই অভিযান তুলে ধরেছিল টিনটিন।

আরও পড়ুন
হার্জের কিশোরবেলার প্রেমিকা মারি-লুই ফন কুটসেম বা মিলু। যার নামে টিনটিনের সঙ্গী ‘স্নোয়ি’র নাম।
ছবি: টিনটিনোম্যানিয়া

হার্জে বদলে দিয়েছিলেন কমিকস–জগৎ

হার্জে শুধু টিনটিনই তৈরি করেননি, তিনি পুরো কমিকস–জগৎকে নতুন পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। টিনটিনের দুঃসাহসিক কাজগুলোকে জীবন্ত করে তোলার জন্য ১৯৫০ সালে তিনি ‘স্টুডিওস হার্জে’ প্রতিষ্ঠা করেন। স্টুডিওতে টিমওয়ার্কের মাধ্যমে নিখুঁত আঁকা ও রং করা হতো। তাঁর ‘স্পষ্ট রেখা’ আঁকার স্টাইল আজও বিখ্যাত। তাঁর এই কাজ কমিক বইগুলোকে শিল্পরূপ দিয়েছিল এবং বিশ্বব্যাপী অগণিত শিল্পীদের প্রভাবিত করেছিল।

টিনটিনের চরিত্রগুলো কল্পনা নাকি বাস্তব?

বলা হয়, টিনটিনের জনপ্রিয় অনেক চরিত্র বাস্তব ব্যক্তিদের দ্বারা অনুপ্রাণিত। যেমন ক্যাপ্টেন হ্যাডককে বলা হয় হার্জের দেখা সমুদ্র জাহাজের একজন ক্যাপ্টেনের আদলে তৈরি। আবার গোয়েন্দা থম্পসন-থমসনকে নাকি বেলজিয়ামের একজোড়া যমজ পুলিশ অফিসার থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আঁকা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল টিনটিন

টিনটিনের কাহিনি ১১০টির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী টিনটিনের ১৭ কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। শুধু কমিকস নয়, টিনটিনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে রেডিও নাটক, কার্টুন, অ্যানিমেটেড সিরিজ, এমনকি হলিউডে স্টিভেন স্পিলবার্গ দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব টিনটিন নামে একটি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। ২০১১ সালে হওয়া এই সিনেমাটি বেশ প্রশংসিত হয়েছে।

ইতিহাসের জীবন্ত দলিল

টিনটিনের প্রতিটি কাহিনি মূলত একেকটি সময়ের দলিল। টিনটিন ইন দ্য কঙ্গোতে ঔপনিবেশিক যুগের পটভূমি যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি দ্য ক্যালকুলাস অ্যাফেয়ার–এ উঠে এসেছে স্নায়ুযুদ্ধকালীন গুপ্তচরবৃত্তির রোমাঞ্চ। হার্জে তাঁর কাহিনিতে ইতিহাস, রাজনীতি আর সমাজের জটিলতা তুলে ধরলেও গল্পগুলো রয়ে গেছে আকর্ষণীয় আর চিরকালীন। তাই টিনটিন শুধু অ্যাডভেঞ্চার নয়, শেখারও দারুণ উৎস।

টিনটিন ইন দ্য কঙ্গো অভিযানের প্রচ্ছদ।
ছবি: টিনটিন ডটকম

টিনটিন যে কারণে পড়া উচিত

টিনটিন পড়া মানেই এক অদ্ভুত দুনিয়ায় ঢুকে পড়া। প্রায় এক শতাব্দী ধরে টিনটিন কিশোর–তরুণদের সবচেয়ে প্রিয় অভিযাত্রী। সারা পৃথিবীর পাঠকেরা মুগ্ধ হয়ে পড়ে আছে এই সাহসী সাংবাদিকের দুঃসাহসিক অভিযানে। তোমরাও জেনে নাও, টিনটিন পড়া এখনো কেন এতটা মজার। তাই খুলে দেখো টিনটিনের বই—আর ঝাঁপ দাও নতুন অভিযানে!

১. টিনটিনের ফ্যাশন

হোক সেটা পরিপাটি টুইড স্যুট, ট্রেঞ্চ কোট, অথবা তার ক্ল্যাসিক আকাশি-নীল সোয়েটার আর হাফপ্যান্ট—টিনটিন সব সময়ই স্মার্ট। হাফপ্যান্টে দৌড়ানো হোক বা ছদ্মবেশে গুপ্তচরবৃত্তি—যেকোনো পোশাকে মানিয়ে যায় ফ্যাশনিস্তা টিনটিন।

আরও পড়ুন

২. রহস্যের ভান্ডার

প্রায় সবার ভেতরেই একধরনের গোপন ইচ্ছা থাকে গোয়েন্দা হওয়ার। কারণ, রহস্য মানেই ভীষণ রোমাঞ্চকর আর মজার। টিনটিনের প্রায় প্রতিটি কাহিনি শুরু হয় এমন এক অদ্ভুত রহস্য দিয়ে, যা হুট করে নেমে আসে তার জীবনে। হার্জে ছিলেন অসাধারণ গল্পকার। ছবির সূত্র ব্যবহার করে তিনি রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চারের পরিধি বাড়িয়ে দিতেন—যেমন কোথাও গুপ্তধন, কোথাও মাদক চক্র, কোথাও আবার অজানা জাদু আবিষ্কার। গোয়েন্দাগিরি পছন্দ করে এমন যে কেউ টিনটিন পড়লে মুগ্ধ হবেই।

শেষ পূর্ণাঙ্গ কাহিনি টিনটিন অ্যান্ড দ্য পিকারোস–এর প্রচ্ছদ।
ছবি: টিনটিন ডটকম

৩. হাসির খোরাক

যতই সিরিয়াস ঘটনা থাকুক—যেমন মাফিয়া বা যুদ্ধ—প্রতিটি বইতেই এমন কিছু মজার দৃশ্য থাকে যে হেসে গড়িয়ে পড়তে হয়। যেমন—থমসন-থম্পসনের ভুলভাল কাণ্ড বা একজন বিমা বিক্রেতার পুরো পরিবার নিয়ে টিনটিনের বাসায় উঠে পড়া! গুরুতর অ্যাডভেঞ্চারের ভেতরেও হঠাৎ এমন মজার মুহূর্ত চলে আসে যে হেসে লুটোপুটি খেতে হয়।

৪. অদ্ভুত সঙ্গী—ক্যাপ্টেন হ্যাডক

গালি দিতে ওস্তাদ, একটু খিটখিটেও বটে—তবু টিনটিনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ক্যাপ্টেন হ্যাডক। মাঝেমধ্যে ঝামেলায় ফেলে দেয় আবার কখনো প্রাণ বাজি রেখে সঙ্গ দেয়। ক্যাপ্টেন হ্যাডকের খামখেয়ালি ও অদ্ভুত সব কাণ্ড দেখে হাসি চেপে রাখা মুশকিল। এ ছাড়া তাঁর কাছে এমন সব কথা আছে, যা শিশু–কিশোরদের অন্য কোনো গল্পে কখনো পাওয়া যাবে না।

মহাকাশযাত্রার কাহিনি নিয়ে ‘এক্সপ্লোরার্স অন দ্য মুন’ অভিযানের প্রচ্ছদ।
ছবি: টিনটিন ডটকম

৫. সেরা কুকুর-সঙ্গী

স্নোয়ি মাঝেমধ্যে বাড়াবাড়ি করে। বিড়াল তাড়া করার লোভ সামলাতে পারে না সে। কিন্তু সে একেবারে পূর্ণাঙ্গ চরিত্র—ঝামেলা, বিরক্তি, দুঃখের মতো মানবিক অনুভূতি প্রকাশ করে। কার্টুন কুকুরকে নিয়ে ‘স্পর্শকাতর’ শব্দটা ব্যবহার করা অদ্ভুত মনে হলেও স্নোয়ি সত্যিই টিনটিনকে ভালোবাসে। টিনটিনকে একাধিকবার বাঁচিয়েছে সে। আর তার কাণ্ডকারখানা গল্পে হাসির খোরাক জোগায়।

আরও পড়ুন

৬. অজানা স্থানে ভ্রমণ

কোথায় যায়নি টিনটিন! তার ভ্রমণ তালিকা বিশাল। ইংল্যান্ডের মার্লিনস্পাইক প্রাসাদ (যা আসলে ফ্রান্সের লোয়ার ভ্যালির শ্যাটো ডি শেভারনি থেকে অনুপ্রাণিত) থেকে সে চলে যায় পূর্ব ইউরোপ, কঙ্গো, সাহারা মরুভূমি, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, চীন, ভারত, তিব্বত, গ্রিনল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সমুদ্রতল, এমনকি চাঁদ পর্যন্ত। যদিও অনেক দেশ কল্পিত, তবু প্রতিটি জায়গা আর চরিত্র এত সুন্দর করে আঁকা যে পড়তে পড়তে মনে হয়, আমিও যেন বেরিয়ে পড়ি।

‘দ্য রেড সি শার্কস’ অভিযানের প্রচ্ছদ।
ছবি: টিনটিন ডটকম

৭. ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তু

টিনটিনের গল্পগুলো আশ্চর্যজনকভাবে বৈচিত্র্যময় ও জটিল। কিছু কাহিনি রাজনৈতিক, কিছু রূপকথার মতো, কিছু আবার একেবারে কমেডি। প্রথম দিকের কাহিনি টিনটিন ইন দ্য ল্যান্ড অব দ্য সোভিয়েতস আর টিনটিন ইন দ্য কঙ্গো ছিল রাজনৈতিক কাহিনি। যা শিশুদের কমিউনিজমের ভয় আর আফ্রিকায় বেলজিয়ামের অব্যাহত সাম্রাজ্যবাদী উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। দ্য ক্যাস্টফিওর এমারেল্ড অনেকটা ক্ল্যাসিক হাস্যনাটকের মতো। আর টিনটিন ইন দ্য তিব্বত–এ লেখকের নিজের মানসিক সংকটের ছাপ স্পষ্ট। ঝড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া বা হ্যাডককে ফেলে আসব কি না, তা নিয়ে টিনটিনের দোটানা মনোভাব একেবারেই হৃদয়বিদারক, যা একেবারে আবেগ ছুঁয়ে যাবে। গল্পগুলোর বুনন যেমন শক্তিশালী, তেমনি আঁকাও অসাধারণ।

টিনটিন ইন তিব্বত অভিযানের প্রচ্ছদ।
ছবি: টিনটিন ডটকম

৮. দারুণ আঁকা

টিনটিনের গল্পের আঁকার প্রসঙ্গ উঠলে এককথায় বলতে হয়—অসাধারণ। টিনটিনের আঁকায় আছে স্পষ্ট রেখা আর উজ্জ্বল রং। ছোট ছোট ছবির ভেতর দিয়ে গল্প এগোয়, আবার কখনো পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে চমৎকার দৃশ্য। আঁকাগুলো এত সুন্দর যে পড়ার মাঝেই চোখ আটকে যায়।

সূত্র: টিনটিন ডটকম, টিনটিনোম্যানিয়া, দ্য গার্ডিয়ান, টাইমসনাউ নিউজ।

আরও পড়ুন