মানুষ কেন ভাইরাল হতে চায়?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো কিছু ছড়িয়ে পড়া অর্থাৎ ভাইরাল হয়ে যাওয়াটা এখন একটা ট্রেন্ডি ব্যাপার। অনেকেই চান ভাইরাল হতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি, রিলস কিংবা অন্য কোনো কনটেন্ট শেয়ার করাই হয় বহু মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য। কনটেন্ট হয়ে উঠেছে অনেকের আয়ের উৎস। শুধু আয় করাই নয়, জনপ্রিয়তার জন্যও ভাইরাল হওয়ার মিছিলে নেমেছেন বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণির মানুষ। অথচ আগে বেশির ভাগ মানুষ নিজেদের শেয়ার করা কনটেন্ট সীমাবদ্ধ রাখতেন কেবল পরিচিত মানুষদের ভেতর। কেন ভাইরাল হওয়ার এই প্রবণতা দেখা দিয়েছে, সে প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছিলাম।
খুব সহজেই এখন ইন্টারনেটে সংযুক্ত হচ্ছেন বহু মানুষ। জীবনের বেশির ভাগটাই এখন আটকে আছে ডিজিটাল স্ক্রিনের গন্ডিতে। সে এক ভিন্ন জগৎ। এ তো শুধু বিনোদন নয়, এই জগতেই চলে জীবনের আনন্দের খোঁজ, কখনো আবার চলে ব্যবসা-বাণিজ্যও। ব্যবসার ক্ষেত্রে যত মানুষের কাছে নিজের কনটেন্ট পৌঁছে যাবে, ততই ভালো। তবে ভাইরাল হওয়ার সঙ্গে মনের আনন্দের সম্পর্কটা কী?
শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের সিনিয়র ক্লিনিক্যাল ফেলো ডা. টুম্পা ইন্দ্রাণী ঘোষ বলেন, ‘সবাই সামাজিক স্বীকৃতি চায়। কেউ কম, কেউ বেশি। জীবনের অন্যান্য চাহিদা মিটে যাওয়ার পর নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করেন মানুষ। অন্যের কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে মানুষের ভালো লাগে। ভালো লাগে প্রশংসা পেতে। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই অন্যদের সঙ্গে সহজে সংযুক্ত হওয়া সম্ভব। সবার মধ্যে বিশেষ একজন হয়ে ওঠার সুযোগটা তাই নিতে চান অনেকেই।’
এ সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক এই চিকিৎসকের কাছ থেকে।
হরমোনের খেলা
আমাদের দেহের ভেতর আমাদের অজান্তেই যে নানা রকম রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া চলে, তা নিশ্চয়ই জানা আছে তোমাদের। এমনই দুটি রাসায়নিক উপাদান হলো ডোপামিন আর সেরোটোনিন। ভালো লাগার অনুভূতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এই দুটি উপাদান। এ রকম কিছু রাসায়নিককে হ্যাপি হরমোনও বলা হয়ে থাকে। দেহে যখন এ ধরনের রাসায়নিকের নিঃসরণ বাড়ে, তখনই ভালো লাগে আমাদের। নিজের একটা কনটেন্ট যখন বহু মানুষের কাছে পৌঁছায় আর তাতে ইতিবাচক সাড়া আসে বা ইতিবাচক মন্তব্য করেন অনেকে, তখন দেহে ডোপামিন আর সেরোটোনিনের নিঃসরণ বাড়ে। তখনই সৃষ্টি হয় ভালো লাগার অনুভূতি।
মস্তিষ্কের ‘পুরস্কার’
একটা কনটেন্ট থেকে যদি নোটিফিকেশন আসতে থাকে, বারবার তা দেখার আগ্রহ জন্মে নিজের ভেতর। এখানেও আছে ডোপামিনের খেলা। পুরো ব্যাপারটা মস্তিষ্কের একটা রিওয়ার্ড সিস্টেম। সহজভাবে বলা যায়, ব্যাপারটা ঘটলে যেহেতু ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে, তাই মানুষ চায়, বারবার তা ঘটুক। বারবার নোটিফিকেশন আসুক। একই কারণে মানুষ চায়, বারবার তাঁর কনটেন্ট নিয়ে হোক আলোচনা। তাই এমন কনটেন্ট তৈরির ইচ্ছা জাগে, যা থেকে বহু নোটিফিকেশন আসতে পারে, বহু মানুষের ভেতর যেটা নিয়ে চর্চা হতে পারে বারবার, অর্থাৎ যা ভাইরাল হয়ে যেতে পারে।
সামাজিক সংযুক্তি
ইন্টারনেটের দুনিয়াতেই গড়ে উঠেছে একটা সমাজ। সেই সমাজের অংশ হয়ে উঠতেই সেখানে সক্রিয় থাকেন বহু মানুষ। যখন নিজের কনটেন্ট অনেকের কাছে পৌঁছায়, তখন নিজেকে তাঁদের সঙ্গে সংযুক্ত মনে হয়। নিজের অনুভূতি বা ভাবনাকে সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে পারার আনন্দে নিজেকে সফল ও সামাজিক মানুষ মনে হয়। হয়তো তিনি ঘরে একা, তবু তাঁর মনে হয় যে সবাই তাঁর সঙ্গেই আছেন। শিক্ষণীয় ও কল্যাণমূলক কনটেন্ট যখন অনেক মানুষের কাছে পৌঁছায়, তখন সমাজের জন্য ভালো কিছু করতে পারার আনন্দও অনুভব করেন তিনি।
আত্মমর্যাদা
নিজের কনটেন্টে সাড়া বা মন্তব্য যত বেশি আসে কিংবা তা যত বেশি শেয়ার হয়, ততই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন মানুষ। তিনি অনুভব করেন যে অন্যদের কাছে তাঁর একটা ‘দাম’ আছে। নিজের একটা সামাজিক অবস্থান সৃষ্টি হয় এভাবে। নিজেকে ‘বিশেষ কেউ’ মনে হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়াটা জনপ্রিয়তা বা সুনাম অর্জনের একটা তুলনামূলক সহজ পথ বটে।
ব্যক্তিত্বের বিশেষ ধরন
অনেক রকম ব্যক্তিত্বের মানুষই তুমি দেখবে তোমার আশপাশে। একটা বিশেষ ধরনের ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় নার্সিসেস্টিক পারসোনালিটি ট্রেইট। নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ট্রেইট থাকলে ভালো অনুভব করতে অন্যের প্রশংসার প্রয়োজন হয় তাঁর। বিষয়টিকে খারাপভাবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। এটি কোনো মানসিক সমস্যাও নয়। ব্যক্তিত্বের একটা ধরনমাত্র। এ ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলে কেউ ভাইরাল হতে চাইতেই পারেন। তবে যাঁরাই ভাইরাল হতে চান, তাঁদের প্রত্যেকেই এই ব্যক্তিত্বের অধিকারী, এমনটাও মনে করা যাবে না। আর মনে রেখো, নার্সিসিস্ট বা আত্মমগ্ন বলতে যে মানুষদের বোঝানো হয়, তাঁদের চেয়ে কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যের মানুষেরা আলাদা।