‘হ্যালো, ফুফু!’ গলা একটু কাঁপল ইভানের। ভয়ে নাকি রিকশার ঝাঁকুনিতে, ঠিক বোঝা গেল না। ওপাশ থেকে ব্যস্ত কণ্ঠে ফুফু জবাব দিলেন,
‘এই দেখো তো একটু তরকারিটা…হ্যাঁ, ইভান, বল। কোথায় তুই? কয়টা বাজে? কী করছিস এখনো বাইরে?’
‘ফুফু, নতুন স্কুলের একটা ছেলের কথা বলেছিলাম না? রাতুল?’
‘বলেছিলি বোধ হয়। কেন? কী হয়েছে?’
‘কিছু হয় নাই। ওর কালকে জন্মদিন।’
‘তো?’
‘তো সবাই ঠিক করেছে, রাতে একটা কেক নিয়ে ওর বাসায় যাবে। সারপ্রাইজ দেবে ওকে। আমাকেও যেতে বলছে। যাব?’
‘না। রাতের বেলা এসব সারপ্রাইজ-টারপ্রাইজের দরকার নাই। তোর প্রিন্টের কাজ হয়ে গেছে না? সোজা বাসায় চলে আয়।’
‘প্লিজ ফুফু, না গেলে ওরা আমাকে ভুল বুঝবে। মনে করবে, আমি ওদের বন্ধু ভাবছি না। বেশি দেরি করব না, জাস্ট কেকটা কেটেই চলে আসব।’
‘ইভান! রাতের বেলা বাইরে থাকা আমি একদম পছন্দ করি না। জানিস না এটা?’
‘জানি তো। কিন্তু আমি কি কখনো রাতে বাইরে থেকেছি?’
‘কেন শুধু শুধু টেনশনের মধ্যে ফেলিস? এমনিতেই দেশের অবস্থা ভালো না। কখন কী হয়, তার কোনো ঠিক আছে?’
‘কিচ্ছু হবে না। যাব আর আসব।’
‘আচ্ছা, ঠিক সময়ে বাসায় আসবি। এক মিনিটও যেন এদিক-ওদিক না হয়।’
‘হবে না। চলে আসব আমি। টেনশন কোরো না।’
ফোনটা রেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ইভান। সাধারণত মিথ্যা কথা বলে না ও। ফুফুকে তো নয়-ই। কিন্তু এখন এ ছাড়া আর উপায় ছিল না। কোনো যুক্তিতেই এত রাতে ওকে চিড়িয়াখানায় যেতে দিতেন না ফুফু। চিড়িয়াখানায় যাওয়ার রাস্তা বেশ কিছুটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। রিকশা ঢাল দিয়ে নামলে ভালো লাগে ইভানের। আজ একটু অস্বস্তি হলো। রাতুলরা কী ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছে, কে জানে! জিকোকে কীভাবে ধরল ওরা? ইভান ভেবেছিল জিকোর সঙ্গে আর ঝামেলায় জড়াবে না। কিন্তু বারবার এমন ঘটনা ঘটছে যে জিকোর মুখোমুখি হতে হচ্ছে ওকে।
একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে রাস্তা। কয়েকটা মোটরসাইকেল সার্ভিসিংয়ের গ্যারেজ ছাড়া বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ দোকান। সারিবদ্ধভাবে রাস্তার দুই পাশে পার্ক করে রাখা হয়েছে কিছু বাস। আজকের মতো ট্রিপ শেষ। সারা দিনের কাজ শেষে ফুটপাতে বসে চা খাচ্ছে বাসের হেলপার-ড্রাইভাররা। কেউ কেউ গোল হয়ে বসে লুডু খেলছে মোবাইলে। ইভান জানে, এখনো তাদের অনেক কাজ বাকি। বাসে তেল ভরে পরদিনের জন্য প্রস্তুত করে ঘুমাতে ঘুমাতে একটা-দুইটা বেজে যাবে। পরদিন আবার ভোরবেলা বের হবে বাস নিয়ে। কঠিন জীবন।
চিড়িয়াখানার বেশ খানিকটা আগেই রিকশা থেকে নেমে গেল ইভান। রাস্তা পার হয়ে ঢুকে পড়ল পাশের স্টাফ কোয়ার্টারের গেট দিয়ে। আগেরবার এভাবেই গিয়েছিল, মনে আছে ওর। এই কলোনির ভেতর দিয়ে একটা গেট টপকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢুকেছিল সেবার। বিকেলের আলো ছিল তখন। কিন্তু এখন জায়গাটা ভালোভাবে চিনতে পারল না ইভান। কল করে ব্যাপারটা রাতুলকে জানাল ও। ‘৫ মিনিট ওয়েট কর।’ বলল রাতুল। অস্থির হয়ে পায়চারি করতে লাগল ইভান। প্রচুর মশা এই জায়গাটায়। নড়াচড়ার মধ্যেও গায়ে বসার চেষ্টা করছে মশাগুলো।
‘ইভান!’ ডাকল কে যেন।
‘এদিক দিয়ে আয়।’ যেদিকে রাস্তা শেষ, ইট বিছানো পথ, সেদিকে পা বাড়াল ইভান। সামনে গিয়েই দেখল শিহাব দাঁড়িয়ে আছে।
‘কিরে, একবার না আসলি, তা-ও চিনতে পারছিস না?’ শিহাব বলল।
‘আরে, আলো থাকতে থাকতে এসেছিলাম। অন্ধকারে রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আচ্ছা, কী ঘটনা ডিটেইল বল তো।’
‘জিকোকে ধরে এনেছি। ওকে এখন ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে।’
‘কোত্থেকে ধরে আনলি?’
‘তুই রাতুলকে ফোন করার পর আমরা জি ব্লকে গেলাম। ওখানে আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেল আছে। কয়েকজন দেখেছে তোরা দৌড়াচ্ছিস। পেছনে পেছনে সিনেমার মতো বাইক তোদের চেজ করছে।’
‘সিনেমার মতো? জান বেরিয়ে গিয়েছিল ব্যাটা। জীবনে এত জোরে দৌড়াই নাই।’
‘আমাদের ফ্রেন্ডরা বলল ওই ছেলেগুলোকে কাউন্সিলরের সঙ্গে ঘুরতে দেখেছে মাঝেমধ্যে। তার মানে জিকোরই লোক হবে হয়তো। আমরা যখন ব্যাক করছি, তখন দেখি জিকো হেঁটে যাচ্ছে। আমরা ওকে ধরলাম। তোকে কল করলাম অনেকবার। ধরলি না। তখন দ্রুত ডিসিশন নিয়ে রাতুল ওকে এখানে ধরে নিয়ে এসেছে।’
সেই ছাউনির নিচে চলে এল ওরা। এখানেই ইভানকে র্যাগ দিয়েছিল রাতুল। ওকে যেখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, ওখানেই দাঁড় করিয়ে রেখেছে জিকোকে। জিকোকে দেখে মনে হলো না ভয় পাচ্ছে। আর্ম ক্রাচে ভর দিয়ে বেশ শান্তভাবেই দাঁড়িয়ে আছে ও।
‘কিরে ফার্মের মুরগি!’ জিকোর গলায় ব্যঙ্গের সুর।
‘শেষমেশ দেশি মুরগিদের দলে এন্ট্রি নিলি! ভালোই তো…’ কথাটা শেষ করতে দিল না রাতুল। তার আগেই চেপে ধরল জিকোর মুখ।
‘চোপ!’ ধমকে উঠল রাতুল।’ ‘তুই কেন কথা বলছিস? আজকে আমরা কথা বলব।’
একঝটকায় রাতুলের হাত থেকে মুখ সরিয়ে নিল জিকো। সশব্দে থুতু ফেলল এক পাশে। ‘আরেকটা ঠ্যাং ভেঙে ফেলব নাকি শালার? কী বলিস ইভান?’ বলল রাতুল।
‘দরকার নাই।’ জিকোর দিকে এগিয়ে বলল ইভান।
‘পরে আবার কোলে করে বাসায় দিয়ে আসতে হবে, বাচ্চাদের মতো।’ রেগে ইভানের দিকে তেড়ে আসতে চাইল জিকো। দুপাশ থেকে বাকিরা ধরে রাখায় এগোতে পারল না।
‘দেখি তো।’ ফোনটা হাতে নিয়েই চমকে উঠল ইভান। ‘সর্বনাশ! এ তো নুরুল ইসলাম আঙ্কেলের লাশের ছবি! জিকোর বাচ্চা! তুই খুন করেছিস নুরুল আঙ্কেলকে!’
‘তুই তোর ম্যাজিকটা দেখা, রাতুল।’ বলল ইভান। মুচকি হাসল রাতুল। ঘুরে গেল উল্টো দিকে। কোটর থেকে কৃত্রিম চোখটা খুলতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগল ওর। তারপর ঝট করে ঘরে জিকোর দিকে হাত বাড়িয়ে রাতুল বলল, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে একদম চোখ তুলে হাতে ধরিয়ে দেব, ঠিক এইভাবে।’ পাশ থেকে ফোনের টর্চ জ্বালল ইভান। আচমকা রাতুলের চোখহীন কোটর আর হাতে কৃত্রিম চোখ দেখে আতঙ্কে বিকট চিৎকার দিল জিকো। আপ্রাণ চেষ্টা করল ওদের কাছ থেকে ছোটার জন্য। কোনো লাভ হলো না। ওর এই অবস্থা দেখে হাসতে শুরু করল বাকিরা।
‘কিরে জিকো, তুই তো ফার্মের মুরগি না। তুই ভয় পাচ্ছিস কেন?’ হেসে বলল ইভান।
‘প্লিজ ইভান, ছাড়তে বল আমাকে!’ ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে জিকো। ‘এসব কী হচ্ছে? কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘মাস্তান পাঠিয়েছিলি কেন? আমাকে মারার জন্য, তাই তো?’
‘আমি কাউকে পাঠাই নাই।’
‘তুই আমাদের ফলো করিস নাই? তোর পোলাপান আমাদের আটকে মোবাইল নিতে চায় নাই? ফাজলামি করিস এখন?’ রাগে ফেটে পড়ল ইভান।
‘বিশ্বাস কর! আমি জাস্ট তোদের ফলো করেছি। এ ছাড়া আর কিছু জানি না।’
‘শুধু শুধু ওরা আমাদের মারতে এসেছে, তাই না? তুই ফোন দিয়ে না বললে ওরা আমাদের খুঁজে পেল কীভাবে?’
‘কারা মারতে এসেছে, আমি সিরিয়াসলি জানি না। পা ভাঙার পর আমার সঙ্গে কারও কন্ট্যাক্ট নাই।’
‘তাহলে তুই আমাদের ফলো করলি কেন?’
‘আমি ওই দিকেই ছিলাম। তোদের দেখে মনে হলো ফলো করি।’
‘কতটা লেইম কথা বলছিস, জানিস তুই?’
‘লেইমই তো বলবে।’ পাশ থেকে বলল রাতুল। চোখটা জায়গামতো সেট করে ফেলেছে ততক্ষণে। ‘ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে না?’ হাসল ওরা।
‘ওর ফোন চেক কর।’ শিহাব বলল।
‘কললিস্ট ঘাঁট। বের হয়ে যাবে ও কাকে কাকে কল করেছে।’
‘ঠিক।’ বলেই জিকোর পকেট থেকে ফোন বের করল রাতুল।
‘গ্যালারিও দেখতে হবে।’ ইভান বলল। ‘আমাদের ছবি তুলেছে কি না দেখা দরকার। শয়তানটা আমার ছবি দিয়ে মিম বানিয়ে সবাইকে পাঠিয়েছিল।’
জিকোর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে মোবাইলের লক খুলল রাতুল। পাশ থেকে তা দেখতে লাগল শিহাব।
‘কললিস্টে তো তেমন কিছু পাচ্ছি না।’ বলল রাতুল।
‘বললাম তো, আমি কাউকে কল দিই নাই। কারা তোদের অ্যাটাক করতে এসেছে, আমি জানি না। আমি হসপিটালে থাকার সময়ই ডিসিশন নিয়েছি যে ভালো হয়ে যাব।’
‘মরে গেলেও আমি এটা বিশ্বাস করব না।’ বলল ইভান।
‘আগের মতো থাকলে তোরা এতক্ষণ আমাকে আটকে রাখতে পারতি না। চিন্তা করে দেখ। পোলাপান খবর পেয়ে ঠিকই চলে আসত। আমি এখন কারও সঙ্গে চলি না।’
‘ও মাই গড! এটা কী!’ অস্ফুট স্বরে বলল শিহাব।
‘ইভান, দেখ। ভালো হওয়ার নমুনা।’ রাতুল বলল। ওদের কাছে গেল ইভান।
‘দেখি তো।’ ফোনটা হাতে নিয়েই চমকে উঠল ইভান। ‘সর্বনাশ! এ তো নুরুল ইসলাম আঙ্কেলের লাশের ছবি! জিকোর বাচ্চা! তুই খুন করেছিস নুরুল আঙ্কেলকে!’
‘ইভান, তোরা ভুল করছিস। খুন আমি করি নাই।’ হতাশ কণ্ঠে বলল জিকো। শিহাবরা শক্ত করে ধরে রেখেছে ওকে। বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে বেরিয়ে স্টাফ কোয়ার্টারের পানির ট্যাংকের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। ইভান কল করেছে ওসি মোস্তাফিজকে। ফোর্স নিয়ে কাছাকাছি চলে এসেছেন তিনি। ‘ইভান, বোঝার চেষ্টা কর। এই ছবি আর ভিডিওগুলো পাওয়ার পরই আমি নুরুল ইসলামের দোকানে গিয়েছিলাম। আমি আমার মতো করে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। তখনই তোদেরকে ওইখানে দেখি। তারপর ফলো করি। জাস্ট এটুকুই। এর বেশি কিছু না।’
‘এটা পুলিশকে বোঝাস, ওকে?’ বলল ইভান।
‘কোথাকার গোয়েন্দা তুই যে তোকে যেচে পড়ে ভিডিও পাঠাল?’
‘আমাকে পাঠায় নাই। আমি কালেক্ট করেছি।’
‘কোত্থেকে?’
‘মামার মোবাইল থেকে। যেটা তোর বাসা থেকে…’
এবারও কথাটা শেষ করতে পারল না জিকো। তার আগেই সাইরেন বাজিয়ে চলে এল পুলিশের গাড়ি।
*
নিজের চেয়ারে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন ওসি মোস্তাফিজ। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি মোটামুটি স্তব্ধ। সামনে বসা ছেলেগুলোর কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। গাড়িতে বসেই যা যা ঘটেছে তাঁকে খুলে বলেছে ইভানরা। জিকো নামের ছেলেটার ফোনে থাকা ছবি আর ভিডিওগুলো দেখেছেন তিনি। আপাতত মনে হচ্ছে, নুরুল ইসলামকে খুন করে ছবি আর ভিডিও পাঠানো হয়েছে জিকোর মামাকে। কে পাঠাল? কেন পাঠাল?—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো অজানা। দ্রুত কঠোর কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে ওসি মোস্তাফিজকে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। ওসি মোস্তাফিজ কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না এখনো।
‘ইভান’, বলে একটু থামলেন ওসি মোস্তাফিজ। তাকালেন সবার মুখের দিকে।
‘তোমরা বাসায় চলে যাও। অনেক রাত হয়েছে। জিকো, তুমি থাকো। ভয়ের কিছু নেই, তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। তোমার গার্জিয়ানদের আসতে বলেছি। ওনারা আসুক, তারপর যে-ও।’
‘আঙ্কেল…আমরা থাকি…’ ইশারায় ইভানের কথা থামিয়ে দিলেন ওসি। উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে নিয়ে এলেন ওদের। ইভানের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তোমরা যা করেছ, তার কোনো তুলনা নাই। আমাদের সন্দেহ ছিল, কিন্তু কোনো প্রমাণ পাচ্ছিলাম না। তোমরা সেটা বের করেছ। এখন মূল আসামিকে ধরতে হবে। এরা অনেক পাওয়ারফুল লোক। আমি জানি না, তাদের ধরতে পারব কি না। কিন্তু আমি চাই না, তোমরা তাদের নজরে পড়ো। বুঝতে পেরেছ?’
‘জি আঙ্কেল।’ মাথা নেড়ে বলল ইভান।
‘তোমরা যাও। সব ঠিকঠাকভাবে শেষ হোক, আমি তোমাদের নিয়ে একদিন ডিনার করব।’
‘আগে জানাবেন স্যার।’ বলল শিহাব। ‘না খেয়ে পেটে জায়গা রাখতে হবে, যেন ডিনারে ইচ্ছেমতো খেতে পারি।’ হাসল সবাই। ওসি মোস্তাফিজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরল সবাই। খাবার শেষ করেই রুশাকে কল করল ইভান। কণ্ঠ শুনেই মনে হলো, ঘুম থেকে উঠেছে রুশা। পুরো ঘটনা শুনে ‘তাই নাকি’, ‘ও আচ্ছা’, ‘তাহলে তো ভালোই’ টাইপ কথা ছাড়া তেমন কিছু বলল না ও। ইভানও দমে গেল। ‘পরে কথা হবে’ বলে রেখে দিল ফোন। মনে পড়ল রুশার অসুখের কথা। মন খারাপ হলো আবার। ক্লান্ত লাগল ওর। বালিশে মাথা রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল ইভান।
সকালে বেশ দেরিতে ঘুম ভাঙল ইভানের। শুয়ে শুয়েই ফোনটা হাতে নিল অভ্যাসমতো। ফোন দেখে ঘুম পালাল ওর। অনেকগুলো মিসড কল। সেগুলো দেখে শেষ করার আগেই আবার কল দিল রাতুল।
‘হ্যালো।’
‘ইভান, টিভি দেখ তাড়াতাড়ি। জিকোর মামা, জিকোর চাচাসহ বেশ কয়েকজনকে অ্যারেস্ট করেছে ওসি আঙ্কেল।’ ‘বলিস কী! দাঁড়া, দেখছি।’
ফোন কেটে দৌড়ে টিভিরুমে গেল ইভান। টিভি অন করেই দেখতে পেল ব্রেকিং নিউজ—‘ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে কাউন্সিলরসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার…’
‘ইয়েস!’ অস্ফুট স্বরে বলল ইভান। খবর দেখে বুঝল, দ্রুত অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। রাতেই অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জিকোর মামা, কাউন্সিলর চাচাসহ মোট পাঁচজনকে। এর মধ্য একজন সেই টাক মাথার লোকটা, যার নাম ফরিদ। দ্রুত রুশাকে কল করল ইভান। ‘কী খবর?’ রুশা বলল।
‘খবর তো তোমার কাছে। তোমার ধারণাই ঠিক। ফরিদ জড়িত।’
‘আমি জানতাম। খুনটা করেছে ফরিদ। কাউন্সিলরের শালা মানে জিকোর মামা নুরুল ইসলামের কাছ থেকে চাঁদা নিতেন।’
‘আচ্ছা। তারপর?’
‘ঢং কোরো না। বাবা তোমাকে সব বলে দিয়েছে, আমি জানি সেটা।’ হুট করে কথা হারিয়ে ফেলল ইভান। রুশা বলল, ‘শোনো, তোমার জিনিস তোমাকে ফিরিয়ে দিতে এসেছি।’
‘তো কয়েক মাস আগে উনি ওই দোকানটা ছেড়ে দিতে বললেন নুরুল আঙ্কেলকে। উনি রাজি হন নাই। কাউন্সিলরও তাঁকে হুমকি দিয়েছে কয়েকবার। লাভ হয় নাই। তখন এই ফরিদ বলেছে, তাকে ভালো শেয়ার দিলে সে নুরুল আঙ্কেলকে সরিয়ে দেবে। তারপর খুন করে সেটা ডেডবডির ছবি আর ভিডিও পাঠিয়েছে জিকোর মামাকে।’
‘কী ভয়ংকর।’
‘ওই ফোন জিকোর হাতে না পড়লে প্রমাণ করা কঠিন হতো। জিকো ভিডিওগুলো নিজের ফোনে সরিয়ে নিয়েছে, স্ক্রিনশটসহ।’
‘কোন মতলবে করেছে, এই কাজ কে জানে। ওকে আমি বিশ্বাস করি না…আচ্ছা বাদ দাও, বের হবা আজকে?’
‘না, আজকে বের হবো না। আমার গোছগাছ করা লাগবে।’
‘কেন?’
‘বলব তোমাকে পরে।’
‘তোমার কি মন খারাপ নাকি? যে রহস্য আমরা সলভ করতে চাচ্ছিলাম, সেটা সলভ হয়ে গেছে। আঙ্কলেকেও আর চাপের মধ্যে থাকতে হবে না। কিন্তু তোমাকে খুশি মনে হচ্ছে না।’
‘খুশি তো আমি। কিন্তু বাবাকে আবার বদলি করবে। আবার নতুন জায়গায় যেতে হবে।’
‘বলো কী? কখন করল?’
‘করেনি এখনো। করবে। বিড়াল তো তা-ই বলল।’ হি হি করে হেসে ফেলল রুশা। হাসল ইভানও। রুশা যে আবার একটা মিথ্যা বলেছে, বুঝে ফেলল ও। কিছু মনে করল না ইভান। জানে, এটা একটা অসুখ।
কয়েক দিন পর ওদের সবাইকে থানায় ডেকে পাঠালেন ওসি মোস্তাফিজ। থানায় মোগলাই খেতে খেতে গল্প শুনল ইভান, রাতুল, রাহাত, শিহাবসহ বাকি সবাই। জিকোকেও ডেকে পাঠিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত আসেনি ও। তাতে খুশিই হয়েছে ইভান। একফাঁকে ওসি মোস্তাফিজকে ফিসফিস করে একটা প্রশ্ন করল ইভান, ‘আঙ্কেল, আপনাকে কি অন্য কোথায় বদলি করে দেবে?’
‘আরে না। কেন?’
'না, এমনিই। রুশা মজা করছিল।’ হেসে বলল ইভান। হাসলেন ওসি মোস্তাফিজও। ওদের বিদায় দেওয়ার আগে বললেন, কয়েক দিন পরই সবাইকে নিয়ে ডিনারটা করবেন। কিন্তু এরপরই নিম্নচাপের কারণে টানা বৃষ্টি শুরু হলো। স্কুল, বাসা আর দোকান ছাড়া কোথাও যাওয়ার উপায় রইল না ইভানদের। দেখা হলো না রুশার সঙ্গেও। বৃষ্টি শেষ হওয়ার পরও সময় করে উঠতে পারল না রুশা। অনেক কাজ নাকি আছে ওর। কী এত কাজ ভেবে পেল না ইভান। প্রায় দুই সপ্তাহ পর হঠাৎ একদিন দেখা করতে বলল রুশা। এলাকার মাঠে এসে ইভান দেখল, কংক্রিটের বেঞ্চে রুশা বসে আছে। পাশে চুপচাপ বসে আছে বিড়ালটা। ইভান এসে বসল ওদের পাশে।
‘কী অবস্থা? তোমার শিডিউল পাওয়াই তো মুশকিল।’ হেসে বলল ইভান।
‘আছি ভালো।’
‘তুমি দেখা করো নাই কেন এত দিন? তোমাকে ফেসবুকেও পাই না। কোথায় ছিলা?’
‘বিজি ছিলাম একটু। আর দেখা করে কী করবা? তোমরা তো মনে করো আমি অসুস্থ।’ হাসল রুশা।
‘আরে না, ধুর। কী বলো এসব।’
‘ঢং কোরো না। বাবা তোমাকে সব বলে দিয়েছে, আমি জানি সেটা।’ হুট করে কথা হারিয়ে ফেলল ইভান। রুশা বলল, ‘শোনো, তোমার জিনিস তোমাকে ফিরিয়ে দিতে এসেছি।’
‘মানে কী?’
‘এই যে, বিড়াল।’ পাশ থেকে বিড়ালটা কোলে নিল রুশা। ‘ওকে দিতে এসেছি।’
‘কেন?’
‘ওমা, আমরা চলে যাচ্ছি তো আজ রাতে।’
‘চলে যাচ্ছ মানে? কোথায়?’
‘বান্দরবান। বাবাকে বদলি করে দিয়েছে। তোমাকে বলেছিলাম না?’
‘সিরিয়াসলি! তুমি আগে বলবা না?’
‘বললে কি তুমি বদলি ঠেকাতে পারতা?’
‘এটা কোনো কথা? আর বিড়ালটা নিয়ে যাও সঙ্গে করে। ফিরিয়ে দিচ্ছ কেন?’
‘নাহ, ওখানে কী পরিস্থিতি জানি না তো। আগে গিয়ে দেখি।’ আবারও কথা হারিয়ে ফেলল ইভান। রুশা বলল, ‘তোমরা বান্দরবান বেড়াতে এসো।’
‘তোমার স্কুল? পরীক্ষা এগুলোর কী হবে?’
‘এগুলো ম্যানেজ হয়ে যাবে। আমি অভ্যস্ত।’
‘আচ্ছা।’
‘আমি গেলাম, দেরি হয়ে যাচ্ছে। বিড়ালটার একটা সুন্দর নাম রেখো।’
কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দৌড়ে চলে রুশা। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বসে রইল ইভান। প্রচণ্ড অভিমান হলো রুশার ওপর। ওকে আগে জানালে কী হতো? নাকি কোনো গুরুত্বই নেই ওর? বিড়ালটা কোলো নিয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিল ইভান। বিড়াল দেখে আবার চিৎকার করবে ফুফা।
ফুফাই দরজা খুললেন। ইভানের কোলে বিড়াল দেখেই হায় হায় করে উঠলেন তিনি। ‘আবার বিড়াল নিয়ে ঘরে এসেছে? আমার বাসায় কোনো বিড়াল থাকতে পারবে না। যাও, যেখান থেকে নিয়ে এসেছ, সেখানে ফেলে আসো।’
‘বিড়াল এখানেই থাকবে।’ ঠান্ডা গলায় বলল ইভান।
‘এখানে থাকবে মানে? বেয়াদবি হচ্ছে?’ চিৎকার শুনে ছুটে এলেন ফুফু।
‘জি, এখানেই থাকবে। যদি বিড়াল না থাকে, তাহলে আমিও থাকব না।’ জবাব দিল ইভান।
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’ ফুফু বললেন। ‘তুই ঘরে যা। আমি দেখছি।’
কোনো কথা না বলে বিড়ালটা নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল ইভান। বিড়ালটাকে একটা বাক্সে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল ও। মনে হচ্ছিল রুশা কল করবে, করল না। কোনো মেসেজও দিল না। একবার মনে হলো, রুশা বোধহয় চাইছে না কথা বলতে। হয়তো খারাপ লাগছে ওর। আবার মনে হলো, তাই বলে জানাবে না? এটা কেমন কথা? এসব ভাবতে ভাবতে আর কোনো কাজে মন বসাতে পারল না ইভান। ১০টা বেজে গেছে। এতক্ষণে রুশার বাস ছেড়ে দেওয়ার কথা। ফোন বেজে উঠল ইভানের। অচেনা নম্বর। নিশ্চয়ই রুশা। কল ধরল ইভান।
‘হ্যালো।’
‘ইভান, আমি জিকো।’
‘জিকো, তুই?’
‘কথা ছিল তোর সঙ্গে।’
‘তোর সঙ্গে আমার কোনো কথা নাই।’ বলে কেটে দিল ইভান। রাগ লাগছে ওর।
ফোনের দিকে তাকাতেই টের পেল, এসএমএস করেছে রুশা। ‘তোমাকে বলা হয় নাই, পিঙ্ক ফ্লয়েড অমার খুব পছন্দ।’ এসএমএস দেখে মুচকি হাসল ইভান। রুশা খুবই অদ্ভুত একটা মেয়ে।
‘জিকো কিন্তু ভালো হয়ে গেছে।’ কথাটা শুনে চমকে উঠল ইভান। ঝট করে ওর চোখ পড়ল বিড়ালের বাক্সের দিকে। বাক্সে নেই বিড়ালটা। এসে বসেছে ওর ঠিক পাশে। পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে ইভানের ঘাড়ে সামনের দুই পা রেখে ভর দিয়ে দাঁড়াল বিড়ালটা। শিউরে উঠল ইভানের গা। বিড়ালটা বলল, ‘জিকোর ওপর রাগ করে লাভ নেই। ও ভালো হয়ে গেছে।’
এই বিড়াল তো সত্যি সত্যি কথা বলে। রুশা তাহলে মিথ্যা বলে নাই। সঙ্গে সঙ্গে রুশাকে কল করল ইভান। জবাব এল, ‘আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না…’
শেষ
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619