ইন্দোনেশিয়ার লোকগল্প

শতসহস্র দ্বীপ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ ইন্দোনেশিয়া। দেশটির দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে ছড়িয়ে আছে অজস্র লোকগল্প। ইন্দোনেশিয়ার ডাক বিভাগ সেই সব গল্পের মধ্য থেকে তুমুল জনপ্রিয় ৩৬টি গল্প নিয়ে প্রকাশ করেছে মোট ১৮৬টি ডাকটিকিট ও ৯টি স্যুভেনির শিট। ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ডাকটিকিটগুলো মোট ৯টি পর্বে প্রকাশিত হয়। তার মধ্য থেকে ‘সোনালি শামুক ও ডাইনি বুড়ি’ ও ‘অশুভ পাথরের মায়াবী ডাক’ গল্প দুটি ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করা হলো।

সোনালি শামুক ও ডাইনি বুড়ি

জাভা দ্বীপে এক রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের রাজপুত্র রাদেন ও রাজবধূ লিমারানের বেশ সুখে দিন কেটে যাচ্ছিল। একদিন প্রাসাদের বাগানে পায়চারি করছিল রাজবধূ লিমারান। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, ঘাসের ওপর একটা শামুক ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। শামুকটি দেখতে ভীষণ বিশ্রী! বমি চলে এল রাজবধূর। বাগানের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা নদীতে সে শামুকটিকে ছুড়ে মারল। কিন্তু সেটা শামুক ছিল না, ছিল এক ডাইনি বুড়ি। যে ডাইনি বুড়ি যখন–তখন যেকোনো রূপ ধারণ করতে পারত। রাজবাগানে আজ সে শামুকের রূপ ধরে হাঁটছিল। এর কিছুই রাজবধূ জানত না।

নদীর পানিতে শামুকরূপী ডাইনিটি টুপ করে ডুবে গেল। তার নাকে–মুখে ঢুকে পড়ল পানি। অল্প সময়ের মধ্যেই ডাইনি শামুকের রূপ ছেড়ে তার আসল মূর্তি ধারণ করল। রাজবধূর ওপর ভীষণ চটে গেল সে। রেগেমেগে চলে এল প্রাসাদের বাগানে। লিমারান তখনো সেই বাগানে পায়চারি করছিল। হঠাৎ অমন বিকট ডাইনিকে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠল সে। চিৎকার করার আগেই ডাইনি বুড়ি মন্ত্র পড়ে রাজবধূকে একটা সোনালি রঙের শামুক বানিয়ে ফেলল। রাজবধূ যেভাবে ডাইনিকে নদীতে ছুড়ে মেরেছিল, ডাইনিও তেমনি রাজবধূকে শামুক বানিয়ে নদীতে ছুড়ে ফেলল।

আরও পড়ুন

নদীতে ছিল তখন ভরা জোয়ার। স্রোতের টানে সোনালি শামুকটি অনেক দূর ভেসে গেল। রাজপ্রাসাদ থেকে বেশ কিছু দূরে সেই নদীর ধারে তখন এক বুড়ি মাছ ধরছিল। শামুকটি এসে তার জালে আটকে গেল। বাহ, কী সুন্দর একটি শামুক! বুড়ি তার জীবনে কখনো এমন সোনালি রঙের শামুক দেখেনি। সে মাছের সঙ্গে শামুকটিকেও বাড়িতে নিয়ে এল।

বুড়ি সারা দিন মাছ ধরে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন ঘুম থেকে উঠে সে দেখল, তার অগোছালো ঘর পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন আর টেবিলে সাজানো আছে বাহারি সব খাবার। এসব দেখে সে বিস্মিত হয়ে গেল; এ কাজ কে করতে পারে? সে ছাড়া তো এ ঘরে আর কেউ নেই। পরদিন সকালেও বুড়ি দেখল একই অবস্থা। তার ঘর সুন্দর করে গোছানো, পরিচ্ছন্ন আর টেবিলে খাবার রাখা। এভাবে দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিল। কে এই কাজ করে, তাকে দেখার জন্য বুড়ির কৌতূহল বেড়ে গেল! তাই একরাতে বুড়ি ঘুমের ভান করে জেগে রইল। মাঝরাতে হঠাৎ সে দেখল, সেদিন নদী থেকে যে সোনালি রঙের শামুক ধরে এনেছিল, সেটা এক সুন্দরী নারীর রূপ ধারণ করেছে। সে বুড়ির ঘর পরিষ্কার করছে, মেঝে ধুয়ে চকচকে বানাচ্ছে, রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় হাঁড়ি বসাচ্ছে। বুড়ি নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে তার পেছনে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি, সুন্দরী?’

বুড়ির কণ্ঠ শুনে লিমারান চমকে উঠল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বুড়িকে জানাল তার আসল পরিচয় যে সে এই রাজ্যের রাজবধূ। এক দুষ্ট ডাইনি কীভাবে তাকে শামুক বানিয়ে নদীতে ছুড়ে মেরেছে—সবকিছু বুড়িকে বলল। রাজবধূ বুড়িকে আরও জানাল যে সে শুধু রাতেই মানুষের রূপ ধারণ করতে পারে, আর সারা দিন তাকে শামুক হয়ে পড়ে থাকতে হয়।

আরও পড়ুন

সব কথা শুনে বুড়ি জানতে চাইল, কীভাবে রাজবধূকে আগের রূপে ফেরানো যায়। তখন রাজবধূ লিমারান বলল, একমাত্র পবিত্র মন্ত্র যদি তার কানে এসে পৌঁছায়, তাহলেই ডাইনির মন্ত্রের শক্তি কমে যাবে। তারপর সে শামুক থেকে আবার মানুষ হয়ে উঠবে।

পরদিন বুড়ি ছুটে গেল রাজপ্রাসাদে। এদিকে রাজবধূ লিমারান নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে রাজপ্রাসাদে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সবাই পাগলের মতো এদিক-সেদিক রাজবধূকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এমন সময় বুড়ি এসে রাজপুত্র রাদেনকে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর খবর দিল। রাদেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। পবিত্র মন্ত্রের জোরে লিমারানকে ফিরে পাওয়া যাবে শুনে সে দেবতার কাছে প্রার্থনা করল সেই পবিত্র মন্ত্রের জন্য। প্রার্থনা চলল বেশ কয়েক দিন ধরে। অবশেষে রাজপুত্রের প্রার্থনা সফল হলো। দেবতা তাকে বলে দিলেন সেই পবিত্র মন্ত্র। অমনি রাজপুত্র বুড়ি মহিলার বাড়িতে ছুটে গেল। সোনালি শামুকের কাছে এসে মন্ত্র উচ্চারণ করল। পবিত্র মন্ত্রের জোরে ডাইনির শয়তানি মন্ত্রের জোর কমে গেল এবং শামুকটি রাজবধূ লিমারানে রূপান্তরিত হয়ে গেল। তারপর রাজপুত্রের সঙ্গে প্রাসাদে ফিরে এল সে। কৃতজ্ঞতাবশত বুড়িকেও তারা তাদের সঙ্গে নিয়ে এল। তারপর বাকি জীবন তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকল।

আরও পড়ুন

অশুভ পাথরের মায়াবী ডাক

অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করত মাক তানজুং নামের এক বিধবা নারী। স্বামীর অকালমৃত্যুর পর বড় মেয়ে মেলুর আর ছোট ছেলে পেকানকে নিয়ে তার কাটছিল অভাবের সংসার। কখনো কাপড় বুনে আবার কখনো মাছ ধরে কোনোমতে সে সংসারের হাল ধরে রেখেছিল। তানজুং সব সময় তার স্বামীর অভাব ভীষণ অনুভব করত। অসুস্থ শরীরেও দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছিল শুধু সন্তানদের কথা ভেবে। স্বামীর মৃত্যুর পর তানজুংয়ের শখ–আহ্লাদ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। আহা, কত দিন হয়ে গেছে তেম্বাকুল মাছ খায়নি সে!

অন্য সব দিনের মতো সেদিনও তানজুং নদীতে মাছ ধরছিল। হঠাৎ পেয়ে গেল সেই তেম্বাকুল মাছ! খুশির সীমা রইল না তার। আনন্দে চিৎকার করে উঠল সে। খোদার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। তারপর বাঁশের ঝুড়িতে করে মাছটি বাড়িতে নিয়ে এল। কাটার পর দেখল যে মাছের পেটে ডিম। তেম্বাকুল মাছের ডিম তানজুংয়ের ভীষণ প্রিয়। তাই সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল।

সুগন্ধি মসলার সঙ্গে মাছের ডিমগুলো চুলার ওপর বুদ্‌বুদ করে নাচছিল আর বাতাসে ছড়াচ্ছিল সুস্বাদু ঘ্রাণ। তানজুংয়ের আর তর সইছিল না, কখন যে ছেলে–মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে এই ডিম সে খেতে বসবে। স্বামীর মৃত্যুর পর এই প্রথম তেম্বাকুল মাছের ডিম খাবে। এই ভেবে তার জিবে জল এসে গেল।

আরও পড়ুন

রান্নাবান্না শেষ করে তানজুং তার মেয়ে মেলুরকে ডেকে বলল, ‘মাছের ডিমগুলো তিন ভাগ করে রেখে গেলাম, এই দুই ভাগ তোমাদের। আর এই ভাগ আমার।’ তারপর তানজুং গোসল করতে গেল। মেলুর আর পেকান দুজনই ছিল ভীষণ ক্ষুধার্ত! মা ফিরে আসা অবধি অপেক্ষা করতে পারল না। তারা দুজন খেতে বসে গেল। ছোট্ট পেকান একটু বেশিই ক্ষুধার্ত ছিল। নিজের ভাগের তেম্বাকুল মাছের ডিম সে গোগ্রাসে খেয়ে শেষ করে ফেলল। তাতে পেট ভরেনি তার। আরও ডিম চাই। মেলুর তার প্লেট থেকে কিছু ডিম তুলে দিল ভাইয়ের থালায়। পেকান সেই ডিমও নিমেষের মধ্যেই খেয়ে ফেলল। পরে আরও চাইল সে। কিন্তু ততক্ষণে মায়ের ভাগেরটুকু ছাড়া আর কোনো ডিম অবশিষ্ট নেই। কিন্তু পেকান তা মানতেই চায় না। সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল, তারপর মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে শুরু করল। কিছুতেই শান্ত করা গেল না তাকে। মেলুর তাই বাধ্য হয়ে মায়ের ভাগের ডিমও তুলে দিল ছোট ভাইয়ের থালায়। সঙ্গে সঙ্গে সেটাও সাবাড় করে ফেলল পেকান। তারপর শান্ত হলো।

তানজুং গোসল সেরে ফিরে এল। তারপর খেতে গিয়ে দেখল, তার জন্য আর একটুও ডিম অবশিষ্ট নেই। তার ছেলে-মেয়ে সবটুকু চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে। ‘তোমরা সব ডিম খেয়ে ফেলেছ, না?’ রাগে-দুঃখে তানজুং তার ছেলে–মেয়েকে বকল। মেলুর তার মায়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করল। ডিম খাওয়ার জন্য পেকানের কান্নাকাটির কথা মাকে জানাল। পেকানকে তা ছাড়া ঠান্ডা করাই যাচ্ছিল না।

আরও পড়ুন

মাক তানজুং বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা। তবু মনে ভীষণ দুঃখ পেল সে। অনেক কষ্টে চোখের পানি ধরে রাখল। আহা, কত দিন পর তেম্বাকুল মাছের ডিম খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তার! তারপর তানজুং আর একটাও কথা বলল না। খাবার না খেয়ে ক্ষুধাপেটেই বিছানায় চলে গেল।

ওই গ্রামের পাশেই ছিল এক গভীর জঙ্গল। সেই জঙ্গলে ছিল বিশাল এক পাথর। ভারি আশ্চর্য পাথর। পাথরের ভেতরে ছিল এক গোপন গুহা। কারও মনে কোনো দুঃখ থাকলে তাকে মায়াবী সুরে ডাকত পাথরটি। সেই মায়াবী ডাকে দুঃখী মানুষটি পাথরের সামনে এসে দাঁড়ালে পাথরটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেত। তারপর সে পাথরের ভেতর ঢুকে পড়লে আর কখনোই বের হতে পারত না। চিরতরে হারিয়ে যেত।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাক তানজুং বারবার সেই তেম্বাকুল ডিমের কথাই ভাবতে থাকে। ছেলে-মেয়ের আচরণে সে খুব দুঃখ পেয়েছে। দুঃখী তানজুংকে বনের সেই অশুভ পাথর মায়াবী সুরে ডাকতে শুরু করল। কিন্তু সে নিজেকে বারবার সংযত করছিল। অবশেষে মাঝরাতে তানজুংয়ের ঘুম ভেঙে গেল। পাথরের ডাকে সাড়া দিয়ে সে জঙ্গলের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

হাঁটতে হাঁটতে তানজুং এসে থামল সেই অশুভ পাথরের কাছে। পাথরটি তানজুংকে কাছে আসার জন্য ইশারা করল। তানজুং নিশিগ্রস্তের মতো হেঁটে গেল পাথরের কাছে। যখন খুব কাছে পৌঁছাল, তখন পাথরের মুখ খুলে গেল। তানজুং সম্মোহিত হয়ে পাথরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। তার গায়ে জড়ানো চাদর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তানজুং যখন পুরোপুরি ভেতরে সেঁধিয়ে গেল, পাথরের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। তানজুং পাথরের ভেতরে চিরতরে হারিয়ে গেল। পাথরের কাছে পড়ে রইল তার পায়ের ছাপ আর গায়ের চাদর।

আরও পড়ুন

সকাল হয়ে গেল। মেলুর ঘুম থেকে উঠে দেখল, তাদের মা বিছানায় নেই। মাকে আশপাশে অনেক খুঁজল। কোথাও তার হদিস পাওয়া গেল না। দ্রুত সে ছোট ভাই পেকানকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। ‘ওঠো, জলদি ওঠো, মাকে খুঁজে পাচ্ছি না।’ পেকান অবাক হয়ে চোখ খুলে তাকাল। তারপর দুই ভাই–বোন মাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। মায়ের পায়ের ছাপ পড়ে আছে মাটিতে। সেই ছাপ ধরে একসময় জঙ্গলের কাছাকাছি চলে এল তারা। জঙ্গলের ভেতরে চলে গেছে সেই ছাপ।

পায়ের ছাপ গুনে গুনে অবশেষে সেই আশ্চর্য পাথরের কাছে এসে থামল দুই ভাই-বোন। পাথরের কাছে তাদের মায়ের গায়ের চাদরটি পড়ে ছিল। অনেকক্ষণ ধরে তারা পাথরের মুখের কাছে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু পাথরের মুখ আর খুললই না। তারা পাথরের শরীরে আছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু তাদের মা আর ফিরে এল না।

আরও পড়ুন