বাংলাদেশের ফুটবলের চিত্র কি কিছুটা হলেও বদলেছে
এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে হংকংয়ের বিপক্ষে খেলছিল বাংলাদেশ। ম্যাচের ৮৪ মিনিটে যখন হংকংয়ের মাটিতে সমতাসূচক গোল করলেন রাকিব হোসেন, বাংলাদেশের সমর্থকেরা ফেটে পড়েছিলেন উল্লাসে। হংকংয়ে থাকা বাংলাদেশি সমর্থক, খেলোয়াড়েরা তো ছিলেনই, বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরাও চিৎকার করে ওঠেন সেই গোলের পর। পুরো দল যখন উল্লাসে ব্যস্ত, হামজা চৌধুরী তখন বল নিয়ে ফিরে গেছেন মাঝমাঠে। তাগাদা দিয়েছেন সবাইকে—ম্যাচের এখনো অনেকটা সময় বাকি। জিততে হবে। হামজার চিন্তায় জয় থাকলেও বাংলাদেশ দল এখনো যেন আটকে আছে আগের জায়গাতেই।
হংকংয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটা ছিল বাঁচামরার লড়াই। টুর্নামেন্টে টিকে থাকতে হলে জয়ের কোনো বিকল্প ছিল না বাংলাদেশের সামনে। বাংলাদেশ তাই নিজেদের ‘সম্ভাব্য সেরা’ একাদশ নামিয়েছিল মাঠে। টুকটাক অদলবদল ছিল, কোচ হাভিয়ের কাবরেরার পছন্দের খেলোয়াড়কে জায়গা দিতে অনেক খেলোয়াড়ই ওলটপালটের শিকার হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে খেলা শেষ দুই ম্যাচের তুলনায় একাদশ ছিল অনেকটাই পরিণত। সেই পরিণত একাদশের ফল দেখা গেছে মাঠে। প্রথমার্ধে বাংলাদেশের রক্ষণ এতটাই শক্ত ছিল যে হংকং আক্রমণে যাওয়ার সুযোগই পাচ্ছিল না। হামজা চৌধুরী আর শমিত সোম মিলে মাঝমাঠ রেখেছিলেন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে।
কিন্তু এর মধ্যেও একটা ভুল হয়েই গেল, দেশের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার তারিক কাজীর ভুলে পেনাল্টি পেয়ে গেল হংকং। ১-০ গোলে এগিয়ে গেল তারা। পুরো ম্যাচে হংকংকে নিজেদের মতো খেলতেই দেয়নি বাংলাদেশ। বরং ম্যাচের একটা বড় অংশজুড়ে বল ছিল বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে। এর ফলাফলই দ্রুত পেয়েছে আক্রমণভাগ। আক্রমণের সুযোগ তৈরি হয়েছিল বেশ কয়েকটি। কিন্তু সেগুলো হেলায় হারিয়েছেন স্ট্রাইকাররা। বিশেষ করে ফাহমিদুল ইসলামের দৃষ্টিকটু মিস হতাশ করেছে সবাইকে। শেষ পর্যন্ত গোল এসেছে, ৮৪ মিনিটে ফাহিমের বাড়ানো ক্রস থেকে ফাহমিদুলের হেড। সেখান থেকে ডিফেন্ডারের পায়ের ফাঁক দিয়ে বল জালে জড়ান রাকিব হোসেন। টানা আক্রমণের ফলাফল হিসেবে গোল যুক্ত হয় বাংলাদেশের নামের পাশে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশা পূরণ হয়নি। ১ পয়েন্ট নিয়ে দেশে ফিরলেও জলাঞ্জলি দিয়ে আসতে হয়েছে এশিয়ান কাপের স্বপ্ন।
হংকংয়ের বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচ—একটায় শেষ মুহূর্তে গোল হজম করে হার, আরেকটায় শেষ মুহূর্তে নিজেরা গোল করে ড্র। বাংলাদেশের ফুটবলের চিত্রটা কিছুটা হলেও বদলেছে, নাকি আগের জায়গাতেই আছে? কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশ ফুটবল দলের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ম্যাচের শুরু থেকে ধরে খেলা দল খেই হারাত শেষ ৩০ মিনিটে গিয়ে। ৬০ মিনিটের পর গোল খেয়ে ম্যাচ হারার ঘটনা অহরহ। স্ট্যামিনার অভাব, সঠিক সময়ে খেলোয়াড় পরিবর্তন না করা, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস—সব মিলিয়ে একটা সময় পর বাংলাদেশ আর খেলায় থাকত না। কিন্তু সেই সমীকরণ বদলে গেছে শেষ কয়েক ম্যাচে। বিশেষ করে এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে বাংলাদেশ দল বরং উল্টোটাই করে দেখিয়েছে। চার ম্যাচের মধ্যে তিনটিতেই গোল পেয়েছে বাংলাদেশ। এবং প্রতিটি ম্যাচেই পিছিয়ে থেকে ম্যাচে ফেরার ঘটনা ঘটেছে।
সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ২ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর গোল পেয়েছিলেন রাকিব হোসেন। ৬৭ মিনিটের সেই গোল অবশ্য শুধু ব্যবধান কমিয়েছিল। তবে শেষ ৩০ মিনিটের পারফরম্যান্স বাংলাদেশকে নতুন আশার আলো দেখিয়েছিল। হংকংয়ের বিপক্ষে নিজেদের মাটিতে একসময় ৩-১ গোলে পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। সেখান থেকে মোরছালিন ব্যবধান কমান ৮৪ মিনিটে। ৯৯ মিনিটে দলকে সমতায় আনেন শমিত সোম। হংকংয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগেও একই দৃশ্য। ৮৪ মিনিটে ১ গোলে পিছিয়ে থাকা দলকে সমতায় ফেরান রাকিব হোসেন। আগে যেমন ১ গোল হজম করলেই দলের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটত, হাল ছেড়ে দিত বাংলাদেশ। সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না। বরং বাংলাদেশ শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়াই করে যাচ্ছে যে কারও বিপক্ষে।
শুধু যে ম্যাচে ফিরছে, তা–ই নয়। বাংলাদেশ ম্যাচে আধিপত্যও বিস্তার করছে। এশিয়ান কাপে বাছাইপর্বের চারটি ম্যাচেই বল দখলের লড়াইয়ে বাংলাদেশ ছিল এগিয়ে। যদিও ম্যাচের কতটুকু সময় বল নিজেদের কাছে রেখেছে, তা দিয়ে ম্যাচের পুরো পরিস্থিতি বোঝা যায় না। তবু ভারতের বিপক্ষে ৫৫ শতাংশ, সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ৫২ শতাংশ, হংকংয়ের বিপক্ষে ৫৮ শতাংশ ও ৫৭ শতাংশ সময় বল নিজেদের কাছে রেখেছে বাংলাদেশ। ম্যাচে কোনোমতে টিকে থাকার মতো খেলা এখন আর খেলে না বাংলাদেশ। বরং বাংলাদেশ যে জেতার জন্য খেলে, তা প্রমাণ হয়েছে প্রতিটি ম্যাচেই, প্রতিটি মুহূর্তে।
ফুটবল এমন একটি খেলা, যেখানে সবটা না দিলে সফলতার মুখ দেখার সম্ভাবনা শূন্য। কারণ, একমুহূর্তের ভুল বদলে দিতে পারে ম্যাচের চিত্র, একমুহূর্তের ভুলে নিশ্চিত জয় হয়ে যেতে পারে হাতছাড়া। হংকংয়ের বিপক্ষে এর প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছে বাংলাদেশ। ৯৯ মিনিটে গোল করেও ১ মিনিটের জন্য সেই সমতা ধরে রাখতে পারেননি হামজারা। বরং পরের মিনিটেই হংকং গোল শোধ করে বদলে দিয়েছে ম্যাচের চিত্র। জয়ের জন্য সর্বদা যে ক্ষুধা, তার প্রচণ্ড অভাব চোখে পড়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি ম্যাচেই। অল্পতেই যেন সন্তুষ্ট তারা।
হংকংয়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই যেমন। ৮৪ মিনিটে দলের ব্যবধান কমান শেখ মোরছালিন। অথচ বাংলাদেশ তখনো ২-৩ গোলে পিছিয়ে। সেখানে উদ্যাপনের চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল ম্যাচে ফেরার চেষ্টা করা। ১টি পয়েন্ট বের করা না গেলে এই গোল মূল্যহীন। মোরছালিন যখন গোল করে দর্শকদের দিকে ছুটছেন, তখন হামজা-শমিত বল নিয়ে ফিরে আসছেন মাঝমাঠে। তাগাদা দিচ্ছেন তাড়াতাড়ি উদ্যাপন শেষ করে ম্যাচে ফিরতে। বাংলাদেশ অবশ্য সেই ম্যাচে ফিরেছিল। শমিত সোম ৯৯ মিনিটে গোল করে দলকে আরেকবার ভাসান উদ্যাপনে। উদ্যাপনে শমিতের সঙ্গী ছিলেন সেই হামজাই। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে যাঁদের মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার ছিল, কোচিং স্টাফ ও অন্যদের, তাঁরা ঠিকই উদ্যাপনে মশগুল হয়ে পড়েছিলেন। দলকে শান্ত করে বাকি দুই মিনিট নিজেদের খেয়াল রাখার কথা যাঁদের, তাঁরাই হয়ে পড়েছিলেন উতলা। ফলাফল? অতিরিক্ত সময়ে সমতায় ফিরেও সমতা ধরে রাখতে না পারা। বাংলাদেশকে হারতে হলো আশা দেখিয়েও।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে হংকংয়ে গিয়েও। ৮৪ মিনিটে বাংলাদেশ যখন সমতায় ফিরেছে, উদ্যাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সবাই, হামজা তখন বল নিয়ে ছুটেছেন। কারণ, দলকে জেতানো তখনো বাকি। ড্র নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে হবে না। জামাল ছুটে গেছেন দলকে ফিরিয়ে আনতে।
বাংলাদেশের পরবর্তী দুই ম্যাচ নেপাল আর ভারতের বিপক্ষে। প্রস্তুতি ম্যাচ আর এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ডেড-রাবার ম্যাচে বাংলাদেশের মূল পরীক্ষা হবে মানসিকতায়। তুলনার করলে প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে। কিন্তু এই যে হার না মানা মানসিকতা, ইউরোপিয়ান দলগুলোর মধ্যে নিয়মিত দেখতে পাওয়া জয়ের স্পৃহা, সেই স্পৃহা অন্যদের মধ্যে আসে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা। তাঁদের পক্ষ থেকে চেষ্টা আছে বৈকি, অন্যরা সেই চেষ্টায় ধরা দেবেন কি? যদি ধরা দেন, তাহলে জয়ের জন্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না বাংলাদেশকে। বরং আমরা অপেক্ষায় থাকব, কয় গোলে হারানো যায় প্রতিপক্ষকে।