টাকার বস্তা নিয়ে দলবদলে লিভারপুল

ফ্লোরিয়ান রিটজছবি: এক্স

লিভারপুল আর দলবদলের মৌসুমে খরচ—এ যেন পৃথিবীর দুই মেরুর দুই বস্তু। লিভারপুলের মালিক ফেনওয়ে স্পোর্টস গ্রুপকে ধরা হয় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম কিপটে মালিক হিসেবে। দলের অবস্থা যেমনই হোক না কেন, খেলোয়াড় কেনার বেলায় তাদের অবস্থান বরাবরই চুপচাপ। লিভারপুলের কোচ হয়ে আসার অর্থ একটাই, যা আছে তাই দিয়েই চলতে হবে তোমাকে।

অর্থকষ্টের আফসোসে বছরের পর বছর পুড়েছেন জার্মান কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। বছরের পর বছর ধরে শিরোপার জন্য লড়াই করা লিভারপুলকে ইউরোপিয়ান হেভিওয়েট করে তুলেছিলেন ক্লপ। একা হাতে লিভারপুলকে গড়ে তুলেছিলেন ইউরোপের হেভিওয়েট ক্লাব হিসেবে। কিন্তু সেই ক্লপকেই কি না বছরের পর বছর তারকা খেলোয়াড়ের জন্য ধরনা দিতে হয়েছে মালিকপক্ষের কাছে। কোনো লাভ হয়নি। অ্যালিসন আর ভার্জিল ফন ডাইকের মতো খেলোয়াড়কে ভেড়াতে বিক্রি করতে হয়েছে কুতিনহোকে। লিভারপুলে বড় নামের আগমন মানেই যেন কেউ না কেউ একজন ছাড়ছেন সঙ্গ।

কোনো দলবদল ছাড়াই লিভারপুলকে প্রিমিয়ার লিগ জিতিয়েছেন আর্নে স্লট।
ছবি: এক্স

ক্লপ যেতে না যেতেই যেন বদলে গেছে সবটা। চলে যেতেই সব বদলে গেছে, ব্যাপারটা তেমন নয়। গত মৌসুমেও লিভারপুলকে লড়তে হয়েছে এই কিপ্টে মালিকের সঙ্গে। লড়তে হয়েছে নতুন কোচ আর্নে স্লটকেও। দেন-দরবার করেও কাউকে দলে ভেড়াতে পারেননি। ক্লপের রেখে যাওয়া দল নিয়েই মৌসুম শুরু করেছিলেন স্লট। আর প্রথম মৌসুমেই দেখিয়েছেন চমক। ১০ পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে থেকে নিশ্চিত করেছেন শিরোপা। আর্নে স্লটের কাছ থেকে এমন পারফরম্যান্স দেখবে, আশা করেনি কেউই। কিন্তু স্লট বদলে দিয়েছেন লিভারপুলের প্লট। যে কারণে এই মৌসুমে রীতিমতো টাকার বস্তা নিয়েই মাঠে নেমেছে অল রেডসরা।

আরও পড়ুন

এই মৌসুমে লিভারপুলের প্রথম কেনাবেচা ছিল বায়ার লেভারকুসেনের সঙ্গে। গত মৌসুমেই আগাম চুক্তি করা ছিল রাইট ব্যাক জেরেমি ফ্রিমপংয়ের ব্যাপারে। ৩৩ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে মৌসুমের প্রথম দিনই লিভারপুলে যোগ দেন ফ্রিমপং। ট্রেন্ট অ্যালেকজেন্ডার আর্লন্ডকে হারানোর দুশ্চিন্তা লিভারপুলকে নিতে হয়নি বিন্দুমাত্র। যোগ্য খেলোয়াড় দিয়েই শূন্যস্থান পূরণ করেছে অল রেডসরা।

লিভারপুলের প্রথম ক্রয় ছিল জেরেমি ফ্রিমপং।
ছবি: এক্স

গত মৌসুমে ফ্রিমপংয়ের পাশাপাশি ফ্লোরিয়ান রিটজের সঙ্গে একটা কানাঘুষা চলছিল লিভারপুলের। কিন্তু এত দামে তাঁকে দলে ভেড়াবে লিভারপুল, এমনটা ভাবনাতেও ছিল না কারও। যে কারণে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, বাকি সব জার্মানদের মতো রিটজের ভবিষ্যৎও বোধ হয় আটকে আছে বায়ার্ন মিউনিখেই। কিন্তু এবার নড়েচড়ে বসল লিভারপুল বোর্ড। ২২ বছর বয়সী লেভারকুসেন তারকাকে দলে ভেড়াতে লিভারপুল খরচ করেছে ১২৫ মিলিয়ন ইউরো! লিভারপুলের ইতিহাসের রেকর্ড তো বটেই, প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের সবচেয়ে দামি তারকার খেতাব এখন ফ্লোরিয়ান রিটজের নামের পাশে। পুরো ফুটবল ইতিহাসের ষষ্ঠ দামি ট্রান্সফার তিনি। অ্যাড-অন গুলো যুক্ত হলে অবশ্য সেটিও হয়তো ছাড়িয়ে যাবে। দর–কষাকষি করতে করতে যোগ দিতে একটু দেরি হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

কিন্তু দেরি বলে তো আর শেষ নয়, তার ঠিক ছয় দিন পর লিভারপুলে যোগ দেন মিলোস কিরকিজ। বোর্নমাউথের লেফট ব্যাককে দলে ভেড়াতে লিভারপুল খরচ করেছে প্রায় ৪৬ মিলিয়ন ইউরো। ডিফেন্সের সে জায়গায় খুব একটা চিন্তা ছিল না অল রেডসদের। কিন্তু রবার্টসনের ইনজুরি আর ডিফেন্সে ভালো ব্যাকআপের কথা চিন্তা করে ৪৬ মিলিয়ন ইউরোকে নস্যিই মনে হয়েছে অল রেডসদের কাছে।

৬ নম্বর জার্সি পরে খেলবেন মিলোস কিরকিজ।
ছবি: এক্স

মাঝ মাঠ, ডিফেন্সের পর আর গোলবার বাকি থাকবে কেন? অ্যালিসনের বয়স হয়েছে, মৌসুমের সব ম্যাচে তাঁকে পাওয়াও মুশকিল। ব্যাকআপ হিসেবে তাই একজনকে তো দরকার। ভ্যালেন্সিয়ার তরুণ গোলরক্ষক জর্জিও মামারদাসভিলিকে হাতছাড়া করল না তারা। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চির দানবীয় গোলরক্ষককে দলে ভেড়াল ২৯ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে।

৬ ফুট ৬ ইঞ্চির গোলরক্ষক জর্জিও মামারদাসভিলি।
ছবি: এক্স

এরপরই দুর্ঘটনা হানা দিল লিভারপুলে। যে ধাক্কায় শুধু লিভারপুল নয়, থমকে গেল পুরো বিশ্ব। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন লিভারপুল খেলোয়াড় দিয়োগো জোতা। কিছুদিন আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসা জোতা ছেড়ে গেলেন পৃথিবীর মায়া, নিজের ভাইকে সঙ্গী করে। জোতার পরিহিত ২০ নম্বর জার্সি আজীবন তুলে রাখল লিভারপুল, ঘোষণা দিল চুক্তির সব টাকা পরিশোধের। লিভারপুলের একজন হয়ে জোতা থাকবেন আজীবন। কিন্তু পৃথিবীকে তো চলতে হয় নিজের নিয়মে। মানুষের মৃত্যুতে তো আর সব থেমে থাকা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন
আজীবনের জন্য লিভারপুলের সঙ্গী দিয়োগো জোতা।
ছবি: এক্স

জোতার রেখে যাওয়া স্থান পূরণে উঠে–পড়ে লাগল লিভারপুল। সেখানেই তাদের নজর কাড়ল এইনট্রাক্ট ফ্র্যাঙ্কফুর্টের ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকার হুগো একিতেকের দিকে। ২৩ বছর বয়সী ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির স্ট্রাইকার লাইমলাইটে এসেছেন গত মৌসুমে। ৪৮ ম্যাচে ২২ গোল করে ইউরোপিয়ান হেভিওয়েটদের নজরে এসেছিলেন দ্রুত। সেখান থেকেই নিউক্যাসল নজরে রেখেছিল তাঁকে। কিন্তু নিউক্যাসলের চোখের সামনে দিয়ে তাঁকে কেড়ে নিয়ে যায় অল রেডসরা। নিউক্যাসলের ৭৫ মিলিয়ন ইউরোর অফারকে টেক্কা দিয়ে লিভারপুল তাঁকে দলে ভেড়ায় ৮০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে। আর পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে এই দামটা পৌঁছে যেতে পারে ৯৫ মিলিয়ন ইউরোতে!

একিতেকের জন্য লিভারপুল খরচ করেছে ৯৫ মিলিয়ন ইউরো।
ছবি: এক্স

এ তো গেল যাঁদের কেনা হয়ে গেছে তাঁদের কথা। এবার আসা যাক তালিকায় থাকা বাকিদের কথায়। ৩০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেও তাদের খরচের হাত কমেনি। বাজারের হেভিওয়েট কয়েকজন তারকার দিকে এখনো নজর আছে অল রেডসদের। এর মধ্যে সবচেয়ে হেভিওয়েট হলেন অ্যালেকজেন্দার ইসাক। নিউক্যাসল তারকা ইতিমধ্যে বয়কট করেছেন ক্যাম্প, যোগ দেননি প্রি-সিজনেও। নিউক্যাসল ছেড়ে লিভারপুলে যোগ দেওয়ার জন্য রীতিমতো প্রস্তুত তিনি। দামের ব্যাপারে কোনো কুণ্ঠাবোধ নেই লিভারপুলের। কিন্তু নিউক্যাসল নিজেদের সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে ছাড়তে নারাজ। নইলে কবেই তাঁকে কেনা হয়ে যেত লিভারপুলের। আবার ইসাক চলে গেলে যাঁকে ভেড়ানোর কথা ছিল, সেই একিতেকেকে কেড়ে নিয়েছে লিভারপুলই। সব মিলিয়ে ইসাককে ভেড়াতে বেশ বেগ পেতে হবে অল রেডসদের। আর ভেড়াতে পারলে খরচের খেরোখাতায় আরও ১০০ মিলিয়ন ইউরো তো যুক্ত হবে নিশ্চিত।

আরও পড়ুন
গত মৌসুমে লিভারপুলকে খাবি খাওয়ানো ইসাক এই মৌসুমে যোগ দিতে পারেন তাদের সঙ্গেই।
ছবি: এক্স

প্রশ্ন করতে পারো, হঠাৎ করে এত খরচ করার মানসিকতা এলো কোত্থেকে লিভারপুলের? সত্যি বলতে লিভারপুলের হাত খুলে খরচ করার পেছনে যেমন মালিকের অবদান আছে, তেমনি দেদার বিক্রিও করতে পেরেছে তারা। ট্রেন্ট অ্যালেকজেন্দার আর্নল্ডকে চুক্তির এক মাস আগে ছাড়ায় পেয়েছে ১০ মিলিয়ন ইউরো। গোলরক্ষক কেলেহারের জন্য ১৫ মিলিয়ন ইউরো, জ্যারেল উইনসার জন্য ৩৫, আর টায়লার মর্টনের জন্য ১২। দলের বেঞ্চে বসে থাকা খেলোয়াড়দের বিক্রি করেই বড় অঙ্কের টাকা কামিয়ে নিয়েছে তারা। তবে সবচেয়ে বড় টাকা এসেছে দপ্লের দুই আক্রমণভাগের তারকার কাছ থেকে। লুইস দিয়াজকে বায়ার্ন মিউনিখে বিক্রি করেছে মোট ৭৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। অন্যদিকে সৌদি ক্লাব আল-হিলালের কাছে ডারউইন নুনেজকে বিক্রি করেছে ৫৩ মিলিয়ন ইউরোতে। দলে সময় ফুরিয়ে আসা খেলোয়াড়দের চড়া দামে বিক্রি করতে পারার মুনশিয়ানা দেখিয়েছে বোর্ড। ফলে সহজেই খরচ করা সম্ভব হয়েছে এবারের দলবদলের মৌসুমে। সেটা কতটা কাজে আসে, তা বোঝা যাবে মৌসুম শুরু হলেই।

আরও পড়ুন