ল্যুভর মিউজিয়ামে রুদ্ধশ্বাস সাত মিনিট

চিহ্নিত অংশ থেকে খোয়া যাওয়া রত্নের মধ্যে আছে নেপোলিয়নের সময়ের অমূল্য গয়নানিউইয়র্ক টাইমস

বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত মিউজিয়াম ল্যুভর। লেওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ এই মিউজিয়ামে রাখা আছে। লাখো মানুষ প্রতিনিয়ত ল্যুভর ভ্রমণ করেন। এই মিউজিয়ামের নিরাপত্তাব্যবস্থা খুব কঠোর বলেই এত দিন লোকে জানত। তবে এই জানায় এবার বুঝি বদল এল। ল্যুভরের নিরাপত্তাব্যবস্থা যে খুব একটা শক্ত না, সেটা প্রমাণ করে ছেড়েছে পেশাদার কয়েকজন চোর।

দিনের আলোয় লোকজনের চোখের সামনে এই জাদুঘরে ঘটেছে অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। একদল পেশাদার চোর শত শত দর্শনার্থীর সামনে থেকে ফ্রান্সের রাজকীয় রত্নভান্ডারের অংশ চুরি করে পালিয়ে গেছে। খোয়া যাওয়া রত্নের মধ্যে আছে নেপোলিয়নের সময়ের অমূল্য গয়না। মাত্র সাত মিনিটের ঘটনা। চুরি করে রত্ন নিয়ে চোরেরা পালিয়েও গেছে এই সাত মিনিটে। গত ১৯ অক্টোবর ঘটে যাওয়া এ ঘটনা শুধু মিউজিয়ামের কর্তাদের না, পুরো বিশ্বের মানুষকে অবাক করেছে।

রুদ্ধশ্বাস সাত মিনিট

চুরির ঘটনাটি যেন হলিউড সিনেমার চিত্রনাট্য। মিউজিয়াম খোলে সকাল ৯টায়, তার মাত্র ৩০ মিনিট পরেই চুরি করেছে চোরেরা। একদম নিখুঁত পরিকল্পনা করে এসেছিল তারা। বোঝা যায়, ভালোই হোমওয়ার্ক করেছে। কারণ, চুরিতে তারা একদম ‘সফল’।

আরও পড়ুন
বাইরে থেকে সিঁড়ি ব্যবহার করে দোতলায় ওঠে চোর
নিউইয়র্ক টাইমস

সাড়ে নয়টার দিকে চারজন চোর এসেছে নির্মাণকর্মীদের মতো হলুদ জ্যাকেট পরে। সেন নদীর পাশে ল্যুভরের পাশের রাস্তায় একটি ট্রাক নিয়ে আসে। সেই ট্রাকে লাগানো ছিল একটি বৈদ্যুতিক বাস্কেট লিফট। এ ধরনের লিফট প্যারিসে আসবাবপত্র সরানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। রাস্তার বাতি লাগানোর জন্য সিটি করপোরেশনের লোকদের সম্ভবত এমন ট্রাক ব্যবহার করতে তুমি দেখেছ। চোরেরা ট্রাফিকের কোন নিয়ে এসেছিল। মানে গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্রাফিক যে তিন কোনা উপকরণটি ব্যবহার করে, সেটা দিয়ে চোরেরা এমন ভান করেছে, যেন সেখানে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে।

সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে দুজন চোর মই বেয়ে দ্বিতীয় তলার বারান্দায় ওঠে। এখানে ল্যুভরের বিখ্যাত অ্যাপোলো গ্যালারি। ফ্রান্সের মুকুটের রত্নগুলো এখানে প্রদর্শিত হয়। চোরেরা গ্রাইন্ডার বা ডিস্ক কাটার ব্যবহার করে একটি জানালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। সঙ্গে সঙ্গে মিউজিয়ামের নিরাপত্তা অ্যালার্ম বেজে ওঠে। কিন্তু চোরদের থামানো যায়নি।

আরও পড়ুন

ভেতরে প্রবেশ করে মাত্র ৯টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে তারা দুটি সুরক্ষিত কাচের ডিসপ্লে কেস ভেঙে ফেলে এবং আটটি মূল্যবান গয়না লুট করে। এই আটটি জিনিসের মধ্যে ছিল সম্রাট নেপোলিয়ন তৃতীয়ের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী ইউজেনির মুকুট ও ব্রোচ। ছিল সম্রাজ্ঞী মারি লুইসের পান্নার হার ও কানের দুল। আরও ছিল রানি মেরি-অ্যামেলি ও হর্তসের নীলা পাথরের সেট থেকে মূল্যবান গয়না। চুরি যাওয়া গয়নাগুলোর মোট মূল্য প্রায় ১০.২ কোটি ডলারের বেশি।

মিউজিয়ামের কর্মীরা নিরাপত্তা প্রটোকল মেনে প্রথমে দর্শনার্থীদের সরিয়ে দেন এবং দ্রুত পুলিশকে খবর দেন। ৯টা ৩৮ মিনিটে চোরেরা একই জানালা দিয়ে নেমে আসে। বাইরে অপেক্ষারত সঙ্গীদের সঙ্গে স্কুটারে চড়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।

আরও পড়ুন

চোর চলে যায়, রয়ে যায় প্রমাণ

চোরেরা পালানোর সময় তাদের ব্যবহার করা ডিস্ক কাটার, ওয়াকিটকি, গ্লাভস এবং একটি হলুদ জ্যাকেট ঘটনাস্থলে ফেলে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা তাদের হাতে থাকা সম্রাজ্ঞী ইউজেনির মুকুটটি বাইরে ফেলে যায়, যা ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এই ফেলে যাওয়া জিনিসগুলো তদন্তকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে কাজ করছে।

এই দুঃসাহসিক চুরির ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এটিকে ‘ফরাসি ঐতিহ্যের ওপর আক্রমণ’ বলে নিন্দা জানান। গয়না উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। প্যারিসের প্রসিকিউটরের অফিস মামলাটি হাতে নেয় এবং প্রায় ১০০ জন তদন্তকারীকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা সিসিটিভি ফুটেজ ও ফরেনসিক নমুনা (ডিএনএ, আঙুলের ছাপ) বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন।

তদন্তের ফল হিসেবে ঘটনার এক সপ্তাহ পর, মানে ২৬ অক্টোবর ফরাসি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, তারা এ চুরির ঘটনায় কয়েকজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে একজন ছিল, যে শার্ল দ্য গল বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছিল।

আরও পড়ুন
ল্যুভর মিউজিয়ামের এই অংশ থেকে চুরির ঘটনা ঘটেছে
নিউইয়র্ক টাইমস

চোর ধরলেই সব ফিরে পাওয়া যায় না

এ চুরির ঘটনা মিউজিয়ামে আগের চুরিগুলো থেকে আলাদা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চোরেরা এখন আর সহজে চেনা যায় এমন চিত্রকর্ম চুরি করে না। যেমন মোনালিসাকে এখন সম্ভবত পাগল না হলে কেউ চুরি করবে না। কারণ, এটা বিক্রি করা কঠিন। এটা চুরি করে কোনো আর্থিক লাভ করা সম্ভব না। আর ধরা খাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। তাই এখন চোরদের লক্ষ্য হলো গয়না, মুদ্রা বা মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি এমন জিনিস চুরি করা। এগুলো ভেঙে ফেলে বা গলিয়ে কাঁচামাল হিসেবে দ্রুত বিক্রি করে দেওয়া যায়। সোনার গয়না চুরি করে গলিয়ে ফেললেই আর জানা যায় না কী গয়না ছিল এটি। ল্যুভরে চুরির পরপরই বিশেষজ্ঞরা এই আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। চুরি যাওয়া রত্নগুলো ভেঙে ফেলা হতে পারে, এই দুশ্চিন্তাই তদন্তকারী বা গোয়েন্দাদের মূল মাথাব্যথা হয়ে ওঠে। কারণ তো বলেছিই, ভাঙা রত্ন শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব।

এই চুরি নিয়ে দুশ্চিন্তার আরও কারণ আছে। এটি ঘটেছে দিনের আলোয়। মিউজিয়ামে এ সময় দর্শনার্থীতে ভরা ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যান্য সুরক্ষিত ভবনের চেয়ে মিউজিয়ামগুলো ‘সহজ লক্ষ্য’। এমন মিউজিয়ামে ভিড়ের মধ্যে সহজে প্রবেশ করা যায়। বলপ্রয়োগ করে দ্রুত লুটে নেওয়া যায়।

আরও পড়ুন

নিরাপত্তাঘাটতি রয়েই গেল

চুরির পর ল্যুভর মিউজিয়ামের দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। মিউজিয়ামের পরিচালক স্বীকার করেন, নিরাপত্তাব্যবস্থা পুরোনো হয়ে গিয়েছিল। চোরেরা যে জানালা দিয়ে ঢুকেছিল, তার বাইরের সিসিটিভি ক্যামেরাটি অন্যদিকে ঘোরানো ছিল।

এ সমালোচনার মুখে প্রেসিডেন্ট মাখোঁ ঘোষণা করেন, ল্যুভরের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য ৮ কোটি ইউরো খরচ করে বড়সড় সংস্কার পরিকল্পনা আগামী বছর শুরু হবে। এ পরিকল্পনার মধ্যে থাকবে উন্নত নজরদারি ক্যামেরা এবং আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থা।

তিন দিন বন্ধ থাকার পর ২২ অক্টোবর ল্যুভর মিউজিয়াম আবার খুলে দেওয়া হয়। তবে চুরি যাওয়া গয়নাগুলো উদ্ধারের জন্য তদন্ত এখনো পুরোদমে চলছে (২৭ অক্টোবর)। এখন পরের খবর জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অনুসন্ধান করে গোয়েন্দারা বের করবেন, গয়নাগুলো কি ফেরত পাওয়া যাবে, নাকি এরই মধ্যে যা হওয়ার হয়ে গেছে? মানে, অমূল্য রত্নগুলো ভেঙে বা গলিয়ে ফেলা হয়েছে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

সূত্র: এপি, বিবিসি এবং সিএনএন ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন