লেনিন সাহেবের বাংলো
রাত তখন কটা হবে কে জানে। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। গাছের পাতায় বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে দারুণ একটা ছন্দময় শব্দ তৈরি হয়। শব্দটা মাহবুবের খুব ভালো লাগে। সেই ছন্দময় শব্দ কানে বাজতে বাজতে চোখে ঘুমটা কেবল লেগে এসেছিল। আর তখনই হঠাৎ দরজায় শব্দ। ধড়াম! ধড়াম!
সঙ্গে চিত্কার, ‘মাহবুব, দরজা খুলুন!’
আলসে কণ্ঠে সাড়া দিল মাহবুব, ‘কে?’
জবাব এল, ‘আমি।’
‘আমি কে?’
‘মাহবুব, আমাকে চিনতে পারছেন না? আশ্চর্য তো! আমি আপনার দাদাভাই।’
মুহূর্তে মাহবুবের চোখ থেকে ঘুম আর শরীর থেকে আলস্য উধাও হয়ে গেল। হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘সরি স্যার। সরি স্যার।’
এবার মৃদু ধমকের সুর ভেসে এল দরজার ওপাশ থেকে, ‘আবার স্যার! কত দিন না বলেছি, আমাকে স্যার বলবেন না?’
এবার তোতলাতে লাগল মাহবুব, ‘সরি স্যার। আর স্যার বলব না।’
জোর ধমকের শব্দ ভেসে এল, ‘আবার স্যার! বলেন দাদাভাই।’
‘দাদাভাই স্যার।’
‘আবার স্যার? শুধু দাদাভাই।’
‘জি দাদাভাই।’
বলেই দরজা খুলে দিল মাহবুব।
দাদাভাই মানুষটাই এমন। দাদাভাইয়ের চেয়ে ও বয়সে কত ছোট। অথচ ওকে আপনি আপনি করেই বলেন।
ঘরের ভেতরে অন্ধকার। তবে বাইরে একটা বাতি জ্বলছে। সেটাও বারান্দার শেষ মাথায়। সোলার প্যানেলের বাতি। খুবই ক্ষীণ আলো। দরজা অব্দি সেই আলো পুরোপুরি আসে না। আবছা। সেই আবছা আলোয় দাদাভাইয়ের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না মাহবুব। কিন্তু অবয়ব আর উচ্চতা একেবারে দাদাভাইয়ের মতো।
তখনো দরজা আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিল মাহবুব। দাদাভাই বললেন, ‘সরে দাঁড়ান। নইলে ঘরে ঢুকব কীভাবে?’
‘সরি দাদাভাই’, বলেই চটপট দরজা থেকে সরে দাঁড়াল মাহবুব। তারপর বলল, ‘দাদাভাই, আপনি এত রাতে হঠাৎ! এ সময় তো আসেন না।’
‘আসি না বলে কি আসতে নিষেধ আছে? জরুরি দরকার তাই এসেছি। আমার ঘরটা খোলার ব্যবস্থা করেন।’
‘করছি দাদাভাই। রাতে কিছু খাবেন?’
‘খাবার কিছু আছে?’
‘তৈরি করে দেব। কতক্ষণ আর লাগবে। ইশ্! যদি জানতে পারতাম আপনি আসবেন, তাহলে...’
‘তাহলে কী?’
এবার আর জবাব খুঁজে পেল না মাহবুব। লজ্জা পেয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল। ঘরের বাতি জ্বালানোর জন্য সুইচ টিপল। বাতি জ্বলল না। বিদ্যুৎ নেই। গ্রামের বিদ্যুতের এ রকমই অবস্থা। তবে সোলারের ব্যবস্থা আছে। সোলার বাতির সুইচ টিপতেই বাতি জ্বলল। তবে না জ্বললেই ভালো হতো। টিমটিমে আলোয় ঘরটা যেন আরও বেশি অন্ধকার হয়ে গেছে।
বিছানার পাশ থেকে চাবির গোছা তুলে নিল মাহবুব। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল দোতলায়। ওখানেই দাদাভাইয়ের ঘর।
দাদাভাই মানে লেনিন সাহেব। শেরপুরের নকলায় হুজুরুমকান্দিতে তাঁর একটা বাংলো আছে। বাংলোর চারপাশে তাঁর কয়েক শ একর জমি। ওই জমিতে সার আর কীটনাশক ছাড়া ফসল ফলানো হয়। তাঁর কিছু নির্ধারিত গ্রাহক আছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। সেই ফসল চলে যায় গ্রাহকদের কাছে। ময়মনসিংহ আর শেরপুরে মিলিয়ে–ঝিলিয়ে থাকেন তিনি। সপ্তাহে দু–তিন দিন ময়মনসিংহ তো বাকি কটা দিন শেরপুর। ময়মনসিংহ আর শেরপুর যাতায়াত করেন সাইকেলে। হাইওয়ে এড়িয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে সরু পথে সাইকেল চালিয়ে আসেন। পথের মাঝে বেশ কয়েকটা খাল পড়ে। সাইকেল ঘাড়ে নিয়ে সে খাল পাড়ি দেন। শর্টকাট রাস্তায় আসা–যাওয়া করতে বেশি সময় লাগে না তাঁর।
মুড়ির কৌটার দিকে তাকাল মাহবুব। মুড়ি নেই। আজ বিকেলেই শেষ করেছে ও। বৃষ্টির মধ্যে পেঁয়াজ, মরিচ আর শর্ষের তেল দিয়ে মুড়িমাখা খেয়েছে। খেতে খেতে পুরো কৌটা খালি করে ফেলেছে। দাদাভাই আসবেন জানলে খেত না।
দোতলার পুরোটাই একটা ঘর। ঘরটা বিশাল। ঘরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে তাঁর বিছানা। মেঝেতে মাদুর পেতে তার ওপর পাতলা একটা তোশক বিছানো। খাট-জাজিমের বালাই নেই।
ঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে গোসলখানা। আর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে লম্বা একটা চওড়া বেঞ্চি। ঘরের ভেতর ওটাই একমাত্র বসার ব্যবস্থা।
চাবি দিয়ে দাদাভাইয়ের ঘরের তালা খুলল মাহবুব। তারপর দরজার পাল্লা খুলে দিয়ে এক পাশে দাঁড়াল, যাতে দাদাভাই ভেতরে ঢুকতে পারেন। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল মাহবুব। কিন্তু দাদাভাই ঘরে ঢুকছেন না কেন?
পেছনে তাকাল মাহবুব। নেই। দাদাভাই নেই। তাহলে কি দাদাভাই রান্নাঘরে? রান্নাঘরটা নিচতলায়।
আস্তে করে হাঁক দিল মাহবুব, ‘দাদাভাই!’
কোনো সাড়া মিলল না। দাদাভাই কি ওর ডাক শুনতে পাননি?
হতে পারে। দাদাভাইয়ের মাথার ওপর যে ছাদ, সে ছাদের কিছু অংশ ঢেউটিনের। কিছু অংশ টালির। টিনের চালের বৃষ্টির শব্দ দাদাভাইয়ের খুব প্রিয়। বৃষ্টির জোরালো শব্দ ভেসে আসছে ঘরের ভেতর।
আরও জোরে হাঁক দিল মাহবুব, ‘দাদাভাই!’
তা-ও সাড়া মিলল না। এবার দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। আর নিচে এসেই অবাক হয়ে গেল। সদর দরজা খোলা।
অবাক হলো মাহবুব। ও কি দরজা বন্ধ করেনি? ঠিক মনে করতে পারছে না। নিচতলার পুরো ঘরে চোখ বোলাল। দাদাভাইকে দেখতে পেল না। দাদাভাই কি তাহলে রান্নাঘরে? খাবার খুঁজছেন?
রান্নাঘরের দিকে এগোতে গিয়েও থেমে গেল মাহবুব। গতিপথ বদলে সদর দরজার দিকে এগোল। আগে সদর দরজা বন্ধ করা দরকার।
সদর দরজা বন্ধ করতে এসে আবারও অবাক হলো মাহবুব। বাইরে ওটা কে? দাদাভাই না? এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে কী করছেন?
হাঁক দিল মাহবুব। ‘দাদাভাই!’
কিন্তু এ কী! দাদাভাই ওর দিকে ফিরেও তাকালেন না। ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাচ্ছেন?
মাহবুবও পেছনে পেছনে গেল। আর কিছু দূর এগিয়ে আলকুশি তলায় গিয়ে হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেলেন দাদাভাই। লতা-পাতা দিয়ে একটা বুনো গাছ আঁকড়ে ধরে রেখেছে আলকুশি।
ভীষণ অবাক হলো মাহবুব। কোথায় গেলেন দাদাভাই? তাহলে কি সে ভুল দেখেছে?
হতে পারে। একে তো রাতের বেলা, তার ওপর টিমটিমে আলো। কাকে দেখতে কাকে দেখেছে কে জানে!
কিন্তু আলকুশিগাছের নিচে তো কাউকে যেতে দেখেছে ও। স্পষ্ট দেখেছে। কে গিয়েছে? এত রাতে কে এসেছে এখানে, এই বাংলোর সীমানার ভেতরে!
ধ্যাৎ! আর ভাবতে ইচ্ছা করছে না। বড্ড বিরক্ত হয়ে ঘরে ঢুকল মাহবুব। ভালোমতো সদর দরজা আটকে দিল। তারপর সোজা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। এতক্ষণে বিদ্যুৎ চলে এসেছে। রান্নাঘরের বাতি জ্বালাল। দাদাভাইয়ের জন্য কী খাবার তৈরি করা যায়, ভাবতে লাগল। দাদাভাইকে জিজ্ঞেস করে তৈরি করলে ভালো হয়। খাবার নিয়ে দাদাভাইয়ের তেমন একটা ঝামেলা নেই। কিছু একটা খেলেই হলো। বিশেষ করে রাতের বেলা সামান্য একটু খাবার হলেই চলে।
মুড়ির কৌটার দিকে তাকাল মাহবুব। মুড়ি নেই। আজ বিকেলেই শেষ করেছে ও। বৃষ্টির মধ্যে পেঁয়াজ, মরিচ আর শর্ষের তেল দিয়ে মুড়িমাখা খেয়েছে। খেতে খেতে পুরো কৌটা খালি করে ফেলেছে। দাদাভাই আসবেন জানলে খেত না।
ডিমের ঝুড়ির দিকে তাকাল। তখনো তিনটা ডিম আছে। একটা ডিম সেদ্ধ করে দেবে? নাকি ভাজি করে দেবে? দাদাভাইকেই জিজ্ঞেস করে দেখা যাক।
কিন্তু কোথায় দাদাভাই?
নিচতলায় বাতি জ্বালাল মাহবুব। নিচতলায় দাদাভাই নেই।
‘দাদাভাই! দাদাভাই!’
হাঁক দিতে দিতে দোতলায় গেল। বাতি জ্বালাল। নেই। গোসলখানার দরজা বাইরে থেকে আটকানো। বাতি জ্বালিয়ে দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল, কেউ নেই।
তাহলে কোথায় গেলেন দাদাভাই!
ধাঁধায় পড়ে গেল মাহবুব। দোতলা আর নিচতলায় ছোটাছুটি করল বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু দাদাভাইয়ের পাত্তাই নেই। হঠাৎ বজ্রপাত শুরু হলো। তুমুল বজ্রপাত। আর বজ্রপাত শুরু হতেই বিদ্যুৎ চলে গেল আবার। গ্রামে বিদ্যুতের অবস্থা এমনই। মাঝেমধ্যে আসে। এমনও হয়েছে, ঝড়ের পরে টানা আট-দশ দিনও বিদ্যুৎ থাকে না।
সোলার বাতিও নিবু নিবু হয়ে আসছে। চার্জ শেষের দিকে। বিছানায় বসে বসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল মাহবুব। তারপর যেই না একটু কাত হয়েছে, অমনি ঘুম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, নিজেও জানে না।
এবারও মাহবুবের ঘুম ভাঙল দরজায় তুমুল শব্দে। চোখ মেলেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঝলমলে রোদ। ধড়মড় করে বিছানা থেকে নামল। তারপর দরজা খুলেই অবাক! ‘দাদাভাই!’
মুখে হাসি ঝুলিয়ে দাদাভাই বললেন, ‘কী ব্যাপার মাহবুব। আজ এত বেলা করে ঘুমুচ্ছেন! রাতে ঘুম হয়নি?’
‘না।’
‘কেন?’
আরও অবাক হলো মাহবুব। বলল, ‘আপনি রাতে এসে আবার কোথায় গেলেন দাদাভাই?’
দাদাভাই ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী বলছেন এসব? আমি আবার রাতে কখন এলাম? আমি তো কাল রাতে ময়মনসিংহ ছিলাম। ভোরে রওনা দিয়ে এই মাত্র এসে পৌঁছেছি। কিছুটা দেরি হয়েছে অবশ্য। খালগুলো বৃষ্টির পানিতে টইটম্বুর। পাড়ি দিতে সময় লেগেছে। কিন্তু আপনি তো এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোন না। কোনো সমস্যা?’
‘গত রাতে আপনি আসেননি?’
‘বললাম তো আসিনি। অন্য কেউ এসেছিল?’
‘অন্য কেউ নয়। আপনিই এসেছিলেন। আমাকে দরজা খুলতে বললেন। আমি দরজা খুললাম। তারপর বললেন আপনার ঘর খুলে দিতে। আমি দোতলায় গিয়ে আপনার ঘরও খুলে দিলাম। তারপর পেছনে তাকিয়ে দেখি, আপনি নেই। আপনাকে ওই আলকুশি লতার কাছে যেতে দেখলাম।’
বলেই আলকুশিগাছটা দেখাল মাহবুব।
অবাক হয়ে মাহবুবের কথা শুনছিলেন দাদাভাই। বললেন, ‘তারপর?’
‘তারপর ওখান থেকে আপনি হাওয়া হয়ে গেলেন। এলেন আজ সকালে। এটা কীভাবে হলো দাদাভাই?’
দাদাভাইয়ের মুখটা এতক্ষণ হাসি হাসি ছিল। এবার গম্ভীর হয়ে গেল। মাহবুবের কথার জবাব দিলেন না। বললেন, ‘আপনি তো এখনো নাশতা করেননি, তাই না?’
ডানে–বাঁয়ে মাথা নাড়ল মাহবুব, ‘না।’
‘তাহলে দুজনের নাশতা তৈরি করেন। আমি নাশতা খেয়ে আসিনি।’
ঘুরে ঘরের দিকে ছুট দিল মাহবুব। দাদাভাইয়ের জন্য নাশতা তৈরি করতে হবে। সদর দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকার সময় খেয়াল করল, দাদাভাই আলকুশি লতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
নাশতা খাওয়ার পর দাদাভাই বললেন, ‘আমি বেরুচ্ছি। দুপুরে ফিরব না। আমার জন্য দুপুরের খাবার রাখবেন না। তবে রাতে খাব।’
বলেই সাইকেলে উঠে বসলেন। তারপর কী যেন মনে পড়তেই হাতের ইশারায় মাহবুবকে কাছে ডাকলেন।
দাদাভাইয়ের কাছে এগিয়ে গেল মাহবুব। ফিসফিস কণ্ঠে দাদাভাই বললেন, ‘সাবধানে থাকবেন। গত রাতে সেই পিশাচটা এসেছিল।’
চমকে উঠল মাহবুব, ‘পিশাচ!’
দাদাভাই ওর বাঁ ঘাড়ে ডান হাত রাখলেন। তারপর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই আলকুশি লতায় পিশাচ আছে বলে অনেকের কাছে শুনেছি। কিন্তু কখনো দেখিনি। তবে এবার নিশ্চিত হয়েছি।’
শুনেই মাহবুবের পুরো শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। চোখ দুটো বড় বড় করে জানতে চাইল, ‘ওখানে পিশাচ আছে!’
‘তাই তো দেখছি। সে জন্যই বললাম, একটু সাবধানে থাকবেন। ভয়ের কিছু নেই। দেখি ওটার কী ব্যবস্থা করা যায়।’
চার দিন পর আজ দাদাভাই এসেছেন। দাদাভাইয়ের ঘরটা গোছানোই আছে। তবে সামান্য হলেও ধুলা জমেছে। ধুলা পরিষ্কার করতে হবে। ধুলা পরিষ্কারের জন্য ভ্যাকুয়াম ক্লিনার আছে। যন্ত্রটা কীভাবে চালাতে হয়, দাদাভাই ওকে শিখিয়ে দিয়েছেন।
বলেই ওর ঘাড়ের ওপর থেকে ডান হাত সরিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলের ওপর রাখলেন। তারপর প্যাডেল মেরে সাঁই করে বেরিয়ে গেলেন।
দাদাভাই দুপুরে খাবেন না। সকালের নাশতা খেতেই তো দুপুর হয়ে গেল প্রায়। কাজেই দুপুরের খাবারের আয়োজন না করলেও চলবে। খিদে পেলে দুপুরে হালকা কিছু খেয়ে নিলেই হবে। বরং রাতের খাবারের ব্যবস্থা করলেই হবে। গত রাতে ভালো ঘুম না হওয়ায় শরীরটাও মেজমেজ করছে। কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়াই যেতে পারে। ওদিকে আকাশটাও কালো হয়ে এসেছে। যেকোনো সময় ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। ঠান্ডা বাতাস শুরু হয়েছে। ঘরে ঢুকে পড়ল মাহবুব। আর ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আজ কোনো কৃষিশ্রমিকও আসেনি। বাইরে তেমন একটা কাজও নেই। আর থাকলেও সেটা নিয়ে মাহবুবের মাথাব্যথাও নেই। তার কাজই হচ্ছে দাদাভাইয়ের বাংলো দেখেশুনে রাখা আর রান্না করে খাওয়া। দাদাভাই এলে তাঁর জন্যও খাবারের ব্যবস্থা করা। তবে দাদাভাইয়ের জন্য বিশেষ কোনো খাবার তৈরি করতে হয় না। মাহবুব নিজের জন্য যা রান্না করে, সেটাই একটু বাড়িয়ে রান্না করতে হয়, এ–ই যা। আরেকটা কাজ করতে হয়। ঘরদোর পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বেলায় দাদাভাই বেশ খুঁতখুঁতে।
চার দিন পর আজ দাদাভাই এসেছেন। দাদাভাইয়ের ঘরটা গোছানোই আছে। তবে সামান্য হলেও ধুলা জমেছে। ধুলা পরিষ্কার করতে হবে। ধুলা পরিষ্কারের জন্য ভ্যাকুয়াম ক্লিনার আছে। যন্ত্রটা কীভাবে চালাতে হয়, দাদাভাই ওকে শিখিয়ে দিয়েছেন।
সিঁড়ির নিচে রাখা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হাতে নিল মাহবুব। কিন্তু যে-ই দোতলায় উঠতে যাবে, অমনি আবার বিদ্যুৎ চলে গেল। সুইচ টিপে দেখল, ভ্যাকুয়াম ক্লিনারেও চার্জ নেই।
ধ্যাৎ! করার মতো আর কোনো কাজই নেই। রান্না তো সেই সন্ধের সময় করবে, যাতে দাদাভাই এসে গরম–গরম খেতে পারেন। রাতে ডিম খিচুড়িই করবে বলে ঠিক করেছে। ঝামেলা কম। কাজেই আপাতত আর কোনো কাজ নেই। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা নিয়ে নিজের বিছানার পাশে রাখল। তারপর চার্জের জন্য সুইচ দিয়ে রাখল, যাতে বিদ্যুৎ এলেই চার্জ হতে পারে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মাহবুব। তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দে বেশ কয়েকবার হাই তুলল ও। বিছানার দিকে তাকাল। মনে হলো বিছানাটা ওকে যেন ডাকছে। আর কিছু ভাবতে পারল না। ধুম করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। আর বিছানায় গা লাগাতেই দুচোখ ভারী হয়ে এল। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ তো নয়, যেন ঘুমপাড়ানি গান। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল মাহবুব।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না। ঘুম ভাঙল সদর দরজায় ধড়াম ধড়াম শব্দে।
চোখ মেলেই দেখল চারপাশ অন্ধকার। মাহবুব ঠিক বুঝতে পারছে না, তখন রাত পেরিয়ে দিন হয়েছে, নাকি দিন পেরিয়ে রাত। তবে বৃষ্টির শব্দ নেই। তার মানে বৃষ্টি থেমে গেছে।
আবারও সদর দরজায় শব্দ। সঙ্গে দাদাভাইয়ের কণ্ঠ, ‘মাহবুব, দরজা খোলেন।’
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে হাঁক দিল মাহবুব, ‘কে?’
জবাব এল, ‘আমাকে চিনতে পারছেন না? আশ্চর্য তো! আমি আপনার দাদাভাই।’
হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নামল মাহবুব। ঘরের বাতি জ্বালাল। যাক বিদ্যুৎ চলে এসেছে। কখন এসেছে কে জানে।
তারপর সদর দরজা খুলে দিল। আর সদর দরজা খুলেই দেখল, দাদাভাই দাঁড়িয়ে আছেন। ঠিক তার সামনে। তবে তার দিকে পিঠ দিয়ে। তাই মুখটা দেখতে পাচ্ছে না।
তখনই হঠাৎ ঘোরটা ভাঙল মাহবুবের। আর ঘোর ভাঙতেই অজানা একটা ভয় চেপে ধরল ওকে। হালকা স্বরে ডাক দিল, ‘দাদাভাই!’
কিন্তু ওর কথার জবাব দিলেন না দাদাভাই। বাইরের ঘন অন্ধকারেও দাদাভাইকে দেখতে পাচ্ছে ও। ধীর পায়ে বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন? আলকুশিগাছের দিকে? সত্যিই কি ওটা দাদাভাই!
খুশিতে দাদাভাইয়ের চোখমুখ ঝকঝক করে উঠল। এ কান থেকে ও কান অব্দি চওড়া হাসি দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘ওটার কী ব্যবস্থা করলেন?’
আশপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছিল মাহবুব। কিন্তু যেটা খুঁজছিল, সেটা দেখতে পেল না। আর তখনই হঠাৎ ওর কী যেন হলো। ঘুরে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল ও। চট করে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। দাদাভাই তখনো বারান্দা পেরোননি। কাছাকাছি গিয়েই তাঁর গায়ে ব্রাশহেড ঠেকিয়ে সুইচ অন করে দিল।
‘মাহবুব, আপনার আজকের রান্নাটা খুব সুস্বাদু হয়েছে।’
‘অনেক ধন্যবাদ দাদাভাই।’
‘খাওয়া শেষ করে আপনি শুয়ে পড়েন। আমি ওই পিশাচের একটা ব্যবস্থা করে আসছি।’
মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে মাহবুব বলল, ‘ওটার ব্যবস্থা আমি করে ফেলেছি দাদাভাই। আজও ওটা আপনার রূপ ধরে এসেছিল।’
তারপর পুরো ঘটনা জানাল। ঘটনা শুনে চোখ দুটো কপালে তুলে ফেললেন দাদাভাই। বললেন, ‘বলেন কী! কিন্তু ওটা যে আমি নই, বুঝলেন কী করে?’
মাহবুব বলল, ‘এ আর এমন কঠিন কী! আপনি এলে তো আপনার সঙ্গে সাইকেলও আসে। কিন্তু ওটা এলে ওটার সঙ্গে তো আর সাইকেল আসে না।’
খুশিতে দাদাভাইয়ের চোখমুখ ঝকঝক করে উঠল। এ কান থেকে ও কান অব্দি চওড়া হাসি দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘ওটার কী ব্যবস্থা করলেন?’
‘বন্দী করে রেখেছি দাদাভাই।’
‘বন্দী! বলেন কী! কোথায়?’
তখনই কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো। চমকে উঠলেন দাদাভাই। ‘কী পড়ল?’
মাহবুব বলল, ‘ভ্যাকুয়াম ক্লিনার।’
‘ভ্যাকুয়াম ক্লিনার!’
‘জি দাদাভাই। ওটার ডাস্টব্যাগের ভেতরেই আছে পিশাচটা। মনে হয় ভেতর থেকে বেরোতে চাইছে।’
সিঁড়ির নিচে থাকা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের দিকে তাকালেন দাদাভাই। মেঝেতে পড়েও নড়াচড়া করছে যন্ত্রটা।