ভূতের সঙ্গে অঙ্কের খেলা: শূন্যের ভেলকি
অধ্যায় দুই
রোহান আবার পিছলে পড়ছিল। সেই পুরোনো ঘটনা। বালিশে মাথা ছোঁয়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল, থামার কোনো নামগন্ধ নেই। তবে এবার সে একটা গাছের গা বেয়ে পিছলে পড়ছিল। নিচের দিকে তাকানো যাবে না ভেবে সে প্রাণপণে গাছটা আঁকড়ে ধরে পিছলে পড়তে থাকল…
তারপর হঠাৎ ধপাস করে নরম শ্যাওলার বিছানায় আছড়ে পড়ল। খিক করে হাসির শব্দ শুনতে পেল সে। তাকিয়ে দেখে, মখমলের মতো একটা বাদামি মাশরুমের ওপর সেই সংখ্যার ভূতটা বসে আছে! তবে রোহানের যতটা মনে ছিল, ভূতটাকে এখন তার চেয়েও ছোট দেখাচ্ছে। সে তার জ্বলজ্বলে চোখে রোহানের দিকে তাকিয়ে আছে।
‘তুমি এখানে এলে কীভাবে?’ রোহানকে জিজ্ঞেস করল ভূতটা। রোহান আঙুল দিয়ে গাছের গুঁড়িটা দেখাল, যেটা লম্বায় আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু ওখানে শুধু একটা গাছ নয়, পুরো জঙ্গলটাই ওই গাছে ভরা। রোহান ভালো করে তাকিয়ে দেখল, ওগুলো আসলে গাছ নয়, ‘এক’। সে ১-এর জঙ্গলে এসে পড়েছে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বাতাসে ভনভন করে মাছি উড়ছে। ওগুলো আসলে মাছি নয়, ছোট ছোট সংখ্যা; রোহানের নাকের ডগায় নেচে বেড়াচ্ছে। সে ওগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সংখ্যা অনেক বেশি: ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ আর ৯। সব সংখ্যা এসে ওর গায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। রোহান এমনিতে মাছি একদম সহ্য করতে পারে না, তার ওপর এই খুদে শয়তানগুলো!
‘ওরা কি তোমাকে বিরক্ত করছে?’ সংখ্যার ভূত জিজ্ঞেস করল। সে মুখের কাছে হাত নিয়ে ফুঁ দিল। সব কটি সংখ্যা একনিমেষে উধাও হয়ে গেল। এখন আকাশ একদম পরিষ্কার, শুধু ১-এর জঙ্গলটা ছাড়া।
‘বসো রোহান,’ ভূতটা বলল। রোহান অবাক হলো, ভূতটা আজ এত খাতির করছে কেন!
‘কোথায় বসব? মাশরুমের ওপর?’
‘কেন নয়?’
‘আমাকে বোকা বোকা লাগবে। আর আমরা আছিই-বা কোথায়? কোনো ছবির বইয়ের ভেতর? গতবার তুমি বসেছিলে পালং শাকের পাতায়, আর এবার মাশরুমের ওপর। মনে হচ্ছে কোনো বইয়ে এমন কিছু পড়েছিলাম।’
‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের মাশরুমের কথা বলছো হয়তো।’
‘কিন্তু একটা বানানো গল্পের সঙ্গে গণিতের সম্পর্ক কী?’
‘স্বপ্নে তুমি যেমন সম্পর্ক তৈরি করো, ঠিক তেমন। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না যে ওই মাছিগুলো আমি পাঠিয়েছি? আর তুমি কি সারা জীবন ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?’
রোহান দেখল কিছু করা দরকার। তাই সে হামাগুড়ি দিয়ে কাছের একটা মাশরুমের ওপর উঠে বসল। মাশরুমটা ছিল বিশাল বড়। কয়েকটা উঁচু-নিচু জায়গা ছাড়া আর্মচেয়ারের মতোই নরম আর আরামদায়ক।
‘কেমন লাগছে?’
‘ভালোই,’ বলল রোহান। ‘আমি শুধু ভাবছি, ওই সংখ্যার মাছি আর ১-এর জঙ্গলটা কার মাথা থেকে এল। আমার মাথায় তো আসার কথা নয়। কোনো জন্মেও না। এটা নিশ্চয়ই তোমার কাজ।’
‘তাতে কী হয়েছে?’ মাশরুমের ওপর আয়েশ করে বসতে বসতে ভূতটা বলল। ‘যদিও এখনো একটা জিনিসের অভাব আছে।’
‘কিসের?’
‘কিছুর না। মানে, শূন্যের।’
কথাটা সত্যি। ওসব মাছির মধ্যে একটাও শূন্য ছিল না।
‘কেন?’
‘কারণ শূন্য সবার শেষে আবিষ্কৃত হয়েছে। এটা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়; কারণ, শূন্য হলো সংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে অভিজাত বা স্মার্ট। এই যে দেখো।’ গাছসমান উঁচু দুটো ১-এর মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা খুঁজে নিয়ে ভূতটা তার লাঠি দিয়ে আকাশে কিছু অক্ষর লিখল।
MCM
‘বলো তো রোহান, তুমি কবে জন্মেছ?’
‘আমি? ১৯৮৬ সালে,’ রোহান একটু অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল।
MCMLXXXVI লিখল ভূতটা।
‘আমি জানি এগুলো কী। এগুলো সেই পুরোনো সংখ্যা, যা মাঝেমধ্যে কবরস্থানে দেখা যায়।’
‘এগুলো এসেছে প্রাচীন রোমানদের থেকে। বেচারাদের জীবনটা খুব কঠিন ছিল। কারণ, তাদের সংখ্যাগুলো পড়া ছিল মহা ঝামেলার। যদিও এটা বেশ সহজ—’
I
‘I মানে এক,’ বলল রোহান।
‘আর এটা?’
X
‘X মানে দশ।’
‘ঠিক। আর এটা হলো তোমার জন্মের সাল:
MCMLXXXVI
প্রথম M মানে ১০০০। C মানে ১০০, কিন্তু যেহেতু এটা দ্বিতীয় M-এর আগে বসেছে, তাই ওটাকে বিয়োগ করতে হবে, মানে ৯০০। L মানে ৫০ আর X হলো ১০। এগুলো যোগ করলে হয় ৮০। V মানে ৫, এটার সঙ্গে আমাদের বন্ধু ১ যোগ করলে হয় ৬। তাহলে পুরোটা হলো ১০০০ + ৯০০ + ৮০ + ৬।’
‘আরেহ! এটা তো ভীষণ জটিল।’
‘আবারও ঠিক বলেছ। কেন জানো? কারণ, রোমানদের কোনো শূন্য ছিল না।’
‘আমি এর সঙ্গে শূন্যের কোনো সম্পর্ক দেখছি না। তা ছাড়া শূন্য নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে? শূন্য মানে তো কিছুই না।’
‘এটাই তো এর আসল জাদু।’
‘কিন্তু এটাকে সংখ্যা বলব কেন? কিছুই না মানে তো তা গোনার মধ্যেই পড়ে না।’
‘এত নিশ্চিত হচ্ছ কেন? মনে আছে, আমরা সেই চুইংগামটা কীভাবে কোটি কোটি মানুষ আর শত কোটি ইঁদুরের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলাম? আর ভাগগুলো এত ছোট হয়ে গিয়েছিল যে মাইক্রোস্কোপ দিয়েও দেখা যাচ্ছিল না? আমরা কিন্তু ওভাবে অনন্তকাল চালিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু কখনোই শূন্যে পৌঁছাতাম না। আমরা কাছে যেতাম, আরও কাছে যেতাম, কিন্তু শূন্য পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতাম না।’
‘তো?’
‘তো আমাদের অন্য কিছু চেষ্টা করতে হবে। যেমন, বিয়োগ করা যায়। হ্যাঁ, ওটা দিয়েই কাজ হবে।’
সে তার লাঠিটা বাড়িয়ে একটা ১-এর মাথায় টোকা দিল। ওটা ছোট হতে হতে একদম রোহানের পায়ের কাছে এসে নিরীহ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।
‘শুরু করো,’ বলল ভূতটা।
‘মানে?’
‘বিয়োগ করার চেষ্টা করো।’
১ - ১ =
‘এক থেকে এক বিয়োগ করলে শূন্য হবে,’ বলল রোহান। ‘এটা সবাই জানে।’
‘দেখলে? দেখলে তো শূন্য কতটা দরকারি? এটা ছাড়া তুমি চলতেই পারবে না।’
‘কিন্তু এটা লেখার দরকার কী? যদি কিছুই অবশিষ্ট না থাকে, তবে জায়গাটা ফাঁকা রাখলেই তো হয়। যেটার অস্তিত্ব নেই, তার জন্য আবার সংখ্যা আবিষ্কার করা কেন?’
‘তাহলে এটা চেষ্টা করো।’
১ - ২ =
‘এটাও সহজ,’ বলল রোহান। ‘এক থেকে দুই বিয়োগ করলে হয় মাইনাস এক।’
‘ঠিক। কিন্তু দেখো শূন্য ছাড়া তুমি কী পাবে: ... ৪, ৩, ২, ১, -১, -২, -৩, -৪... চার আর তিনের পার্থক্য এক। তিন আর দুইয়ের পার্থক্যও এক। দুই আর একের পার্থ্যক্য এক। আর এক এবং মাইনাস একের পার্থক্য?’
‘দুই।’
‘তার মানে এক আর মাইনাস একের মাঝখানে নিশ্চয়ই একটা সংখ্যা হারিয়ে গেছে।’
‘সেই পিচ্চি শয়তান শূন্যটা।’
‘আমি তো বলেছিলাম এটা ছাড়া আমরা চলতে পারব না। এবার রোমানদের কথায় ফেরা যাক। ওরা ভেবেছিল শূন্য ছাড়াই চালিয়ে নেবে, আর দেখো কী হলো। ১৯৮৬ লেখার বদলে ওদের ওসব M, C, L, X আর V নিয়ে কাজ করতে হলো। রোমানদের একেকটা সংখ্যার জন্য একেকটা অক্ষর লাগত। কারণ, ওদের কোনো শূন্য ছিল না।’
‘কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের চুইংগাম আর বিয়োগের সম্পর্ক কী?’
‘চুইংগাম ভুলে যাও। বিয়োগও ভুলে যাও। শূন্যের আসল সৌন্দর্য অন্য জায়গায়। কিন্তু সেটা বুঝতে হলে তোমাকে মাথা খাটাতে হবে। তুমি কি তৈরি, নাকি বড্ড ক্লান্ত?’
‘না, যতক্ষণ আমি স্লাইডে পিছলে পড়ছি না, ততক্ষণ আমি ঠিক আছি। আসলে, মাশরুমের ওপর বসে থাকতে আমার ভালোই লাগছে।’
‘বেশ। তাহলে তোমাকে ছোট্ট একটা অঙ্ক দিই।’
হঠাৎ ও আমার সঙ্গে এত ভালো ব্যবহার করছে কেন? ভাবল রোহান। নিশ্চয়ই ওর কোনো মতলব আছে। কিন্তু মুখে বলল, ‘বলে ফেলো।’
সংখ্যার ভূত জিজ্ঞেস করল:
৯ + ১ =
‘দশ,’ চটপট উত্তর দিল রোহান। ‘ব্যাস, এটুকুই?’
‘আর ওটা তুমি কীভাবে লেখো?’
‘আমার কাছে তো কলম নেই।’
‘তাহলে আকাশে লেখো। এই নাও, আমার লাঠিটা ধরো।’
৯ + ১ = ১০।
রোহান বেগুনি মেঘের অক্ষরে লিখল।
‘এক আর শূন্য?’ বলল ভূতটা। ‘এক আর শূন্য যোগ করলে তো দশ হয় না।’
‘উফ, থামবে তুমি!’ রোহান চেঁচিয়ে উঠল। ‘আমি এক যোগ শূন্য লিখিনি! আমি একটা ১ আর একটা ০ লিখেছি, আর ওটাই ১০!’
‘জানতে পারি, ওটা কেন দশ?’
‘কারণ ওভাবেই লিখতে হয়।’
‘আর তুমি ওভাবে কেন লেখো?’
‘কেন, কেন, কেন?’ রোহান বিরক্ত হয়ে বলল। ‘তুমি কিন্তু আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছ।’
‘আমি বলে দেব?’ ভূতটা মাশরুমের ওপর আয়েশ করে হেলান দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
অনেকক্ষণ চুপচাপ।
‘ঠিক আছে! বলো!’ আর সহ্য করতে না পেরে রোহান বলল।
‘সহজ। এটা এসেছে লাফানো থেকে।’
‘লাফানো?’ রোহান অবজ্ঞার সুরে বলল। ‘এর মানে কী? সংখ্যা কি আবার লাফায় নাকি?’
‘আমি যদি বলি তবে সংখ্যা লাফায়,’ ভূতটা উত্তর দিল। ‘ভুলে যেও না তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে,’ বলল রোহান। ‘লাফানো বলতে কী বোঝাচ্ছ শুধু সেটা বলো।’
‘এইতো লাইনে এসেছ। চলো আবার শুরুতে ফিরে যাই। মানে সংখ্যা ১-এ ফিরি আরকি।
১ × ১ = ১
১ × ১ × ১ = ১
১ × ১ × ১ × ১ = ১
তুমি যত খুশি ১ জোড়া লাগাও, উত্তর সব সময় ১ পাবে।’
‘তো? তাতে কী প্রমাণ হলো?’
‘দুই দিয়ে একই কাজ করলেই বুঝবে।’
‘ঠিক আছে,’ বলল রোহান।
২ × ২ = ৪
২ × ২ × ২ = ৮
২ × ২ × ২ × ২ = ১৬
২ × ২ × ২ × ২ × ২ = ৩২
…………….....
‘বাহ, এটা তো খুব দ্রুত বাড়ছে! আরও গুণ করতে চাইলে ক্যালকুলেটর লাগবে।’
‘পাঁচ দিয়ে শুরু করলে আরও দ্রুত বাড়বে। চেষ্টা করেই দেখো না।’
৫ × ৫ = ২৫
৫ × ৫ × ৫ = ১২৫
৫ × ৫ × ৫ × ৫ = ৬২৫
৫ × ৫ × ৫ × ৫ × ৫ = ৩১২৫
৫ × ৫ × ৫ × ৫ × ৫ × ৫ = ১৫৬২৫
‘ওরে বাবা!’ রোহান চিৎকার করে উঠল।
‘বড় সংখ্যা দেখলে তুমি এত ভড়কে যাও কেন? আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি, বেশির ভাগ বড় সংখ্যাই একদম নিরীহ।’
‘তাতে তোমার কী!’ বলল রোহান। ‘তা ছাড়া পাঁচকে বারবার পাঁচ দিয়ে গুণ করার মানেটা কী, বুঝলাম না।’
‘সেটাই তো বলছি। জানো, সংখ্যার ভূত ওই বোরিং ৫ গুলো বারবার না লিখে কী করে? সে লেখে:
৫১ = ৫
৫২ = ২৫
৫৩ = ১২৫
এভাবে চলতেই থাকে। পাঁচের পাওয়ার এক, পাঁচের পাওয়ার দুই, পাঁচের পাওয়ার তিন। সোজা কথায়, আমি সংখ্যাগুলোকে লাফ দেওয়াই। এখন বুঝতে পারছ? দশ দিয়ে একই কাজ করো, দেখবে পানির মতো সহজ। ক্যালকুলেটর ফেলে দিতে পারো। দশকে একবার লাফ দেওয়ালে ওটা যা আছে তাই থাকবে:
১০১ = ১০।
দুইবার লাফ দিলে পাবে:
১০২ = ১০০।
তিনবার লাফ দিলে পাবে:
১০৩ = ১০০০
‘তাহলে যদি পাঁচবার লাফ দিই,’ রোহান চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি পাব ১,০০,০০০! আরও একবার দিলে পাব দশ লাখ বা এক মিলিয়ন!’
‘এভাবে চলতেই থাকবে, অনন্তকাল,’ ভূতটা বলল। ‘সহজ না? এটাই হলো শূন্যের জাদু। এটা তোমাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গা ধরে রেখে সামনে এগোতে সাহায্য করে। একটা সংখ্যা কোথায় বসেছে, সেটা দেখেই তুমি তার মান বুঝতে পারো: যত বাঁয়ে যাবে, তার দাম তত বাড়বে; যত ডানে যাবে, তত কমবে। ৫৫৫ লেখার সময় তুমি জানো, শেষের পাঁচটার মান ঠিক পাঁচ, এর বেশি না। মাঝখানের পাঁচটার মান দশ গুণ বেশি, মানে পঞ্চাশ। আর প্রথম পাঁচটার মান শেষেরটার একশ গুণ বেশি, মানে পাঁচ শ। কেন? কারণ, ওটা লাফ দিয়ে সামনে চলে এসেছে। এখন দেখো, প্রাচীন রোমানদের পাঁচ কিন্তু ৫ ছাড়া আর কিছুই হতে পারত না। কারণ, রোমানরা লাফাতে জানত না। কেন লাফাতে জানত না? কারণ, জায়গা ধরে রাখার জন্য ওদের কোনো শূন্য ছিল না। ফলে ওদের কপালে জুটেছিল MCMLXXXVI-এর মতো সব বিদঘুটে জঞ্জাল।’
‘তাই খুশি হও, বাছা! রোমানদের চেয়ে তুমি অনেক ভালো আছ। শূন্যের সাহায্যে তুমি আরেকটু লাফানোর কায়দা শিখলে যেকোনো সংখ্যা বানাতে পারবে—হোক তা বড় বা ছোট। যেমন ধরো, ৭৮৬।’
‘কিন্তু আমার ৭৮৬ দরকার নেই।’
‘আরে সত্যি! তুমি তো এর চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান! তোমার জন্মের সালটা চেষ্টা করো, ১৯৮৬।’
ভূতটা আবার বড় হতে শুরু করল, সঙ্গে তার মাশরুমটাও।
‘কিসের অপেক্ষা করছো?’ সে গর্জন করে উঠল। ‘শুরু করো!’
আবার শুরু হলো, ভাবল রোহান। ওকে একবার কোনো কিছুতে পেয়ে বসলে আর রক্ষা নেই। মিস্টার বাকেরের চেয়েও খারাপ। সে সাবধানে আকাশে একটা বড় ১ লিখল।
‘ভুল!’ ভূতটা চিৎকার করে উঠল। ‘একদম ভুল! এমন একটা গাধার পাল্লায় আমি পড়লাম কীভাবে? আমি তোমাকে সংখ্যাটা তৈরি করতে বলেছি, লিখতে বলিনি।’
জেগে ওঠার জন্য রোহান তখন যা খুশি করতে রাজি ছিল। সে ভাবল, আমি আর এটা সহ্য করব না। সঙ্গে সঙ্গে দেখল সংখ্যার ভূতের মাথাটা ফুলে উঠছে আর ক্রমশ লাল থেকে আরও লাল হচ্ছে।
‘শেষ,’ ওপর থেকে বলল ভূতটা।
রোহান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, কিছুই বুঝতে পারছে না।
‘শেষ থেকে শুরু করো, শুরু থেকে নয়।’
‘তুমি যেভাবে বলো,’ বলল রোহান। তর্ক করার মেজাজে নেই সে। ১ মুছে ফেলে সেখানে একটা ৬ লিখল।
‘অবশেষে মাথায় ঢুকেছে তাহলে? বেশ, এবার এগোনো যাক।’
‘সমস্যা নেই,’ রোহান সতর্ক হয়ে বলল, ‘তবে কথায় কথায় রেগে না গেলে খুব খুশি হতাম।’
‘দুঃখিত, কিন্তু তুমি কী আশা করো? আমি সংখ্যার ভূত, সান্তা ক্লজ নই।’
‘আমার ৬টা কেমন হয়েছে?’
ভূতটা মাথা নাড়ল আর লিখল:
৬ × ১ = ৬
‘কিন্তু ওটা তো একই হলো,’ রোহান প্রতিবাদ করল।
‘আমি কী বোঝাতে চাইছি, একটু পরেই বুঝবে। এবার আটের পালা। লাফাতে ভুলো না কিন্তু।’
হঠাৎ রোহান বুঝতে পারল, ভূতটা কী চাইছে। সে লিখল:
৮ × ১০ = ৮০
‘বুঝেছি!’ ভূতটা কিছু বলার আগেই রোহান চিৎকার করে উঠল। ‘৯-এর বেলায় আমি দশকে দুইবার লাফ দেওয়াব।’ সে লিখল:
৯ × ১০০ = ৯০০
এবং
১ × ১০০০ = ১০০০
‘ওটা ছিল ট্রিপল বা তিনবারের লাফ,’ সে বলল। ‘আর এবার সব মিলিয়ে—
৬ + ৮০ + ৯০০ + ১০০০ = ১৯৮৬
আসলে এটা বেশি কঠিন না। এমনকি আমার সংখ্যার ভূতকেও দরকার নেই।’
‘তাই নাকি? তোমার সংখ্যার ভূতকে দরকার নেই, অ্যাঁ? তুমি বড্ড পেকে গেছ, ছোকরা! এতক্ষণ তুমি যা দেখলে, তা হলো সব সাধারণ সংখ্যা। আহামরি কিছু না। দাঁড়াও, আমি যখন আমার টুপি থেকে হরেক রকমের সংখ্যা বের করা শুরু করব, তুমি তাল খুঁজে পাবে না।! অবাস্তব সংখ্যা, অযৌক্তিক সংখ্যা। তোমার কোনো ধারণাই নেই কত রকমের সংখ্যা আছে! এমন সংখ্যা আছে যা গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। আবার এমন সংখ্যা আছে, যেগুলো তোমার মস্তিষ্ক নিয়ে খেলবে। এমন সংখ্যাও আছে, যার কোনো শেষ নেই...’
কথা বলতে বলতে তার হাসি চওড়া থেকে আরও চওড়া হতে লাগল। রোহান তার মুখের সব কটি দাঁত দেখতে পাচ্ছিল; মনে হলো দাঁতের সারিরও কোনো শেষ নেই। তারপর সে আবার রোহানের মুখের সামনে তার লাঠিটা ঘোরাতে শুরু করল।
‘বাঁচাও!’ রোহান চিৎকার করে উঠল, আর তার ঘুম ভেঙে গেল।
পরদিন সকালেও রোহানের ঘোর কাটেনি। সে তার মাকে বলল, ‘তুমি কি জানো আমি কোন সালে জন্মেছি? সেটা হলো ৬ গুণ ১, ৮ গুণ ১০, ৯ গুণ ১০০ এবং ১ গুণ ১০০০।’
‘ছেলেটার যে কী হয়েছে ইদানীং বুঝি না,’ রোহানের মা মাথা নেড়ে বললেন। ‘এই নাও,’ তিনি রোহানের হাতে এক কাপ দুধ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হয়তো এটা খেলে ঠিক হবে। তুমি বড্ড অদ্ভুত কথা বলো।’
রোহান চুপচাপ দুধে চুমুক দিল। সে ভাবল, কিছু কথা আছে যা মাকে বলা যায় না।
হান্স ম্যাগনুস এনজেন্সবার্গারের ডের সালেন-টয়ফেল অবলম্বনে