হাজারো গল্পের সমাহারে ভারতের মেয়েদের বিশ্বজয়

বিশ্বকাপের শিরোপা হাতে ভারতের মেয়েরা তখন উদ্‌যাপনে ব্যস্ত। উদ্‌যাপনের মাঝেই নজর কেড়ে নিলেন তিনজন নারী। ভারতের জার্সি পরা নন তাঁরা, কিন্তু উদ্‌যাপন দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁরা এই দলের সদস্য নন। বরং তাঁদের ওপর ভর করেই বিশ্বকাপ নিজেদের করে নিয়েছে ভারত। সেই তিন নারীর নাম—আনজুম চোপড়া, মিতালি রাজ ও ঝুলন গোস্বামী। ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের দিনে তাঁরাও ছিলেন কেন্দ্রবিন্দুতে। মিতালি, শেফালি থেকে কোচ অমল মজুমদার—সবার নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে হাজারো অব্যক্ত গল্প।

পুরোনো তারকাদের মেলবন্ধন

বিশ্বকাপের সঙ্গে মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী ও আনজুম চোপড়া।
ছবি: এক্স

গত ২ নভেম্বর মুম্বাইয়ের ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়াম হয়ে উঠেছিল ভারতীয় নারীদের উৎসবের কেন্দ্র। কে ছিলেন না সেখানে? ঘরের মাটিতে মেয়েদের হাতে শিরোপা দেখতে হাজির হয়েছিলেন ডায়না ইদুলজি। ম্যাচের শেষ ক্যাচ ধরা পড়ার পরই যাঁর দিকে ঘুরে গিয়েছিল ক্যামেরার চোখ। আশির দশকে ভারতের অধিনায়ক, খেলোয়াড় হিসেবে যাঁকে ধরা হতো কপিল দেবের সমকক্ষ। ছিলেন মিতালি রাজ আর ঝুলন গোস্বামী। ভারতের নারী ক্রিকেটের ইতিহাসের সেরা জুটি। ভারতীয় নারী দলের শক্তিশালী অবস্থানে আসার পেছনে তাঁদের অনেক অবদান, দুজনই ছিলেন দলের প্রাণ। বল হাতে ঝুলন আর ব্যাট হাতে মিতালি। আনজুম চোপড়া তাঁদেরও এক যুগ পুরোনো সেনানি। তিনজনের কেউই ভারতকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারেননি৷ তাঁদের গল্প আটকে গেছে ব্যর্থতায়। তাঁদের হয়ে যেন দায় পূরণ করলেন হারমানপ্রীত কৌর। বিশ্বকাপের শিরোপা তুলে দিলেন তাঁদের হাতে। সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিলেন বিশ্বকে, ভারতীয় নারী ক্রিকেটারদের উঠে আসার পথটা এতটা মসৃণ ছিল না।

আরও পড়ুন

পুরো দলের স্পনসর ছিলেন একজন

মিতালি রাজের সঙ্গে মন্দিরা বেদী।
ছবি: এক্স

গল্পটা খুব বেশি আগের নয়। ভারতে পুরুষ দলের ঠিক যতটা কদর, নারী দল সে তুলনায় বরাবরই ছিল অবহেলার শিকার। শচীন-দ্রাবিড়-গাঙ্গুলীরা যখন নতুন যুগের জন্ম দিচ্ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের, তখন মিতালি রাজ–ঝুলন গোস্বামীরা নিয়মিত শিকার হতেন অবহেলার। পুরুষ ক্রিকেটে চলত টাকার মেলা আর নারী ক্রিকেটে তখন স্পনসরের জন্য যুদ্ধ করতে হতো রীতিমতো। পাক্কা দুই বছর ভারতীয় নারী দলের স্পনসর ছিলেন অভিনেত্রী মন্দিরা বেদী। যিনি তাঁর নিজের মডেলিং চুক্তি থেকে নিজের প্রভাব খাটিয়ে স্পনসর জোগাড় করতেন ভারতীয় মেয়েদের জন্য। ২০০৫ সালেই সেই অবদানের পুরস্কার পেতে পারতেন মন্দিরা। কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ২১৬ রানের টার্গেট পেরোতে পারেনি ভারত। বিশ্বকাপে রানার্সআপ হয়ে লাইমলাইটের বাইরেই থেকে যান ভারতের মেয়েরা।

আরও পড়ুন

ব্যর্থ অমল মজুমদারের সাফল্য

ভারতীয় নারী দলের কোচ অমল মজুমদার।
ছবি: এক্স

ব্যর্থতা যে সঙ্গী ছিল শুধু ভারতীয় নারীদের, তা কিন্তু নয়। ব্যর্থতার গল্প ছুঁয়ে গিয়েছিল কোচ অমল মজুমদারকেও। ভারতের জার্সিতে না খেলা সেরা ব্যাটসম্যান ধরা হতো অমল মজুমদারকে। স্কুল ক্রিকেট ইতিহাসের দীর্ঘতম জুটি ছিল বিনোদ কাম্বলি আর শচীন টেন্ডুলকারের। ১৪ বছর বয়সে ৬৬৪ রানের ইতিহাস গড়া ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। সেদিন তাঁদের পরেই ব্যাট হাতে নামার কথা ছিল অমলের। অমল অপেক্ষা করে গেছেন, নামার সুযোগ হয়নি। অমল সেই সুযোগ আর পাননি কখনো। রঞ্জি ট্রফির অভিষেকে ২৬০ রান, পুরো ক্যারিয়ারে ১১ হাজার রান—কোনোটাই তাঁকে নীল জার্সিতে সুযোগ করে দিতে পারেনি। কারণ, যে টেস্ট ফরম্যাটে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য, সেই ফরম্যাটে ব্যাট হাতে জাতীয় দলে জায়গা দখল করে আছেন রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলী, ভি ভি এস লক্ষ্মণ। তাঁদের টপকে ভারতের হয়ে আর খেলা হয়নি অমলের। ২০২৩ সালে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় নারী ক্রিকেটারদের দায়িত্ব। ক্যারিয়ারে যে কাজ করতে পারেননি, সেই অসম্ভব করে দেখিয়েছেন ড্রেসিংরুমে বসে। ড্রেসিংরুম থেকে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতিয়েছেন হারমানপ্রীত কৌরদের।

আরও পড়ুন

বাবার স্বপ্নপূরণ 

হারমানের জন্য কেনা সেই জামা।
ছবি: এক্স

জন্মের সময় হারমানপ্রীত কৌরের বাবা কিনে এনেছিলেন হলুদ রঙের একটা জামা। সেখানে আঁকা ছিল একজন ব্যাটসম্যানের ছবি। ছোটবেলা থেকেই বাবা স্বপ্ন দেখতেন মেয়েকে ক্রিকেটার বানানোর। তিন ছেলেসন্তানের পরও তাই মেয়েকে আলাদা করে দেখেননি। নিজ হাতে বড় ব্যাট কেটে তৈরি করে দিয়েছেন ব্যাট, যাতে হারমানকে খেলতে কোনো কষ্ট পেতে না হয়। সেই হারমানই ফাইনালে ৫২ রান করে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জিতে নিলেন প্রথম বিশ্বকাপ। স্বপ্নপূরণ বুঝি এভাবেই হয়।

আরও পড়ুন

কাঠুরিয়া বাবার গল্প

বাবার সঙ্গে আমানজত কৌর।
ছবি: এক্স

মেয়ে আমানজত কৌর যখন মাঠে খেলছেন, বাবা তখন হাসপাতালে। আমানজতের দাদি ফাইনালের আগের দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন হঠাৎ। মেয়েকে জানতেই দেননি সে কথা। পরিবার যখন হাসপাতালের টিভির সামনে, মেয়ে তখন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়কের ক্যাচ পুরে নিয়েছেন পকেটে। মেয়েকে ‘রক্ষা’ করার গুরুদায়িত্ব একেবারে ছোটবেলা থেকেই নিয়েছেন তিনি। ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা মানা, পাড়া-প্রতিবেশী, পরিবারের লোকের হাজারো বাধা সামলেছেন বাবা। কাঠের কাজ করতেন তিনি, নিজ হাতে বানিয়ে দিয়েছেন মেয়ের ব্যাট। মেয়েকে নিয়ে একাডেমিতে যেতে হবে বলে কাজ রাখতেন না নিজের হাতে। ১২০ কিলোমিটার বাইক চালিয়ে নিয়ে যেতেন একাডেমিতে, কাজ রাখলেও রাখতেন সেই এলাকার আশপাশে।

আরও পড়ুন

দুঃস্বপ্ন থেকে স্বপ্নপূরণ

বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় দীপ্তি শর্মা।
ছবি: এক্স

২০১৭ বিশ্বকাপের ফাইনাল, ১২ বলে দরকার ১১ রান। এমন সময় উদ্ভট এক শট খেলতে গিয়ে আউট হয়ে গেলেন দীপ্তি শর্মা। বিশ্বকাপ হাতের মুঠোয় রেখে ফিরে আসার গল্পটা লিখেছিলেন সেদিন। ২০২২ সালে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ১ বলে ৪ রান থাকার সময় দিয়েছিলেন নো বল। ভারতের সেমিফাইনালে যাওয়ার স্বপ্ন রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। দুই ম্যাচেই ভারতের সব ক্ষোভ–ঘৃণার পাত্রী হয়েছিলেন দীপ্তি। ২০২৫ সালের চিত্রনাট্য একটু ভিন্ন। এই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় তিনি। ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ফাইনালে ৫০ রান আর ৫ উইকেট নেওয়া খেলোয়াড় দীপ্তি। ফিরে আসার গল্প বুঝি এভাবেই লিখতে হয়।

আরও পড়ুন

জবাব দেওয়ার গল্প

গানের সঙ্গে ব্যাট চালাতেও দারুণ জেমাইমা।
ছবি: এক্স

জেমাইমা রদ্রিগেজ বরাবরই একটু রসিক, ড্রেসিং রুমে গিটার নিয়ে থাকেন, ইনস্টাগ্রাম-টিকটকে তাঁর সরব উপস্থিতি। কিছুদিন আগেও বাজে ফর্মের কারণে দলে তাঁর জায়গাটা হয়ে পড়েছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বকাপের প্রথম তিন ম্যাচে দুইবার ডাক মেরে বাদ পড়েছিলেন একাদশ থেকে। সেই একাদশে ফিরলেন সতীর্থ প্রতীকা রাওয়ালের চোটে। নামেই যেন জবাব দিলেন ব্যাটে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাঁচামরার লড়াইয়ে অপরাজিত ৭৬ আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে রেকর্ড গড়া জয়ের ম্যাচে অপরাজিত ১২৭। দুই ম্যাচ দিয়েই জেমাইমা যেন শান্ত করে দিলেন লক্ষাধিক মুখকে।

আরও পড়ুন

খেলার জন্য ছেলেদের চুলের ছাঁট

খেলার জন্য ছেলেদের চুলের ছাঁট দিতেন শেফালি।
ছবি: এক্স

একাদশে তো দূরে থাক, অফ ফর্মের কারণে দলেই ছিলেন না। সতীর্থরা যখন বিশ্বকাপ খেলতে ব্যস্ত, তিনি ব্যস্ত লিগের খেলায়। হুট করে ডাক পড়ল, প্রতীকা রাওয়ালের চোটে দলে ডাকা হয়েছে তাঁকে। ব্যাগ গুছিয়ে চললেন দলের সঙ্গে যোগ দিতে। তারপর? ফাইনালে শেফালি ভর্মার ৭৮ বলে ৮৭ রানের ইনিংস হয়ে রইল ভারতের রক্ষাকবচ। অথচ ছোটবেলায় এই শেফালির খেলার সুযোগ ছিল না। তাঁর ভাইদের সঙ্গে চুল ছোট করে বাবা পাঠাতেন খেলাতে। একবার তো ভাই অসুস্থ থাকায় তাঁকে ভাইয়ের নামে খেলতেও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। ম্যাচসেরার পুরস্কার নিতে গিয়ে জানাজানি হয়, পুরো ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পর। সেই শেফালি ভারতকে বিশ্বজয়ী করেছেন ম্যাচসেরা হয়ে।

আরও পড়ুন