স্কুলের করিডরে এলেই কেমন একটা প্রতিধ্বনি শুনতে পায় ইভান। বিভিন্ন ক্লাস থেকে পাওয়া যায় বিচিত্র রকমের শব্দ। কোনো ক্লাস থেকে আসছে শিক্ষার্থীদের হাসির শব্দ। কোনো ক্লাসে হয়তো ডাস্টার দিয়ে লেকচার টেবিলের ওপর ঠকঠক করে বাড়ি দিচ্ছেন স্যার। ‘অ্যাই, কথা হবে না’ বলে চেঁচিয়ে উঠছেন ম্যাডাম। কিন্তু আজ এসবের কোনো কিছুই কানে ঢুকছে না ইভানের। করিডর দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে জাকির মামা। পেছনে জম্বির মতো হাঁটছে ইভান। জাকির মামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছে না সে। ওর মনে হচ্ছে, জুতার তলায় আলকাতরা লেগে আছে, মেঝের সঙ্গে আটকে যাচ্ছে বারবার। করিডরটাকেও অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছে। ক্লাসরুমগুলো ডানে–বাঁয়ে হেলে দুলছে।
‘দেরি কইরা কইলাম লাভ নাই মামা। তাড়াতাড়ি আসো।’ শ্লেষমাখা কণ্ঠে বলল জাকির মামা। দ্রুত পা চালাল ইভান। একটার পর এক ক্লাসরুম পেরিয়ে যাচ্ছে ওরা। ‘হোমওয়ার্ক আনে নাই কে কে?’, ‘তাহলে কী দাঁড়াল বিষয়টা? থার্ড বেঞ্চ…কর্নারে…তুমি বলো…’--প্রতিটা ক্লাসরুম পার হওয়ার সময় স্যার-ম্যাডামদের কথাগুলো ভেসে আসছে ইভানের কানে। ক্লাসের লেকচার অগ্রাহ্য করে জানালা দিয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে কৌতূহলী ছেলেরা। দু–একজন শিক্ষকও আড়চোখে তাকালেন ইভানের দিকে। ফার্স্ট পিরিয়ডে একজন ছাত্র বেরিয়ে যাচ্ছে ক্লাস থেকে, দপ্তরির হাতে তার স্কুলব্যাগ—গন্তব্য কোথায় বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কারও। ইভানের মনে হলো তাকিয়ে থাকা কৌতূহলী চোখগুলো বলছে—‘যাও বাবা, আজকে খেলা হবে।’ দপ্তরি জাকির মামার চোখেমুখে বিজয়ীর ভঙ্গি। ভাবটা এমন, যেন অনেক দিন ধরে খুঁজতে থাকা আসামিকে এইমাত্র ধরেছে সে। মামার ডান হাতে ইভানের ব্যাগ। বাঁ হাতটা পেছনে ভাঁজ করে কোমরের ওপর রেখে বেশ ভাব নিয়ে হাঁটছে সে। হাঁটার এই ভঙ্গি ইভানের খুব পরিচিত। ওদের হেডস্যার এভাবেই হাঁটেন। হেডস্যারের হাঁটার ভঙ্গিটা অবিকল অনুকরণ করে জাকির মামা (অবশ্যই হেডস্যারের সামনে নয়)। ইভানরা আড়ালে তাকে ডাকে ‘হেডু লাইট’। হেডসারের লাইট ভার্সন।
সিঁড়ি দিয়ে এক তলায় নেমে এল ওরা। পদবি ‘হেডস্যার’ হলেও তাঁর কক্ষটা এক তলায় কেন, এটার ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না ইভান। হেড যেহেতু সবার ওপরে, হেডস্যারের রুমটাও হওয়া উচিত একেবারে ওপরের তলায়—ভাবল সে। হেডস্যারের রুমের সামনে সব সময়ই একটা ব্যস্ততা থেকে। কয়েকজন কর্মচারী ছোটাছুটি করে অযথা। ইভান দেখল, কয়েকজন শিক্ষক বেরিয়ে আসছেন হেডস্যারের রুম থেকে। তাঁদের মধ্যে একজন রফিক স্যার, ইভানদের আইসিটি শিক্ষক। ইভানকে দেখেই বললেন, ‘মোবাইল আইনা ধরা খাইছ, তাই না? এই মোবাইল জিনিসটা শেষ করে দিল আজকালকার পোলাপানরে। যাও, ঘুইরা আসো।’
কোনো জবাব দিল না ইভান। মোবাইল ছাড়াও আরও একটা জিনিস পাওয়া গেছে তার ব্যাগে—ছুরি। ব্যাগে ছুরি পাওয়ার কী ব্যখ্যা দেবে তা ভাবতেই পারছে না সে। হেডস্যার নিশ্চয়ই একটা তদন্ত কমিটি করবেন। স্যাররা থাকবেন সেই কমিটিতে। তদন্ত করলেই দেখা যাবে সে নির্দোষ। তা ছাড়া তাকে তো হেডস্যার ভালো করেই চেনেন। স্কুলে ছুরি নিয়ে আসার মতো ছেলে সে নয়, হেডস্যারের তা ভালোমতোই জানার কথা।
হেডস্যারের রুমের কাছে এসে হাঁটার গতি বেড়ে গেল জাকির মামার। দরজার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে মামা বলল—
‘স্যার, ওরে নিয়া আসছি স্যার।’ স্যারের ইঙ্গিত পেয়ে ভেতরে ঢুকল সে। এক মুহূর্ত পর ইশারায় ভেতরে ঢুকতে বলল ইভানকে।
‘আসসালামুআলাইকুম স্যার।’ মাথা নিচু করে সালাম দিল ইভান। হেডস্যার কোনো জবাব দিলেন না। আঙুলের আলতো ধাক্কায় ওপরে ওঠালেন নাকের ডগায় চলে আসা চশমাটা। ভ্রু কুঁচকে তাকালেন দপ্তরি জাকিরের দিকে। দ্রুত হাতে ব্যাগ খুলে ছুরিটা বের করল জাকির মামা। ‘এইটা পাইছি স্যার ওর ব্যাগে।’ ছুরিটা স্যারের সামনের টেবিলে ওপরে রেখে দিল সে। স্যার তখনো নিশ্চুপ। গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছেন টেবিলে রাখা ছুরিটার ওপর।
‘কী সাংঘাতিক! চিন্তা করা যায় স্যার?’ পাশ থেকে বলে উঠলেন সালেহ স্যার। ‘আজকালকার ছেলেপেলে তো ভয়ংকর। ভয়ই লাগে স্যার। কোন দিন খবরে হেডলাইন দেখবেন– ‘নাম্বার কম দেওয়ায় ছাত্রের হাতে শিক্ষক খুন!’
‘আহা, আপনি থামুন তো সালেহ স্যার।’ ভরাট গলায় বললেন হেডস্যার।
বড় বড় দুটো আলমারি স্যারের রুমে। মাঝখানে দেয়ালে ঝোলানো প্রধান শিক্ষকদের নামের তালিকা। তার নিচে ডান পাশে একটা লম্বা শোকেস। বেশ কয়েকটা ট্রফি সাজানো আছে শোকেসে। বেশির ভাগই রানার্সআপ কিংবা দ্বিতীয়-তৃতীয় পুরস্কার। ইভানদের স্কুল এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।
‘না না, আপনি ব্যাপারটা হালকাভাবে নেবেন না স্যার। সেদিন ক্লাস এইটের এক ছেলেকে সামান্য একটু কড়া কথা বলেছি। ওরে বাবা, সে এমন লুক দিল, যেন চোখ দিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে আমাকে। ভয়ই লাগে স্যার। আমাদের সময় শিক্ষকেরা ছাত্রদের মারতেন। এখন তো দেখছি উল্টো ঘটনা। চাকরিবাকরি ছেড়ে কৃষিকাজ শুরু করতে হবে। জমানো টাকা তুলে দুটি সিএনজি কিনে ভাড়া দিয়ে দেব। জানের ভয় নাই।’
‘সালেহ স্যার, কথা কি আপনিই বলবেন? বলেন। আমি তাহলে চা খেতে খেতে আপনার কথা শুনি। অ্যাই, চা দাও তো এক কাপ…বলেন স্যার। শুরু করেন।’
‘না স্যার, আমি কথা বললাম কোথায়? আমি তো আপনার সামনে কথা বলার সাহসই পাই না। যাই স্যার, একটু পর আমার ক্লাস।’
স্যারের কথা শুনে এই বিপদের মধ্যেও হাসি পেল ইভানের। টেবিলে পত্রিকা বিছিয়ে পড়তে শুরু করলেন হেডস্যার। খালা এসে চায়ের কাপ রেখে গেল তার সামনে। সঙ্গে এক প্যাকেট লেক্সাস বিস্কুট। স্যার সশব্দে চায়ে চুমুক দিয়ে পত্রিকা পড়া শুরু করলেন। অস্বস্তিতে পড়ে গেল ইভান। স্যার কি কিছু বলবেন না? নাকি অপেক্ষা করছেন আমার কথা শোনার জন্য? ‘স্যার…।’ ইতস্তত করল ইভান। কোনো ভ্রুক্ষেপই হলো না স্যারের। আগের মতোই এক মনে পত্রিকা পড়ছেন তিনি। এদিক ওদিক তাকাল ইভান। বিশাল এই রুমে সে, হেডস্যার আর জাকির মামা—আর কেউ নেই। রুমের বাইরে লোকজনের হাঁটাহাঁটির শব্দ, কোলাহল শোনা যাচ্ছে। কয়েক ধাপে আটকে শেষমেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইভান।
এত মনোযোগ দিয়ে আগে কখনো হেডস্যারের রুমটা দেখা হয়নি ওর। স্যারের টেবিলটা বিশাল, খুব আরাম করে টেবিল টেনিস খেলা যাবে এখানে। টেবিলের ওপরে মোটা কাচ। প্রথম আলো ছাড়াও একটা ইংরেজি পত্রিকা আছে। ওপরে লেখা সৌজন্য সংখ্যা। স্যারের সামনে দুটো ক্যালকুলেটর। একটা টিস্যুবক্সও আছে তাঁর হাতের কাছে। একপাশে তিনটা ফুলদানি। দুটোর মধ্যেই প্লাস্টিকের ফুল রাখা। আর একটাতে কোনো ফুলই নেই। বাঁ হাতের কাছে বড় কাচের মগে পানি ঢাকা দিয়ে রাখা। পেনস্ট্যান্ডে অনেকগুলো কলম, পেনসিল, মার্কার। একপাশে দুটো স্ট্যাপলার, ডেস্ক ক্যালেন্ডার। সবকিছু এত পরিপাটি করে গোছানো, দেখে মনে হয় এগুলো জাদুঘরের জিনিস, ব্যবহার করাই হয় না।
বড় বড় দুটো আলমারি স্যারের রুমে। মাঝখানে দেয়ালে ঝোলানো প্রধান শিক্ষকদের নামের তালিকা। তার নিচে ডান পাশে একটা লম্বা শোকেস। বেশ কয়েকটা ট্রফি সাজানো আছে শোকেসে। বেশির ভাগই রানার্সআপ কিংবা দ্বিতীয়-তৃতীয় পুরস্কার। ইভানদের স্কুল এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। টেবিলের ঠিক বিপরীত দিকে একটা ফটোকপি মেশিন। কম্পিউটার টেবিল…
‘মাস্তানি করতে আসছ স্কুলে? বহুত মাস্তান দেখা আছে আমার।’
হঠাৎ হেডস্যারের ঝাড়ি শুনে চমকে উঠল ইভান। ‘জি স্যার…’
‘স্কুল কি মাস্তানির জায়গা?’
‘স্যার…আমি জানি না এটা কীভাবে আমার ব্যাগে…’
‘জানো না? ছুরিটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ দেখল, তুমি ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছ, লাফ দিয়ে তোমার ব্যাগে ঢুকে গেল?’
‘জি না স্যার।’
‘বাবা কী করে?’
‘দেশের বাইরে থাকে স্যার।’
‘বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠায়, আর সেটা দিয়ে তুমি ছুরি চাকু চাপাতি কিনে ঘোরো?’
‘জি না স্যার।’
‘মায়ের নাম্বার বলো। তোমার মাকে ডেকে পাঠাব।’
‘মা নাই স্যার, মারা গেছে।’
হেডস্যার চশমা খুলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
‘আচ্ছা, গার্ডিয়ান কে তোমার?’
‘ফুপু।’
‘ফোন নাম্বার লেখো এখানে। ওনাকে আসতে বলব। উনি আসুক, তারপর তোমাকে টিসি দিয়ে বের করে দেব স্কুল থেকে। মাস্তান ছাত্রের দরকার নাই আমার।’
‘স্যার প্লিজ…স্যার, বিশ্বাস করেন স্যার, আমি এটা আনি নাই। আমি কিছুই জানি না।’
‘বের হও। বের হয়ে রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকো।’
‘স্যার…’
‘আবার কথা বলে? যাও বের হও।’
বারান্দায় এসে পুরো ব্যাপারটা শুরু থেকে ভাবল ইভান। ছুরিটা ব্যাগে এল কী করে? কে করল কাজটা? এই কয়েক মাসে তো কারও সঙ্গেই কোনো ঝামেলা হয়নি ওর। বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে রইল ইভান। হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে হাত–পা ঠান্ডা হয়ে গেল ওর। একটা পুলিশের গাড়ি এসে থেমেছে স্কুলের গেটে। হেডস্যার পুলিশে খবর দিয়েছেন! ভাবতে পারল না ইভান। কোনো কথা না শুনেই হেডস্যার পুলিশ ডেকে আনবেন—এটা কল্পনাও করেনি সে। এখন কী হবে?
গাড়ি থেকে নেমে এলেন দুজন পুলিশ সদস্য। হাতে ওয়াকিটকি। স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকে সোজা ইভানের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন দুজন। আতঙ্কে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইভান। কিন্তু ওকে কিছু না বলে দুই পুলিশ সদস্য গিয়ে ঢুকলেন হেডস্যারের রুমে। একটু পর রুম থেকে ছুটে বের হলো জাকির মামা। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না ইভান। পাঁচ-সাত মিনিট পর জাকির মামা ফিরে এল আবার। সঙ্গে একটি মেয়ে। কাঁধ পর্যন্ত চুল। চোখে চশমা। ভয়ে ভয়ে হেডস্যারের রুমে ঢুকে গেল মেয়েটা। ‘মামা, কী ব্যাপার? পুলিশ কেন?’ জাকির মামাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ইভান। কোনো জবাব না দিয়ে হনহন করে চলে গেল জাকির মামা। হেডস্যার ছাড়া আর কাউকে গোনার সময় নেই তার আজ।
‘কোত্থেকে যে আসে এসব পাগল ছাগল!’ বিরক্তি ঝাড়ল ইভান। হেডস্যারের রুম থেকে কথার গুঞ্জন ভেসে আসছে। বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল ইভান। হেডস্যার রুম থেকে সিঁড়ির কাছে আসতেই ‘এই যে!’ বলে ডাক দিল কে যেন। ইভান পেছনে তাকিয়ে দেখে সেই মেয়েটা।
বেশ কিছুক্ষণ পর চিন্তিত মুখে বেরিয়ে এল মেয়েটা। ডান দিকে ঘুরেই দ্রুত সিঁড়ির দিকে এগোল সে। আবার ফিরে এল একমুহূর্ত পরই। ডানে–বাঁয়ে তাকিয়ে কী যেন ভেবে উদ্ভ্রান্তের মতো আবার ছুটল সিঁড়ির দিকে। ‘কিরে ভাই, পাগল নাকি?’ মনে মনে বলল ইভান। একটু পর আবার এল মেয়েটা। নার্ভাস ভঙ্গিতে ইভানকে বলল—
‘আচ্ছা, তুমি কি এই স্কুলের?’ প্রচণ্ড বিরক্ত হলো ইভান।
‘তোমার কি মনে হয়? অন্য স্কুল থেকে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি? অন্য স্কুলে বারান্দা নাই?’
‘উফ! সরি, আমি এই স্কুলে নতুন এসেছি। এই মেইন গেটটা ছাড়া স্কুল থেকে বের হওয়ার আর কোনো গেট আছে?’
মেয়েটা এত দ্রুত কথাগুলো বলল, কিছু বুঝতেই পারল না ইভান। কোনোমতে সে বলল,
‘মানে কী?’
‘মানে আমাকে বের হতে হবে। মেইন গেট দিয়ে বের হতে পারব না। হেল্প করো প্লিজ।’
‘কেন?’
‘আরে ভাই, এত প্রশ্ন করো না তো। হেল্প করবে কি না, বলো।’
‘দেখো, আমি খুব ঝামেলায় আছি। পুলিশ-টুলিশ চলে এসেছে। আমি আর কোনো ঝামেলার মধ্যে নাই।’
‘পুলিশ তো এসেছে আমাকে নিতে।’
‘মানে?’
‘এত কথা বলার সময় নাই। তুমি হেল্প করবা কি না, বলো। এত টাইম নাই আমার।’
‘ডিটেইল না বললে আমি কিছুই করব না।’ ঘুরে আবার মাঠের দিকে তাকাল ইভান।
‘ঠিক আছে। লাগবে না তোমার হেল্প।’ এক ঝটকায় ঘুরে সিঁড়ির দিকে ছুটল মেয়েটা। ইভান দেখল আড়চোখে। ঘুরল সে-ও। পেছন থেকে ডেকে বলল, ‘আমি একটা রাস্তা চিনি।’
ঘুরে একবার ইভানের দিকে তাকাল মেয়েটা। তারপর দৌড়ে চলে গেল ওপরে।
‘কোত্থেকে যে আসে এসব পাগল ছাগল!’ বিরক্তি ঝাড়ল ইভান। হেডস্যারের রুম থেকে কথার গুঞ্জন ভেসে আসছে। বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল ইভান। হেডস্যার রুম থেকে সিঁড়ির কাছে আসতেই ‘এই যে!’ বলে ডাক দিল কে যেন। ইভান পেছনে তাকিয়ে দেখে সেই মেয়েটা। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির সামনে। এক মুহূর্ত ভেবে মেয়েটার দিকে এগোল ইভান।
‘কী?’
‘উফ! স্যারদের মতো বারবার প্রশ্ন করবা না। চুপচাপ শোনো, আমি বলছি। যে পুলিশ দুটোকে দেখছ, ওরা আসলে নকল পুলিশ। আমি শিওর, ওরা আমাকে কিডন্যাপ করতে এসেছে। পুলিশ পরিচয় দিয়ে হেডস্যারকে বলেছে, বাবা ওদেরকে পাঠিয়েছে, আমাকে নিতে। আমার নাকি বিপদ। আসলে কিন্তু বাবা ওদের পাঠায়নি।’ একটানা কথা বলে হাঁপিয়ে উঠল মেয়েটা। সিঁড়ি থেকে একটু দূরে সরে গেল ওরা। ইভান বলল,
‘তুমি কী করে বুঝলে ওরা নকল?’
‘পুলিশের ড্রেস খুব ভালো করে চিনি আমি।’
‘সেটা আমরা সবাই চিনি।’
‘আমার মতো করে চেন না। আমার বাবা এখানকার থানার নতুন ওসি।’
‘বলো কী?’
‘জি। বাবা একটা কনফারেন্সে আছে। আমি চাইলেও এখন তাকে রিচ করতে পারব না। সো, প্রথম কাজ হচ্ছে এখান থেকে পালানো। নইলে কোনো না কোনোভাবে ওরা আমাকে নিরাপত্তার অজুহাতে দেখিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবে। তারপর যে কোথায় নিয়ে যাবে কেউ জানে না। এখন হেল্প করো আমাকে, প্লিজ। তুমি যে রাস্তার কথা বললে, ওটা কোথায়?’
‘তুমি হেডস্যারকে বললে না কেন?’
‘তোমার মনে হয় হেডস্যার আমার কথা বিশ্বাস করবে? উনি তো আমাকে চেনেই না। বললাম না, আমি নতুন এসেছি। তুমি কি যাবা এখন?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘তাহলে আমার সময় নষ্ট করলা কেন? এতক্ষণে আমি নিজেই কিছু একটা করে ফেলতাম।’
এক মুহুর্ত ভাবল ইভান। বিপদ যা হবার হয়ে গেছে। এত ভেবে লাভ নেই। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি ওয়ালে উঠতে পারবে?’
‘পারব না কেন?’
‘ওকে। চলো তাহলে।’
সিঁড়িটা পেরিয়ে করিডরের একেবারে শেষ মাথায় চলে গেল ওরা। তারপর ডানে ঘুরতেই স্কুলের বাগান। বাগানের গাছপালার ভেতর দিয়ে এগোল ইভান। একটু ইতস্তত করে মেয়েটাও এল তার পেছন পেছন। কিছুদূর হাঁটার পর আরেকটা করিডরে উঠে এল ওরা। এখান দিয়েই যেতে হয় প্রাইমারি স্কুলের বিল্ডিংয়ে। কোনোভাবে প্রাইমারি স্কুলের পেছনে যেতে পারলেই কাজ হয়ে যাবে। পেছনের দেয়ালটা বেয়ে লাফ দিলেই কম্পাউন্ডের বাইরে চলে যাবে ওরা।
‘অ্যাই ছেলে, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল কেউ। থমকে দাঁড়াল ওরা। ইভান পেছনে ঘুরে দেখল স্কুলের সবচেয়ে কড়া দিলশাদ ম্যাডাম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে।
চলবে...
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619