দুই হাতের তালু ঠান্ডা হয়ে গেছে, টের পেল ইভান। দ্রুত পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে এলেন দিলশাদ ম্যাডাম। ‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা? ক্লাস নাই?’ ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ‘প্রাইমারিতে যাচ্ছি ম্যাডাম।’ চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ইভান।
‘কেন? প্রাইমারিতে তোমাদের কী ব্যাপার?’
‘ক্লাবের ব্যাপারে একটু কথা ছিল, ম্যাডাম।’
‘কোন ক্লাব?’
‘ম্যাডাম…’
‘বুক ক্লাব।’ পাশ থেকে বলে উঠল মেয়েটা। মনে মনে নিজের কপাল চাপড়াল ইভান। কোনো বুক ক্লাব নেই তাদের স্কুলে। মেয়েটা নতুন, না জেনেই আন্দাজে একটা কথা বলে দিল? এখন আবার কোন ঝামেলায় পড়তে হবে কে জানে।
‘বুক ক্লাব?’ ভ্রু কুঁচকে মেয়েটার দিকে তাকালেন দিলশাদ ম্যাডাম।
‘জি ম্যাডাম। ম্যাডাম, আপনি তো জানেন, ছেলেমেয়েরা এখন বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ জন্য আমরা ঠিক করেছি ওদের কিছু বই দিয়ে আসব। ওরা সেগুলো পড়ল কি না, সেটা বোঝার জন্য আমরা একটা কুইজ করব মাস শেষে। বই আমি ব্যাগে নিয়েই এসেছি।’ ব্যাগ খুলে মুহম্মদ জাফর ইকবালের দস্যি ক’জন বইটা বের করল মেয়েটা। ওর কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেল ইভান।
ম্যাডাম চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে। ‘শেষ আমরা। ধরা খাব এখনই।’ ভাবল ইভান। ‘তোর কেন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে হবে? এহ, বুক ক্লাব বোঝাচ্ছে ম্যাডামকে। পড়ার বাইরের বইয়ের কথা শুনলে আরও খেপে যাবেন ম্যাডাম…’
‘নাইস আইডিয়া।’ গম্ভীর মুখে বললেন ম্যাডাম। তোমাকে তো আগে দেখিনি। নাম কী তোমার?’
‘ম্যাডাম, আমার নাম রুশা। আমি এ স্কুলে নতুন এসেছি।’ মেয়েটার দিকে তাকাল ইভান। ‘রুশা? এটা আবার কেমন নাম? যার নাম রুশা, তাকে দাও ঘুসা।’ ভাবল সে।
‘ঠিক আছে। যাও তোমরা।’ ঘড়ি দেখে বললেন ম্যাডাম। ‘আর শোনো, ক্লাবের ব্যাপারে কোনো হেল্প লাগলে সোজা আমার কাছে চলে আসবে। হেজিটেট করবে না একদম। ঠিক আছে?’
জি ম্যাডাম, অবশ্যই। আপনার পরামর্শ ছাড়া আমরা বেশি দূর যেতে পারব না, ম্যাডাম। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’ রুশা বলল।
ঘুরে ক্লাসের দিকে চলে গেলেন দিলশাদ ম্যাডাম। ‘ভাই! এই মেয়ে তো ডেঞ্জারাস!’ ভাবল ইভান। ‘পাম-পট্টি দিয়ে ম্যাডামকেও ম্যানেজ করে ফেলল! সৌম্য সরকার যেমন মাঝে মাঝে জায়গায় দাঁড়িয়ে শট খেলে, ঠিক সে রকম অন দ্য স্পট মিথ্যা কথা বলে দিল গরগর করে! অন্য কোনো বিপদে পড়ার আগেই ওর কাছ থেকে কেটে পড়তে হবে।’
‘আরে কী আশ্চর্য, দাঁড়িয়ে আছ কেন খাম্বার মতো?’ চাপা স্বরে বলল রুশা। ‘চলো।’
‘হ্যাঁ, যাচ্ছি। তুমি তো খুব ভালো মিথ্যা বলতে পারো।’
‘এইসব একটু পারতে হয়। জানো না, একটু চালাক না হলে দুনিয়াতে টেকা কঠিন।’
‘ওরে বাপরে! আচ্ছা, তোমার ব্যাগে কি সব সময় বই থাকে?’
‘শুধু বই না, আমার ব্যাগে অনেক কিছুই থাকে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইভান। ‘ছুরি নিশ্চয়ই থাকে না।’ মনে মনে বলল সে। নিজের ব্যাগের কথা একদম ভুলেই গিয়েছিল সে। ব্যাগের কথা মাথায় আসতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কী অপেক্ষা করছে ওর ভাগ্যে কে জানে। দ্রুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল চিন্তাটা।
করিডর ধরে এগোতে শুরু করল ওরা। বাঁ পাশে ছোট একটা মাঠ। প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চারা এখানে খেলাধুলা করে। মাঠের ভেতর দিয়ে কোনাকুনি পথ ধরে চলল ওরা। ওপাশে প্রাইমারি স্কুলের পুরোনো একতলা ভবন। ‘এখন আর এখানে ক্লাস হয় না।’ ভবনটা দেখিয়ে বলল ইভান বলল।
‘সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। নতুন বিল্ডিং হয়ে গেছে, পুরানোটায় ক্লাস হবে কেন?’ মুখটা একটু বাঁকা করে বলল রুশা।
‘সেটাই। এখন এটা স্টোররুম হিসেবে ইউজ হয়। অনেকে বলে এই স্টোররুমে নাকি ভূত আছে।’
‘এসব কথা আমাকে বলছ কেন? আমি কি তোমার কাছে কী-কেন-কীভাবে টাইপ প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছি?’
রুশার কথায় গা জ্বলে গেল ইভানের। ‘অদ্ভুত তো মেয়েটা! ওর উপকার করতে আসাই ভুল হয়েছে আমার।’ থমকে দাঁড়িয়ে ভাবল সে।
‘আরে, কী সমস্যা?’ তাড়া দিল রুশা। জবাব না দিয়ে দ্রুত পা চালাল ইভান। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে ওর।
পুরোনো ভবনের পেছনে চলে এল ওরা। হাত দিয়ে মাকড়সার জাল সরিয়ে নিল ইভান। রোদ পড়ে না এদিকটায়। স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ। পাশের বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটগুলোর জানালা থেকে নিয়মিত ময়লা ফেলা হয় দেয়ালের এই পাশে। তাই পুরো জায়গাটাই নোংরা হয়ে আছে। নতুন বিল্ডিংয়ে যাওয়ার পর থেকে এই জায়গাটা আর পরিষ্কার করা হয়নি। লম্বা ড্রেনটা খোলা, উৎকট গন্ধ আসছে সেখান থেকে। হাত দিয়ে নিজের নাক চেপে ধরল রুশা। একটা বড় ইঁদুর দৌড়ে পালিয়ে গেল ওর পায়ের সামনে দিয়ে। চমকে উঠল রুশা। পাত্তাই দিল না ইভান। বড় একটা লাফ দিয়ে ড্রেনটা পার হয়ে গেল সে। রুশার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এভাবে লাফ দিয়ে এই পাশে আসতে হবে। পারবে?’ নাক চেপে ধরেই মাথা নাড়ল রুশা। পারবে সে।
‘মিস করলেই কিন্তু ড্রেনে গিয়ে ল্যান্ড করবে। সাবধান। ড্রেনে পড়ে গেলে কিন্তু আমি তোমাকে ওঠাব না।’ সাফ জানিয়ে দিল ইভান।
‘ড্রেনে পড়ব কেন?’
‘আমাদের এক বন্ধু স্কুল পালাতে গিয়ে এই ড্রেনে পড়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে যেতে হয়েছিল তাকে।’
‘কেন? এটা কি অনেক গভীর?’ চিন্তিত হলো রুশা।
‘আরে না। দুর্গন্ধেই জ্ঞান হারিয়েছিল গাধাটা। এখনো মাঝে মাঝে ওর পাশে বসলে ড্রেনের গন্ধ পাই আমরা।’
‘খুবই লেম জোক।’
‘আচ্ছা। আমি আর কিছু বলব না। আসো তাহলে। আমি আছি, সমস্যা হলে ধরে ফেলব।’
‘খবরদার, তোমাকে ধরতে হবে না। এটুকু পার হওয়া কোনো ব্যাপারই না।’
মুখে বললেও একটু ভয়ই পেল রুশা। ড্রেনটা বেশ চওড়া, পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষ পড়ে গেলেও অবাক হবে না সে। বেকায়দায় পড়ে গেলে মাথা ফাটা কিংবা পা ভাঙারও আশঙ্কা আছে। কাঁধ থেকে ব্যাগটা খুলে ওপাশে ছুড়ে দিল রুশা। তারপর পিছিয়ে গেল কিছুটা। নিশ্বাস নিল বড় করে। ইভানের দিকে তাকিয়ে ছুটে গিয়ে লম্বা একটা লাফ দিল। এক লাফে ড্রেন পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে নামল রুশা। বেশি জোরে লাফ দেওয়ায় বেকায়দায় পড়ল পা, ভারসাম্য হারাল সে। পড়ে যাওয়া ঠেকাতে রুশা হাত বাড়াল ইভানের দিকে। হাতটা ধরল না ইভান। রুশার হাঁটু গিয়ে ঠেকল মাটিতে। ব্যথায় ককিয়ে উঠল সে।
অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল ইভান। ‘একদম ঠিক আছে। খুব ত্যাড়া কথা বলছিল আমার সাথে। এবার বোঝো।’
‘তুমি ধরলে না কেন?’ চোখ-মুখ কুঁচকে বলল রুশা।
‘তুমিও তো নিষেধ করলে।’ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল ইভান। কোনোমতে উঠে দাঁড়াল রুশা। হাঁটুতে ময়লা লেগে গেছে ওর। হাত দিয়ে ময়লাগুলো একটু ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। মাটিতে পড়ে থাকা ব্যাগটা তুলে নিল কাঁধে। তারপর বলল,
‘এখন কী করব?’
‘এই দেয়ালটা বেয়ে উঠতে হবে।’ বাঁ পাশের শ্যাওলাধরা দেয়ালটা দেখাল ইভান। সিমেন্ট উঠে ইটগুলো বেরিয়ে আছে নির্লজ্জের মতো। ‘ইটগুলো ধরে ধরে ওপরে উঠবে। তারপর একইভাবে ইটে পা রেখে রেখে ওপাশে গিয়ে নামবে।’
‘আচ্ছা।’ মাথা নাড়ল রুশা। ‘আগে তুমি ওঠো।’
‘কেন?’
‘উফ্! তোমাকে বলেছি উঠতে, উঠবে। এত প্রশ্ন করো কেন?’
স্কুলের টয়লেটের দেয়াল রীতিমতো একটা আর্ট গ্যালারি মনে হয় ইভানের কাছে। ছেলেরা তাদের যাবতীয় প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় টয়লেটের দেয়াল আর ক্লাসের বেঞ্চে। কত ছবি, কার্টুন, তত্ত্ব, সূত্র যে লেখা আছে টয়লেটের দরজা আর দেয়ালগুলোতে, তার কোনো হিসাব নেই।
ইভানের কাছে এই দেয়াল খুবই পরিচিত। তরতর করে দেয়ালের খাঁজে পা রেখে ইটগুলো ধরে ওপরে উঠে গেল সে। ও যেভাবে উঠেছে, ঠিক সেভাবেই ধীরে ধীরে উঠে পড়ল রুশা। পুরোনো জীর্ণ দেয়ালের ওপর পাশাপাশি দাঁড়াল দুজন। ইভান বলল, ‘বেশিক্ষণ থাকা যাবে না এখানে। লোকজন দেখলে ঝামেলা করতে পারে। তুমি সাবধানে নেমে যাও।’
‘আচ্ছা।’ ব্যাগটা আবার ইভানের হাতে দিয়ে নামতে শুরু করল রুশা।
ওঠার চেয়ে নামাটাই বেশি কঠিন মনে হলো রুশার। আন্দাজের ওপর ভর করে পা ঘষে খুঁজতে হচ্ছে ইটগুলো। এক–দুবার পিছলেও গেল। দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে কোন দিকে পা রাখতে হবে বলে দিচ্ছিল ইভান। মাঝামাঝি এসেই লাফ দিয়ে নিচে নেমে গেল রুশা। ওপর থেকে ব্যাগটা ওর হাতে ফেলল ইভান।
‘থ্যাংকস।’ বলল রুশা।
‘সাবধানে যাও। এখান থেকে ঘুরে যেতে হবে মেইন রোডে। দূর আছে। রিকশা নিয়ে নিয়ো।’
‘ঠিক আছে।’
ঘুরে এগোতে গিয়েই আবার ফিরল রুশা।
‘আবার কী?’ বলল ইভান।
‘তোমার কাছে টাকা হবে?’
‘না।’
‘৫০ টাকা হলেই চলবে। পরে দিয়ে দেব।’
‘মনে করে দিয়ো।’ নিচু হয়ে দেয়ালে বসে রুশার দিকে ৫০ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিল ইভান। হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল রুশা।
‘থ্যাংকস।’
দ্রুত দেয়াল বেয়ে নামতে শুরু করল ইভান। ওপাশ থেকে আবার চেঁচিয়ে উঠল রুশা।
‘এই, শোনো শোনো!’
‘আরে কী!’
‘তোমার নামটা তো বললে না।’
‘আমি ইভান।’ মাটিতে নেমে চেঁচিয়ে বলল ইভান। ‘ক্লাস টেন। খ শাখা।’
যেভাবে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই লাফিয়ে ড্রেন পার হলো ইভান। দ্রুত মাঠ পেরিয়ে চলে গেল প্রাইমারি স্কুলের করিডরে। এখন কোনো স্যার বা ম্যাডামের সামনে না পড়লেই হয়। দ্রুত বাগানের ভেতর দিয়ে চলে এল ওদের স্কুলের বিল্ডিংয়ে। হাত-মুখ ধোয়া দরকার। দোতলায় উঠে সোজা টয়লেটে চলে গেল ইভান।
স্কুলের টয়লেটের দেয়াল রীতিমতো একটা আর্ট গ্যালারি মনে হয় ইভানের কাছে। ছেলেরা তাদের যাবতীয় প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় টয়লেটের দেয়াল আর ক্লাসের বেঞ্চে। কত ছবি, কার্টুন, তত্ত্ব, সূত্র যে লেখা আছে টয়লেটের দরজা আর দেয়ালগুলোতে, তার কোনো হিসাব নেই। বেসিনের সামনে এসে কল ছাড়ল ইভান। চোখে–মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিতেই মনটা জুড়িয়ে গেল ওর। এতক্ষণ পর এই প্রথম একটু ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ পেল ইভান। নোংরা ঘোলা আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখল একবার। সকাল থেকে বেশ ধকল গেছে ওর ওপর। মাথায় একটু পানি দিয়ে ঠিক করে নিল এলোমেলো চুলগুলো। বড় করে দম নিল কয়েকবার। বেসিনের কলটা বন্ধ করতেই চমকে উঠল ইভান। একটা বিষয় এতক্ষণ খেয়ালই করেনি সে। এইমাত্র টের পেল, শুরু থেকেই ওর সঙ্গে মিথ্যা বলেছে রুশা। কিন্তু কেন?
ঠিক তখনই ঢং ঢং করে বেজে উঠল স্কুলের ঘণ্টা। এইমাত্র শেষ হলো দ্বিতীয় পিরিয়ড।
*
হেডস্যারের রুমে বসে অধৈর্য হয়ে পা নাচাচ্ছেন এসআই শাহ আলম। তাঁর সামনে চায়ের কাপ, পিরিচে লেক্সাস বিস্কুট। চা শেষ হয়ে গেছে বেশ আগেই। বিস্কুট ছুঁয়েও দেখেননি শাহ আলম। পাশে বসা কনস্টেবল আজিজুল অবশ্য চায়ে ডুবিয়ে বিস্কুট খাচ্ছেন। টেবিলের দিকে ঝুঁকে চায়ে ভেজা বিস্কুট মুখে তুলতে গেলেন আজিজুল। বিস্কুটের অর্ধেক ভেঙে টুপ করে পড়ল চায়ের কাপে। ছিটকে টেবিলের ওপর পড়ল চায়ের ফোঁটা। আঙুল দিয়ে ডুবে যাওয়া বিস্কুট ওঠানোর চেষ্টা করছেন আজিজুল। বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে তাকালেন এসআই শাহ আলম। হেডস্যারকে বললেন,
‘অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল, স্যার। এত দেরি হচ্ছে কেন?’
‘বুঝতে পারছি না।’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন হেডস্যার। পরপর দুইবার টেবিলের কলিংবেলের সুইচ চাপলেন অধৈর্য হয়ে। ছুটে এল নুরু মিয়া।
‘জে স্যার?’
‘দেখো তো জাকির কোথায়। এত দেরি করছে কেন?’
‘জে।’
‘আরেক কাপ চা দিতে বলব?’ এসআই শাহ আলমের দিকে তাকিয়ে বললেন হেডস্যার।
‘না।’
‘দিনকাল তো ভালো না, কী বলেন? ছিনতাই বেড়ে চলছে। রাস্তায় বের হওয়াই মুশকিল।’
‘ছিনতাই কমেছে আগের চেয়ে।’ বিস্কুট চিবোতে চিবোতে পাশ থেকে বললেন কনস্টেবল আজিজুল।
‘তাই নাকি?’ জিজ্ঞেস করলেন হেডস্যার।
‘জি। আগের মতো ছিনতাই এখন হয় না। তবে ডাকাতি অনেক বেড়েছে। সংঘবদ্ধ ডাকাতি।’
‘আচ্ছা।’
‘দুই দিন আগেও তো একটা খুনও হইল।’
‘বলেন কী!’
‘জি স্যার। একদম ছুরিকাঘাতে মৃত্যু। মেইন রোডের মাথায় বডি পাওয়া গেছে। আননোন বডি।’
‘আহহা, আপনি চুপ করেন তো। চা খান চুপচাপ। নেন, আমার পিরিচের বিস্কুটগুলাও খান।’ মৃদু ধমক দিলেন এসআই শাহ আলম।
শুধু আজিজুল নন, হেডস্যারও চুপসে গেলেন। পুরো রুমে নীরবতা। আজিজুলের চা খাওয়ার সুড়ুত সুড়ুত শব্দ হচ্ছে শুধু। এমন সময় দরজার পর্দা দুলিয়ে ছুটে এল স্কুলের দপ্তরি জাকির। পেছনে নুরু মিয়া। জাকির হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘স্যার, গ্যাঞ্জাম হইয়া গেছে স্যার। ওই মেয়েরে তো খুঁইজা পাইতেছি না।’
‘বলো কী?’ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন হেডস্যার।
‘জি স্যার। ক্লাসরুম, কমনরুম কোথাও নাই। হে নাকি লাইব্রেরি থেইকা বই আনতে যায় মাঝে মাঝে, লাইব্রেরিতেও খুঁজছি—নাই।’
‘চলেন তো গেটে দেখি।’ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন এসআই শাহ আলম। চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে দুটি বিস্কুট হাতের মুঠোয় নিয়ে আজিজুলও দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলেন স্যার।’
সবার আগে বের হলো জাকির। তাকে দেখে মনে হচ্ছে স্কুলে আগুন লেগেছে। ফায়ার এক্সটিংগুইশার তার হাতে। যা করার তাকেই করতে হবে। ঠিক তার পেছনে হেডস্যার। হেডস্যারের পর রুম থেকে বেরোলেন এসআই শাহ আলম। হাতে লেগে থাকা বিস্কুটের গুঁড়া প্যান্টে মুছে পেছন-পেছন এগোলেন আজিজুল।
দ্রুত এগোতে থাকা দলটির সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল ইভানের। ইভানের দিকে আঙুল তুলে জাকির বলল, ‘স্যার, এই যে পাইছি।’ চমকে উঠল ইভান।
‘কোথায় গিয়েছিলে তুমি?’ ধমক দিলেন হেডস্যার।
‘টয়লেটে গিয়েছিলাম স্যার।’
‘এতক্ষণ টয়লেটে কী?’
‘মাথাব্যথা করছিল স্যার। মাথায় একটু পানি দিলাম।’
‘এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। আমি এসে তোমার ব্যবস্থা করছি।’
‘আচ্ছা স্যার।’
হেডস্যারসহ সবাই সামনে এগোলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল ইভান। পুরো ব্যাপারটাই গোলমেলে লাগছে ওর কাছে। রুশা বলেছিল এই পুলিশ দুজন নকল। তাকে কিডন্যাপ করতে এসেছে। ইভানের মনে হচ্ছে না এরা নকল পুলিশ। তা ছাড়া পুলিশের পোশাক হয়তো ম্যানেজ করা সম্ভব। কিন্তু বাইরে যে পুলিশের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, এটা ম্যানেজ করা মোটামুটি অসম্ভব। রুশা মিথ্যাই বলেছে। কিন্তু কেন মিথ্যা কথা বলল ও? ব্যাগে ছুরি রাখার সঙ্গে কি এটার কোনো সম্পর্ক আছে? মেয়েটাকে পুলিশ কেন খুঁজছে? কোনো উত্তর পাওয়ার আগে ইভান দেখল, আবারও হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন সবাই। দ্রুত নিজের রুমে ঢুকলেন হেডস্যার। তাঁর পেছন-পেছন রুমে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন এসআই শাহ আলম। ইভানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তুমি তো এখানেই দাঁড়িয়েছিলে, তাই না?’
‘জ-জি।’ ঘাবড়ে গেল ইভান।
‘একটা মেয়েকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলে? ঘাড় পর্যন্ত চুল, চোখে চশমা?’
‘জি। দেখেছি।’ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল ইভান।
‘কোন দিকে গেছে সেটা দেখেছ?’
‘সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল এটা মনে আছে। তারপর আর দেখিনি।’
‘আচ্ছা। তা তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? ক্লাস নেই?’
‘স্যার দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন।’
‘কেন?’
‘ওর পানিশমেন্ট হচ্ছে।’ এগিয়ে এসে বললেন হেডস্যার। ‘তেমন কিছু না। ওর গার্ডিয়ান ডেকে পাঠিয়েছি। চলুন, আমরা এগোই।’
অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে আলমারি থেকে ব্যাগটা বের করে আনল জাকির মামা। টেবিলের ওপর রেখে ব্যাগের চেইন খুলে ছুরিটা দেখাল সবাইকে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন আজিজুল। ‘স্যার, মারাত্মক ব্যাপার, স্যার। দেখছেন?’
চেপে রাখা নিশ্বাসটা আস্তে করে ছাড়ল ইভান। ভয়ে রীতিমতো ঘেমে গেছে সে। মনে মনে অনেকগুলো ধন্যবাদ দিল হেডস্যারকে। এমন সময় ইভান দেখল, গটগট করে হেঁটে আসছেন ওর ফুফু। হেডস্যার, আর সঙ্গে দুজন পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। কেউ কিছু বলার আগে বলে উঠলেন,
‘স্যার, এটা কী হলো স্যার? আমি আসার আগেই আপনারা পুলিশ ডেকে একাকার করে ফেললেন? আমার কনসার্ন নেওয়া উচিত ছিল না?’
‘না মানে…’ আমতা আমতা করতে লাগলেন হেডস্যার।
‘কী ব্যাপার বলেন তো।’ জিজ্ঞেস করলেন এসআই শাহ আলম।
‘আমার ছেলে নির্দোষ স্যার। আমি শিওর কেউ ওকে ফাঁসানোর জন্য কাজটা করেছে।’
‘আপা, আপনি শান্ত হন। ভেতরে আসেন। এই ছেলে, তুমিও আসো।’ গম্ভীর স্বরে বললেন এসআই শাহ আলম।
ইভানের মনে হলো ওর পা দুটো ভারী গেছে। এগোতেই পারছিল না ও। কোনোমতে হেডস্যারের রুমে ঢুকে ও তাকাল ফুপুর দিকে। বেচারির চোখ ছলছল করছে। যেকোনো মুহূর্তে কেঁদে ফেলবেন। হেডস্যার চেয়ার টেনে বসে বললেন,
‘আসলে, আজ সকালে ইভানের ব্যাগে একটা ছুরি পাওয়া গেছে।’
‘ইভান এ রকম ছেলেই না স্যার। আপনি তো ওকে চেনেন ভালোমতো।’ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন ইভানের ফুফু।
‘দেখি ছুরিটা।’ আগ্রহী হয়ে উঠলেন এসআই শাহ আলম।
‘জাকির, ওর ব্যাগটা আনো।’ বললেন হেডস্যার।
অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে আলমারি থেকে ব্যাগটা বের করে আনল জাকির মামা। টেবিলের ওপর রেখে ব্যাগের চেইন খুলে ছুরিটা দেখাল সবাইকে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন আজিজুল। ‘স্যার, মারাত্মক ব্যাপার, স্যার। দেখছেন?’
‘হ্যাঁ।’ ছুরিটার দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন এসআই শাহ আলম।
‘দুই দিন আগে যে ডেড বডি পাইছি, আমি শিওর, এই ছুরি দিয়াই মার্ডারটা হইছে।’
‘কী বলেন এই সব!’ চমকে উঠলেন হেডস্যার। পাশ থেকে আর্তনাদ করে কান্না শুরু করলেন ইভানের ফুফু।
পা নাচাতে নাচাতে এসআই শাহ আলম ইভানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাকে যে একটু থানায় আসতে হয় বাবু।’
কোনো জবাব দিল না ইভান। শুধু তাকিয়ে রইল এসআই শাহ আলমের দিকে। আপাতত তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই।
চলবে...
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619