গাড়িগুলো দেখেই দ্রুত স্যারদের কাছে ছুটে এল রাহাত। কিছু বলার আগেই জমির স্যারের ফোন বেজে উঠল। একটুও দেরি না করে ফোন রিসিভ করলেন স্যার।
‘হ্যালো।’
‘স্যার, আপনারা নিচে নেমে আসেন প্লিজ। স্যার অপেক্ষা করছেন।’
‘আপনি কে বলছেন?’
‘নিচে আসেন, স্যার। দুইবার বললাম। তৃতীয়বার বলতে বাধ্য করবেন না। সবাইকে নিয়ে আসেন।’
জমির স্যারের ভ্রু কুঁচকে যেতে দেখল সবাই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যার বললেন, ‘এই, সবাই নিচে চলো।’ খটকা লাগল রাহাতের। মনে হলো কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। জমির স্যারের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট বলে দেয়, আগন্তুকদের আগমন অপ্রত্যাশিত। দ্রুত অন্যদের সঙ্গে নিচের দিকে এগোল রাহাত।
মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে একে একে নিচে নেমে এল সবাই। শক্ত করে জিকোকে ধরে রেখেছে কয়েকজন। বারবার জোর খাটিয়ে তাদের হাত থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে জিকো। দেয়ালের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল সবাই। জমির স্যার বয়স্ক মানুষ। এই বয়সে দেয়াল বেয়ে ওঠানামা তার জন্য বেশ কঠিন। স্যারকে ওপাশে যাওয়ার সময় দিল ওরা। তারপর কয়েকজন নেমে গেল স্যারের পেছন পেছন। এরপর ছাড়া হলো জিকো আর তপুকে। নামার সঙ্গে সঙ্গেই আবার ওদের আটকে ফেলল ছেলেরা। রাহাতও দেয়াল টপকে নামল ওপাশে। দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বিল্ডিংয়ের সামনে। ওপর থেকে গাড়ি দেখে যা আন্দাজ করেছিল রাহাত, তা-ই হয়েছে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মকবুল হোসেন টিটুর গাড়ি এটা। সঙ্গে তাঁর কর্মীরা। মকবুল হোসেন টিটু রাহাতদের স্কুল কমিটির সাধারণ সম্পাদক। সবচেয়ে বড় কথা, জিকো তাঁর ভাতিজা। জমির স্যারকে দেখে হাসিমুখে হাত মেলাতে এগিয়ে এলেন কাউন্সিলর টিটু। কিছুটা বিব্রত মনে হলো জমির স্যারকে। বোঝাই যাচ্ছে, কাউন্সিলরকে এখানে আশা করেননি তিনি। অস্বস্তি নিয়ে হাত বাড়ালেন তিনি।
‘কেমন আছেন, স্যার? হাতটা ধরে বিগলিত হয়ে বললেন টিটু।
‘জি, ভালো।’ হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন স্যার।
‘একটু মনে হয় শুকায়ে গেছেন? শরীর ঠিক আছে?’ হাতটা আরও শক্ত করে ঝাঁকিয়ে বললেন কাউন্সিলর।
‘জি, ঠিক আছে। আপনি ভালো আছেন?’
‘আর আমার ভালো থাকা। জনগণ ভালো থাকলেই আমি ভালো। রাত-দিন জনগণের সেবা করি। বাসার দিকে যে নজর দেব, সেই সময়ও পাই না।’
‘জি।’
‘তো স্যার, আপনি এখানে? আমাকে পোলাপান হঠাৎ ফোন কইরা বলল, আপনি আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুইটা আসলাম। গাড়িতে আসেন। এসির মধ্যে বইসা কথা বলি।’
‘না না। এখানেই কথা হোক।’
‘আচ্ছা স্যার। আপনি যা বলবেন, তা-ই। আমার ভাতিজারে আপনারা আটকাইসেন শুনলাম। বিষয়টা কী? ও কোনো দোষ করসে? ’
‘আপনার ভাতিজা ক্লাস টেনের এক ছেলের ব্যাগে ছুরি রেখেছে। সেটা দেখেছে ওই ক্লাসের আরেক স্টুডেন্ট। আপনার ভাতিজা ওকে হুমকি দিয়েছে। শেষমেশ ধরে এনেছে এখানে।’
‘জিকো!’ চেঁচিয়ে উঠলেন কাউন্সিলর। পেছন থেকে সামনে এগিয়ে এল জিকো। ভাতিজার দিকে কড়া চোখে তাকালেন টিটু্।
‘স্যার কী বলতেসেন? এই সব সত্য?’
মাথা নাড়ল জিকো। সত্য।
‘ছি ছি ছি! আমার ভাতিজা হইয়া তুই ছুরি নিয়া ঘুরিস?’
‘আমি ছুরি নিয়া ঘুরি না। কুড়ায় পাইসি ওইটা।
‘কোথায় পাইলি?’
‘মেইন রোডের পাশে। ওই দিকে একটা বড় ড্রেন আছে, ওইটার পাশে।’
‘ছি ছি ছি! কী লজ্জার কথা! আরেকজনের ব্যাগে রাখলি ক্যান ওই ছুরি?’
‘আরে কী অদ্ভুত। এত প্রশ্ন করতেস ক্যান! ছুরিটা যখন দেখসি, তখন ইভান ওই দিক দিয়া যাইতেসিল। একটা বিড়াল নিয়া। তখন মনে করলাম, ওরে একটা শিক্ষা দেই। ও ফেসবুকে আমারে ডিরেক্টলি ইনসাল্ট করসিল।’
‘তাহলে আমার কথা শোনো। জিকো যা করেছে, তা চরম অন্যায়। অবশ্যই ওর শাস্তি হবে। কঠোর শাস্তি। কিন্তু তার জন্য তোমাদের এখানে রাত পর্যন্ত থাকার দরকার নেই। এখানে আমি আছি, তোমাদের জমির স্যার আছেন। কাউন্সিলর সাহেব আছেন। এসআই শাহ আলম সাহেব আছেন। আমরা সবাই মিলে এই ঘটনার একটা বিচার করব। ঠিক আছে? সবাই এখন বাসায় যাও।’
আচমকা জিকোর গালে প্রচণ্ড জোরে একটা চড় বসিয়ে দিলেন টিটু। হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল জিকো। তাকে ধরে ফেলল ছেলেরা। আরও চড় মারতে এগোচ্ছিলেন কাউন্সিলর, বাধা দিলেন জমির স্যার।
‘আরে আরে কী করছেন?’ জিকোর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন স্যার।
‘এই সব করতে কলেজে পাঠাইসি তোরে?’ রাগে ফুঁসছেন কাউন্সিলর। মান-ইজ্জত সব শেষ কইরা দিল। বদের হাড্ডি হইতেসে দিন দিন। আবার বড় বড় কথা। লজ্জা লাগে না তোর? মানুষের সামনে যামু কোন মুখে?’
‘প্লিজ, আপনি উত্তেজিত হবেন না।’ অনুরোধ করলেন জমির স্যার।
‘স্যার, আপনি মুরব্বি মানুষ। সম্মানিত মানুষ। আপনার কথার ওপরে কোনো কথা বলা বেয়াদবি হবে। হবে কি না বলেন।’
‘ছি ছি, এসব কী বলছেন?’
‘আপনি অনুমতি দিলে আমি এই হারামজাদাকে বাসায় নিয়া যাইতে চাই। ওরে আজকে এমন শিক্ষা দেব, জীবনে কোনো দিন আর এই রকম কাজ ও করবে না।’
‘অবশ্যই বাসায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু আমি হেডস্যারকে আসতে বলেছি। স্যারের এতক্ষণে চলে আসার কথা। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আপনার যা সিদ্ধান্ত আপনি নেবেন।’
‘হেডস্যারকেও জানাইসেন? বাহ্। আর আমারে একটা ফোন দিতে পারলেন না? আমার নম্বর নাই আপনার কাছে? নাকি আমরা ভাই না? আউটসাইডারের কাছ থেইকা আমারে জানতে হইল?’
‘আমিও একটু আগেই এখানে এসেছি। সবকিছু এত দ্রুত ঘটেছে, আর কারও কথা মাথায় আসে নাই।’
রাহাতের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল রাজন। ফিসফিস করে বলল,
‘দোস্ত, ঘটনা তো অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। বুঝতে পারছিস?’
‘হ্যাঁ।’ রাহাতও বলল ফিসফিস করে। ‘জিকোর চ্যালা দুটো বেরিয়ে কাউন্সিলরকে ফোন করেছে। আমি শিওর।’
‘নইলে তাঁর তো জানারই কথা না। ওই যে হেডস্যার এসেছেন।’
রাহাত তাকিয়ে দেখল, পুলিশের একটা গাড়ি এসে থামল। একদম সামনের সিটে বসে আছেন হেডস্যার। মনে মনে খুশি হলো রাহাত। পুলিশ চলে এসেছে। এবার অন্তত আর কোনো চালাকি করতে পারবে না জিকোরা।
গাড়ি থেকে নেমে এত মানুষের জটলা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন হেডস্যার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হেডস্যারের দিকে এগিয়ে গেলেন কাউন্সিলর টিটু। ‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার। কেমন আছেন? সেদিন দেখলাম স্কুলের পেছন দিকের দেয়ালটা ভাঙা, বলবেন না আমারে? আসেন, কথা বলি।’ স্যারকে নিয়ে চলে গেলেন এক পাশে।
‘স্যার!’ জমির স্যারের কাছে এসে দাঁড়াল রাহাত আর রাজন। ‘উনি হেডস্যারকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে কনভিন্স করে ফেলবেন, স্যার।’
‘তা-ই ভাবছি।’ চিন্তিত হয়ে বললেন জমির স্যার। ‘কিন্তু কী করব বল।’
‘জিকো যদি আবার চান্স পায়, ও আমাদের কাউকে ছাড়বে না। ডেঞ্জারাস ছেলে, স্যার।’
‘সেটা নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি আছি তো। ভরসা রাখ।’
কিছুক্ষণ পর ওদের কাছে ফিরে এলেন হেডস্যার আর কাউন্সিলর টিটু। পুলিশের এসআই শাহ আলম দাঁড়ালেন তাঁদের পাশে। হেডস্যার বললেন,
‘অনেক রাত হয়েছে। তোমরা যার যার বাসায় যাও। গার্ডিয়ানরা টেনশন করছেন।’
‘স্যার, এটার একটা বিচার না করলে আমরা কেউ যাব না স্যার।’ কড়া স্বরে বলল আলভী।
‘এটা বড় ক্রাইম, স্যার। জিকো ভাই জোর করে রাহাতকে তুলে এনে এইখানে আটকে রেখেছে।’ বলল রাজন। ‘আমরা না এলে ওর বড় বিপদ হতে পারত, স্যার। আমরা বিচার চাই।’
ছেলেরা রাজনের সঙ্গে একমত হলো সমস্বরে। আশপাশের বাসাগুলো থেকে লোকজন আসতে শুরু করেছে। কেউ কেউ উঁকি মারছে বারান্দা থেকে। হেডস্যার দুই হাত তুলে থামানোর চেষ্টা করছেন ছেলেদের।
‘অ্যাই, আস্তে। সাইলেন্ট! আমাকে কথা বলতে দাও।’ গুঞ্জনটা থেমে গেল হুট করে। হেডস্যার বললেন, ‘আমার ওপর তোমাদের আস্থা আছে?’
‘জি স্যার, আছে।’ একসঙ্গে বলল সবাই।
‘আমি কি তোমাদের ক্ষতি চাই, না ভালো চাই?’
‘ভালো চান, স্যার।’
‘তাহলে আমার কথা শোনো। জিকো যা করেছে, তা চরম অন্যায়। অবশ্যই ওর শাস্তি হবে। কঠোর শাস্তি। কিন্তু তার জন্য তোমাদের এখানে রাত পর্যন্ত থাকার দরকার নেই। এখানে আমি আছি, তোমাদের জমির স্যার আছেন। কাউন্সিলর সাহেব আছেন। এসআই শাহ আলম সাহেব আছেন। আমরা সবাই মিলে এই ঘটনার একটা বিচার করব। ঠিক আছে? সবাই এখন বাসায় যাও।’
‘কিন্তু স্যার…’
‘রাজন, আমি আশা করব তুমি আমার সম্মান রাখবে। সবাইকে নিয়ে বাসায় যাও। বললাম তো, আমরা দেখছি।’
হতাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরল সবাই। যেতে যেতে একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল, কথা বলছেন হেডস্যার আর কাউন্সিলর। এক পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে জিকো আর তপু। রাগে গা জ্বলে উঠল রাহাতের।
‘ব্যাপারটা মিটমাট করে ফেলবে ওরা, দেখিস।’ রাজন বলল।
‘হুঁ।’ কথা খুঁজে পেল না রাহাত।’
‘লস হয়ে গেল রে।’ আলভী বলল পাশ থেকে। ‘স্কুলের পেছনের দেয়ালটা এবার রিপেয়ার করে ফেলবে। স্কুল পালানোর পথ বন্ধ।’
‘হেহ।’ ব্যঙ্গ করে হাসল রাজন।
দ্রুত হেঁটে রাস্তার মোড়ে চলে ওরা। রাজন আর আলভীকে জড়িয়ে ধরল রাহাত। ‘থ্যাংকস, দোস্ত। তোরা না এলে এতক্ষণে ভাইরাল হয়ে যেতাম।’
‘আরে মামা, নাটক করিস না তো।’ পিঠ চাপড়ে দিল রাজন। ‘যা, বাসায় যা।’
বিস্ময় ফুটে উঠল ইভানের চোখেমুখে। যদিও তা প্রকাশ করল না, কিন্তু রাহাত ঠিকই বুঝতে পারল। সেদিন সকাল থেকে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, সব খুলে বলল সে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিকশায় উঠল রাহাত। হঠাৎ ওর মনে পড়ল ইভানের কথা। এত কিছু ঘটে গেছে, অথচ কিছুই জানে না ইভান। ওর সঙ্গে দেখা করা দরকার। কিন্তু এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে অনেক। আজকে বাসায় গেলে মা আর আস্ত রাখবে না ওকে। তারপরও রাহাত রিকশাচালককে বলল, ‘মামা, ঘোরান তো।’
ইভানদের বাসার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় একটু অস্বস্তি হচ্ছিল রাহাতের। ইভান কী ভেবে বসে আছে কে জানে। দরজার সামনে এসে কয়েক সেকেন্ড থামল রাহাত। কী বলবে, ঠিক করে নিল মনে মনে। তারপর বড় একটা শ্বাস নিয়ে চাপল কলিং বেল। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলল ইভান।
‘আরে তুই!’ ইভানের মুখে সেই পরিচিত হাসি। ‘ভেতরে আয়।’
জুতা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল রাহাত। ইভানের ফুফু টিভি দেখছেন ড্রয়িংরুমে বসে। আড়চোখে একবার তাকালেন রাহাতের দিকে। রাহাতের মনে হলো, দুই চোখ দিয়ে ওকে স্ক্যান করে ফেললেন ফুফু। তাঁকে সালাম দিয়ে সোজা ইভানের ঘরে চলে গেল রাহাত।
ইভানের ঘরটা খুব ভালো লাগে রাহাতের। বেশ গোছানো। ক্লাস টেনে পড়া একটা ছেলের ঘর এত গোছানো থাকে কীভাবে? ‘আমার ঘরে কেউ ঢুকলেই দেখবে, একটা চেয়ারের ওপর একগাদা কাপড়।’ মনে মনে ভাবল রাহাত।
‘খাওয়ার কিছু আছে বাসায়?’ জিজ্ঞেস করল রাহাত। ‘যে খিদে পেয়েছে, দুটি ফুল প্লেট তেহারি খেয়ে ফেলতে পারব এক বসায়।’
‘নোনতা বিস্কুট আছে। খাবি?’
‘দে, খাই।’ রাহাতের কণ্ঠে হাতশা।
‘আয়, তোকে একটা জিনিস দেখাই।’ বিস্কুটের কৌটা এগিয়ে দিয়ে বলল ইভান। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল ও। রাহাতও অনুসরণ করল ওকে। আস্ত একটা বিস্কুট মুখে ঢুকিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। ইভানের দেখাদেখি খাটের নিচে উঁকি দিয়েই চমকে উঠল রাহাত। গলায় আটকে গেল বিস্কুট। খাটের নিচে জুতার বাক্সে বসে আছে ফুটফুটে একটা বিড়াল।
‘আরে! কোথায় পেলি এটা!’ কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল রাহাত।
‘সেদিন স্কুলে যাওয়ার সময় এটাকে রেসকিউ করেছি।’
‘ফুফু রাখতে দিল?’
‘টেরই পায়নি এখনো। খুবই শান্তিপ্রিয় বিড়াল। ক্যাওম্যাও করে না। খায় আর ঘুমায়।’
‘দেখিস, টের পেলে বিড়ালের সাথে তোকেও রাস্তায় গিয়ে থাকতে হবে।’
‘আরে না। ফেসবুকে অ্যাডপশন পোস্ট দিয়েছি। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই ফোন করবে।’
ইভানের এই স্বভাবটাই অদ্ভুত লাগে রাহাতের। এমনভাবে কথা বলছে, যেন এ কদিনে কিছুই হয়নি। অন্য কেউ হলে প্রথমেই একগাদা প্রশ্ন করত। অনেক সময় ওর এই আচরণ সহজ করে দেয় কথা বলা। কিন্তু এখন রাহাত বুঝতে পারছে না প্রসঙ্গটা কীভাবে তুলবে।
‘নিচে নামবি? চল, পুরি খাই।’ বলল রাহাত। ‘কথাও ছিল তোর সঙ্গে।’
‘এখন? নামতে দেবে না ফুফু। আমি এখন নজরদারির মধ্যে আছি। এখানেই বল।’
‘জিকো আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, পুরোনো বিল্ডিংয়ে।’
‘কীহ্! কেন!’
‘কারণ, আমি জমির স্যারকে বলে দিয়েছিলাম কে ছুরি রেখেছে তোর ব্যাগে।’
‘কে রেখেছে?’
‘জিকো।’
বিস্ময় ফুটে উঠল ইভানের চোখেমুখে। যদিও তা প্রকাশ করল না, কিন্তু রাহাত ঠিকই বুঝতে পারল। সেদিন সকাল থেকে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, সব খুলে বলল সে। শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল ইভান। তারপর বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল,
‘বাদ দে।’
‘বাদ দে মানে?’ বিরক্ত হলো রাহাত। ‘শাস্তি হবে না ওর? ওর কারণে তোকে থানায় যেতে হয়েছে। সবাই জানে তুই ব্যাগে ছুরি নিয়ে এসেছিস।’
‘জানলে জানুক। আমার কী করার আছে?’
‘কিচ্ছু করার নাই?’
‘আমি কী করব? সবার ঘরে ঘরে গিয়ে বলব? লাভ হবে বলে?’
‘আজব তো!’
‘শোন, আমি অন্য একটা বিষয় নিয়ে ভাবছি। ব্যাপারটা আরও ইন্টারেস্টিং।’
‘কী সেটা? বিড়ালের নাম কী দিবি, এ-ই তো?’
‘সেটা তো আছেই। আরেকটা বিষয় হলো নুরুল ইসলাম।’
‘এটা আবার কে?’
‘যে লোকটা কয়েক দিন আগে খুন হয়েছেন, উনি। ছুরি মেরে তাঁকে খুন করেছে কেউ একজন। সেই ছুরিটাই আমার ব্যাগে রেখেছে জিকো।’
‘তো?’
‘খুনটা কে করল? আমি বাসায় বসে বসে অনেকগুলো নিউজ ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছি। বিষয়টা খুবই সন্দেহজনক।’
‘কোন বিষয়টা?’
‘তোমার বাবা-মা পারমিশন দেবে? অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ বিড়াল নিয়ে যায়। পরে আবার ফেরত দিয়ে যায় মা-বাবা রাখতে দিচ্ছে না বলে।’
‘আরে, এই যে নুরুল ইসলাম খুন হলেন, এইটা। উনি একজন ব্যবসায়ী। কয়েকটা রেস্টুরেন্ট আছে ওনার। আমরা মাঝেমধ্যে জি ব্লকে যে ওয়াফেল খেতে যাই, ওই দোকানের মালিকও এই নুরুল ইসলাম।’
‘আচ্ছা। কিন্তু তুই কী বলতে চাচ্ছিস?’
‘আমি নিজেও জানি না। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন না? লোকটা ছুরিকাঘাতে মারা গেলেন। খুনি সেই ছুরি ফেলে গেল মেইন রোডের পাশে। আর ঠিক সেই ছুরিই জিকো খুঁজে পেল? বেশি কাকতালীয় মনে হয় না?’
‘তুই কি জিকোকে সন্দেহ করছিস?’
‘আমি সন্দেহ করছি না। খটকা লাগছে আরকি। আমি নিউজগুলো সেভ করে রেখেছি। তুই পড়ে দেখ।’
‘এখন?’
‘হ্যাঁ। পড়। আর…’
ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বেজে উঠল ওর ফোনের রিংটোন। ফোন রিসিভ করে এক পাশে সরে গেল ইভান। কম্পিউটারের স্ক্রিনে সেভ করে রাখা খবরগুলো পড়তে শুরু করল রাহাত। পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ইভান।
‘জি জি, আমি অ্যাডপশনের পোস্ট দিয়েছিলাম। আপনি কে বলছেন?’
‘আমি রুশা। চিনতে পারছ?’
কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা খুঁজে পেল না ইভান। ওপাশ থেকে রুশা বলল,
‘কথা বলবা না?’
‘তুমি আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছ।’
‘হ্যাঁ, বলেছি। ওই সময় আমার কাছে আর কোনো অপশন ছিল না। আমার সিচুয়েশন তুমি বুঝবা না। আমি যে কিসের মধ্যে আছি, সেটা আমিই জানি।’
‘বলো, না বললে বুঝব কীভাবে?’
‘বলব দেখা হলে। এখন আসল কথা বলো। বিড়ালটা আমি নিতে চাই। দিবা?’
‘আগে কখনো বিড়াল ছিল তোমার?’
‘হ্যাঁ, ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি বিড়াল পুষি। আমরা তো কদিন আগে বদলি হয়ে এখানে এসেছি। বিড়ালগুলো আনতে পারিনি। ’
‘তোমার বাবা-মা পারমিশন দেবে? অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ বিড়াল নিয়ে যায়। পরে আবার ফেরত দিয়ে যায় মা-বাবা রাখতে দিচ্ছে না বলে।’
‘আরে ওসব নিয়ে প্যারা নাই। বিড়ালের টেককেয়ার করতে পারব আমি। চিন্তা কোরো না।’
‘আচ্ছা, তাহলে কাল দেখা করি। আমি বিড়ালটা নিয়ে আসব। তুমি একটা নাম ভেবে রাখো, ঠিক আছে?’
‘আচ্ছা। আমি তাহলে ফোন করব। আর এটা আমার নম্বর। সেভ করে রাখতে পারো।’
‘ঠিক আছে।’
ফোন রেখেই রাহাতের দিকে তাকাল ইভান। চিন্তিত মনে হচ্ছে রাহাতকে।
‘কিরে, তোর আবার কী হলো?’ জিজ্ঞেস করল ইভান।
‘জিকো মেসেজ পাঠিয়েছে।’
‘কী লিখেছে?’
‘স্কুলে আসবি না? খেলা হবে।’
রাহাত আর ইভান দুজনই চিন্তিত হয়ে গেল। ইভান বলল, ‘কাল আমিও স্কুলে যাব। অনেক দিন খেলি না।’
চলবে
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619